ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

ঘুঙুর

প্রকাশিত: ০৬:১৯ এএম, ০৫ আগস্ট ২০১৫

ঘুঙুর

স্বকৃত নোমান

ঘাট ছেড়ে মাঝনদীতে পড়েছে বোট, ঢেউ কাটতে কাটতে এগিয়ে চলছে। বিরামহীন ভটভট ভটভট শব্দ। ব্যাগটা গলুইর কাছে রেখে ছাদে গিয়ে দাঁড়াল আমান। পশ্চিমে নজর ফেলে দেখল, ক্রমে ধূসর হয়ে আসছে কালুরঘাট ব্রিজ। ভাদ্রের জলভরপুর যুবতী কর্ণফুলী। জোয়ার না ভাটা বোঝা মুশকিল। এখানে-ওখানে যাত্রীবাহী বোট আর সাম্পান ভাসছে। আকাশে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ, বাতাসে আলকাতরা আর ডিজেল-পোড়া গন্ধ, দূরের তীরে ঢেউখেলানো কাশবন, জেলেদের শুকোতে দেয়া জাল, চরে বেড়ানো গরু-মোষের পাল। এসব দৃশ্য তার কত না চেনা! বিশটি বছর ধরে তার স্মৃতিতে এমনই গন্ধ বারবার ঝাপটা দিয়ে গেছে, স্মৃতির জমিনে এমনই কাশবন ঢেউ খেলেছে, এমনই গরুমোষের পাল চরে বেড়িয়েছে।

বিশ বছর আগে দেখা প্রকৃতির এই রূপ যেন তার চোখ ঝলসে দিচ্ছে। ঝাপসা হয়ে আসে দু-চোখের পাতা। চোখ বন্ধ করে সে লম্বা শ্বাস নেয়, ডানামেলা পাখির মতো দু-হাত দুদিকে ছড়িয়ে দেয়। দমকা বাতাস তার লম্বা চুল এলোমেলো করে দেয়। মনে হয়, ডানায় ভর করে যেন সে উড়ে বেড়াচ্ছে স্মৃতি-বিস্মৃতির ধূসর জগতে।

কালুরঘাট থেকে জ্যৈষ্ঠপুরা বোটে দু-আড়াই ঘণ্টার পথ, আর বাসে বড়জোর এক ঘণ্টার। বাসে চড়ে গুমদণ্ডী-বোয়ালখালী হয়ে যেতে পারত। সময়ও লাগত কম। কিন্তু তার কাছে সময়ের হিসাব-নিকাশ আপাতত গৌণ। এখন সকাল আটটা। জ্যৈষ্ঠপুরা পৌঁছতে যদি সন্ধ্যাও হয়ে যায়, তাতেও আপত্তি নেই। পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে, চার দিন ফুরালে তবেই না সময়ের হিসাব করবে।

জ্যৈষ্ঠপুরা কার কাছে যাবে, কোথায় থাকবে, কোথায় খাবে ঠিক করা নেই। একদিন যাদের সঙ্গে পরিচয় ছিল, বন্ধুত্ব ছিল, তাদের কে কোথায় আছে কে জানে। বাড়িতে থাকলেও এত বছর পর তাকে ঠিক চিনবে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। জ্যৈষ্ঠপুরা ছাড়ার পর বছর দুয়েক মোজাম্মেলের সঙ্গে পত্রযোগাযোগ ছিল, নূরালি সওদাগরের মুদি দোকানের ঠিকানায় সে নিয়মিত চিঠি পাঠাত। তারপর সে গ্রাম ছেড়ে লেখাপড়ার জন্য শহরে চলে গেল। ছুটিছাটায় বাড়ি এলে মোজাম্মেলের দু-একটা চিঠি পেত, কিন্তু সময়ের অভাবে অথবা নিতান্ত খামখেয়ালির কারণে উত্তর দেয়া হতো না। উত্তর না পেয়েই হয়ত মোজাম্মেল চিঠি দেয়া বন্ধ করে দেয়।

