ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

বিদ্রোহী কবি নজরুল ও মহাকবি হাফিজ

প্রকাশিত: ০৯:০০ এএম, ২৬ আগস্ট ২০১৫

নজরুল ও হাফিজের যোগসূত্রের অন্যতম মাধ্যম ফারসি সাহিত্য। কাজেই নিবন্ধের শুরুতেই এদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিস্তারের পটভূমিটি জানা জরুরি। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বাংলায় পদার্পণ করেন হিজরীর পঞ্চম শতকের শেষভাগে। এই মুসলমান শাসক এতদাঞ্চলে রাজকার্য পরিচালনার শুরুতেই ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিস্তারে গুরুত্বারোপ করেন। বিশেষ করে ফারসি ভাষা বিস্তারের জন্য তিনি রংপুরে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিস্তারের এটিই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। এরপর নাসিরউদ্দিন বোগরা খান হিজরী সপ্তম শতকে ফারসি ভাষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্র প্রসারিত করেন। পরবর্তীতে একই শতকে বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন। সুলতান গিয়াস এসময় ফারসি সাহিত্যের অমর প্রতিভা ইরানের মহাকবি হাফিজকে বাংলা ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। জবাবে হাফিজ নিম্নের বিখ্যাত গজলটি রচনা করেন-
“সাকী! সার্ভ, গুল ও লাল ফুলের আলোচনা চলছে,
তিন ধৌতকারীনীসহ এ আলোচনা চলছে।
ফাররিস এ মিছ্রিখণ্ড যা বাংলায় যাচ্ছে- তা নিয়ে
ভারতের তোতা পাখিরা (কবিরা) সবাই মিষ্টিমুখ হবে।”১
কথিত আছে যে, গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের আমন্ত্রণ পেয়ে মহাকবি হাফিজ বাংলায় আগমনের জন্য যাত্রা করেন, কিন্তু জাহাজে ওঠার আগে সমুদ্রে প্রবল ঝড় উঠলে একে দৈবের অশনিসংকেত ভেবে হাফিজ ফিরে যান। জীবৎকালে তাঁর আর বাংলা-ভারত সফর করা সম্ভব হয়নি।

২.
ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির কালে সূচনা হয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিনের হাতে পরিপূর্ণতা লাভকারী ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এদেশে চরম উৎকর্ষ লাভ করে মোঘল শাসনামলে। দীর্ঘ সাতশত বছর ফারসির এই উৎকর্ষ অভিযান এদেশে অব্যাহত থাকে এবং ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ শাসনেরও পরবর্তী ৮১ বছর ফারসি এদেশের রাজভাষা ছিলো। ১৮৩৭ সালে ব্রিটিশরা ফারসির পরিবর্তে ইংরেজিকে রাজভাষা করলে ফারসি ভাষার গুরুত্ব কমে যায়। তবে দীর্ঘ ৭-শ বছর একক আধিপত্য নিয়ে ফারসি ভাষা এদেশে বিরাজের ফলে এভাষা কখনোই এদেশে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ফারসির বহু শব্দ বাংলা-হিন্দীসহ স্থানীয় সব ভাষায় কমবেশি ঢুকে পড়েছে। এসব শব্দ এখন বাংলাসহ অন্যান্য স্থানীয় ভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘ফেরদৌসীর শাহনামা, ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ, শেখ ফরিদ উদ্দিন আজরের রচনাবলি যেমন- পান্দানামা, শেখ সাদীর গুলিস্তান ও বুস্তান বিশেষ করে এর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষাসমূহ যেমন কারীযায়ে সাদী। এ ছাড়াও আছে মাওলানা রুমীর মসনবী, হাফিজ শিরাজীর গজলসমূহ প্রভৃতির যে খ্যাতি এখনো এদেশে বিদ্যমান তা মূলত বাংলার ফারসি ভাষা অনুরাগী জনগণের উপর ফারসি ভাষা, সাহিত্য ও কবিতার প্রভাবেরই ফল।’২

