‘মা : আদিপর্ব’ জীবনবোধের গহীন অনুষঙ্গ
নাজনীন বেগম
মা শব্দটির ব্যাপক আর গভীরতায় নিমগ্ন হতে কোনো সন্তানকে বেশি সময় নিতে হয় না। মা তার সার্বক্ষণিক পরিচর্যায় সন্তানের জীবনে মননে এমনভাবে গেঁথে থাকেন সেখান থেকেই কোনো সন্তান তার মাকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে জানতে, বুঝতে এবং ভাবতে পারে। মাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা কিংবা মায়ের সযত্ন স্পর্শে নিবিষ্ট হওয়া প্রতিটি সন্তানের সহজাত প্রত্যয়। যে বোধ তৈরি করতে মাকেই সন্তানের মধ্যে একাত্ম হয়ে যেতে হয়। তরুণ কবি গিরীশের মাকে নিয়ে লেখা কবিতাগুচ্ছ পড়তে গিয়ে সে কথাই ঘুরেফিরে পাক খাচ্ছে। মায়ের আজন্ম লালিত স্বাপ্নিক অনুভূতি দশ মাস দশ দিন সন্তানকে জঠরে লালন করে একসময় পৃথিবীর আলো দেখানো। মায়ের কল্পনাতাড়িত এই বোধ শুরু হয় সেই শৈশবের পুতুল খেলার মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় :
‘ছিলি আমার পুতুল খেলায়
প্রভাতের শিব পূজার বেলায়
তোরে আমি ভেঙ্গেছি আর গড়েছি।’
গিরীশের ভাষায় :
‘নারীদের গর্ভে সন্তান এলে
দুধে ভরে ওঠে স্তন।
সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে পরে-
তার মুখে স্তন গুঁজে গুণতে থাকে স্নেহের নক্ষত্র।
বিপরীতে-ভূমিষ্ঠ শিশু মৃত হলে
তখন তাদের স্তন নিজেদের কাছে হয়ে ওঠে বিষের পেয়ালা।
একদা আমার মায়ের স্তনও হয়েছিলো বিষের পেয়ালা
আমাকে জন্মানোর পরে কিংবা তোমাকে ভূমিষ্ঠ করার আগে।’
(মা : আদিপর্ব ৫১)
রবীন্দ্রনাথের কবিতায়-পুতুল খেলার নির্মল বাসনা যখন বাস্তবে রূপ নেয় মা তখন সর্বংসহা স্বর্গাদপী গরীয়সীর ভূমিকায় চলে আসেন। উদীয়মান কবির কবিতায় মায়ের অনুভব আর আবেগের প্রতিষঙ্গ হিসেবে সন্তানের যে নিবিড় ঘন আবেশ তা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মা স্নেহাতিশয্যে সন্তানের যে অবয়বে নিজের সর্বাঙ্গীন স্পর্শের নিরবচ্ছিন্ন সৌরভ বিলিয়ে দেন সে জায়গা থেকে মাতৃমঙ্গলের কোনো বিকল্প নেই। গিরীশ সন্তান আর মায়ের এই অনবচ্ছেদ একাত্মতাকে দক্ষ নির্মাণশৈলীতে পরিপূর্ণ করেছেন :
‘আমার মা এক মৃন্ময়ীবৃক্ষ
তার জীবিত শরীর জুড়ে উইপোকার বসবাস।
আমি সেই বৃক্ষে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে গেঁথে আছি
আর টের পাচ্ছি-বিষাক্ত কামড়ের জ্বালা।
অথচ-উইপোকারা জানে না-
আমাদের কাঠ থেকে তৈরি হবে ম্যাচবাক্সের কাঠি।’
(মা : আদিপর্ব ০১)
এই স্বাভাবিক অথচ নিগূঢ় বন্ধনে মা-সন্তানের অদ্ভুত শুভযোগ পাঠকদের কাছে মাতৃস্নেহকে আরও একবার নতুন মাত্রা এনে দেবে। মায়ের স্নেহ, মায়ের শাসন যে কোনো সন্তানের জীবনের গতিকে নির্মল করে, শুদ্ধ করে, নিষ্কণ্টক করে সর্বোপরি নিরাপদ করে। আর মায়ের অনুপস্থিতি সন্তানের জীবনকে কোন্ মাত্রায় নিয়ে যেতে আরে তাও কবিকে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করে :