মোজাম্মেল এখন কোথায় আছে কে জানে। বুলির দেখা পাবে কিনা তাও সন্দেহ। দেখা পাওয়ার কথাও তো নয়। কোনো মেয়ে কি এতদিন বাপের বাড়ি থাকে? কে জানে কোথায় বিয়ে হয়েছে তার। আশপাশের কোনো গ্রামে যদি তার বিয়ে হয়, নিশ্চয়ই তবে একবার দেখা করতে যাবে। বুলি কি চিনবে তাকে? না চেনার তো কথা নয়। মেয়েরা প্রথম প্রেম কোনোদিন ভুলতে পারে না। পুরুষও কি পারে? পারলে কই, আমান তো পারেনি।

আচ্ছা, বুলি কি আগের মতোই আছে? নাহ্, তা হয়ত নেই। মানুষ কি চিরকাল একরকম থাকে! তবে নিশ্চয়ই আগের চেয়ে আরো সুন্দরী হয়েছে বুলি। এখন তো তার মধ্যযৌবন। মধ্যযৌবনা নারীর রূপ কখনো কখনো তরুণীর চেয়েও মনকাড়া হয়। আমান যখন জৈষ্ঠ্যপুরায় বুলিদের বাড়িতে থাকত, বুলি তখন সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুণী। শ্যামল বর্ণ, টোলপড়া গাল, চোখের মণি দুটির মধ্যে উদ্ভাসিত তারুণ্য। সে যখন ভেতর ঘর থেকে আমানের কক্ষ-লাগোয়া দরজা দিয়ে বের হতো, না দেখেই আমান বুঝতে পারত কে হেঁটে যাচ্ছে। দু-পায়ে ঘুঙুরের রুনুর-ঝুনুর শব্দ,  স্নো-পাউডারের মন-উতালা ঘ্রাণ এ বাড়িতে আর কার আছে!

প্রথম কদিন তো তার সামনেই পড়ত না বুলি। পড়লেও না দেখার ভান করে চঞ্চলা হরিণীর মতো এক দৌড়ে ছুটে পালাত। কোথা থেকে তার বাবা একজোড়া ঘুঙুর এনে দিয়েছিল তাকে, সারাক্ষণ ঘুঙুরের রুনুর-ঝুনুর শব্দে মুখর হয়ে উঠত সারা বাড়ি। সেই শব্দ আমানকে আকুল করে রাখত সারাদিন। বুলি যতই তাকে এড়িয়ে চলে, তার প্রতি আমানের আকর্ষণ ততই বাড়ে। এ-ই তো মানুষের স্বভাব―অধরা জিনিসের প্রতি তার আকর্ষণ চিরায়ত।

বুলির জন্যই হয়ত জ্যৈষ্ঠপুরায় তার মনটা স্থিরতা পেয়েছিল। শহরের মানুষ সে। জন্ম ও বেড়ে ওঠা শহরেই। শহরই তো। জেলাসদর কুমিল্লাকে তো আর গ্রাম বলা যায় না। নাগরিক সব সুবিধাই তো আছে। গ্যাস বিদ্যুৎ পাকা রাস্তা, স্কুল কলেজ, কল কারখানা―কী নেই? তবু কী এক খেয়ালের বশে বাবা তাকে এই বর্ধিষ্ণু জেলাশহরে না রেখে পড়ালেখার জন্য পাঠিয়ে দিলেন আরেক শহরে, চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম শহরে হলে হয়ত এতটা খারাপ লাগত না আমানের। মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে শহর থেকে প্রায় বিশ মাইল দূরে অজানা-অচেনা অজগাঁ জ্যৈষ্ঠপুরায় তার খারাপ তো লাগারই কথা। মন সারাক্ষণই উচাটন, পড়ালেখায় ঠিকমতো বসাতে পারে না। ভাইবোন আর পাড়ার বন্ধুদের জন্য সারাক্ষণ বুক পোড়ে, সপ্তায় সপ্তায় বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে।

