কাঠগড়া
স্ত্রী-সন্তান হত্যা মামলার আসামি সোহেলের মুখটা ব্যান্ডেজে ঢাকা। বেশ কিছুদিন ধরে কারাগারে হাজতি হিসেবেই আছে সে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরানীগঞ্জ থেকেই আজ তাকে আদালতে আনা হয়।
শুনানির দিন ছিল। সপ্তাহখানেক আগে হাসপাতাল থেকে আটক হয় সে। তার আগের সপ্তাহে স্ত্রী-সন্তানসহ প্রাইভেটকার অ্যাকসিডেন্ট করে সোহেল। গুরুতর আহত অবস্থায় নিজে বেঁচে গেলেও স্ত্রী আর কলেজ পড়ুয়া একমাত্র ছেলে মারা যায়। স্ত্রী-সন্তান দাফনের সময়ও উপস্থিত থাকতে পারেনি। সজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়েছিল হাসপাতালের বিছানায়।
একটু সুস্থ হয়েই জানতে পারলো স্ত্রী-সন্তান কেউ বেঁচে নেই। শোকের সংবাদের সঙ্গে এটাও জানলো পুলিশের হাতে আটক অবস্থায় চিকিৎসা চলছে তার। তার বিরুদ্ধেই স্ত্রী-সন্তানকে খুনের অভিযোগ।
একটু সুস্থ হতে না হতেই আদালতের মাধ্যমে তাকে জেলে পাঠায় পুলিশ। এখন কারা হাসপাতালেই চলছে চিকিৎসা। সেখান থেকেই আজ আদালতে তুলে ১০ দিন রিমান্ড চায় পুলিশ। মেডিকেল রিপোর্ট দেখার পর আসামি কতটুকু সুস্থ তা যাচাইয়ের জন্য তাকেও সশরীরে দেখতে চান বিচারক। এ কারণেই কাঠগড়ায় তোলা হয় তাকে।
হাঁটা-চলা করতে পারলেও পুরো শরীর ব্যান্ডেজে ঢাকা। মাথায় যেন ব্যান্ডেজের পাগড়ি। মুখে ব্যান্ডেজ থাকায় চেহারাটাও ঠিকমত বোঝা যায় না।
বিচারক তার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আপনার শরীর কতটুকু সুস্থ? পুলিশ রিমান্ড চাইছে। কিন্তু মেডিকেল রিপোর্ট দেখার পর আমার মনে হলো আপনার সঙ্গে কথা বলেই রিমান্ড মঞ্জুর করা উচিত।’
মাথা নিচু করেই আসামি জবাব দিল, ‘সব হারিয়েছি ম্যাডাম। স্ত্রী-সন্তান হত্যা মামলার আসামিও হয়েছি। আমার আর কিছু বলার নেই। শুধু বলবো- যদি নিজেও মরে যেতাম তাহলেই বোধহয় নিরাপরাধ গণ্য হতাম!’
বিচারক বললেন, ‘নিরাপরাধ হলে নির্দোষ প্রমাণিত হবেন।’
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বিচারকের দিকে তাকালো সোহেল। দেখেই চমকে উঠলো। মনে যেন ঝড় বইছে। একি! বিচারকের আসনে কে!
কিছু বলছেন না যে! জানতে চাইলেন বিচারক।
আসামির শুকনো জবাব, ‘আমি কোনো অপরাধ করিনি সোহেলী।’ যা কেবল বিচারকের কান পর্যন্তই পৌঁছেছে বোধকরি।
বিচারক তার রিমান্ড ও জামিন দুই আবেদন নাকচ করে উন্নত চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। কেবল কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামিই বিচারকের কুঞ্চিত কপালের দিকে লক্ষ্য করলো।
কয়েক মাস পর বেশ কয়েকটা পত্রিকার শিরোনাম, ‘আসামিকে বিয়ে করলেন বিচারক’। খবরের ভেতরের অংশ থেকে জানা গেল, সোহেল নামের যে আসামিকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম তানজীনা তাসনীম সোহেলী বিয়ে করেছেন। তার বিরুদ্ধে স্ত্রী-সন্তান হত্যার অভিযোগ ছিল। কিন্তু পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে সোহেলের ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ তাকে সপরিবারে হত্যা করে তা দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল। হত্যার নেপথ্যের খলনায়ক একটি গার্মেন্টস কোম্পানির মালিক জিসান চৌধুরী। সোহেলের সুন্দরী স্ত্রীকে এককালে বিয়ে করার কথা ছিল তার। কিন্তু তার মতো চরিত্রের কারো কাছে বিয়ে না দিয়ে সোহেলের মতো এক মধ্যবিত্ত ঘরের ভদ্রছেলের কাছে তাকে বিয়ে দেয় পরিবার। সেই ক্ষোভটা জমা ছিল। সেইসঙ্গে সোহেলেও ব্যবসায় সাফল্য দেখিয়ে নিজের অবস্থান গড়েছে।
