ঘাম থেকে পারফিউম
অয়নের কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই। এক সময় হয়তো ছিল কিন্তু তারা সবাই কেটে পড়েছে। কিংবা বলা যায় অয়ন নিজেই তাদের কাছ থেকে কেটে পড়েছে। ছুটির পর রবীন্দ্র সরোবরে একাই সন্ধ্যার শেষে অনেকক্ষণ বসে থাকে অয়ন। তারপর বাসায় গিয়ে গল্প-উপন্যাস পড়ে, টেলিভিশন দেখে। পরের দিন অফিসের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখে, মানে কাপড় লন্ড্রি, জুতা পালিশ, ময়লা কাপড় থাকলে সেসব ধুয়ে দেওয়া। সকালের নাস্তার জন্য কী কী খাবে সেসব ঠিক করে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে চন্দ্রিমা উদ্যানে কয়েক পাক ঘুরে এসে গোসল করে নেয়। এরপর অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। এটাই হচ্ছে ওর নিয়মিত রুটিন।
ইকবাল রোডে দুই রুমের বাসাটাই অয়নের একটা জগত। বাবা নেই। মা থাকেন সান্তাহারে। মাকে কয়েকবার নিজের কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু মা আসেননি। তিনি স্বামীর ভিটে ছাড়বেন না। অয়নের মায়ের পূর্বপুরুষ ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরের। সেখানে তাদের আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। বোন, বোন জামাই রয়েছে। অয়নের বড় খালু, ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট। মাঝেমাঝে তারাও আসতে পারেন কিন্তু কেউ আসেন না। মা চাইলে সেখানেও ঘুরতে যেতে পারেন। কিন্তু তিনি সান্তাহারের বাইরে কোথাও যেতে চান না। এমনকি ঢাকাতে অয়নের কাছেও আসতে চান না। একবার ঢাকায় এসে তিনদিন ছিলেন; সেই তিনদিন যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তার।
অয়নের বন্ধু-বান্ধব না থাকার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে অয়ন বেশ ভালোই ছিল। ভালো বলতে ছাত্র হিসেবে ভালো ছিল। এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সে পড়তো। থার্ড ইয়ার পর্যন্ত সিজিপি যথেষ্ট ভালো ছিল। কিন্তু ফোর্থ ইয়ারে এসে বেশ ধাক্কা খায়। পরপর দুই সেমিস্টার ধাক্কা খেয়ে সিজিপিএ ফল করলো। অয়ন তখন অনার্স পাস নিয়েই বেকায়দায় পড়ে যায়। ফাইনালি সিজিপিএ অ্যারাউন্ড থ্রি নিয়ে পাস করে যায় কোনোমতো। অয়নের আকস্মিক এই পরিবর্তন টিচাররাও মেনে নিতে পারছিলেন না। পারার কথাও না। অয়নের অ্যাসাইনমেন্ট পেপার কপি পেস্ট করে অন্যরা চালিয়ে নিত। প্রেজেন্টেশনে অয়ন নিজ গ্রুপে সামনে থাকতো। সবাই ঠেলেই পাঠাতো। এছাড়াও ডিপার্টমেন্টের যেকোন বিষয়েই সবাই অয়নের গ্রুপেই থাকতে চাইতো। সেই অয়নের কাছ থেকে ফোর্থ ইয়ারে সব বন্ধুরা দূরে সরে যেতে থাকলো।
