ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মাহিনের ইচ্ছেগুলো

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ | প্রকাশিত: ০৯:৪৯ এএম, ১২ আগস্ট ২০১৫

মাহিন লেখালেখি করুক এটা কখনোই চায়নি মিথিলা। এ নিয়ে অনেকবার বাকবিতণ্ডাও হয়েছে। তবুও মাহিন থেমে যায়নি। মিথিলাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। বলেছে, ‘দ্যাখো, আমার লেখা কবিতা পড়েই তুমি আমার প্রেমে পড়েছো।’ মিথিলা বলেছে, ‘সেটা ছিলো অপ্রকাশিত কবিতা। তা শুধু আমার জন্যই লেখা। এখন যে গল্প-কবিতা লেখ তা অনেকেই পড়ে। আমি সেটা চাই না।’

মাহিন ঘাবড়ে যায়। কি করবে সে। মিথিলাকে ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হয়।

একদিন খুব উৎফুল্ল মেজাজেই মিথিলাকে ফোন করে। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর মাহিন একটা সুখবর জানায়। মিথিলা আঁৎকে ওঠে। বলে, ‘কী? তুমি সাহিত্য পুরস্কার পেতে যাচ্ছ। তা আবার আমাকে বলছো? তুমি তাহলে আমাকে না জানিয়ে গোপনে গোপনে লিখছো। আজ সেটা স্পষ্ট। তুমি আমাকে ঠকিয়েছো।’ মিথিলা এবারও চটে যাবে তা ভাবতে পারেনি মাহিন। তাই কথা না বাড়িয়ে ফোনটা রেখে দেয়।

মাহিনের উভয় সংকট। কাকে রেখে কাকে ছাড়বে? লেখালেখি তার নেশা। ভালোবাসাও বলা যায়। মিথিলাও তার কাছে কম কিছু নয়। দুটি বিষয়ই গুরুত্ব বহন করে। মাহিন হারিয়ে যায় অতীতে- প্রেমের প্রথম পর্বে রোজ একটা করে কবিতা লিখে মিথিলার বইয়ের মধ্যে রেখে আসতো। কবিতা পেয়ে মিথিলাও খুশি হতো। সেই থেকে নেশাটা আরো বেড়ে যায়। মিথিলা প্রশংসা করে কবিতার। তাই প্রথম সাহস করে পত্রিকায় কবিতা পাঠায়। একটি কবিতা ছাপা হয়। এরপর ছোটগল্প, প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ করে। লেখার হাতটা মোটামুটি পাঁকা হয়। লেখার সাহসও বাড়ে। তখন তেমন বাঁধা দেয়নি মিথিলা। কিন্তু হঠাৎ এমন ঘোরবিরোধী হয়ে ওঠার কারণও খুঁজে পায় না।

মাহিনের অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো একটা বই প্রকাশের। অনেক প্রকাশনীতেও ধর্ণা দিয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। মাহিন তেমন পরিচিত কবি বা লেখক নন। নিজের তেমন টাকাও নেই। এদিকে মাহিনের লেখালেখির ঘোরবিরোধী মিথিলা। আশার গুড়েবালি। মাহিন দমে যায়।

একদিন বিকেলে নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে মাহিন জানতে চায়- ‘আমি লিখি এটা তুমি চাও না? মিথিলা এককথায় বলে, ‘না।’ মাহিনের পাল্টা প্রশ্ন- ‘কেন?’ মিথিলা একটু থামে। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমার ভাইরা কবি-লেখক পছন্দ করে না। কবিদের চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলে। আমার শুনতে ভালো লাগে না।’ মাহিন দৃঢ় কণ্ঠে জানতে চায়, ‘তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?’ মিথিলার ছোট্ট জবাব- ‘করি।’ মাহিন বলে, ‘তবে?’ মিথিলা শেষবারের মতো বলে, ‘আমার ভাইরা যেটা পছন্দ করে না, আমিও সেটা মেনে নিতে পারি না।’ বলেই দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় মিথিলা। মাহিন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে আলো। আঁধারে ঢেকে আসছে পৃথিবী।

থেমে থাকেনি জীবন। থেমে থাকেনি মাহিন। থেমে থাকেনি তার লেখালেখি। মিথিলার সাথে আর বোঝাপড়া হয়ে ওঠেনি। অঘোষিত বিচ্ছেদই বলা চলে। দেখা হলে কথা হয়, কুশলাদি বিনিময় হয়। ভালোবাসি একথাটি বলা হয় না আর।

একদিন মিথিলার ফোন কল দেখে অবাক হয় মাহিন। ভরদুপুরে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় কতগুলো কাক। চৈত্রের খা-খা বিষণ্ন দুপুর। ওপ্রান্তে মিথিলার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর। ‘একটা সুখবর দেই তোমায়। শুক্রবার আমার বিয়ে। ছেলে ব্যবসায়ী। ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি সব আছে তার।’

মাহিন কান থেকে সরিয়ে নেয় ফোনটা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার কিনারে। সা-সা আওয়াজ তুলে দুর্দান্ত গতিতে পালিয়ে যায় দুটি ট্রাক।