জিসানের সেসব সহ্য হয়নি। তাই তাকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনা করে। বেঁচে গিয়েও ফেঁসে যায় সোহেল! তাকেই হতে হয় স্ত্রী-সন্তান হত্যা মামলার আসামি। মামলার সবকিছু এমনভাবে সাজানো ছিল- সোহেলের পক্ষে ফাঁসির দড়ি এড়ানো প্রায় অসম্ভব! কিন্তু বিচারক তানজীনা তাসনীম সোহেলীর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বন্ধু হওয়ায় তিনি বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে সুষ্ঠু তদন্ত করিয়ে নেন। থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে।
সোহেলের জন্য ফাঁসির দড়ি প্রস্তুত করে এখন সেখানে ঝোলার প্রহর গুনছে জিসান। অপরদিকে চিরকুমারী বিচারক তার সেই বন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে তাকে মুক্ত করেন। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়েও করেন। বিচারক বলে কথা! তাই বোধহয় পত্রিকাগুলো আর বেশি বাড়ায়নি। না হলে রসিয়ে লিখতো।
পত্রিকাগুলো ড্রয়িংরুমে বসে দেখছিল সোহেল। পাশে এসে দাঁড়ালো সোহেলী। সে এসে দাঁড়াতেই সোহেল বললো, ‘আমার জন্য তোমাকে বদনামের ভাগিও হতে হলো।’
হাসলো সোহেলী। বললো, ‘দু’দিন পর আর আলোচনা থাকবে না। বাদ দাও ওসব। গতবার অবকাশ নেইনি, তাই ভাবছি এবার নেব। চলো ঢাকার বাইরের কোনো জায়গা থেকে ঘুরে আসি।’
‘তুমি একটু আমার পাশে বসবে?’ বললো সোহেল।
বসে পড়লো সোহেলী।
‘তুমি আমায় ক্ষমা কোরো সোহেলী। সেসময় আমি লোভী হয়ে পড়েছিলাম। কোটিপতি বাবার একমাত্র মেয়ে বন্যার জন্য। সে মেয়ে ভালো ছিল। সংসার জীবনেও আমরা সুখেই ছিলাম। কিন্তু আমার সেই পাপ ছাড়েনি। তোমাকে ঠকিয়েছি তাই আজ আমার এ অবস্থা।’ তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো সোহেল।
সোহেলী বললো, ‘দেখ সোহেল। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা খাঁটি ছিল। তাই তো ছাত্রজীবনেই কোনো কিছুর পরোয়া না করে তোমার মেসে পর্যন্ত গিয়ে বহুবার একান্তে সময় কাটিয়েছি। তুমি যখন চলে গেলে তখন আমি নিজের উপরই বেশি বিরক্ত হয়েছি। ভাবলাম আর কোনো পুরুষের বিছানায় যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি তেমন মেয়েও না। তাই কখনো বিয়ে না করার জন্য দৃঢ় সংকল্প করেছিলাম। পড়াশোনাটা ভালোভাবে করে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে টিকে গেলাম। তুমি না এলে আর কাউকে কোনোদিন বিয়েই করতাম না। বাড়ি থেকেও আর কেউ আমার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি।’
‘জানি, এখনও আমি অপরাধী।’ মাথা নিচু করে বললো সোহেল।
‘না তোমায় আমি সেই কবে ক্ষমা করেছি। ভুল তো আমিসহ ওইসব মেয়ের, যারা ভালোবাসার লোভে সম্ভ্রম পর্যন্ত বিলায়। সতর্ক থাকলে আজ হয়তো আমার সৎবৃত্তি আমাকে দীর্ঘসময় এমন একা রাখতো না।’ জবাব দিল সোহেলী।
সোহেল বললো, ‘তুমি আমায় ক্ষমা কর। আর একটা অনুরোধ। আজ তোমাকে অসামান্য সুন্দর লাগছে। বাইরে বৃষ্টিও হচ্ছে।’ চোখে প্রচ্ছন্ন নিমন্ত্রণ।
হাসলো সোহেলী। হেসে বেডরুমের দিকে হাঁটা দিয়ে বললো, ‘ঘরে এসো। বাইরে আর যাচ্ছি না।’
এসইউ/জেআইএম