বুলির বাবা নজির হোসেন ভুঞা আমানের বাবার প্রবাসজীবনের বন্ধু। নিজ পুত্রের মতোই বন্ধুপুত্রকে স্নেহ করেন তিনি। মনকে আমান তবু টিকাতে পারত না এখানে। প্রথম দিকে সপ্তায় না হলেও মাসে একবার বাড়ি চলে যেত। ছয় মাসের মাথায়, বুলির প্রতি তার আকর্ষণের কারণেই হয়ত, জ্যৈষ্ঠপুরায় তার মন থিতু হয়ে এলো। বাড়ির জন্য তেমন খারাপ লাগে না আর। দু-মাস গিয়ে তিন মাস কেটে গেল, তবু বাড়ি গেল না। খরনদ্বীপ পোস্ট অফিস থেকে তার নামে বাবার চিঠি এলো―‘বাড়ি হইতে তোমাকে দূরে পাঠাইয়াছি শুধু পড়ালেখার জন্য নয়, ছোটবেলা থেকেই যেন বাংলাদেশটাকে চিনিয়া লইতে পার ইহাই এত দূরে পাঠাইবার কারণ। তার মানে ইহা নয় যে, তুমি বাড়িঘর ভুলিয়া বাউণ্ডুলে হইয়া যাইবে। পত্র পাওয়া মাত্র বাড়ির উদ্দেশে রওনা করিবে।’

রওনা সে করল না, উল্টো নিজ হাতে লিখে একটি চিঠি রওনা করিয়ে দিল―‘বাবাজান, পত্রের প্রথমে আমার সালাম জানিবেন। আশা করি ভালো আছেন। পর, বাউণ্ডুলে আমি হই নাই। সামনে আমার পরীক্ষা, পড়ালেখার খুব চাপ চলিতেছে, এখন বাড়িতে গেলে খুব ক্ষতি হইবে।’

বুলির কাছে নিজেকে মেধাবী ছাত্র হিসেবে জাহির করার জন্যই হয়ত গভীর রাত পর্যন্ত জেগে পড়ালেখা করত আমান। তাতে ফলাফলও হয়েছিল ভালো, তিন বিষয়ে লেটার মার্কসসহ ফার্স্ট ডিভিশন। এবার তার বাড়ি ফেরার পালা। অন্য শহরের অন্য কোনো কলেজে ভর্তি হতে হবে―বাবার আদেশ।

কিন্তু ফিরতে মন চায় না আমানের। জ্যৈষ্ঠপুরার মাঠঘাট, সাগরকন্যা কর্ণফুলী, জোয়ার-ভাটা, মেঘ ছুঁই ছুঁই শৈলশ্রেণি একদিন তার কাছে বিরক্তিকর লাগত। অথচ এখন মনে হয় পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর স্থান আর কোথাও নেই। হয়ত নেই, কিংবা আছে―কিন্তু তার এমনটা মনে হওয়ার কারণ একমাত্র বুলি। বুলির প্রেমই তার চোখে জ্যৈষ্ঠপুরাকে এত বেশি সুন্দর করে তুলেছে। একে ঠিক প্রেমও কি বলা যায়? সে তো কখনো বলেনি―‘বুলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ বুলিও না। তবু তার মনে হয়, এই না বলার মধ্যেই হাজার বার বলা হয়ে গেছে। বুলির সঙ্গে তার প্রেমই যদি না হয়, রোজ ভোরে তবে তার কক্ষের দরজায় কে ছড়িয়ে দেয় সুগন্ধী বকুল? রোজ বিকেলে পড়ার টেবিলে কে রেখে যায় একগুচ্ছ রজনীগন্ধা? বুলি সহজে ধরা দেয় না। তবু তার মনে হয়, ওই ধরা না দেয়ার মধ্যেই সারা জীবনের জন্য ধরা পড়ে যাওয়ার ইশারা।