অয়ন যখন ফার্স্ট ইয়ারে অ্যাডমিশন নেয়; তখন সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হবে। সেভাবেই অবশ্য তার পড়াশোনাও এগিয়ে যাচ্ছিল। সেকেন্ড ইয়ারের মাঝামাঝির দিকে ডিপার্টমেন্টের এক ব্যাচ জুনিয়র এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। নাম মিথিলা। প্রথমে তারা বড়ভাই-ডিপার্টমেন্ট জুনিয়র ছিল। নোট নেওয়া সম্পর্ক ছিল। তারপরে হয়ে গেল বন্ধুত্ব। ধীরে ধীরে অয়নের সাথে মিথিলার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। বন্ধুরা বলতো বাহ! বেশ ভালো মানিয়েছে। মিথিলাদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালোই ছিল। বাবা তেমন কিছু করতেন না। এলিফ্যান্ট রোডে কয়েকটা দোকান রয়েছে আর পরীবাগে পাঁচতলা একটা বাড়ি। নিজেরা চারতলার দুইটা ইউনিট নিয়ে থাকতো। বাকি ফ্ল্যাটের ভাড়া, এলিফ্যান্ট রোডের দোকান ভাড়া থেকে যা আসতো- তা প্রচুর। প্রতিমাসে প্রচুর টাকা পয়সা জমেও যেত। মিথিলাও দু’হাতে টাকা খরচ করতো।
সেই মিথিলাই যখন অয়নকে প্রত্যাখ্যান করলো; তখন কেউই ধরতে পারলো না বিষয়টা আসলে কী? মিথিলাকে খারাপ মেয়ে ভাবার সুযোগ নেই। অয়নের বন্ধুরা টানা সাতদিন মিথিলাকে পর্যবেক্ষণ করলো। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বলা যায় পর্যায়ক্রমে বন্ধুরা মিথিলাকে লক্ষ্য করলো। নাহ! মিথিলা নতুন কোনো ছেলের সাথে যুক্ত হয়নি। বরঞ্চ ক্লাসের যে দুয়েকজন বন্ধুর সাথে মিশতো এই সাতদিন তাদের সাথেও মিথিলা কোথাও যায়নি। কোথাও আড্ডা দেয়নি। এরমধ্যে মিথিলা দুইদিন নীলক্ষেত গিয়েছিল, একদিন বসুন্ধরা সিটি আর কাঁটাবনে গিয়েছিল। মিথিলার সাথে ঊর্মি আর সোহেলি নামের দু’বান্ধবী সবখানে গিয়েছিল। অয়নের বন্ধুরা দুই বান্ধবীকেও বিশেষ শর্তে রিমান্ডে নিয়েছিল। রিমান্ডে তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া গেল না।
যখন মিথিলা আর অয়নের বিষয়টি নিয়ে সবাই হতাশ; তখন রিফাত নামের তাদের এক সার্কেলের বন্ধু নতুন একটা ব্যাপার আবিষ্কার করলো। কী ব্যাপার? ব্যাপার হলো- কোনো কারণ ছাড়াই মিথিলা অয়নকে ছেড়ে যেতে পারে না। অবশ্যই কারণ আছে। কারণ কী? মিথিলা অবশ্যই অন্য কারো প্রেমে পড়েছে। কিন্তু সবাই তো এটাই ধারণা করেছিল। আদতে তেমন কিছুই পাওয়া গেল না তো। রিফাত সবাইকে ডেকে বলল, ‘মিথিলা নিশ্চয়ই এমন কারো সাথে ইনভলভ হয়েছে যে কাছেপিঠে থাকে না। অন্য কোনো শহরে থাকে কিংবা দেশের বাইরে থাকে।’ রিফাতের কথা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তাদের ক্লাসেই নিশা প্রেম করে শাওন নামের এক ছেলের সাথে। শাওন চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তাদের দুই তিন মাস পর দেখা হয়। আরেক বান্ধবী শাইনা প্রেম করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ইয়াং টিচারের সাথে, শাইনার পড়াশোনা শেষ হলেই বিয়ের আয়োজন।
সবাই মোটামুটি একমত হলো মিথিলা মোবাইলে প্রেম করে। অর্থাৎ সে মোবাইলেই তার রিলেশন কন্টিনিউ করছে।