৩.
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের বিপ্লবাত্মক বিদ্রোহ-চেতনার অন্যতম প্রধান কবি। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবিও। পরাধীন দেশে জন্মেছিলেন তিনি। এই পরাধীনতার মর্মপীড়া আর শৃঙ্খল-মুক্তির অদম্য বাসনাই তাঁকে বিপ্লবাত্মক ও সাম্যবাদী ধারার রাজনীতি এবং সাহিত্য-সঙ্গীতের জগতে আত্মপ্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে। সাহিত্যিক জীবনের সূচনালগ্নে ধূমকেতুর মতোই আবির্ভাব ঘটে তাঁর এবং করাচির সেনানিবাস থেকে কলকাতা আগমনের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের। ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘সওগাত’ ও ‘মোসলেম ভারতে’র নানা রচনায় এবং সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা ‘নবযুগে’ প্রতিবাদী ধারার প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে ঘটে তাঁর আত্মপ্রকাশ। বিশেষ করে ‘মোসলেম ভারত’ ও ‘বিজলী’তে প্রায় একই সময়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করে বাঙালি সমাজে তিনি হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় ‘বিদ্রোহী কবি’। আর ১৯২২ সালে অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’তে ব্রিটিশ শাসকদের সাম্রাজ্যলিপ্সা ও শোষণ-নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং সর্বাত্মক স্বাধীনতার দাবি উত্থাপনের জন্যও দেশবাসীর কাছে তিনি হয়ে ওঠে বিদ্রোহের মূর্ত প্রতীক।

    পরাধীনতার শৃঙ্খল-মুক্তির জন্য সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের তাগিদ জানানোই শুধু নয়, বিদ্রোহের আহ্বান এবং পরবর্তীকালে গণ-আন্দোলনের ডাক তাঁর রাজনৈতিক ও সমাজমনস্ক সাম্যবাদী ভাবনারই ফসল। প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবাত্মক চেতনার পরিণতি হিসেবেই তাঁর মনোভূমিতে এই সাম্যবাদী চেতনা বিকাশ লাভ করে। আর তা প্রকাশের প্রধান অবলম্বন ছিল সমকালের পত্র-পত্রিকা, রাজনৈতিক মঞ্চ ও তরুণ-যুব সমাবেশ।
    সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই নজরুল ইসলামের রচনা আমরা পেয়েছি। যদিও তিনি পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত কবি হিসেবেই। তাঁর স্বাতন্ত্র্য, ঐতিহ্য, জাতীয়তাবাদী চেতনা ও স্বাধীনতার অন্বেষণ এবং বিদ্রোহ-বিপ্লবের বাণীমণ্ডিত উচ্চস্বরটি এদেশের মানুষের চেতনাকে সেদিন গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। এমনি করেই পরাধীন মাতৃভূমি ও নির্যাতিত দেশবাসী হয়ে উঠেছিল তাঁর রচনার প্রধান উপজীব্য।

    চরম অসুস্থতার আগে পর্যন্ত নজরুল ইসলামের প্রকাশিত গ্রন্থ-সংখ্যা ৫০। এর পরিসংখ্যানটি নিম্নরূপ - কাব্যগ্রন্থ-১৭, অনুবাদ কাব্য- ২, সঙ্গীতগ্রন্থ-১৫, প্রবন্ধগ্রন্থ-৪, উপন্যাস-৩, গল্পগ্রন্থ- ৩, নাট্যগ্রন্থ-৩, কিশোর কাব্য ও নাটক-২ এবং পাঠ্যপুস্তক-১। অসুস্থ হওয়ার পর বিভিন্ন নামে তাঁর আরো ১১টি গ্রন্থ প্রকাশের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যার অধিকাংশই সুস্থাবস্থায় রচিত। তবে এগুলি অগ্রন্থিত ছিল এবং কবি কর্তৃক সঙ্কলিতও নয়। কাব্যগ্রন্থ ‘নতুন চাঁদ’ (১৯৪৫), ‘মরু ভাস্কর’ (১৯৫০), ‘শেষ সওগাত’ (১৯৫৮), কাব্যানুবাদ ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ (১৯৫৯), ‘ঝড়’ (১৯৬০), সঙ্গীতগ্রন্থ ‘রাঙাজবা’ (১৯৬৬), ‘বুলবুল’ - ২য় খণ্ড (১৯৫২), ‘দেবীস্তুতি’ (১৩৭৫), ‘গীতিমাল্য’ (১৯৬৯), প্রবন্ধগ্রন্থ ‘ধূমকেতু’ (১৯৬১) ও কিশোরনাট্য ‘জাগো সুন্দর চির কিশোর’ (১৯৯২) এ ধরনের কয়েকটি উলে­খযোগ্য গ্রন্থ। তাই অসুস্থ্য হওয়ার আগে পরে মোট মিলিয়ে নজরুল ইসলামের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে ৬১। যার অধিকাংশই প্রথমে পত্রিকা-সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। তবে সরাসরি গ্রন্থভুক্ত হয়েছে এমন কিছু উলে­খযোগ্য কবিতা-গানও এসব গ্রন্থে রয়েছে। যার অধিকাংশই সমকালে সভা-সমাবেশে গীত হয়েছিল। রাজরোষের কারণে এগুলি পত্রিকায় প্রকাশের সুযোগ লাভ করেনি। নজরুল ইসলাম বরাবরই রাজনিগৃহীত ছিলেন। ১৯২০ সালে সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা ‘নবযুগে’ গরম গরম প্রবন্ধ লেখার জন্য সরকার কয়েকবার সতর্ক করে দিয়ে চূড়ান্ত অবস্থায় পত্রিকাটির জামানত বাজেয়াপ্ত করে। ফলে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯২২ সালে আবার ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ্যে দেশের সর্বাত্মক স্বাধীনতা দাবি করায় পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধসহ কবিকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। যদিও ইতোমধ্যেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে এবং ‘যুগবাণী’ বইটি প্রকাশ করে কবি সরকারকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন। কারাভোগের পর মুক্ত হয়েও কবি কিন্তু দমে যাননি। পুনরায় বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশোদ্ধারের কাজে। ফলে বিভিন্ন সময় সরকার তাঁর সর্বমোট ১২টি বই বাজেয়াপ্তির জন্য তালিকাভুক্ত করে। তারমধ্যে চূড়ান্তভাবে ৬টি বই গ্যাজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাকি বই গুলি সম্পর্কে এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা প্রকাশ্যে পরিলক্ষিত না হলেও সরকারি ও পুলিশ-গোয়েন্দাদের হয়রানির অন্ত ছিল না। শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও একজন লেখকের এতসংখ্যক বই বাজেয়াপ্তির ঘটনা বিরল।

