ফকির ইলিয়াসের পাঁচটি কবিতা
উনুনের উপভাষা
বৃষ্টির কলতান বন্দী থাকে জলরেকর্ডারে। যে নদী একচিলতে
আগুন বুকে নিয়ে, যায় ভাটির সন্ধানে- তার গভীরেও জাগ্রত
থাকে সবুজ উনুন। আমি উনুনের উপভাষা বুঝি। তাই তোমার
ঠোঁটে নিমিষেই লিখে দিতে পারি প্রেমের সর্বনাম।
তুমি এই নামগুলো বিলিয়ে দাও নগরের প্রতিটি নক্ষত্রে।
ওরা উনুনের মতো জ্বলে উঠুক। অথবা নিভে যাক-
তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি তোমার পাতালেই
খুঁজেছি বিনম্র বিহার। ভ্রমণের শতবর্ষী ভ্রম। আর তারপাশে
আমাদের পদছাপের স্মৃতি। জানি তা-ও একদিন মিশে যাবে
অনন্ত সমুদ্রে। নীল ফেনার বিরহ, গিলে খাবে দ্বৈত সূর্যের বিচ্ছেদ।
তারপর দু’য়ে মিলে উপভোগ করবে সেইসব উপভাষার উপবাস।
আকাশের রং বন্দী থাকে চোখের নীলরেকর্ডারে। যতদূর দৃষ্টি যায়,
দেখি- বাঁচার ইচ্ছে নিয়ে উঁকি দিচ্ছে কর্মগুলোর ভ্রুণ। হয়তো ওরাও
বেঁচে থাকবে। শুধু থাকবে না কর্মীর দুটি হাত। যে হাতগুলো
ছবি এঁকেছিল, অথবা লিখেছিল কবিতা। কিংবা তোমাকে পাবার জন্য
বাড়াতে চেয়েছিল দশটি আঙুল। সংরক্ষিত উনুনের উপভাষায়-
লিখে যেতে সবটুকু ভুল।
****
আকাশের বৃষ্টিধর্ম
লোনাজল কিংবা মিঠেপানি, অথবা আকাশের দিকে উড়ে যাওয়া বাষ্প-
আবার যখন মধ্যরাতের গায়ে ঝরে পড়ে, তাকে ছুঁতে ছুঁতেই একাকী চাঁদ
খোঁজে একান্ত বৃষ্টিধর্ম। জলের গরিমা যেভাবে পরখ করেছিল নিম্নবিত্ত নদী,
আষাঢ়ের সান্ধ্য ঝাপটা যেভাবে বরণ করেছিল তছনছ নগর, আর বসন্তের
প্রেমাশ্রু চোখে, পরদেশি প্রেমিকের পথে গোলাপ ছিটিয়েছিল যে নারী, তারাও
মানে এই গ্রন্থের বিধান। জলসমগ্রের গায়ে আছড়ে পড়ে যে মানবিক আকুতি,
তাকে-ও তো প্রেম বলা যায়, বলা যায় বিরহ— আর কিছু স্বপ্নের সাথী।
****
দাগহীন ঝড়ছায়া
যুগল ঝড়ের চিহ্ন রেখে যায় বৈশাখ। যে কবিতাটি গ্রন্থসূচিতে
রাখবো না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম- তার জন্মসন পুনরায়
স্মরণ করার চেষ্টা করি। কিছুটা তাণ্ডব আর কিছুটা বিস্ময়ের
খড়কুটো কুড়াবার জন্য আবারও প্রস্তুত হই। রোদশূন্য নগরের
মধ্যাহ্ন হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকে। সাড়া দিতে দিতে জেনে যাই-
ভোরের বৃষ্টি হয়ে আসে যে প্রেম, মানুষ তার দাস ছিল অনন্তকাল।
আমার ভেতরে একজন ক্রীতদাস যাপন করে দীর্ঘজীবন। আমার
দুহাতকে শাসন করে অন্য দুটি হাত। এমন সত্যের কাছে নতজানু
হতে হতে আমি যখন আবারও ঝড়ের দিকে তাকাই, তখন দাগহীন
আকাশের ছায়া আমাকে আলিঙ্গন করে। একই ছাদের নিচে বসবাস করেও
যে সূর্যের মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি- আজ তার জন্মদিনেই
নিবেদন করি আমার সেই কবিতা। রোদগ্রস্ত প্রেমের কিরণ।
****
বজ্র ও বন্ধুভাগ্য
একদিন সকালে জেগেই দেখি আমার মুখবই থেকে উধাও
হয়ে গেছে অনেকগুলো মৌসুমী পাখি। মূলত যাদের কোনো
ডানা ছিল না, তারা কীভাবে উড়েছে আকাশে- তা ভেবে
বেড়ে গিয়েছিল আমার বেদনা। বিষাদের দানা দিয়ে আমি
এঁকেছিলাম যে বন্ধুভাগ্য, তার জন্য ভুলে গিয়েছিলাম কাঁদতেও।
কান্নার আদলে যে বজ্র পতিত হয়েছিল আমার প্রতিবেশে,
অতঃপর তাকে সাক্ষী রেখে সেই বিজলীবাষ্প-
আমি লিখেছিলাম আমার স্বপ্নকালীন ভোরের তৃতীয় গান।
মানুষ মূলত একাকী-গৃহহীন
এই সত্যের সাথে করতে করতে শব্দের আদান।
****
কথাগুলো মুছে যায়
আমাদের চারপাশে অক্ষরের প্রচারণা দেখে খুঁজে ফিরি
ভালোবাসার পথ। বৃষ্টি এসে মুছে দেয় যে স্বপ্নগুলো
আসলে তা হারায় না। জেগে থাকে চাঁদের চোখের মতো।
কখনও কাঁদতে পারে, কখনও কাঁদায়
পথ চেয়ে সেই সত্য পরখ করে অভিসারী মন।
বিজ্ঞাপনটি টিভির পর্দায় ভেসে উঠলেই শিশুটির
সাথে আমিও পার হই পরিচিত সাঁকো। তারপর
দৌড়ে গিয়ে তালাশ করি বিধ্বস্ত চিঠির স্তুপ। হাতে
লেখা বর্ণের ছটা। আর হস্তছাপ। এই ভূমিতে একদিন
আমার পিতামহেরও ছায়া পড়েছিল!
এসইউ/আরআইপি