অয়ন তাদের সাথে থাকে। সে কিছু বলে না। বেচারার মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে। সবাই যা বলে সে শুধু চুপচাপ শুনে যায়। অয়ন কখনোই প্রেমে পড়েনি। ইউনিভার্সিটিতে এমন একজনের প্রেমে পড়লো যে কি না তাকে না জানিয়েই চলে গেল। এই অজানা কারণই অয়নকে পুড়িয়ে মারতে লাগলো। শাওনের বন্ধুরা বহু কায়দা করে বিভিন্ন লিংক তৈরি করে মোবাইল কম্পানির কাস্টমার কেয়ার থেকে মিথিলার চালু মোবাইল নম্বরের কল তালিকা তুলে নিয়ে এলো। কল তালিকায় বেশকিছু নম্বর পাওয়া গেল। এরমধ্যে সন্দেহজনক চারটি নম্বর আইডেন্টিফাই করা হলো। বাকি নম্বরগুলোর মধ্যে রয়েছে মিথিলার বাবা, মা, ছোটবোনের নম্বর যেগুলো অয়নের মোবাইলে সেভ করা আছে।
রাতে হলে শাওনের রুমে বসেই শুরু হলো অভিযান। প্রথম সন্দেহজনক নম্বরটিতে ফোন করে যাকে পাওয়া গেল তার নাম শওকত। শওকতের গ্রামের বাড়ি গাইবান্দার সাদুল্লাপুরে। থাকে কাঠাল বাগানে। পেশা রিকশা চালানো। তার মানে ভার্সিটিতে একই রিকশায় মিথিলা আসা-যাওয়া করে। দ্বিতীয় নম্বরটি হলো হুমায়ুন নামের এক ভদ্রলোকের। তিনি পরীবাগেই থাকেন। গ্রামের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনে। পেশা লন্ড্রি ব্যবসা। বাকি দুইটা নম্বর হলো জাকির হোসেন নামের এক ভদ্রলোকের। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনি মিথিলার মামা। গ্রামে থাকেন। আরেকটা নম্বর মিথিলাদের বাড়ির দারোয়ান আজমের। আজমের সাথে অয়নের কখনো কথা হয়নি। কিন্তু আজমকে সে চেনে। ফলাফল অভিযান ব্যর্থ।
তবে এর শেষটা দেখে ছাড়তে চায় অয়নের বন্ধুরা। কিভাবে শেষ দেখে ছাড়বে? একটাই উপায়, সরাসরি মিথিলার সাথেই কথা বলতে হবে। মিথিলাকে জানাতে হবে কেন সে অয়নের সাথে ব্রেক আপ করেছে। সবাই একমত হয়। মিথিলার সাথে সরাসরি কথা বলবে। অয়ন কিছুই বলে না, যা করার বন্ধুরাই করে। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার বন্ধুরাই নেয়। এরই মাঝে একদিন মিথিলাকে সবাই ধরলো। মিথিলা সেদিন লাইব্রেরি থেকে একটা বই নিয়ে বের হচ্ছিল। খবর আগেই পেয়ে গিয়েছিল অয়নের বন্ধুরা। মিথিলাকে নিয়ে সবাই টিএসসিতে আসে। ক্যাফেটেরিয়ার সামনে বসে মিথিলার মুখোমুখি হয় সবাই। মিথিলার দুই বান্ধবীকেও ডেকে আনা হয়েছে। পাপ্পু কথা শুরু করে।
মিথিলা বিষয়টা কী?
কোন বিষয়?
তুমি হুট করে অয়নকে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে কেন?
এমনিই। মনে হলো, ওর সাথে অ্যাডজাস্ট হচ্ছে না।
মিরাজ নামের আরেক বন্ধু মিথিলার কথার পাল্টা প্রশ্ন তৈরি করে। অয়ন সেখানে ছিল না। অয়ন মিথিলার সামনে আসতে চায় না। যখন লাইব্রেরির সামনে মিথিলাকে ওর বন্ধুরা পাকড়াও করে তখনই অয়ন সরে যায়। মিরাজ মিথিলাকে বলে-
আমরা সেটাই জানতে চাচ্ছি, কেন অ্যাডজাস্ট হচ্ছে না? স্পেসিফিক কারণগুলো আমাদের জানা দরকার।
জেনে কী করবেন?