৪.
মহাকবি হাফিজের সঙ্গে নজরুলের কালগত ব্যবধান কয়েক শতাব্দীর। দুস্তর সময়ের পরিক্রমায় ফারসি ভাষা প্রচলনের সুবাদে হাফিজ তাঁর সমকালেই বাংলায় ব্যাপক পরিচিত ছিলেন ফারসি সাহিত্যের অমর কবি হিসেবে। হাফিজকে বাংলায় পরিণত ঐশ্বর্য সম্পদে রূপান্তর করেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ প্রসঙ্গে নজরুলের মুখেই  শোনা যাক বাকি কথা-
    “আমি তখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি। সে আজ ইংরেজি ১৯১৭ সালের কথা। সেইখানে প্রথম আমার হাফিজের সাথে পরিচয় হয়। আমাদের বাঙালি পল্টনে একজন পাঞ্জাবী মৌলবী সাহেব থাকতেন। একদিন তিনি দীওয়ান-ই-হাফিজ থেকে কতকগুলি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। শুনে আমি এমনই মুগ্ধ হয়ে যাই যে, সেইদিন থেকেই তাঁর কাছে ফার্সি ভাষা শিখতে আরম্ভ করি। তাঁরই কাছে ক্রমে ফার্সি কবিদের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত কাব্যই পড়ে ফেলি।
    তখন থেকেই আমার হাফিজের ‘দীওয়ান’ অনুবাদের ইচ্ছা হয়। কিন্তু তখনো কবিতা লিখবার মত যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। এর বৎসর কয়েক পরে হাফিজের দীওয়ান অনুবাদ আরম্ভ করি। অবশ্য তাঁর রুবাইয়াৎ নয়-গজল। বিভিন্ন  মাসিক পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছিলে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি গজল অনুবাদের পর আর আমার ধৈর্যে কুলোল না, এবং ঐখানেই ওর ইতি হয়ে গেল।
    তারপর এসসি চক্রবর্তী এণ্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী মহাশয়ের জোর তাগিদে এর অনুবাদ শেষ করি। যে দিন অনুবাদ শেষ হ’ল, সেদিন আমার খোকা বুলবুল চলে গেছে।
    আমার জীবনের যে ছিল প্রিয়তম, যা ছিল শ্রেয়তম তারই নজরানা দিয়ে শিরাজের বুলবুল কবিকে বাঙলায় আমন্ত্রণ করে আনলাম। . . . .  আমার আহ্বান উপেক্ষিত হয়নি। যে পথ দিয়ে আমার পুত্রের ‘জানাযা’ (শবযান) চলে গেল, সেই পথ দিয়ে আমার বন্ধু, আমার প্রিয়তম ইরানী কবি আমার দ্বারে এলেন। আমার চোখের জলে তাঁর চরণ অভিষিক্ত হল’...।৩
খুব দুঃসময়ে পুত্রের মৃত্যু শয্যায় বসে কবি ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’এর অনুবাদ সম্পন্ন করেন। তাই কবি যথার্থই বলেন, যেপথ দিয়ে আমার পুত্রের শবযান চলে গেল, সেপথ দিয়েই এলেন তাঁর প্রিয়তম ইরানী কবি হাফিজ।’
‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ অনুবাদ কাব্যের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন-
“বাবা বুলবুল!
    তোমার মৃত্যু-শিয়রে বসে ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’
হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ আরম্ভ করি। যেদিন
অনুবাদ শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি আমার
কাননের বুলবুলি উড়ে গেছ। যে দেশে গেছ তুমি,
সে কি বুলবুলিস্তান ইরানের চেয়েও সুন্দর?