‘আমার মৃত্যু হলে-মায়ের মৃতদেহে
একবার জীবিত হতে চাই।
মায়ের মৃতদেহের অন্ধকারে-জোনাক আলো জ্বেলে
পাঠ করে নিতে চাই-তার সুখ ও দুঃখের খবর।
কিংবা তিনি কতটা কষ্টে পৃথিবীতে এসেছিলেন
আবার কতটা কষ্টে পৃথিবী ছেড়ে গেলেন
জীবিত থাকতে আমি এসবের কিছুই বুঝিনি।’
(মা : আদিপর্ব ২২)
মাতৃস্নেহ রসধারায় সন্তানের জীবন সিক্ত হয়, পুষ্ট হয় এমনকি বীরপূর্ণ হয়। মাকে নিবিড় মমতায়, অনুভবের মাত্রায় কবির আবেগস্নাত অম্লান শব্দশৈলীর যে নিরবচ্ছিন্ন দ্যোতনা তা যেমন পাঠকদের এক অন্যরকম পরিবেশে নিয়ে যায় একইভাবে কবিতার কাঠামোগত অবয়বকেও ভিন্ন মাত্রা দেয়। মা-ই জীবনের সমস্ত সম্পদ আর সত্যের আধার :
‘একফোঁটা চোখের জলে-থাকে যতটুকু নুন
তারও অধিক থাকে ব্যথার আগুন।
শুনেছি ব্যথার আগুন-প্রসব বেদনা থেকে কম হলে
সন্তানের আঘাতে কাঁদে না মা, চোখের জলে।
তাই মায়ের চোখে কুলাদ্রির প্রেম প্রতিভাত হয়
মায়ের শরীরে মিশরীয় মমির খুশবু কথা কয়।’
(মা : আদিপর্ব ৪৯)
এমন গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে মাকে সম্মোহিত করার যে উচ্ছ্বাস প্রবণতা তা কবিকে মাতৃবন্দনার এক শৈল্পিক পূজারী হিসেবে পাঠকের সামনে নিয়ে আসে। সত্যিই যে কোনো মায়ের অহঙ্কার, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা এমন সন্তানের যে মাকে শুধু দায়বদ্ধতায় নয় সম্মোহনের আবেগেও ভরিয়ে দেবে। মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক জন্ম-জন্মান্তরের। মাতৃজঠোর থেকে এ যাত্রা শুরু হলেও আশৈশব চৈতন্যের আবেগে যে স্বাপ্নিক অনুভূতিকে লালন করে তা যেন অনন্তকালের পথযাত্রীর এক অভিনব নিবিষ্টতার চূড়ান্ত নির্দেশনা। মা যেমন অনুক্ষণের, প্রতিদিনের চিরকালের একইভাবে মা-ই হয়ে ওঠেন সন্তানের জীবনব্যাপী সাধনার এক অক্ষয় বৈভব। নিত্যকর্মযোগে, প্রাত্যহিক আবেদনে মা যেমন সন্তানের শুভ আর মঙ্গলের এক অনির্বাণ দীপ্তি তেমনি সমস্ত আবর্জনা আর অভিশাপ থেকে রক্ষা করারও এক অকৃত্রিম শুদ্ধ প্রতিমা। সন্তানকে আগলে রাখতে স্নেহে আর শাসনে মার যে দ্বৈতসত্তা তা প্রতিটি মায়ের এক অনুপম মঙ্গল শিখা। গিরীশের কবিতার ছত্রে ছত্রে তারই অনুরণন, মাতৃপূজার এমন সাবলীল অভিব্যক্তি কবির প্রতিভাদীপ্ত সৃজনের এক অনন্য রূপ যা পাঠককে নতুন করে মাতৃসঙ্গ অনুভব করাবে।
‘মা : আদিপর্ব’ পড়তে পড়তে মনে আসে রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি নারীর দ্বৈতসত্তা নিয়ে সেই অমর বাণী : ‘নারীর দুটো রূপের একটি হলো স্নেহে, মায়ায়, মমতায় নারী মাতা আর প্রেমে, পূজায়, নিবেদনে নারী প্রিয়া।’ এই পরম সত্যটি বিশ্বকবির সাহিত্যে নারী চরিত্রের এক দীপ্যমান শিখা। এই বিষয়টি গিরীশের কবিতায় এসেছে জীবনবোধের প্রগাঢ় মহিমায় : ‘মায়ের স্তনের প্রতি পিতা ও পুত্রের যে ধ্রুপদী দ্বন্দ্ব/ সেই দ্বন্দ্বে নারীরা কভু হারিয়ে ফেলে না প্রেমের ছন্দ।’ (মা : আদিপর্ব-এর স্তন কাণ্ডের ভূমিকা)।
