অপেক্ষা
‘কি রে? যাবি না? ঠায় দাঁড়িয়ে আছিস যে?’ স্বর্ণা তাড়া দিলো। বিরক্তির ঝাঁঝে জিজ্ঞেস করল স্বর্ণা।
আচমকা প্রশ্নবাণে ঘোর কেটে গেল নীলার। বাইরে মিশকালো মেঘের ঘনঘটা, বর্ষার প্রথম বারিধারার অশনিসংকেত। চারিদিকে কেমন যেন গুমোট আবহাওয়া। একি কালবৈশাখীর আগমনী বার্তা, না গ্রীষ্মের গনগনে রোদের সঙ্গে আসন্ন বর্ষার বোঝাপড়া, ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। এ সময় বের হওয়াটা ঠিক মনোপুত হচ্ছিলো না নীলার। কিন্তু সে যে নিরুপায়! অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওনা হয়ে আছে তার। অনেকদিন প্রতীক্ষার পর আজ সে এক জটিল রহস্যের খোলাসা করতে যাচ্ছে। আজ কোন কিছুই তাকে বাধাগ্রস্ত করতে অক্ষম। আজ সে অদম্য, দুর্নিবার।
‘তুই যেতে চাস আমার সাথে? আমার একা যাওয়াটা ভালো না?’ ঠিক কী কারণে স্বর্ণাকে সঙ্গে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল না তার। স্বর্ণা সবকিছু জানে। তাও কোথাও যেন বাঁধছিল নীলার। এত গুরুত্বপূর্ণ দিনটা সে কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাইছিল না। এর মহিমা শুধু সে-ই উপলব্ধি করতে পারে। আর কেউ না। এমনকি তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিও নয়।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল স্বর্ণা, ‘তুই একা যাবি? এই দুর্যোগের মধ্যে? উদ্বিগ্ন স্বরে বলল সে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে মায়া হল নীলার। মেয়েটা এত ভিতু হল কী করে, কে জানে? মেয়েটা কেন যে এত ভিতু। খুব বেশি হলে জলাবদ্ধ রাস্তায় তাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হতে পারে যানবাহনের জন্য। হয়তো সে বেশ খানিকটা ভিজে যাবে। হয়তো বাদলা হাওয়ার শক্তিশালী তোড়ে হাত থেকে ছিটকে পড়ে, মাটিতে লুটোপুটি খাবে তার ছাতাখানা। এরচেয়ে বেশি আর কী হতে পারে?
অনেক কিছু নীলা, তার অন্তর্যামী বলে উঠল।
নীলার দুঃসাহস পরিমাপ করার মত নয়। এমনকি সে নিজেও মাঝেমাঝে হতবাক হয়ে যায়। একজন যুবতী মেয়ে হয়েও বিধিনিষেধ, বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে সামান্য কিছু উপার্জনের আশায়, গৃহশিক্ষিকার রূপে অবতীর্ণ হতে হয়েছে তাকে। নিত্যদিন হোস্টেল সুপারের হিমশীতল দৃষ্টি সহ্য করে রাত-বিরেতে হোস্টেলে ফিরতে তার বিন্দুমাত্র ভয় কিংবা উৎকণ্ঠা হত না। দুঃসাহসী ও সচেতন বলেই প্রতারণার শিকার হতে হয়নি তাকে কখনই। নিজের অধিকার, মর্যাদা সম্পর্কে সে সর্বদা সোচ্চার। কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েও সে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার পেয়েছে। ছিনতাইকারীদের কুপোকাত করতে পেরে সেদিন গর্ব হয়েছিল নারীত্বের উপর। সহপাঠীরা সেদিন থেকে তার গায়ে ‘সুপার-ওম্যান’ অর্থাৎ ‘আশ্চর্য-মানবী’ তকমা লাগিয়ে দেয় নির্দ্বিধায়।
নীলার মত মহীরুহকে উপড়ে ফেলবে কোন কালবোশেখীর সাধ্য?