    জানি না তুমি কোথায়! যে লোকেই থাক, তোমার
শোক-সন্তপ্ত পিতার এই শেষ দান শেষ চুম্বন বলে গ্রহণ করো।
    তোমার চার বছরের কচি গলায় যে সুর শিখে গেলে,
তা ইরানের বুলবুলিকেও বিস্ময়ান্বিত করে তুলবে।
    শিরাজের বুলবুল কবি হাফিজের কথাতেই
তোমাকে স্মরণ করি,
    ‘সোনার তাবিজ রূপার সেলেট
        মানাত না বুকে রে যার,
    পাথর চাপা দিল বিধি
        হায়, কবরের শিয়রে তার।”৪

৫.
‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ নজরুল ইসলাম অনূদিত বাংলা ভাষায় বহুল প্রচারিত ও পঠিত একমাত্র সফল অনুবাদ কাব্য। এর ‘মুখবন্ধে’ কবি নজরুল হাফিজের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এর বর্ণনাসহ ভক্তি-স্তুতির বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। আর গ্রন্থের একদম শেষ পর্যায়ে ‘বুলবুল-ই-শিরাজ : মরমী কবি হাফিজের সংক্ষিপ্ত জীবনী’ শিরোনামে কবি হাফিজের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করেন। পারস্যের মরমী কবি হাফিজকে জানতে হলে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ অবশ্য পঠিতব্য একটি সংক্ষিপ্তাকারের পরিপূর্ণ গ্রন্থ।

    এ প্রসঙ্গে গ্রন্থের মুখবন্ধে নজরুল উল্লেখ করেন-
    “সত্যকার হাফিজকে চিনতে হলে তাঁর গজল-গান-প্রায় পঞ্চশতাধিক পড়তে হয়। তাঁর রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতাগুলি পড়ে মনে হয়, এ যেন তাঁর অবসর সময় কাটানোর জন্যই লেখা। অবশ্য এতেও তাঁর সেই দর্শন, সেই প্রেম, সেই শারাব-সাকি তেমনিভাবেই জড়িয়ে আছে।
    এ যেন তাঁর অতল সমুদ্রের বুদবুদ-কণা। তবে এ ক্ষুদ্র বিশ্ব হলেও এতে সারা আকাশের গ্রহ-তারার প্রতিবিম্ব পড়ে একে রামধনুর কণার মত রাঙিয়ে তুলেছে। হয়ত ছোট বলেই এ এত সুন্দর।
    আমি অরিজিন্যাল (মূল) ফার্সি হতেই এর অনুবাদ করেছি। আমার কাছে যে কয়টি ফার্সি ‘দীওয়ান-ই-হাফিজ’ আছে, তার প্রায় সব কয়টাতেই পঁচাত্তরটি রুবাইয়াৎ দেখতে পাই। অথচ ফার্সি সাহিত্যের বিশ্ববিখ্যাত সমালোচক ব্রাউন সাহেব তাঁর History of Persian Literature- এ এবং মৌলানা শিব্লী নৌমানী তার ‘শেয়রুল-আজম’-এ মাত্র উনসত্তরটি রুবাইয়াতের উল্লেখ করেছেন; এবং এই দুইজনই ফার্সি কবি ও কাব্য সম্বন্ধে authority-বিশেষজ্ঞ। আমার নিজেরও মনে হয়, ওদের ধারণাই ঠিক। ... হাফিজকে আমরা কাব্য-রস পিপাসুর দল- কবি বলেই সম্মান করি, কবি-রূপেই দেখি। তিনি হয়তবা সুফি দরবেশও ছিলেন। তাঁর কবিতাতেও সে আভাষ পাওয়া যায় সত্য। শুনেছি, আমাদের দেশেও মহর্ষি দেব্রেন্দ্র নাথ ঠাকুর, কেশব সেন প্রভৃতি হাফিজের কবিতা উপাসনা-মন্দিরে আবৃত্তি করতেন। তবু তাঁর কবিতা শুধু কবিতাই। তাঁর দর্শন আর ওমর খৈয়ামের দর্শন প্রায় এক।’৫

