অনুরণন
সকাল থেকে বুকের মাঝে কাঁপন অনুভব করে সারা। শীতের রোদে পিঠ দিয়ে যখন পত্রিকার প্রথম পাতায় লাল রঙের হেডলাইনটা চোখে পড়ে তখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে। ‘ও... তাহলে আজ ১৪ তারিখ?’ ক’ বছর ধরে তো এই তারিখেই ‘ভালোবাসা দিবস’ হচ্ছে এখানে। তবু, প্রতি বছরই তার মনে থাকে না। চায়ের কাপের উত্তাপ ঠোঁটে ছোঁয়াতেই সজীবের উচ্ছল হাসি যেন বুকের মাঝে ঝনঝনিয়ে বেজে ওঠে। ভালোলাগা একটা দীর্ঘশ্বাস সারার বুক থেকে বেরিয়ে বসন্তের বিকেলে হারিয়ে যায় আর সারাকে ডুবিয়ে দেয় সজীব নামের সেই একুশ বছরের ছেলেটির মিষ্টি ভাবনায়।
ময়মনসিংহ- এর রেল কলোনির সেই ছোট পুরনো বিল্ডিয়ের ছাদের কোণে বাবার বকুনিতে যখন ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, তখন কোথা থেকে উদয় হ’ল সজীব! কখনো দেখেনি আগে যাকে, সে এসে বলে কিনা, “এই মেয়ে, কাঁদছ কেন?” ক্যাবলার মতো হাঁ করে সজীবকে দেখেছিল সারা। কিছু বোঝার আগেই, শার্টের পকেট থেকে একটা গোলাপের কুঁড়ি সারার সামনে ছাদের রেলিয়ে রেখে হাত নেড়ে পালিয়ে গেলো সে।
সেই শুরু। কখনো সিঁড়ি আটকে দাঁড়ানো, কখনো পেছন থেকে ওড়না টানা, কখনো উড়ো চিঠি। কি যে জ্বালাতন করত ছেলেটা! সারার গালে টোল পড়ে আনমনেই। একদিন তো চিঠির জবাব না পেয়ে পাইপ বেয়ে সারার জানলায় এসে উপস্থিত। সারা পড়ছিল, ফিসফিসিয়ে সারা কে ডাকল ছেলেটা। সারা ওকে দেখে চেয়ার উল্টে পড়ে গেল। শব্দ শুনে মা পাশের ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল, “ কি হয়েছে রে সারা?” সারা ভয়ে হিম। তাও বলল, “কিক...কিছু না মা!” জানলার পাশে গিয়ে সে’বার কথা না বলে পারেনি।
-“আপনি প্লিজ চলে যান। কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হবে”।
-“ তুমি কিছু বল না কেন?”
-“ কি বলব...”
- “আমাকে কি তোমার পছন্দ না?”
-“ প্লিজ, পাগলামি কইরেন না...কেউ দেখলে...”
-“দেখুক”।
কাকুতি-মিনতি চলেছিল অনেকক্ষণ। সারা এখনও কৈশোরের সেই বুক-ধুকপুকানিটা অনুভব করতে পারে। তারপর পরদিন বিকেলে ছাদে আসার শর্তে তাকে মুক্তি দিয়েছিল সজীব। উফ! পাগল একটা! অবশ্য পাগলামির বয়সই তো ছিল। সেও তাই পারেনি সজীবকে বেশিদিন এড়িয়ে থাকতে। স্কুল পালিয়ে সজীবের সাইকেলে হাওয়ার সাথে রেস, অথবা ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ছোট্টো চড়ুইভাতি।
তারপর যা হয় সব গল্পে। কারো চোখে ধরা পড়ল সারার সাথে সজীবের গতিবিধি। সারা আটকে গেল চার দেয়ালে। সজীব ব্যাকুল হয়ে সারাকে খোঁজে, কিন্তু নাগাল পায় না।
সারা গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর, স্কুল ফাইনালের গণ্ডি পেরিয়ে বন্দীদশার বাঁধন একটু আলগা হতেই সারা বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু কোথায় সজীব? ওর তো তেমন কিছুই জানেনা সারা। কিছু না জেনে বুঝি কৈশোরেই মন দেয়া যায়। তারপরও ওর বাসা খুঁজে বের করে। রেলকলোনির পাশে ছোটো দোতালা বিল্ডিঙের এক চিলেকোঠায় নাকি সজীব নামে এক ছেলে থাকত। নাইট কলেজে পড়তো আর কোন সাপ্তাহিক পত্রিকায় দিনের বেলা কাজ করত।
একদিন হঠাৎ করে উধাও হ’লো। বাসা ভাড়া বাকি ছিল, তাই বাড়ীওয়ালা পুলিশে খবর দিয়েছিল। ক’দিন পর পুলিশ জানিয়েছে রেল লাইনে কাটা এক দেহ মর্গে এসেছে ক’ দিন আগেই। সনাক্ত করার উপায় নেই তবে একটা মানিব্যাগ পাওয়া গেছে...। সারা এসব শুনতে আসেনি। সে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। অবশ্যই এই সজীব সেই সজীব নয়। জ্ঞান ফিরলে এই বিশ্বাসটুকু নিয়ে সে চলেই আসছিল। হঠাৎ, বাড়ীওয়ালাটি তাকে অদ্ভুতভাবে দেখতে দেখতে পিছু ডেকে একটা খামে কিছু একটা ধরিয়ে দিয়ে মুখের উপর দরজা দিল।
খাম খুলে সারা দেখল, একটা জীর্ণ মানিব্যাগ। তাতে সজীবের লেখা একটা কাঁচা কবিতা-
“ সারা সারা সারা
আমার ভুবন হারা”
সারা যেন ধ্যান ছেড়ে ওঠে। ভারী গ্লাসের চশমাটা টেবিল থেকে তুলে নেয়। আজকাল লাঠি ছাড়া এ ঘর থেকে ও ঘর করা হয় না। বোনের নাতনীটা ছুটে এসে ধরে জায়নামাজে বসিয়ে দেয়। ১৪ই ফেব্রুয়ারি বড় নানুর সারাটা দিন কাটে নামাজে। জানেনা, কেন।
এইচআর/এমএস