রবীন্দ্রনাথ নিজের মাকে সাহিত্যে নিয়ে আসতে না পারার কষ্ট জীবনভর লালন করেছেন। এক আলাপচারিতায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে উল্লেখ করেন যে ঠাকুরবাড়ির চিরায়ত নিয়মকে মেনেই তিনি বড় হন ধাত্রীমাতা এবং গৃহপরিচারকদের তত্ত্বাবধানে। মাতৃসান্নিধ্য থেকে প্রায়ই বিচ্ছিন্ন কবি একসময় বড়দিদি সৌদামিনী দেবীর স্নেহছায়ায় বড় হতে থাকেন। পর্যায়ক্রমে নতুন বৌঠান কাদম্বরীর মায়া মমতায়ও সিক্ত হন প্রায়ই সমবয়সী রবি। ফলে মাকে কাছে না পাওয়ার ফারাকটুকু ভরে দিতে পারেনি তাঁর সাহিত্যে মায়ের অনুপস্থিতি। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রগবেষক ও বিশেষজ্ঞ প্রমথনাথ বিশী বলেন : ‘নিজের মাকে সাহিত্যে না আনার দুঃখ ম্লান হয়ে যায় যখন দেখি গোরার আনন্দময়ীকে। যিনি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মাতৃ আসনে আজও মর্যাদা রক্ষা করে যাচ্ছেন। এমন মা বাস্তব কিংবা সৃজন সত্যিই বিরল।’ মাতৃমহিমার আরও নানামাত্রিক রূপে কবির কবিতাও সমৃদ্ধ হয়েছে। ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’-এ কুন্তীর অবিচলিত মাতৃশৌর্যে যেমন বিমুগ্ধ জন্ম মুহূর্তে পরিত্যক্ত সন্তান কর্ণ একইভাবে নানা বর প্রার্থনায় পাওয়া অন্য পঞ্চ সন্তানও। আর ‘গান্ধারীর আবেদন’ কবিতায় গান্ধারী শুধু স্নেহে আর মমতায় নয় আদর্শে, নিষ্ঠায়, নীতি নৈতিকতায় এক বলিষ্ঠ মাতৃমূর্তি। দ্রোপদীর বস্ত্রহরণ থেকে শুরু করে পঞ্চপাণ্ডবের প্রতি সন্তান দুর্যোধন আর দুঃশাসনের অন্যায়, অবিচার আর অনাচারের বিরুদ্ধে যেভাবে ক্ষুব্ধ অভিব্যক্তিতে স্বামী জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে সন্তান পরিত্যাগের আকুল আবেদন জানায় সেখানে নিষ্ঠাবতী গান্ধারীর শাসনের কঠিন বলয়ে স্নেহসিক্ত, করুণাময়ী মায়ের যে দ্বৈতসত্তা কবিকে প্রাণিত করে সেই মা-ই তো তাঁর সারা জীবনের আরাধ্য মাতৃদেবী। এখানে আর একটি অনুপম দৃষ্টান্ত উল্লেখ না করলে মাতৃমহিমার আর এক জলন্ত শিখাকে অসম্মান করা হয়। নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না কাকে আনার অপেক্ষায়। সাড়া জাগানো সেই বিশ্বখ্যাত উপন্যাস মাক্সিম গোর্কির ‘মা’। যা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। স্নেহে, মায়ায়, সংগ্রামে, বিপ্লবে, দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত এক মমতাময়ী মায়ের অনবদ্য জীবন লড়াই। যা আজও পাঠক সমাজকে আনন্দ, বেদনায় আর অনুভূতিতে বিভোর করে রাখে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাঠককে এমন এক জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে শুধু একটি শব্দই বারবার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় মা-মা-মা...।