সময় থেমে থাকে না। বহতা নদীর মতোই বয়ে চলে। পুরোনোকে পেছনে ফেলেই এগিয়ে যেতে হয়। হাঁটিহাঁটি পা-পা করে এগিয়ে যেতে থাকে মাহিন। লেখালেখি আর পেটের তাগিদে করা কর্মই তার সম্বল। তেমন উচ্চাশা নেই। পুরোনো একটা ইচ্ছা আজো অপূর্ণই রয়ে গেল। এখনো তার কোনো গ্রন্থ আলোর মুখ দেখেনি। তবে লেখক হিসেবে সুনাম ছড়িয়েছে। তিনবার সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে। নিয়মিত জাতীয়, স্থানীয় দৈনিকসহ সাহিত্যের ছোট কাগজে লিখে যাচ্ছে। তবুও অভাবটা বড্ড নাড়া দেয় মাহিনকে।

বর্তমানে স্থানীয় একটি কলেজের বাংলা প্রভাষক হিসেবে বেশ সুখিই বলা যায় মাহিনকে। বিয়েটা এখনো করা হয়ে ওঠেনি। করি করি করেও ঠিক পছন্দের মতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরিবারের পীড়াপীড়ি তো রয়েছেই। মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে মিথিলার স্মৃতি।

শেষ বিকেলের আলোয় বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছিলো মাহিন। দরোজায় সাইকেলের ক্রিং ক্রিং ঘণ্টায় মাথা তুলে তাকায়। ডাকপিয়ন কাছে এসে একটা খাম দিয়ে চলে যায়। মহিন খামটা খুলে একটা চিঠি বের করে। মিথিলা প্রকাশনীর একটি প্যাডে লেখা দাওয়াতপত্র। ‘সুধী, আপনি জেনে আনন্দিত হবেন যে, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে আপনার কবিতার বই ‘মাহিনের ইচ্ছেগুলো’র প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানে আপনার উপস্থিতি একান্ত কাম্য। নিবেদনে-প্রকাশক।’

মাহিন অবাক হয়। হওয়ারই কথা। হিসেব মেলে না। সে তো কাউকে পাণ্ডুলিপি দেয়নি। তবে গ্রন্থ প্রকাশ হবে কীভাবে? অনেক ভেবেও কূল-কিনারা না পেয়ে নিরস্ত হয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়- যাই, দেখি- কীভাবে কী হলো।

যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। উপস্থাপিকা অনু্ষ্ঠানের প্রধান অতিথি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, প্রকাশক মিথিলা রহমান ও কবি মাহিনকে মঞ্চে আসন গ্রহণের আহ্বান জানান। মাহিন নির্বাক। ভাবনার অতলে হারিয়ে ঘোষণাটুকুও কর্ণগোচড় হয় না। অনুষ্ঠান সহযোগী এসে মাহিনকে ডেকে নিয়ে যায় মঞ্চে।

অতিথিরা বহুল প্রশংসিত বক্তব্য রাখেন। মাহিনকে নিজের কাছে একজন অযোগ্য-অপদার্থই মনে হয়। কবির বক্তব্যে বেশি কিছু বলা হয় না তার। শুধু প্রকাশনী ও প্রকাশককে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন। প্রকাশক মিথিলা রহমান তার বক্তব্যে চমকে দেন মাহিনকে। মিথিলা বলেন, ‘কবির দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিলো একটা বই প্রকাশ করার। আমি শুধু তার এই একটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার দুঃসাহস দেখিয়েছি। বিভিন্ন সময় আমার সংগৃহিত মাহিনের কবিতাগুলোর একটি সংকলন করেছি মাত্র। ভুল-ত্রুটি মার্জনার দৃষ্টিতে দেখবেন।’

মাহিনের চোখ তখন ছলছল করছিলো জলে। টেবিলে রাখা টিস্যু নিয়ে অনবরত চোখ মুছছিলো। মিথিলার বক্তব্যের পর অুনষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে অতিথিরা বিদায় নিলেন। মিথিলা এসে দাঁড়ায় মাহিনের পাশে। মিথিলা বলে, ‘এই রাতে কোথায় যাবে? চলো আমার সাথে।’ মাহিন বলে, ‘আর কত ঋণি করবে আমায়?’ মিথিলা হাসে। হাসতে হাসতে বলে, ‘ভয় নেই শোধ করতে হবে না। আর যদি ইচ্ছে হয় শোধ করে দিও।’ প্রসঙ্গ পাল্টে মাহিনের জিজ্ঞাসা- ‘বাসায় কে কে আছে?’ মিথিলা বলে, ‘তেমন কেউ নেই। শুধু আমি, আমার একমাত্র মেয়ে ও একজন গৃহপরিচারিকা।’ মাহিনের জিজ্ঞাসা- ‘কেন? সাহেব নেই?’ মিথিলা বলে, ‘দুবছর হলো আমার কাঁধে সব ঝামেলা চুকে দিয়ে তিনি স্বর্গে চলে গেলেন।’ মাহিন অবাক হয়- ‘মানে?’ মিথিলা কথা ঘুরিয়ে বলে, ‘সে থাকগে। ওর জন্য দোয়া করো, যেন সুখে থাকে- ভালো থাকে।’

মাহিন নির্বাক। কিছু বলার ভাষা আর অবশিষ্ট নেই। মিথিলা মাহিনের হাত ধরে টান দিয়ে বলে- ‘চলোতো।’  ড্রাইভার গাড়ির দরোজা খুলে দেয়। মিথিলা আর মাহিন প্রবেশ করে গাড়ির গহীনে অন্ধকারে। বহুদিন পর পাশাপাশি দুজন।

এইচআর/পিআর