জেনে কিছুই করবো না। তোমাকেও আমরা জোর করবো না যে, তুমি অয়নের সাথে থাকো। জাস্ট কারণগুলো বলো। অন্তত আমরা একটা জায়গায় নিশ্চিত থাকি যে, কোনো একটা কারণেই তুমি অয়নকে ছেড়ে গেছো।
এক টানা বলে গেল রিফাত। রিফাতের সাথে একমত হয় শাইনা। শাইনাও জোর করে মিথিলাকে-
সম্পর্ক না রাখিস, সমস্যা নেই। কারণগুলো বলে দে...
মিথিলা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে-
আসলে কারণগুলো নেই।
নেই মানে?
মিথিলা কোনো কথা বলে না। পাপ্পু ফের বলে-
নেই মানে কী?
মিথিলা চুপ। শাইনা বলে-
এভাবে চুপ থাকলে তো হবে না।
মিথিলা কোনো কথা বলে না। কেউ আর প্রশ্নও খুঁজে পায় না। কিনারাও করতে পারছে না বিষয়টা আসলে কী!
মিথিলা প্রায় পনের মিনিট পরে কথা বলে-
আসলে কারণগুলো নেই। এটা প্লুরাল নাম্বার নয়।
আচ্ছা সিঙ্গুলার নম্বর, বুঝলাম। সেই একটি কারণই বলো। ভালো লাগার জন্য একটি কারণই যথেষ্ট। ছেড়ে যাওয়ার জন্যও একটি কারণই যথেষ্ট।
রিফাত বলে। তার সাথে পাপ্পু যোগ করে-
আমরা অয়নের ভুল খুঁজে পাইনি। তার মাঝে কোনো পরিবর্তন, কোনো ভুল খুঁজে পাইনি যে, অয়নকে তুমি ছেড়ে চলে যাবে?
পাপ্পু ভাই, আপনারা কোনো কারণ খুঁজে পাবেন না। অয়ন ভালো ছেলে ওর কোনো ভুল নেই। সমস্যা হয়তো আমারই।
মিথিলা যে কারণ দেখালো তা কারো মাথাতেই ঢুকছিল না। এটা কেমন কারণ হতে পারে? এ কারণে কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে পারে? অবিশ্বাস্য! অয়নের শরীরে ঘামের গন্ধ। এই গন্ধ মিথিলা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছিল না। অনেকদিন চেষ্টা করেছিল। সে অয়নকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। অয়ন বিষয়টা গায়েই মাখেনি। নিয়মিত পারফিউম বা বডি স্প্রে ইউজ করতে বলতো। সেটাও সে ভুলে যেতো। ফাইনালি মিথিলা চেষ্টা করেছে বিষয়টাকে মানিয়ে নিতে। তবে বাতিকগ্রস্ত মিথিলার পক্ষে এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। যে জিনিসটা মিথিলা সহ্য করতে পারে না, আজীবন সেই জিনিসটার সাথেই থাকতে হবে। অসম্ভব। সেদিন মিথিলাকে আর কেউ কোনো কথা বলেনি। অয়নের কানে যাতে কথাটা না যায় সবাইকে তা বলেও দেওয়া হয়।
কিন্তু কিভাবে কিভাবে অয়নের কানে ঠিকই এ কথা পৌঁছে যায়। অয়ন শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি ঠিকই কিন্তু এরপর থেকেই বিভিন্ন স্কিন স্পেশালিস্টদের কাছে ধর্ণা দেওয়া শুরু করলো। একটা সময় এটা নিয়ে এতোই আপসেট হয়ে যায় যে, অয়ন মানসিক রোগীর মতো হয়ে যায়। সবার কাছ থেকে নিজে নিজেই ডিটাচড হতে শুরু করে। পড়াশোনা লাটে উঠলো। মাঝে মাঝে ভার্সিটিতে যাওয়া আসা করতো ঠিকই কিন্তু ক্লাস টেস্ট মিডটার্ম সব কিছুতেই খারাপ করতে শুরু করলো। সবচেয়ে বড় কথা সে কারো ধারেকাছে ভিড়তো না। কোনো মানুষের শরীরে ঘামের গন্ধ হয়। বিকট হতে পারে। অয়নেরও তাই হতো। কিন্তু ওর বন্ধুরা হয়তো অতটা সেন্সেটিভ না এজন্যই বোধোয় কেউ টের পায়নি। আর টের পেলেও বা কি? ছেলেদের নাকে এসব কিছু না।