যেতে চায় না আমান, কিন্তু থাকারও উপায় নেই। পড়ালেখা তো তাকে করতে হবে। জ্যৈষ্ঠপুরায় কোনো কলেজ নেই, আছে বারো মাইল দূরে বোয়ালখালী উপজেলাসদরে। বাবাকে চিঠি মারফত জানাল, বোয়াখালী কলেজে সে ইন্টারমিডিয়েট পড়তে চায়। কঠোর ভাষায় বাবার উত্তর―‘জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত লইবার অধিকার তো তোমাকে এখনো দেয়া হয় নাই। বিলম্ব না করিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি চলিয়া আস।’

পরদিনই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হতে হলো আমানকে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে ভুঞাবাড়ি থেকে বের হলো। কাঁধে ব্যাগ, হাতে পুরনো বইপুস্তক। বাসন্তী বাতাসে রাস্তার ধুলোবালি উড়ছে। জ্যৈষ্ঠপুরা হাটের কাছাকাছি গেলে পেয়ারাবাগান থেকে বেরিয়ে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াল বুলি। খালি পা, ওড়ানাটা কাঁধে ঝুলানো, বেণীবাঁধা চুল, সুরমাটানা চোখ, নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম।
: আর কনোদিন ন আইবান আঁরার বাড়িত?
আমানের চোখের ভেতর যেন ভরাকাটালের জোয়ার আসে। ভরা জোয়ার চোখের বাঁধ ভেঙে তার দুই গাল ভাসিয়ে দেয়। বাহুতে চোখ মুছে সে বুলির মুখের দিকে তাকায়। বুলির ঠোঁটে বিষণ্ণ হাসি, চেহারায় সব-হারানোর বেদনা।
: নিশ্চয়ই আসবো, বুলি। তোমার কথা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না।
: আঁই জানি, আঁই বুঝি বেগগিন। অনে কনোদিন ন আইবান। আঁরার স্মৃতিরে মনত গরি গরি অনে কান্দিবানে কান্দিবান।

বুলির স্মৃতি মনে রেখেছে আমান। মেঘলা দুপুরে, বিষণ্ণ সাঁঝে, নিঝুম রাতে তার স্মৃতি মনে করে কেঁদেছেও বটে। মনে রাখতে রাখতে, কাঁদতে কাঁদতে দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর আসে; বছরের উদরে ঢুকে যায় আরেক বছর। যৌবন গ্রাস করে তারুণ্যকে।

তারপর হয়ত আর বুলির জন্য কাঁদেনি, কিন্তু বুলি তার জীবনের পবিত্রতম স্মৃতি হয়ে থেকে গেল। বুলি আর জ্যৈষ্ঠপুরা, জ্যৈষ্ঠপুরা আর বুলি তার কাছে একাকার হয়ে যায়। জ্যৈষ্ঠপুরার মাঠঘাট, সাগরকন্যা কর্ণফুলী, জোয়ার-ভাটা, মেঘ ছুঁই ছুঁই শৈলশ্রেণি, ঘুঙুরের রুনুর-ঝুনুর শব্দ, স্নো-পাউডারের মন-উতালা ঘ্রাণ, খালি পা, কাঁধে ঝুলানো ওড়না, বেণীবাঁধা চুল, সুরমাটানা চোখ, নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম, গোলগাল মুখ, চোখের মণিতে উদ্ভাসিত তারুণ্য―সব কিছু গলাগলি করে বিশ বছর ধরে তার স্মৃতিতে ভেসে বেড়াচ্ছে।

সেসব স্মৃতির টানে বিশ বছর পর আবার তার জ্যৈষ্ঠপুরায় যাওয়া। কর্ণফুলী আগের মতোই আছে, এখনো জোয়ার-ভাটা হয়, ক্যাঁচকুঁচ শব্দে এখনো নদীর বুকে সাম্পান ভাসে, ঢেউ কাটতে কাটতে বোটগুলো ভটভট শব্দে চলাচল করে, ঘাটে ঘাটে নোঙর ফেলে, যাত্রী নামায়, যাত্রী ওঠায়।