‘আজ আমায় একলা যেতে হবে রে।’ অনুনয় করল নীলা। সে কখনো কারো সাহায্য আশা করে না। তার নিরাপত্তার জন্য কারো উপর নির্ভর করেনি সে কোনদিনই। এই ধরণীতে তার আপন কেউ নেই, সে এতিম বলেই এই সত্যের মর্ম হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সারাজীবন।
কিন্তু আজ সে স্থিতির খোঁজে যাচ্ছে। অনেক তো হলো ভেসে বেড়ানো। এবার সে ঘরে ফিরতে চায়। নিশ্চয়তা, সচ্ছলতা, প্রশান্তির কামনা করে সে এতোগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছে। লড়াই করেছে পরিস্থিতির সাথে, দারিদ্র্যের বিপক্ষে। নির্জন দ্বীপে জীবনযাপন হাঁপিয়ে তুলেছে তাকে। এতোকাল যেই নৌকার আশায় দিন গুজরান করেছে, অবশেষে এসেছে সেই নৌকার মাঝি। সে কি নিয়ে যাবে নীলাকে বহুদূর কোন এক স্বর্গরাজ্যে? যার কল্পনা সে স্বপ্নেও করেনি? না কি অধরা রয়ে যাবে সোনার হরিণ? মরীচিকার মত মিলিয়ে যাবে হাত বাড়াতেই?
স্বর্ণা চলে যাওয়ার আগে পইপই করে বলে গেল, ‘হোস্টেলে পৌঁছে একটা টেলিফোন করে দিস।’ স্বর্ণাকে আশ্বস্ত করে বাড়ি পাঠাতে কিছুক্ষণ বিলম্ব হল।
গাঢ় নীল রঙের পাটভাঙা শাড়িটা পরে সে দেয়ালে টাঙানো আয়নাটার সামনে দাঁড়ালো। স্বচ্ছ কাঁচটা কেমন যেন ঘোলাটে লাগছিলো। সময় পেলে ভালো করে ঘঁষামাজা করতে হবে। নতুন কেনা টিপের পাতাটি থেকে শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে একটা টিপ বেছে নিল। খুব মনোযোগ দিয়ে আলতো হাতে লাগিয়ে নিল ললাটে। টিকালো নাক, মসৃণ গাল, উঁচু চোয়ালের নীলাকে দেখে স্বয়ং চন্দ্রনাথের তপস্যা ভেঙে যাবে যেন। জীবনসংগ্রামের নিষ্ঠুরতা আজও হরণ করতে পারেনি তার রূপের আলোকচ্ছটা।
ঘরের কোনে রাখা ছোট্ট আলমারির দেরাজ খুলে আলগোছে বের করল উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কারুকার্য করা মেহগনি কাঠের বাক্সটি। যত্নের সঙ্গে বের করল লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা রাশি রাশি নীল কাগজের একটি বাণ্ডেল। সন্তর্পণে ঘড়ি দেখল নীলা। তার হাতে ঠিক এক ঘণ্টা সময় আছে এখনও। বিছানায় বসে লাল ফিতাটা সাবধানে খুলে নিল। পরিপাটি করে গোছানো বাণ্ডেল থেকে বের করে নিল প্রথম চিরকুট। নিবিষ্ট মনে পড়তে লাগলো। ‘নীলা,
তুমি আমাকে চিনতে পারবে না। তুমি বলে সম্বোধন করছি বলে রাগ করলে না তো? তুমি বললে খুব দূরের মানুষকেও আপন মনে হয়, সে জন্য বলছি। আমি তোমাকে কত ভালো করে চিনি, আমি নিজেও জানি না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, তোমাকে যতোবারই দেখেছি, মুহূর্তগুলোকে ক্যামেরায় বন্দি করে রাখতে ইচ্ছে হয়েছে। যদিও আমি তেমন ভালো ছবি তুলতে পারি না। কিন্তু আমাদের স্বল্পায়ু জীবনে মাঝেমাঝে এমন কিছু অপার্থিব মুহূর্তের জন্ম হয়, যা স্মৃতির পাতায় অম্লান হয়ে থাকে। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, তার পর থেকে তৃষ্ণার্ত চোখে অপেক্ষা করতাম তোমার দেখা পাওয়ার আশায়। মনষ্কামনা পূরণ হয়েছে অবশ্য। বারবার চিরকুটটা কোন উদ্ভ্রান্ত, পাগলাটে যুবকের বলে ফেলে দেবে জঞ্জালের মাঝে? না কি বখাটে ছেলের রসালো প্রেমপত্র ভেবে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলবে? এসব কিছু করার অধিকার আছে তোমার। কিন্তু নির্মমভাবে কুটিকুটি করার আগে কোন প্রশ্ন জাগবে না মনে? নিশ্চয়ই মনে হবে, এই অদ্ভুত নীল রঙের কাগজে নিজেকে উজাড় করছে কোন সে বোহেমিয়ান?