অনার্সের পর দীর্ঘদিন অয়ন মানসিক অবসাদে ভুগেছিল। এই সময় বলা যায় যে, পৃথিবীর কাছ থেকে দূরে ছিল। সারাদিন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে মেসে ফিরতো। তখন হল ছেড়ে দিয়েছিল। সবাই যখন চাকরির পরীক্ষার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত অয়ন তখন বিভিন্ন স্কিন স্পেশালিস্টদের ঠিকানা জোগাড়ে ব্যস্ত। প্রায় বছরখানেক পরে যখন হুঁশ ফিরলো, অয়ন তখন কিছুটা বুঝতে পারলো তার একটা চাকরি প্রয়োজন। ফের পড়াশোনা শুরু করে। শেষমেষ একটা চাকরি জোগাড় করে সে। প্রাইভেট চাকরি হলেও অয়নের এখন ভালো অবস্থা। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করে নেবে ভাবছে।
আজ রবীন্দ্র সরোবরে অনেকক্ষণ বসে থাকবে অয়ন। প্রায় বছরখানেক আগে তাদের অফিসে মিলি নামে একটা মেয়ে জয়েন করেছে। অন্তত অয়নের চেয়ে চার বছরের ছোট হবে মিলি। মিলি-প্রায়ই তার ডেস্কে এসে কথা বলে। অবশ্য অধিকাংশই কাজের কথা। অফিসে অয়ন কথা কম বলে। পারতপক্ষে কারো কাছে তেমন ভেড়ে না। অয়নের মনের ভেতর সবসময় একটা ভয় কাজ করে। এই ফোবিয়া তাকে তাড়া করে বেড়াতো। এই বুঝি কেউ তার শরীর থেকে ঘামের বন্ধ টের পেয়ে গেল। এতোদিনে তার শরীরে ঘামের গন্ধ আছে কি না কে জানে। অফিসে তার ড্রয়ারেই পারফিউমের বোতল রাখে অয়ন। কেউ কোনো গিফট করতে চাইলে সে না না করবে। একান্তই কেউ যদি জোর করে তাহলে সে পারফিউম গিফট করতে বলে। মিলিকে নিয়েও তার ভয়। এই মেয়ে কাজ-অকাজে তার কাছে ভেড়ে। যদি সে ঘামের গন্ধ পেয়ে যায়। অফিসে এয়ারকন্ডিশনের ভেতর ঘাম উৎকট গন্ধ ছড়ায়।
মিলি মাঝেমাঝে অফিস শেষে অয়নের সঙ্গে একসাথে বাসে আসার চেষ্টা করে। অফিসের গাড়ি আছে। তারপরেও সে আসার চেষ্টা করে। অয়ন অবশ্য সে সুযোগ দেয় নি। বাইরে বেরিয়ে বড়জোর দুজনে মিলে এক কাপ চা খেয়েছে। এর বেশি কিছু না। আজও মিলি অয়নের সাথে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে পাশ কাটিয়ে অয়ন একটা সিটিং সার্ভিস বাসে উঠে পড়ে। মিলির বাসা তেজকুনিপাড়া। পারিবারিক অবস্থাও ভালো। কিন্তু অয়ন যখন ভাবছিল মিলির উদ্দেশ্য কি ঠিক তারপরই পরিষ্কার হয়ে গেল। অয়নের ধারণা এই জীবনে অয়নের প্রেমে কেউ পড়বে না। আর প্রতারণা করে সে কাউকে বিয়েও করবে না। বিয়ের পরে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে সেটা হবে আরেক যন্ত্রণার নাম। কাল শুক্রবার অফিস নেই। মিলির সাথে দেখা করে তাকে খুলে বলতে হবে, মিলি আজ টেক্সট পাঠিয়েছে। সে বিয়ের সিদ্ধান্তে যেতে চায়। পারিবারিকভাবে একটা চাপ আছে। তাই সোজাসাপ্টা অয়নকে পছন্দের কথা জানিয়ে টেক্সট করেছে। হয়তো মিলি আজ তার সাথে আসতে চেয়েছিল এ কারণেই। টেক্সট না করে যাতে মুখে বলা যায়। কিন্তু সে সুযোগ তো সে দেবে না।
