রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান : বিচিত্র সৌন্দর্যের অনুসন্ধান
কবিতার ঋতু, কবিদের ঋতু, আবেগের ঋতু বর্ষা। মেঘের দামামা বাজাতে বাজাতে বর্ষা আসে। পরনে তার মেঘের পাগড়ি। ঋতুর রাগ-রাগিণীর মধ্যে বসন্তের পর বর্ষা। বসন্তের জন্য আছে বসন্তবাহার আর বর্ষার জন্য মেঘ, মল্লার, দেশ এবং আরও বিস্তর প্রকৃতির প্রান্তর। রবীন্দ্র সাহিত্যজুড়ে বর্ষা আছে এক চির নতুন অবয়বে। একটু নমুনা দেখা যাক— ‘আপনি বসে বসে ভাবুন। ভরা পুকুর, আমবাগান, ভিজে কাক ও আষাঢ়ে গল্প মনে করুন। আর যদি গঙ্গার তীর মনে পড়ে, তবে সেই স্রোতের উপর মেঘের ছায়া, জলের উপর জলবিন্দুর নৃত্য, ওপারের বনের শিয়রে মেঘের উপর মেঘের ঘটা, মেঘের তলে অশ্বত্থগাছের মধ্যে শিবের দ্বাদশ মন্দির স্মরণ করুন। মনে করুন পিছল ঘাটে ভিজে ঘোমটায় বধূ জল তুলছে; বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে, পাঠশালা ও গয়লাবাড়ির সামনে দিয়ে সংকীর্ণ পথে ভিজতে ভিজতে জলের কলস নিয়ে তারা ঘরে ফিরে যাচ্ছে; খুঁটিতে বাঁধা গরু গোয়ালে যাবার জন্য হাম্বারবে চিৎকার করছে; আর মনে করুন, বিস্তীর্ণ মাঠে তরঙ্গায়িত শস্যের উপর পা ফেলে ফেলে বৃষ্টিধারা দূর থেকে কেমন ধীরে ধীরে চলে আসছে; প্রথমে মাঠের সীমান্তস্থিত মেঘের মতো আমবাগান, তার পরে এক একটি করে বাঁশঝাড়, এক একটি করে কুটির, এক একটি করে গ্রাম বর্ষার শুভ্র আঁচলের আড়ালে ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে আসছে, কুটিরের দুয়ারে বসে ছোটো ছোটো মেয়েরা হাততালি দিয়ে ডাকছে ‘আয় বৃষ্টি হেনে, ছাগল দেব মেনে’— অবশেষে বর্ষা আপনার জালের মধ্যে সমস্ত মাঠ, সমস্ত বন, সমস্ত গ্রাম ঘিরে ফেলেছে; কেবল অবিশ্রান্ত বৃষ্টি— বাঁশঝাড়ে, আমবাগানে, কুঁড়ে ঘরে, নদীর জলে, নৌকোর হালের নিকটে আসীন গুটিসুটি জড়োসড়ো কম্বলজোড়া মাঝির মাথায় অবিশ্রাম ঝরঝর বৃষ্টি পড়ছে।’ (বর্ষার চিঠি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
রবীন্দ্রসংগীতে এই বর্ষা ঋতুটা ধরা দিয়েছে এক স্নিগ্ধ শ্যামল সুন্দর রূপে। একমাত্র কালিদাসের ‘মেঘদূত’ ছাড়া বর্ষার কাব্যগাথা কোনো সাহিত্যে এমন রূপে বাধা পড়েনি। মেঘদূতে যেমন বর্ষার সমস্ত অন্তর্বেদনা নিত্যকালের ভাষায় লেখা হয়েছে তেমনি রবীন্দ্র সাহিত্যে, সংগীতে, বর্ষা এসেছে এক অনির্বচনীয় কবিত্বগাথা, মানবের হৃদয়ের অপরূপ ভাষায়।