মহাকবি হাফিজসহ পারস্যের কবিদের জীবন দর্শন পর্যালোচনা করতে গিয়ে নজরুল আরো উল্লেখ করেন,
“এঁরা সকলেই আনন্দ-বিলাসী। ভোগের আনন্দকেই এঁরা জীবনের চরম আনন্দ বলে স্বীকার করেছেন। ইরানের অধিকাংশ কবিই যে শারাব-সাকি নিয়ে দিন কাটাতেন, এও মিথ্যা নয়।
তবে এও মিথ্যা নয় যে, মদিরাকে এঁরা জীবনে না হোক কাব্যে প্রেমের আনন্দের প্রতীকরূপেই গ্রহণ করে ছিলেন।
শারাব বলতে এঁরা বোঝেন-ঈশ্বরের ভূমার প্রেম যা মদিরার মতই মানুষকে উন্মত্ত করে তোলে। ‘সাকি’ অর্থাৎ যিনি সেই শারাব পান করান। যিনি সেই ঐশ্বরিক প্রেমের দিশারী, দেয়াসিনী। পানশালা- সেই ঐশ্বরিক প্রেমের লীলা-নিকেতন।
ইরানী কবিদের অধিকাংশই তথাকথিত নাস্তিক রূপে আখ্যাত হলেও এঁরা ঠিক নাস্তিক ছিলেন না। এঁরা খোদাকে বিশ্বাস করতেন। শুধু স্বর্গ, নরক, রোজকিয়ামত (শেষ বিচারের দিন) প্রভৃতি বিশ্বাস করতেন না। কাজেই শাস্ত্রাচারীর দল এঁদের উপর এত খাপ্পা ছিলেন। এঁরা সর্বদা নিজেদের ‘রিনদান্’ বা স্বাধীন চিন্তাকারী, ব্যভিচারী বলে সম্বোধন করতেন। এর জন্য এঁদের প্রত্যেককেই জীবনে বহু দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছিল।
হাফিজের সমস্ত কাব্যের একটি সুর -
    “কায় বেখবর, আজ ফস্লে গুল্ ও তরকে শারাব।”

    “ওরে মূঢ়। এমন ফুলের ফসলের দিন - আর তুই কিনা শারাব ত্যাগ করে বসে আছিস।”৬

উপরের বক্তব্যের সূত্রেই হাফিজের সঙ্গে নজরুলের জীবনের একাংশের গভীর যোগসূত্র পরিলক্ষিত হয়। আর তা হচ্ছে পারস্যে হাফিজদের নাস্তিক আখ্যা দেয়া হয় এবং এজন্য তারা বহু দুর্ভোগ সহ্য করেন। বাংলায় নজরুলকেও একসময় কাঠমোল্লার দল কাফের ফতোয়া দিয়েছিলো এবং এজন্য কবিকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিলো। অথচ নজরুল নাস্তিক ছিলেন না এবং ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এদেশে আজ নজরুলের হামদ, নাত ও গজল ছাড়া কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হয় না। হাফিজ ও নজরুলের এই ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ বোধ করি সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে সাধনার স্তর উত্তীর্ণের ফলেই জীবন দর্শনে বিশেষ অবস্থা তৈরি হওয়া। যা ঘটেছে হাফিজ ও নজরুলের ক্ষেত্রে এবং মূর্খরা না বুঝেই এই অমর কবিদ্বয়কে নাস্তিক ও কাফের আখ্যা দিয়েছে।

৬.
নজরুলকৃত ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজে’ মোট ৭৩টি রুবাই রয়েছে। এর বাইরে ‘মুখবন্ধে’ কবি আরো দু’টি রুবাইর অনুবাদ দিয়ে বলেছেন, ‘সমস্ত রুবাইয়াতের আসল সুরের সঙ্গে অন্তত এই দু’টি রুবাইয়াতের কোনো মিল নেই। বেসুরো ঠেকবে বলে আমি এ দুটির অনুবাদ মুখবন্ধেই দিলাম।”৭
    ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৩৭ সালের আষাঢ় মাসে। প্রকাশক : শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী এণ্ড সন্স, ২১, নন্দকুমার চৌধুরী লেন, কলিকাতা। মূল্য ২ টাকা। এর বেশ কিছু রুবাই প্রথমে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে ১৩৩৭ এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ‘জয়তী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ১০টি (৬, ৭, ৮, ১২, ১৫, ৩২, ৪১, ৪৯, ৫৩, ৫৪ সংখ্যক) রুবাই উল্লে­খযোগ্য। এখানে ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজে’র কয়েকটি রুবাই তুলে ধরা হলো,