রবীন্দ্র সরোবরে প্রায় ঘণ্টাখানেক থাকার পর বিরক্তি চলে এলো। সে মিলিকে টেক্সট করলো কাল চন্দ্রিমা উদ্যানে দেখা করতে পারবে না। মিলি উত্তর দিলো শুক্রবার চন্দ্রিমা উদ্যানে ভিড় থাকে। তারচেয়ে তারা ধানমন্ডির ক্যাফে অক্সিজেনে বসতে পারে। অয়ন সম্মতি জানিয়ে ফের টেক্সট করে। ফোনে আলাপ হয় না। অয়ন বাসায় ফিরে বিছানায় গা ছেড়ে দেয়। মিলি মেয়েটা সুশ্রী। যেকোন ছেলে তাকে পেলে আনায়াসেই খুশি হবে। সে চাইলেও মিলিকে পাবে। কিন্তু সেটা প্রতারণা হয়ে যাবে। শরীরে ঘামের গন্ধ। এটা একটা ভয়ংকর অসুখ। মিলির সাথে আসলে প্রতারণা করতে পারে না। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়ায়। প্রায় এগারোটা বাজে।
ঢাকা যেন আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। আগে ঢাকা সারারাত জেগে থাকতো। একবার ইলেক্ট্রিসিটি বাঁচাতে রাত ৮টায় সমস্ত দোকান পাট বন্ধ রাখার ঘোষণা দিল তারপর থেকেই ঢাকা যেন ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসলো। ঢাকায় এখন বুঝি দ্রুত রাত হয়ে যায়। অয়নের বারান্দার সামনে বেশ কয়েকটা নিচু বাড়ি। বাতাস আসতে পারে সহজেই। কেননা নিচু কয়েকটা বাড়ির পরেই খেলার মাঠ। খেলার মাঠের পাশে রয়েছে একটা বট গাছ। গ্রীষ্মকালে কাঠফাঁটা রোদে অয়ন মাঝেমাঝে বটগাছের তলে গিয়ে বসে। অয়নের মন বেশ ফুরফুরে একটা ভাব কাজ করে। মিলির বিষয়টা কাল মিটে যাবে। মেয়েটা হয়তো তাকে পছন্দ করতো। একটা ভুল পছন্দ নিয়ে এতোদিন বসে ছিল, কাল সেটা কেটে যাবে। বেশ রাত করে ঘুমালো অয়ন। ড্যান ব্রাউনের একটা বই পড়লো। শেষ করতে করতে রাত সাড়ে ৩টা; ঘুমাতে ঘুমাতে চারটা।
মিলি অয়নের সামনে বসে আছে। সন্ধ্যার পরপরই মিলি চলে এসেছে। মিলিদের পারিবারিক একটা গাড়ি আছে। সেই গাড়ি তাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। হালকা গোলাপি রঙের একটা জামা পরেছে মিলি। মিলির হাইট বেশ ভালো। অয়নের ৫ ফিট ১১ ইঞ্চি, মিলির অন্তত ৫ ফিট সাড়ে ৩ তো হবেই। ঠোঁটে হালকা লিপিস্টিক দিয়েছে মিলি। অয়ন কথা বলতে শুরু করে।
মিলি, তুমি আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানো না।
জানি।
অয়ন স্থির হয়ে মিলির চোখের দিকে তাকায়। স্থির চোখ। তার পক্ষে কিছুই জানা সম্ভব না। খুব বেশি হলে জানতে পারবে তার পারিবারিক অবস্থা, পড়াশোনা। অবশ্য বিয়ের জন্য পারিবারিক অবস্থা জানাটাই গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরে তেমন কিছু না জানলেও চলে। অয়ন কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে-
কি জানো?