শরণদ্বীপ, খরণদ্বীপ, ভারাম্বাঘাট, চৈলতাঘাট―চেনা অচেনা আরো কত ঘাট পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠপুরাঘাটে এসে থামল বোট। ঘাট থেকে জ্যৈষ্ঠপুরা হাটের দূরত্ব মাইল খানেক। হাঁটাপথে আধঘণ্টার বেশি লাগল না। হাটের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় ঘুরে ঘুরে নূরালি সওদাগরের মুদিদোকান খোঁজে আমান।
: নূরালি সদাগরের মুদিদোয়ান? না বদ্দা, এই বাজারর মাঝে এই নামর কনো দোয়ান নাই।
: দোকানদারি কি ছেড়ে দিল নূরালি?
: কন নূরালি আঁই ত বুঝিন না পারিদ্দে। বাড়ি কঁইক্যা তার?
: জৈষ্ঠ্যপুরার নূরালি। এই বটগাছটার নিচে তার দোকান ছিল।
: ও আইচ্ছা আইচ্ছা! অনে নূরালি চদরী মামার কতা কইতে লাইগ্গুনদে নে? ইবা তো বোত আগৈতে আরবদেশত গিয়্যেগই।
: ও! আচ্ছা, তুমি মোজাম্মেলকে চেন?
: কন মোজাম্মেল?
: জ্যৈষ্ঠপুরা স্কুলের সামনে তাদের বাড়ি।
: ও আইচ্ছা আইচ্ছা, চিনি পাইজ্জি। ইবও ত বিদেশত গিয়্যেগই।...অনে কডে যাইবেন দে?
: আচ্ছা, তুমি কি বুলিকে চেন?
: বুলি? বুলি তো আঁর আম্মাজানের নাম! অনে কন বুলির কতা কইতে লাইগ্গুন দে, আঁরে খুলি কন না।
: তোমার মায়ের নাম? বাহ্। হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার মুখ দেখে তা-ই মনে হয়েছিল আমার। আচ্ছা, তোমার নানাবাড়ি কি জ্যৈষ্ঠপুরার ভুঞাবাড়ি?
: হ্যাঁ। আঁই তো নজির হোসেনর নাতি। অনে আঁর নানারে চিনন পাঁল্লার?
: হ্যাঁ চিনি। তোমাদের বাড়ি কোথায়?
: আঁরার বাড়ি ত মুন্সিরহাট।
: মুন্সিরহাট? কী নাম তোমার?
: কালাম। মোহাম্মদ আবুল কালাম।
: তোমার মা কেমন আছেন?
: মা গম আছে। আঁরার বাড়িত যাইবেন না অনে?
: নিশ্চয়ই। নেবে আমাকে?

একটা রিক্সায় চড়ে বসল দুজন। রাস্তা পাকা বলে প্যাডেল থামায় না চালক। জ্যৈষ্ঠপুরা হাট পেছনে ফেলে দ্রুতগতিতে পশ্চিমে ছুটছে রিক্সা। স্মৃতি-বিস্তৃতির দোলায় দোলে আমান। রাস্তাটা তখন কাঁচা ছিল, গরুর গাড়ি ও সাইকেল ছাড়া কোনো যানবাহন চলত না। কত বদলে গেছে জ্যৈষ্ঠপুরা! কালাম জানায়, তার নানাবাড়ির পেছনে খালটার ওপর ব্রিজ হয়েছে, কাঁচা রাস্তা পাকা হয়েছে, মাটির ঘরগুলো দালান হয়েছে। বদলায়নি কেবল ওই পাহাড়গুলো। আগের মতো এখনো আকাশ ছু্ইঁ ছুঁই। পাহাড়ের গা বেয়ে সিঁথির মতো একটা রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে দূর পাহাড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে চেয়ে থাকে আমান। ওই পাহাড়ের কাছেই ভুঞাবাড়ি। বুলির সঙ্গে দেখা করে কালামের সঙ্গে জ্যৈষ্ঠপুরায় ফিরবে। ভুঞাবাড়ি গিয়ে কালামের নানা-নানির সঙ্গে দেখা করবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বন্ধুদের খুঁজে বের করবে। সবার সঙ্গে দূর পাহাড়ের পেয়ারাবাগানে যাবে, পাকা পেয়ারা খাবে, ঘুরে বেড়াবে নিঝুম পাহাড়ের আনাচে-কানাচে। সন্ধ্যা নামলে আবার ফিরে আসবে গ্রামে। গ্রামে হোটেল-মোটেল নেই তাতে কী, থাকার কি অসুবিধা হবে! কতদিন পর দেখা, বন্ধুরা কি তাদের বাড়ি না নিয়ে ছাড়বে! চার দিনই তো মাত্র। একেক বন্ধুর বাড়িতে থাকবে একেকদিন। তা ছাড়া কালামদের বাড়ি তো আছেই। কোথাও থাকার জায়গা না হলে হাইস্কুল আছে। পূর্ণিমার রাত। স্কুলের মাঠে বসে সারা রাত চাঁদ দেখে কাটিয়ে দেবে।