বর্ষা নিয়ে বাঙালির ভালো অভিজ্ঞতার চেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাই বেশি। বাঁধভাঙা বর্ষা বিস্তর জনপদের মানুষকে করেছে ঘরছাড়া। গ্রামের কথা বাদ দিলেও এই ঢাকা নগরেও বর্ষার মোহন রূপের চেয়ে দুঃখ-দুর্দশা আর দুর্ভোগের চিত্রই চোখে পড়ে বেশি। একটু বৃষ্টি হলেই মাঠ-ঘাট বৃষ্টির পানিতে সয়লাব। কোথাও বেরোনোর এতটুকু অবসর মেলে না। রাস্তায় জমে যাওয়া পানিতে পথ হাঁটা তো দূরের কথা, গাড়ি ঘোড়াও অচল। তবু বর্ষায় অভ্যস্ত পরিচিত সংসার থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে মন বাইরের দিকে যেতে চায়। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী। উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে। নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে। রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম।’
আমাদের এখানে আলোচ্য বিষয় হবে- রবীন্দ্রসংগীতে বর্ষার গানের বহু বিচিত্র সৌন্দর্যের অনুসন্ধান। ঋতুভাগের ভিত্তিতে গীত বিতানে ১১৫টি বর্ষার গান রয়েছে।
‘আমরা সম্পন্ন গৃহস্থটি হইয়া আরামে সন্তোষে অর্ধনিমিত লোচনে যে গৃহটুকুর মধ্যে বাস করিতেছিলাম। কালিদাসের মেঘ ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ হঠাৎ আসিয়া আমাদিগকে ঘরছাড়া করিয়া দিল।’ কালিদাসের মেঘদূত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এ উক্তি তাঁর নিজের বেলায়ও প্রযোজ্য। বর্ষায় বাঙালির চির সংবেদনশীল মন রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান ছাড়া একেবারে রুক্ষ্ম শুষ্ক। গীত বিতানের বৃষ্টির সুবাসিত বর্ষার গান ছাড়া বর্ষা যেন কালিদাসের মেঘহীন মেঘদূত। মন এতটুকু চলতে চায় না; অথচ বৃষ্টি এলেই পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল মনটা ছুটে বেড়ায় দিগদিগন্তে। যেখানে চেনা নেই, জানা নেই; সেখানেও মন ছুটে চলে যায় মেঘে সওয়ারী হয়ে।
গীত বিতানের বর্ষার প্রথম গানে কবি বর্ষাকে আবাহন করেছেন শ্যামল সুন্দর বলে। তাপ শুষ্ক পৃথিবীকে সুধারসে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য। যেখানে বিরহী হৃদয় চাতক পাখির ধেয়ান নিয়ে চেয়ে আছে আকাশে। বিছিয়ে দিয়েছে তার ব্যথিত হৃদয়। তমাল কুঞ্জপথে সজল ছায়াতে। নয়নে করুণ রাগ-রাগিণী জাগিয়ে। বকুল ফুলের মালা গেঁথে নিয়ে আগন্তুক বসে আছে। কখন মিলনের বাঁশি বাজবে তার জন্য। গীত বিতানে কখনও বর্ষা আসে নব সৌরভে নব হরষে।
‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে
ঘন গৌরবে নব যৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা।
গুরু গর্জনে নীল অরণ্য শিহরে,
উতলা কলাপী কেকাকল রবে বিহরে—
নিখিল চিত্ত হরষা
ঘন গৌরবে আসিছে মত্ত বরষা।’
নতুন বর্ষা এসেছে আকাশজুড়ে। এসেছে ভুবন ভরসা। বাতাসে বন বীথিকা দুলছে। যেন শত যুগের কবিদলে মিলে আকাশে ধ্বনি তুলছে শতেক যুগের। তার জন্যই গীতি মুখরিত হয়েছে বনদল।
মেঘকে তুলনা করা হয়েছে প্রেয়সীর কাজল কালো চোখের সঙ্গে।
‘হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে
সেই সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে।’
করুণামাখা অধর মিনতির বেদনা এঁকে নীরবে চেয়ে থাকে বিদায় ক্ষণে। ঝরঝর বৃষ্টি ঝরে বিজলি আঘাত হানে বাতাস পাগল হয় পরাণ পুটে হৃদয় কোণে কার কথা যেন জেগে ওঠে।
‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীত যামিনী রে
কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।’
‘শাল পিয়াল তমাল বনে বাঁশি বাজছে। ঘন হয়ে মেঘ আসছে।
সখি বল, এ দুর্যোগে কোথা গেলে রাধাকে পাওয়া যাবে।’
আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমেছে। ফলে পৃথিবী আঁধারে ছেয়ে গেছে। এমন সময় আমায় কেন একলা ঘরের কোণে বসিয়ে রাখো। কাজের দিনে নানা কাজ থাকে। তখন আমি কাজের মাঝেই ডুবে থাকি। কিন্তু আজ আমি তোমারই আশ্বাসে বসে আছি।
‘তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা।’
‘দূরের পানে আঁখি মেলে চেয়ে থাকি পরান আমার কেঁদে বেড়ায়
বৃষ্টিভেজা মিষ্টি বাতাসে কখন আসবে তুমি।’
গানটিতে আকুল করা প্রেমিকের করুণ আর্তি ফুটে উঠেছে।
‘যেতে দাও যেতে দাও গেল যারা
তুমি যেয়ো না, তুমি যেয়ো না,
আমার বাদলের গান হয়নি সারা।’
কুটিরে কুটিরে দ্বার বন্ধ। নিভৃত রজনী অন্ধকারে ডুবে আছে ঘুমহীন চঞ্চল বাতাসে কেঁপে উঠছে। দীপ নিভেছে নিভুক। আঁধারেই তোমার পরশ রাখো। তোমার হাতের কাঁকন বেজে উঠুক আমার গানের তালের সাথে। যেমন- নদীর ছলো ছলো জলে ঝরো ঝরো ঝরো শ্রাবণধারা।
‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা
তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা।
তোমার মন্ত্রের গুণে পাষাণগলে, ফসল ফলে
মরুভূমি বয়ে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা।
মরো মরো পাতায় ঝর ঝর জলের রবে
ওরু ওরু মেঘের মাদল বাজে কি উৎসবে।
সবুজ সুধার ধারায় প্রাণ এনে দাও এ ধরায়
বামে রাখ ভয়ঙ্করী বন্যা।’
ঝড়কে আমরা ভয় পাই। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতে এই ঝড়কেই আবাহন করেছেন কবি অন্তপ্রাণে। কিন্তু কেন?—
‘ওরে ঝড় নেমে আয়
আয়রে আমার শুকনো পাতার ডালে
এই বরষায় নবশ্যামের আগমনের কালে।
.......
যা কিছু উদাসীন যা প্রাণহীন যা আনন্দ হারা
চরম রাতের অশ্রু ধারায় আজ হয়ে যাক সারা।
যাবার যা যাক সে চলে রুদ্র নাচের তালে
আসন আমায় পাততে হবে রিক্ত প্রাণের ঘরে।
নবীন বসন পড়তে হবে সিক্ত বুকের পরে।’