    ১ নং রুবাই
‘তোমার ছবির ধ্যানে, প্রিয়
    দৃষ্টি আমার পলক-হারা।
তোমার ঘরে যাওয়ার যে-পথ
    পা চলে না সে-পথ ছাড়া।

হায়, দুনিয়ায় সবার চোখে
নিদ্রা নামে দিব্য সুখে,
আমার চোখেই নেই কি গো ঘুম,
    দ্বগ্ধ হ’ল নয়ন-তারা।।’৮

    ৫ নং রুবাই
‘আন্তে বল পেয়ালা শারাব
    পার্শ্বে ব’সে পরান-বঁধুর।
নিঙাড়ি’ লও পুষ্প-তনু
    তন্বঙ্গীর অধর-আঙুর।

আহত যে-ক্ষত-ব্যথায়
সোয়াস্তি চায়, চায় সে আরাম;
বিষম তোমার হৃদয়-ক্ষত,
    ডাকো হাকিম কপট চতুর।।’৯

    ১৫ নং রুবাই
‘তোমার পথে মোর চেয়ে কেউ
    সর্বহারা নাইকো, প্রিয়!
আমার চেয়ে তোমার কাছে
    নাই সখি, কেউ অনাত্মীয়।

তোমার বেণীর শৃঙ্খলে গো
নিত্য আমি বন্দী কেন? --
মোর চেয়ে কেউ হয়নি পাগল
    পিয়ে তোমার প্রেম-অমিয়।।’১০

    ২২ নং রুবাই
‘সোরাই-ভরা রঙিন্ শারাব
    নিয়ে চলো নদীর তটে!
নিরভিমান প্রাণে বসো --
    অনুরাগের ছায়া-বটে!

সবারই এই জীবন যখন
সেরেফ্ দুটো দিনের রে ভাই,
লুট করে নাও হাসির মধু,
    খুশির শারাব ভরো ঘটে।।’১১

    ২৬ নং রুবাই
‘চাঁদের মত রূপ গো তোমার
    ভরছে কলঙ্কেরি দাগে।
অহঙ্কারের সোনার বাজার
    ডুবছে ক্রমে ক্রান্তি-কাগে।

লজ্জা অনেক দেছ আমায়,
প্রেম নাকি মোর মিথ্যা-ভাষণ!
আজ ত এখন পড়ল ধরা
    কলঙ্ক কোন্ মুখে জাগে।।’১২

    ৩০ নং রুবাই
‘দাও মোরে ঐ গেঁয়ো মেয়ের
    তৈরি খাঁটি মদ পুরানা।
তাই পিয়ে আজ গুটিয়ে ফেলি
    জীবনের এই গাল্চে’ খানা।

যদি ধরার মন্দ ভালো
দাও ভুলিয়ে মস্ত্ ক’রে
জানিয়ে দেবো এই সৃষ্টির
    রহস্যময় সব অজানা।।’১৩

    ৩২ নং রুবাই
‘মদ্ লোভীরে মৌলোভী কন,
    পান করে এই শারাব যারা,
যেমন মরে তেমনি ক’রে
    গোরের পারে উঠবে তারা।

তাই ত আমি সর্বদা রই
শারাব এবং প্রিয়ার সাথে,
কবর থেকে উঠব-নিয়ে
    এই শারাব, এই দিল্-পিয়ারা।।’১৪

    ৪৬ নং রুবাই
‘প্রিয়া তোমায় দেছে দাগা?
    বন্ধু, পীড়ন সহ্য কর!
আমার পরামর্শ শোন,
    সকল ভুলে শারাব ধর।

মত্লব্ হাসিল কর তোমার
খুব সুরতী রতির সাথে,
অন্তর দিও না তারে
    সে তব অযোগ্যতর।।’১৫

‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজে’ মোট ৭৩টি রুবাই মুদ্রিত হয়েছে। গ্রন্থের মুখবন্ধে রয়েছে আরো ২টি রুবাইর অনুবাদ। এই ৭৫টি রুবাইর মধ্যে বিষয় নির্দেশক প্রতিনিধিত্বশীল মোট ৮টি রুবাই এখানে উপস্থাপন করা হলো। ভাষা ও বিষয় শৈলীর গুণে এসব রুবাইর মর্মকথা মূর্ত হয়ে উঠেছে অত্যন্ত সাবলীলভাবে।

৭.
নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র পারস্যের মহাকবি হাফিজই নন, অন্যান্য কবির অমর কাব্য মহিমা দ্বারাও বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তার অপর অমর দৃষ্টান্ত নজরুলের ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’। কবি অসুস্থ্য হওয়ার ১৬ বছর পর ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ভূমিকা লেখেন সৈয়দ মুজতবা আলী। প্রকাশক জোহরা খানম। ৯, এন্টনী বাগান লেন, কলকাতা- ৯। পরিবেশক : স্টান্ডার্ড পাবলিশার্স, কলকাতা-১২। মূল্য ১০ টাকা। ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয় কার্তিক ১৩৭০-এ।