ভরদুপুর। রিক্সা এসে থামল একটা পাকা মসজিদের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে কালামের পিছু পিছু মসজিদের পেছনে তাদের বাড়ির উঠোনে এসে থামল আমান। গেরস্ত বাড়ি। বিশাল টিনের ঘর। মাঝবয়সী একটা লোক বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে লোটা হাতে ঘরের পেছন দিকে চলে গেল। উঠোনের এককোণে চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে খেলছে, আরেক কোণে বড় কড়াইতে ধান সেদ্ধ হচ্ছে। সারা বাড়িতে সেদ্ধ ধানের গন্ধ। উঠোনের মাঝখানে শুকোতে দেয়া ধান। রঙজ্বলা শাড়ি পরা এক মহিলা হেঁটে হেঁটে ঘেঁটে দিচ্ছে ধানগুলো।
: মা!
কালামের ডাকে পেছনে ফিরে তাকাল মহিলা। ভাঙা চোপার মেচতাপড়া গাল, পানখাওয়া লাল দাঁত, কোটরে ঢোকা দুই চোখ। বেগানা পুরুষ দেখে দ্রুত পিঠের আঁচলটা মাথায় টেনে পাশ ফিরে দাঁড়াল। গুটিয়ে নিল নিজেকে।
বিস্মিত আমানের কুঁচকানো ভ্রূ সমান হয় না। বুলিকে চিনতে তার অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এই কী বুলি! কোথায় তার টোলপাড়া গাল, মুক্তোঝরা হাসি, ঘুঙুরের রুনুর-ঝুনুর শব্দ, স্নো-পাউডারের মন-উতালা ঘ্রাণ? কোথায় তার বেণীবাঁধা চুল, সুরমাটানা চোখ? এতটা বছর ধরে যে মুখ তার স্মৃতিতে জাগরুক সেই মুখের সঙ্গে এই মুখের কোনো মিল খুঁজে পায় না সে। সময় তার বিদঘুটে ছাপ রেখে গেছে বুলির চেহারায়। যৌবন কী নিষ্ঠুর, কত তাড়াতাড়িই না ফুরিয়ে যায়!
: আঁর বাড়িত নোয়া মেমান আইসসে দে ইবা কন, কালাম?
: আঁই ন জানি ত। অনের কন আত্মীয় বলে আইস্সেদে ইবা!
: আঁর কনদিক্যা আত্মীয় ইবা? আঁরে ইবা ক্যানগরি চিনে? আঁই তো গম গরি ন চিনিয়ের।
চিনতে পারেনি বুলি। হয়ত পেরেছে। চিনেও এড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে তার স্বামী উপস্থিত, ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। তারা যদি লোকটার পরিচয় জানতে চায় কী জবাব দেবে? গেরস্তবাড়ির বৌ সে, তাকে তো কোনো বেগানা পুরুষ চেনার কথা নয়!
: অনে কারে চাইতে লাইগগুন দে? ঘোমটার আড়াল থেকে প্রশ্ন করে বুলি।
: কাউকে না। আমি ভুল করে ভুল ঠিকানায় চলে এসেছি।
আর দাঁড়াল না আমান, ধীর পায়ে হাঁটা ধরল। কালাম কিংবা তার মা, কেউ তাকে ডাকল না পেছন থেকে। ডাক শোনার আশাও নেই তার। বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দিল। পাকা রাস্তায় উঠে একটা কদমগাছের ছায়ায় দাঁড়াল। ধুলো উড়িয়ে একটা বাস চলে গেল জ্যৈষ্ঠপুরার দিকে। উড়ন্ত ধুলো এসে পড়ল তার চোখেমুখে। ঝাপসা চোখে সে পুবে তাকায়। জ্যৈষ্ঠপুরার ধূসর পাহাড়সারি দেখা যায়। কেমন মোচড় দিয়ে উঠল বুকের ভেতরটায়। সুখের না দুঃখের, স্মৃতির না বিস্মৃতির―ঠিক বুঝে উঠতে পারল না মোচড়টা কীসের।
: জ্যৈষ্ঠপুরা ন যাইবেন নিকি, বদ্দা?
কালামের গলা শুনে চমকে উঠল আমান। জবাব দিল না। একটা বাস এসে থামল কদমতলায়। জ্যৈষ্ঠপুরা টু চট্টগ্রাম।
: আমি যাই কালাম। ভালো থেকো।
মুচকি হেসে কালাম মাথা দোলাল।
বোয়ালখালী পার হয়ে হাইরোডে উঠল বাস। কালুরঘাট আর বেশি দূরে নয়। কালুরঘাট থেকে বটতলী রেলস্টেশন পৌঁছতে বড়জোর এক ঘণ্টা লাগবে। ঢাকার উদ্দেশ্যে সুবর্ণ এক্সপ্রেস ছাড়বে রাত ৯টায়। যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় পৌঁছতে চায় আমান। আজ জ্যৈষ্ঠপুরা গিয়েছিল এ কথা মন থেকে মুছে ফেলতে চায়।

সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে আমান। বাসের টানা ঢুলুনিতে চোখে তন্দ্রা নামে। তন্দ্রার ঘোরে দেখতে পায় জৈষ্ঠপুরার মাঠঘাট, ভুঞাবাড়ির উঠান, সাগরকন্যা কর্ণফুলী, জোয়ার-ভাটা, মেঘ ছুঁই ছুঁই শৈলশ্রেণি, ঘুঙুরের রুনুর-ঝুনুর শব্দ, খালি দুই পা, টোলপড়া গাল, বেণীবাঁধা চুল, সুরমাটানা চোখ, মণিতে উদ্ভাসিত তারুণ্য, কাঁধে ঝুলানো ওড়না, নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম...।

হঠাৎ স্নো-পাউডারের ঘ্রাণ এসে লাগল নাকে। তন্দ্রা কেটে যায় আমানের। বিমর্ষ চোখে আশপাশের যাত্রীদের দিকে তাকায়, কী যেন খুঁজে বেড়ায় চোখ। বাইরে তাকিয়ে দেখল, কর্ণফুলী ব্রিজ পার হচ্ছে বাস। অসংখ্য বোট আর সাম্পান ভাসছে নদীর বুকে। ফোলা-ফাঁপা নদী। আজ তো পূর্ণিমা, হয়ত ভরাকাটালের জোয়ার শুরু হয়েছে। বুকটা ভারি ভারি লাগে। চোখেও বুঝি ভরাকাটালের জোয়ার আসবে! কে জানে!

আবার চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসল আমান। চলন্ত বাসের শব্দে তার গোঙানির স্বর চাপা পড়ে যায়। কানের কাছে টানা বেজে চলে ঘুঙুরের রুনুর-ঝুনুর শব্দ।

এইচআর/পিআর