কোন কোন গানে বর্ষা আর বিরহী হৃদয় মিলেমিশে একাকার। উতল ধারা বৃষ্টি ঝরছে। সকল বেলা একা ঘরে। সজল বাতাসে বেগে বয়ে যায় তারই পরশ লেগে পাগল নদী জেগে ওঠে। আকাশ ঘিরে কাজল কালো মেঘে, তমাল বন আঁধার হয় তাতে। এমন দিনে তুমি কেমন বেশে এলে, আঁচল দিয়ে শুকাব জল পা মুছিয়ে দেব আকুল কেশে। অন্ধকার রাত ক্রমেই নিবিড় হয়ে আসবে। তখন প্রেমের বাতি জ্বেলে দেব। পরানখানি পেতে দেব। তারপরে চরণ রেখ। জীবন মরণ ভুলে গিয়ে তোমায় বরণ করে নেব। শরম লজ্জার ভয় না করে তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াব। যত বাধা আসে যাবে জ্বলে। সুখ-দুঃখ দেব দলে। ঝড়ের রাতে তোমার সাথে বের হবো অভয়ভরে। উতল ধারা বাদল ঝরে দুয়ার খুলে এলো জাগে সকল মনে। তোমার মুখ পানে চাইতে গিয়ে চোখ কেঁপে ওঠে শরমে। বর্ষার গানে মেঘদূতের মতো বৃষ্টিকে প্রাণ দেওয়া হয়েছে। বাদলকে বলা হয়েছে একতারা বাজানিয়া বাউল।
‘বাদল বাউল বাজায়রে একতারা—
সারাবেলা ধ’রে ঝরো ঝরো ঝরো ধারা।’
জামের বনে ধানের ক্ষেতে আপন তানে আপনি মেতে নেচে হল সারা।
জটাধারী বাউলের কেশ যেন কালো মেঘরাজি। পাতায় পাতায় টুপুরটুপুর মধুর নূপুর বাজে। ঘর ছাড়ানো আকুল সুরে পুবের গৃহহারা উদাস হাওয়া বেড়ায় ঘুরে।
‘এসো নীপ বনে ছায়াবীথি তলে
এসো কর স্নান নবধারা জলে।’
গানে এভাবেই বৃষ্টিকে আহ্বান করা হয়েছে। আকুল করে দাও ঘন কালো কেশপরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ কাজল নয়নে যুথী মালা গলে দিয়ে ছায়াবীথি তলে এসো। ক্ষণে ক্ষণে হাসির রেখা উঠুক সখী। তোমার অধর নয়ন উঠুক চমকি বর্ষার মেঘ মল্লার রাগে ঘন বরিষণে জল কল কলে ছায়াবীথি তলে এসো।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সংলগ্নতার কথা ক’জন অনুভূতিপ্রবণ লেখক বলতে পেরেছেন এমনভাবে।
‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরান সখা বন্ধু হে আমার’
বর্ষা এলে ময়ূর নাচে। কিন্তু মন আজ ময়ূরের মতো নেচে উঠছে। কেননা বর্ষা আজ জাগ্রত দ্বারে। কবি বলেন—
‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে
শত বরণের ভাব উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে।’
নির্জনে বকুল শাখায় আজকে দোলা দিয়ে যায়। ঝরকে ঝরকে বকুল ঝরছে আঁচল আকাশে আকুল হচ্ছে। বিচূর্ণ চুল ওড়ে এসে চোখ ঢেকে দিচ্ছে। চুল খসে পড়ছে খোঁপা থেকে।
ঝরে ঘন নবধারা নবপল্লবে কাঁপিয়ে কানন ঝিল্লির রবে তীর ছাপিয়ে নদী কল কল করে চলে এল পল্লীর কাছে। তাই হৃদয় আজ ময়ূরের মতো নেচে ওঠে।
বৃষ্টির গানে বর্ষার অপরূপ মাধুর্য সম্পর্কে বলেছেন—
‘আজ বরষায় রূপ হেরি মানবের মাঝে
চলেছে গরাজ চলেছে নিবিড় সাজে।
হৃদয়ে তাহার নাচিয়া উঠিছে ভীমা
ধাইতে ধাইতে লোপ করে সীমা,
কোন তাড়নায় মেঘের সহিত মেঘে
বক্ষে বক্ষে মিলিয়া বজ্র বাজে।’
মেঘের ঘর্ষণে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে কবি মানবীয় করে তুলে বলেছেন, বুকের সঙ্গে বুক মেলানো। কবি প্রশ্ন রেখেছেন- কোন কোন তাড়নায় এ মহামিলন।