নীল নভঃ, নীলাভ শিখা, নীল হ্রদ, নীল দুঃখ- সুবিশাল এই পৃথিবীতে কত নীল!
কিন্তু জগতের সবচেয়ে সুন্দর নীলের জন্য এই এক টুকরো নীল আবেগের চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার আর কী হতে পারে?
ইতি, আমি।’
চিরকুটটা ভাঁজ করে রাখল নীলা। তার সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা নীলের সমারোহ। সেদিন যদি সত্যিই ক্রোধের বশে একে ছিড়ে ফেলে দিত সে, কোথায় ঠাঁই হতো এগুলোর? অস্তিত্ব থাকতো কি এই এক চিলতে নীল আকাশের? হয়তো না।
কখনো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, কখনো অভিমান, কখনো কৌতুকময়, কখনো দুরন্ত, কখনো স্বতঃস্ফূর্ত, কখনো সমাহিত। সহসা মেঘ, পরক্ষণেই ঝলমলে রোদ। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, ছেলেমানুষি উচ্ছ্বলতায় পরিপূর্ণ। এরা যে শুধু এক টুকরো কাগজ নয়! হৃদয়ের ভেতর জমে থাকা কথার পুঞ্জিভূত বাষ্প। আরেকটির ভাঁজ খুলল সে, মসৃণ কালো কালিতে, গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-
‘আজকে নীল শাড়িতে তোমাকে কী অনিন্দ্য সুন্দর দেখাচ্ছিল, জান? চোখে কাজলের সরু রেখা, খোপা করা ঘন কালো কেশরাশি, স্নিগ্ধ বেলি ফুলের মালা এলোমেলোভাবে জড়ানো- এমন স্বর্গীয় রূপ নিয়ে কী করে জন্মালে নীলা?’
প্রথমবার পড়ে কী চমকেই না গিয়েছিল সে! বারবার প্রশ্ন করছিল বিবেককে- অজানা, অচেনা, নামহীন এ কাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে সে? সেই অদৃশ্য মানব যে-ই হোক না কেন; সে প্রতি পদে পদে তার উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। সে কি নীলাকে প্রতিদিন দেখতে পায়? অনুসরণ করে ছায়ার মত?
কখনো ব্যাগের এক অন্ধকার কোণে, খাতার শুভ্র পৃষ্ঠার ফাঁকে, কখনো বা বইয়ের ভাঁজে- কতো ভাবে আবিষ্কার করেছে এদের অস্তিত্ব!