গিরীশের ‘মা : আদিপর্ব’ সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে ঘুরিয়ে নিয়ে আসল। রবীন্দ্রনাথ আমার প্রতিমুহূর্তের প্রেরণা, নিত্যদিনের কর্মযোগ, তাঁকে স্মরণ করা আমার নিয়মিত কাজের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু মাক্সিম গোর্কিকে মনে পড়ল মা নিয়ে লেখা কবিতাগুলো পড়তে পড়তে।সৃষ্টি আদি থেকে এভাবে মা যুগে যুগে সন্তানদের কাছে তো বটেই-মননশীল এবং সৃষ্টির দ্যোতনায় নিমগ্ন বিশিষ্টজনদের কাছেও দুর্লভ মহিমান্বিত রূপশৌর্য। পৃথিবীর আদি এবং অকৃত্রিম শব্দই মা। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে অবাধ স্বেচ্ছাচারে বাবার কোনো পরিচয় ছিল না। মার গর্ভ থেকে সন্তান আসত বলে মাকেই চেনা যেত। সম্পত্তি এবং বংশ পণ্ডিত উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানের ওপর মায়ের দিক থেকেই বর্তাত। আর পৃথিবীতে প্রথম পরিবারই শুরু হয়েছিল মাতৃতান্ত্রিক যার সামান্য অপভ্রংশ আজও পৃথিবীর কোনো কোনো জায়গায় দৃশ্যমান। বাংলাদেশের গারো সমাজ এখনও মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের অনুবর্তী।
আবারও গিরীশের মাকে নিয়ে বলতে চাই। মার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের গাঢ়তায় যে দ্বৈত মিলন গ্রন্থি তৈরি হয় তা সত্যিই অভিনব আর আপন বৈশিষ্ট্যে অনবদ্য। মায়ের যেমন সন্তানকে বুঝতে বেশি সময় লাগে না তেমনি সন্তানের কাছে মায়ের অবাধ আর অপ্রতিহত বন্ধন মাকেও নিয়ে আসে সন্তানের একান্ত সান্নিধ্যে। মায়ের অনেক অব্যক্ত কথা সন্তানের হৃদয়ে গেঁথে যায়। মায়ের সঙ্গে সন্তানের মিলনসৌধে অনিবার্যভাবে এসে যায়, মাতৃভূমি আর দেশপ্রেম। মা নিজেই দেশমাতৃকার এক অনন্য প্রতিবিম্ব। মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখো মায়ের সম্ভ্রম হারানোর বেদনা কবির শৈল্পিক দ্যোতনায় যে আঁচড় কাটে তার প্রকাশ পায় ঠিক এভাবে :
‘কারণ তুমি চেয়েছিলে-
মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিত তোমার সেই কিশোরী দেহের দাহ
বৃষ্টির জলে ধুয়ে পবিত্র হোক।
কারণ তুমি চেয়েছিলে-
তোমার ধর্ষক ভণ্ড মাওলানার বিচার হোক।’
(মা : আদিপর্ব ৩৩)
যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই বারবার ধর্ষিত হয় ভণ্ড দেশপ্রেমিক আর উগ্র মৌলবাদীদের নগ্ন থাবায় সেখানে লাঞ্ছিত মায়ের সম্মান কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে তার জবাব কারও কাছে আছে কিনা জানি না। আমরা শুধু চাই উদীয়মান, আধুনিক এবং নতুন প্রজন্ম দেশমাতৃকার সম্মান আর গৌরবকে নতুন বোধ আর অভিব্যক্তিতে উপলব্ধি করুক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নবোদ্যমে শাণিত