সে যে বর্ষার বৃষ্টি তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বর্ষার সেই মোহন রূপ এখন অনেকটাই ম্লান। সেই বজ্রবিদ্যুৎ কোথায়? মেঘের দামামা কোথায়? কবি আফসোস করে বলেছেন— ‘ছেলেবেলায় বর্ষা যেমন দেখতেম, তেমন ঘনিয়ে বর্ষাও এখন হয় না। বর্ষার তেমন সমারোহ নেই যেন, বর্ষা এখন যেন ইকোনমিতে মন দিয়েছে— নমোনমো করে জল ছিটিয়ে চলে যায়। কেবল খানিকটা কাদা, খানিকটা ছাঁট, খানিকটা অসুবিধে মাত্র— একখানা ছেঁড়া ছাতা ও চীনে বাজারের জুতোয় বর্ষা কাটানো যায়— কিন্তু আগেকার মতো সে বজ্র বিদ্যুৎ বৃষ্টি বাতাসের মাতামাতি দেখি নি। আগেকার বর্ষায় একটা নৃত্য ও গান ছিল, একটা ছন্দ ও তাল ছিল— এখন যেন প্রকৃতির বর্ষার মধ্যেও বয়স প্রবেশ করেছে, হিসাব কিতাব ও ভাবনা ঢুকেছে, শ্লেষ্মা শঙ্কা ও সাবধানের প্রাদুর্ভাব হয়েছে।’ (বর্ষার চিঠি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
যায় দিন শ্রাবণ দিন। মন আঁধার করে আসে শঙ্কায়। শিলনের বৃথা প্রত্যাশায় মায়াবী এই সন্ধ্যায়। আসন্ন নির্জন রাতে আমার পথ চাওয়ার ব্যাকুলতা। ফিরে ক্ষ্যাপা হাওয়া গৃহছাড়া ব্যথিত হৃদয় বৃষ্টির মর্মর ছন্দে ভাষা খুঁজে বেড়ায়।
‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।’
এই চঞ্চল সজল পবন বেগে উদভ্রান্ত মেঘে, মন চায় হংস বলাকার মতো উড়ে বেড়াতে। বর্ষার মেঘমল্লারে সারাদিনমান ঝর্নার গান বেজে ওঠে। তাই মন আজ হারিয়ে যেতে চায় পথ ভুলে। হৃদয় জুড়াতে চায় কারে যেন চিরঋণে।
অথবা
‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে।’
বর্ষাকে বলা হয় নিষ্প্রয়োজনের ঋতু। কবির ভাষায়— ‘সকল বয়সেরই একটা কাল আছে। যৌবনের যেমন বসন্ত, বার্ধক্যের যেমন শরৎ, বাল্যকালের তেমনি বর্ষা। ছেলেবেলায় আমরা যেমন গৃহ ভালোবাসি এমন আর কোনো কালেই নয়। বর্ষাকাল ঘরে থাকবার কাল, কল্পনা করবার কাল, গল্প শোনবার কাল, ভাইবোনে মিলে খেলা করবার কাল।’ (বর্ষার চিঠি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
গীতবিতানের বর্ষার গানগুলো প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একটা নিবিড় সম্পর্ক রচনা করে দেয়। বর্ষাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কাব্যগাথা দ্বিতীয়টি আর নেই। তাই বর্ষাকে স্বাগত জানাতেই হয়। হে নব ঘনশ্যাম হে শ্যামল সুন্দর। আমরা তোমাকে অভিবাদন করি। এসো এসো জগতের যত অকর্মণ্য, এসো এসো ভাবের ভাবুক, রসের রসিক— আষাঢ়ের মৃদঙ্গ ওই বেজে উঠল, এসো সমস্ত খেপার দল, তোমাদের নাচের ডাক পড়েছে।
বিশ্বের চিরবিরহ বেদনার অশ্রু-উৎস আজ খুলে গেল, আজ তা আর বাঁধ মানলো না। এসো গো অভিসারিকা, কাজের সংসারে কপাট পড়েছে, হাটের পথে লোক নাই। চকিত বিদ্যুতের আলোকে আজ যাত্রায় বের হবে। জাতীয় পুষ্প সুগন্ধি বনান্ত হতে সজল বাতাসে আহ্বান আসলো কোন ছায়া বিতানে বসে আছে বহু যুগের চির জাগ্রত প্রতীক্ষা।
এসইউ/আরআইপি