আশ্চর্যজনকভাবে নীলা আজ পর্যন্ত তার একটি পত্রেরও জবাব দেয়নি। কিন্তু এক বিচিত্র কারণে তিল তিল করে জমিয়েছে তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা কথার ফুলঝুড়ি। কে জানত, কুয়াশার মত ধোঁয়াটে এক অতিথির আগমন ঘটবে তার জীবদ্দশায়? কতোবার খুঁজেছে তাকে নীলা! হাজার মানুষের ভিড়ে মিশে থাকা এক ব্যক্তি যে কি না তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাও অনুসন্ধিৎসু মনকে সান্ত্বনা দিতে হয় বলে সে নিরলসভাবে দিনের পর দিন খোঁজ করেছে তার।
সবই ছিল পণ্ডশ্রম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলা সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত চিরকুটটা খুলল-
‘নীলা,
অনেক অপেক্ষা করালাম তোমাকে, না? জানি তুমি আমার মতো এক ধোঁয়ার কুণ্ডলীকে হাতের মুঠোয় আনতে অনেক চেষ্টা করেছ। অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমায়। ক্ষমা করবে কি আমায়?
সত্যি কথা বলতে আমি নিজেও ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি এই অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা খেলতে খেলতে। অনেক হল। এবার দেখা দেওয়ার পালা। তুমি হয়তো ভাবছ, এতদিন পর আচমকা তোমাকে এ কথা কেন বলছি? কেন তোমার সামনে আসার অনুমতি চাইছি?
নীলা তুমি জান না, মনের কত তীব্র বাসনাকে জলাঞ্জলি দিয়েছি প্রত্যাখ্যানের ভয়ে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? তোমার যত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব সব যে আমাকে ঘিরে, একি আমার অজানা?
নিজে কষ্ট পেয়ে, তোমাকে কষ্ট দিয়ে অনেক পাপ করেছি। আরো পাপের ভাগিদার হতে চাই না। তোমার হোস্টেলের দুই মাইল দূরে যে পার্ক, তার ঠিক মাঝখানটায় একটা পুকুরে অনেক পদ্ম ফুল ফুটে আছে।
আমি ঠিক সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করব নীলা। আগামী সোমবার। সেদিন আমার শেষ চিঠিটা তোমার হাতে তুলে দেব। তুমি পড়বে, আমি দেখব। আসবে তো?
ইতি, আমি।’
নীলার বুক ধকধক করছিল। ‘ইতি আমি’ তাকে নিরাশ করবে না তো? সে কি কোন ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে? জানার একমাত্র উপায়- আজ তাকে যেতেই হবে। ঝড়ো বাতাস বইছে। থমথম করছে চারিদিক। নীলা উঠে দাঁড়ালো, ঝড় ওঠার আগেই রওনা দিবে সে। হঠাৎ করে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দ্রুতপদে গিয়ে দরজা খুলে দিল সে। হোস্টেলের চৌকিদার নিতাইয়ের ভীতসন্ত্রস্ত মুখকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আগেই অস্ফুট স্বরে কৈফিয়ত, ‘আপা আপনার টেলিফোন। থানা থেকে এক পুলিশ অফিসার কথা বলতে চাইছে।’
ছ্যাঁত করে উঠল নীলার বুক। পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে। এত অশুভ চিন্তা কেন করছে সে? কম্পিত হাতে টেলিফোন কানে লাগাল নীলা।
‘হ্যালো, কে বলছেন?’
‘আমি রায়েরবাজার থানা থেকে বলছিলাম। কিছুক্ষণ আগে লেকসার্কাস পার্কের ওদিকে রাস্তা পার হতে গিয়ে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় এক যুবক নিহত হয়েছে। আন্দাজ বাইশ-তেইশ বছর, নাম-ঠিকানা এখনো জানা যায়নি। লাশের বুকপকেটে একটি নীল রঙের চিঠি পাওয়া গিয়েছে, যেখানে এই হোস্টেলের ঠিকানা লেখা। আপনি নিহতের কে হন?’
নীলার চারপাশে সবকিছু ভনভন করে ঘুরছে। ওপাশ থেকে কর্কশ কণ্ঠস্বর বলেই চলেছে, ‘আপনি কি নীলা বলছেন? হ্যালো, হ্যালো?’
জ্ঞান হারাবার আগে নীলা শুনতে পেল ‘আপনার সঙ্গে নিহতের সম্পর্ক কী? হ্যালো...’
এসইউ/পিআর