করুক, কট্টর প্রতিপক্ষ আর প্রতিক্রিয়াশীল সমস্ত অপশক্তিকে মুক্তবুদ্ধি আর সার্বজনীন জ্ঞানচর্চার সঙ্গে নতুন জাগরণের বলিষ্ঠ পথ পরিক্রমায় এগিয়ে নিয়ে যাক। মায়ের আদলে দেশকে অনুভব করে দেশমাতৃকার সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করতে অনেক সন্তানকে দুর্বার, দুরন্ত মিছিলে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে হবে। দেশকে বাঁচাতে না পারলে মা-ও যথার্থ মর্যাদায় টিকে থাকতে পারবে না।
‘মা : আদিপর্ব’ গ্রন্থটির কাঠামো মহাকাব্যিক। মহাকাব্যে যেমন পর্ব থাকে কাণ্ড থাকে, গিরীশের এই কবিতাগ্রন্থও ঠিক এমন করে সাজানো হয়েছে। তিনি আদিপর্বে রেখেছেন চারটি কাণ্ড- বৃক্ষকাণ্ড, অশ্রুকাণ্ড, স্তনকাণ্ড ও নদীকাণ্ড। প্রতিটি কাণ্ডে একটি-দুইচরণ বিশিষ্ট বিশমাত্রার ভূমিকা আছে, পঁচিশটি করে কবিতা আছে এবং প্রতিটি কাণ্ডে একটি করে সিরিজ পেইন্টিং আছে। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেছেন শিল্পী সমর মজুমদার। কবির কাছে জেনেছি- তিনি মাকে নিয়ে চার শতাধিক কবিতা লিখেছেন। তিনি পরবর্তীতে মাকে নিয়ে আরো তিনটি পর্ব প্রকাশ করবেন। এটি তার প্রকাশিত দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ। তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’।
মাকে নিয়ে গিরীশের যে সূক্ষ্ম আর শৈল্পিক ব্যঞ্জনা তা শুধু মাতৃবন্দনাই নয়-মা ও সন্তানের এক চিরস্থায়ী বন্ধনের অম্লান সম্পদ। যেখানে হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার আকাঙ্ক্ষা আর বিরোধের সঙ্গে পারস্পরিক সহমর্মিতা, এগিয়ে চলা, স্বপ্নদেখা, হরেক রকম উপমা আর প্রতীকে মাকে আবৃত করা সর্বোপরি মায়ের অবিচল শক্তি আর সৌন্দর্যের অনুগামী হওয়া। বইটি মায়ের প্রতি নিবেদনের এক চমৎকার সৃষ্টিশীল আখ্যান। যা পাঠককে নানা মাত্রিকে উদ্বুদ্ধ করবে, আনন্দ দেবে, নতুন অনুভূতিতে মায়ের প্রতি ভালোবাসা আর দায়বদ্ধতায় ভরিয়ে তুলবে। সেই চিরন্তন মাকে প্রতিদিনের পথযাত্রায় অপরিহার্য আবেদনের মাত্রায় নতুন কিছু সংযোজনও করতে পারে। কবিতাগ্রন্থটির বহুল প্রচার এবং সর্বাঙ্গীন সফলতা কামনা করছি। অবশেষে গৈরিকের একটি কবিতা দিয়ে সমাপ্ত করি :
‘সবুজ চা পাতা শুকিয়ে গরম পানিতে স্নান করালে
ওই পানির রঙ রক্তলাল হয়ে যায়
চা পাতার এই রক্তলালের রহস্য খুবই কুয়াশাময়।
আমার মায়ের গল্পে শুনেছি-চা পাতার এই রক্তাক্ত রহস্যকথা
মা বলেছিলেন- ‘চা পাতার মাঝে লুকিয়ে আছে
চা শ্রমিক নির্যাতনের রক্ত। তাই সে লাল।’
সেই থেকে আমার চা পান করলে মনে হয়
আমি কোনো না কোনো শ্রমিকের রক্ত পান করছি।’
(মা : আদিপর্ব ৯০)
কবিতাগ্রন্থ- মা : আদিপর্ব
প্রকাশকাল- ২০১৭
প্রকাশক- বেহুলাবাংলা
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ- শিল্পী সমর মজুমদার
মূল্য- ২০০ টাকা
এসইউ/পিআর