এখানে উল্লেখ্য যে, পারস্যের এই দুই মহাকবিই নজরুল ইসলামকে বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেন। এঁদের মনন-মেধা, সুর-চেতনা দ্বারা নজরুল এতটাই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যে, তাঁর অনেক গজল-গানে, ধর্মীয় আধ্যাত্মিক সঙ্গীতে এঁদের প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ‘নজরুল-গীতিকা’, ‘সুর-সাকী’, ‘জুলফিকার’, ‘বন-গীতি’, ‘গুল-বাগিচা’, ‘গীতি শতদল’ ও ‘গানের মালা’র অনেক কবিতা-গানে ফারসি সাহিত্যের প্রভাব লক্ষণীয়। ‘নজরুল গীতিকা’তে তো ‘ওমর খৈয়াম-গীতি’ ও ‘দীওয়ান-ই-হাফিজ-গীতি’ নামে আটটি করে কবিতা গান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে ফারসি সাহিত্য তথা-পারস্যের মহাকবি হাফিজ দ্বারা নজরুল কতটা অনুপ্রাণিত ছিলেন।

৮.
বর্তমান প্রবন্ধটি সমাপ্তির আগে নজরুলকৃত হাফিজের জীবনীর দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। মাত্র ৫ পৃষ্ঠার এই সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্তে নজরুল অমর কবি হাফিজের জীবনের অনেক উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী তুলে ধরেছেন। পারস্যের কবি সম্পর্কে বাংলার কবি লিখছেন-
“শিরাজ ইরানের মদিনা, পারস্যের তীর্থভূমি। শিরাজেরই মোসল­া নামক স্থানে বিশ্ববিশ্রুত কবি হাফিজ চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে জন্মগ্রহণ করেন।
ইরানের এক নীশাপুর (ওমর খৈয়ামের জন্মভূমি) ছাড়া আর কোনো নগরই শিরাজের মত বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করে নাই। ইরানের প্রায় সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিরই লীলা নিকেতন এই শিরাজ।
ইরানীরা হাফিজকে আদর করিয়া ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’ বা শিরাজের বুলবুলি বলিয়া সম্ভাষণ করে।
হাফিজকে তাহারা শুধু কবি বলিয়াই ভালোবাসে না। তাহারা হাফিজকে ‘লিসান-উল্-গায়েব (অজ্ঞাতের বাণী), ‘তর্জমান্-উল-আস্রার’ (রহস্যের মর্মসন্ধানী) বলিয়াই অধিকতর শ্রদ্ধা করে। হাফিজের কবর আজ ইরানের শুধু জ্ঞানী-গুণীজনের শ্রদ্ধার স্থান নয়, সর্ব সাধারণের কাছে ‘দরগা’, পীরের আস্তানা।”...
“হাফিজের আসল নাম শামসুদ্দিন মোহাম্মদ। ‘হাফিজ’ তাঁহার ‘তখল­ুস’, অর্থাৎ কবিতার ভণিতায় ব্যবহৃত উপ-নাম। যাঁহারা সম্পূর্ণ কোরান কণ্ঠস্থ করিতে পারেন, তাঁহাদিগকে মুসলমানেরা ‘হাফিজ’ বলেন। তাঁহার জীবনী লেখকগণও বলেন, হাফিজ তাঁহার পাঠ্যাবস্থায় কোরান কণ্ঠস্থ করিয়া ছিলেন।”...
“হাফিজের গান অতল গভীর সমুদ্রের মত। কুলের পথিক যেমন তাহার বিশালতা, তরঙ্গ লীলা দেখিয়া অবাক বিস্ময়ে চাহিয়া থাকে, অতল-তলের সন্ধানী ডুবুরী তেমনি তাহার তলদেশে অজস্র মণিমুক্তার সন্ধান পায়। তাহার উপরে যেমন ছন্দ-নর্তন, বিপুল বিশালতা; নিম্নে তেমনি অতল গভীর প্রশান্তি, মহিমা।”...
“হাফিজের সমস্ত কাব্য ‘শাখ্-ই-নবাত্’ নামক কোনো ইরানী সুন্দরীর স্তবগানে মুখরিত। অনেকে বলেন, ‘শাখ্-ই-নবাত্’ হাফিজের দেওয়া আদরের নাম। উহার আসল নাম হাফিজ গোপন করিয়া গিয়াছেন। কোন ভাগ্যবতী এই কবির প্রিয়া ছিলেন, কোথায় ছিল তাঁর কুটির, ইহা লইয়া অনেকে অনেক জল্পনা-কল্পনা করিয়াছেন। রহস্য-সন্ধানীদের কাছে এই হরিণ - আঁখি সুন্দরী আজো রহস্যের অন্তরালেই রহিয়া গিয়াছেন।”
“তাঁহার মৃত্যু সম্বন্ধে একটি বিস্ময়কর গল্প শুনা যায়। শিবলী নোমানী, ব্রাউন সাহেব প্রভৃতি পারস্য-সাহিত্যের সকল অভিজ্ঞ সমালোচকই এই ঘটনার উলে­খ করিয়াছেন।