সব।
সব বলতে পারবে?
হুম। এই যে ভার্সিটি লাইফে আপনার একজন প্রেমিকা ছিল যার নাম মিথিলা। আমার নামের সাথে মিল রয়েছে। মিথিলা আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি সিডনিতে থাকেন।
মিলির কথাতে সত্যি চমকে উঠতে হয়। অয়ন অবাক হয়ে চোখ সরু করে।
আর?
আর আপনাকে মিথিলা আপুর ছেড়ে যাওয়ার ছোট্ট একটা বিষয়। যেটার কারণে আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তারপর ফের কামব্যাক।
অয়নের বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে যায়। এই মেয়ে তো বেশ জেনেশুনেই অয়নের দিকে এগিয়েছে। কিন্তু অয়ন বুঝতে পারছে না, সব জেনেশুনেও কেউ বিষ খেতে চায় কিভাবে? ডিনারের অর্ডার করেছে অয়ন। তার আগে দুইটা কোক দিয়ে যেতে বলেছে। বেয়ারা কোক রেখে যায়। অয়ন ঠোঁটে লাগিয়ে চুমুক দেয়। মিলিও মুখের কাছে কোকের বোতলটা টেনে নেয়। একটা চুমুক দিয়ে অয়ন বলে-
সব জেনেশুনেও এগোতে চাও?
আমাকে একটা পারমিশন দেওয়া যাবে?
কী?
আমি কি আপনাকে ‘তুমি’ করে বলতে পারি?
অয়ন হেসে ফেলে। মিলি টেবিলের ওপর রাখা একটা হাত দিয়ে অয়নের ডান হাত স্পর্শ করে। অয়নের বুকের রক্ত যেন ছলকে ওঠে। মিলি খুব আস্তে করে বলে-
আমি তোমার সাথে সারা জীবন থাকতে চাই, সারা জীবন অয়ন। তোমার শরীরের সাথে পারফিউম মিশে গিয়ে অদ্ভুত এক মাদকতা তৈরি করে। যেটার কারণেই অফিসে আমি তোমার ডেস্কের কাছে মাঝেমাঝে এগিয়ে যেতাম। সে এক অদ্ভুত মাদকতা। তুমি বুঝবে না অয়ন।
অয়ন মিলির এগিয়ে রাখা হাতের আঙুল স্পর্শ করে। মিলির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ধীরে ধীরে প্রসারিত করে। যেন দীর্ঘদিনের জমে থাকা মেঘ এই মুহূর্তে কেটে গেল। আয়ন বুঝতে পারে ধ্রুব বলতে কিচ্ছু নেই। সব আপেক্ষিক। এই ধ্রুব শব্দটা নিজেও আপেক্ষিক।
এসইউ/আরআইপি