হাফিজের মৃত্যুর পর একদল লোক তাঁহার ‘জানাজা’ পড়িতে (মুসলমানী মতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করিতে) ও কবর দিতে অসম্মত হয়। হাফিজের ভক্তদলের সহিত ইহা লইয়া বিসম্বাদের সৃষ্টি হইলে কয়েক জনের মধ্যস্থতায় উভয় দলের মধ্যে এই শর্তে রফা হয় যে, হাফিজের সমস্ত কবিতা একত্র করিয়া একজন লোক তাহার যে কোনো স্থান খুলিয়া দিবে; সেই পৃষ্ঠার প্রথম দুই লাইন কবিতা পড়িয়া হাফিজের কি ধর্ম ছিল তাহা ধরিয়া লওয়া হইবে।
আশ্চর্যের বিষয়, এইরূপে নিম্নলিখিত দুই লাইন কবিতা পাওয়া গিয়াছিল। --

“কদমে দরিগ মদার আজ জানাজায়ে হাফিজ,
কে র্গচে গর কে গোনাহস্ত মি রওদ বেহেস্ত।”

“হাফিজের এই শব হ’তে গো তু’লো না কো চরণ প্রভু
যদিও সে মগ্ন পাপে বেহেশতে সে যাবে তবু।”
ইহার পর উভয় দল মিলিয়া মহাসমারোহে হাফিজকে এক আঙুর-বাগানে সমাহিত করেন। সে স্থান আজিও ‘হাফিজিয়া’ নামে প্রসিদ্ধ। দেশ বিদেশ হইতে লোক আসিয়া আজও কবির কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করে।”১৬

বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী মহাকবি হাফিজের জীবনের চূড়ান্ত পরিণতিটাও বিস্ময়কর ঘটনায় সমৃদ্ধ। নজরুল ইসলাম এই ইরানী বুলবুলকে বাংলায় স্বাগত জানিয়ে আনলেন। এর জন্য নিজের রচনায় যেমন নজরুল বেঁচে থাকবেন বহুকাল, তেমনি বাংলায় হাফিজের রূপকার হিসেবেও নজরুল স্মরণ হবেন অনন্তকাল।

তথ্যসূত্র :
১. ড. মাহমুদ বাশিরি ‘কবি নজরুল ও ইরানি সাহিত্য’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১০৫-তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুরের নজরুল মঞ্চে আয়োজিত সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধ। প্রাবন্ধিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানীয়ান ভিজিটিং প্রফেসর। প্রবন্ধটি পরে ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরামের ২০ জুলাই ২০০৪ তারিখে প্রকাশিত ‘ব্রহ্মপুত্র’ শীর্ষক স্যুভেনিরে প্রকাশিত হয়। পৃষ্ঠা- ৪৩

২. পূর্বোক্ত
৩. কাজী নজরুল ইসলাম ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’। মুখবন্ধ। নজরুল রচনাবলী, নতুন সংস্করণ, দ্বিতীয় খণ্ড। ২৫ মে ১৯৯৩। বাংলা একাডেমি, ঢাকা। পৃ: ১৫
৪. পূর্বোক্ত। পৃ: ১৩
৫. পূর্বোক্ত। পৃ:১৫-১৬
৬. পূর্বোক্ত। পৃ: ১৬-১৭
৭. পূর্বোক্ত। পৃ: ১৬
৮. পূর্বোক্ত। পৃ: ১৯
৯. পূর্বোক্ত। পৃ: ২০
১০. পূর্বোক্ত। পৃ: ২৩
১১. পূর্বোক্ত। পৃ: ২৫
১২. পূর্বোক্ত। পৃ: ২৬
১৩. পূর্বোক্ত। পৃ: ২৭
১৪. পূর্বোক্ত। পৃ: ২৮
১৫. পূর্বোক্ত। পৃ: ৩২
১৬. পূর্বোক্ত। পৃ: ৪১-৪৪

এইচআর/পিআর