ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মণিপুরী ভাষা : সংগ্রহ সংরক্ষণ ও চর্চা- শেষ পর্ব

প্রকাশিত: ০৯:৪৭ এএম, ১৫ জুন ২০১৭

মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার শব্দ সংগ্রহ
বাংলাদেশে এ যাবতকালে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ওইসব পত্রপত্রিকায় এ ভাষার প্রবীণ ও নবীন লেখকরা কবিতা, প্রবন্ধ, গান প্রকাশ করেছেন। সেসব সাহিত্যে অনেক পুরনো শব্দ যা ভাষার মৌলিক শব্দ প্রয়োগ হয়েছে। তাছাড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মুখে ও প্রাচীন মৌলিক ভাষাসমূহ জীবিত রয়েছে, যা তাদের পরিবারের নাতি-নাতিনদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যদিও আধুনিক কালের সমাজে বাংলা ভাষাভাষি মানুষের সংস্পর্শে এসে বাংলা ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং তা অহরহ ঘটছে। বর্তমান প্রবন্ধকারের কঠোর শ্রম ও চেষ্টার ফলে প্রায় পাঁচ হাজার শব্দ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাভাষি অধ্যুষিত সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় গ্রামসমূহ সফর করে এ কর্ম সাধিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় অনুবাদ ও ব্যাকরণগত দিক ও নির্দেশ করা সমাপ্ত হয়েছে কিন্তু অদ্যাবধি তা প্রকাশ করা সম্ভব হয় নাই।

মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ
পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ কোন ভাষাভাষি সমাজের প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা উপলব্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ভাষাতত্ত্ব বিশ্লেষণ ও সমাজ বিবর্তনের ধারা নির্ণয়েও পাণ্ডুলিপি পাঠ আবশ্যক হয়ে পড়ে। পাণ্ডুলিপি এক অমূল্য দলিল। কিন্তু নিষ্ঠাবান পাঠক, উৎসাহী সংগ্রাহক কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টির অভাবে এ নির্দশনগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সমাজের কীর্ত্তনবিদ, দোহার, পালাকার, রাসলীলার ওস্তাদ, কবিরাজ, মৃৃদঙ্গবাদক, পণ্ডিত, ব্রাহ্মণ সর্বোপরি সমাজনেতা বা সাহিত্যসেবীর কাছে এসব পাণ্ডুলিপি, গ্রন্থ, লেখা কাগজাত সংরক্ষণে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সেগুলোকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যায়-
১. বৈষ্ণব ধর্মানুসারী মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সমাজে সংস্কৃত ভাষাকে তারা ভক্তি রসের আখর বলে মনে করে। আগেকার দিনে সংস্কৃত টোলে অধ্যয়ন কিংবা নবদ্বীপ-বৃন্দাবন তীর্থস্থানে গিয়ে সংস্কৃত ভাষাশ্রয়ী শাস্ত্র অধ্যয়ন সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতো। সমাজ পরিচালনায় ধর্মীয় বিধিবিধান পৌরহিতের প্রাচীন শাস্ত্র ব্রাহ্মণদের কাছে তালপাতার পুঁথি সংরক্ষিত ছিল।

monipuri

২. মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া মণ্ডপ ও মন্দিরসমূহে বারো মাসই বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি হয়ে থাকে। যেমন- রথযাত্রার জয়দেব গান, বৈষ্ণব গুরু বন্দনা, সমাজের দোহার ও কীর্তনীয়া, সূত্রধারীরা প্রয়োগ করে থাকেন।

৩. যাদুমন্ত্র, ধাণ্য ফলন বর্ধক মন্ত্র, আয়ু বর্ধন মন্ত্র- এ সমস্ত মন্ত্রাদি আগেকার দিনে কবিরাজ ও পণ্ডিতগণ প্রয়োগ করতেন। এসব মন্ত্র আধুনিক সমাজে অচল হলেও ভাষাতত্ত্ব বিশ্লেষণে গুরুত্ব বহন করে।

৪. মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সমাজে পরম ভক্তিমান রাসলীলা অনুষ্ঠানের সংগীত বাংলা, ব্রজবুলি ও নিজ ভাষার সম্মিলন। আবার গোষ্টলীলা, নটপালা, উদুখল, আরতি এসব শিল্পীদের মুখে মুখে বা লিখিত পাণ্ডুলিপিতে সংরক্ষিত যা প্রতি বছরই বিভিন্নভাবে গীত হয়ে থাকে।

৫. কীর্তন মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের প্রাণ। এ সমাজের মতো কীর্তনপ্রিয় জাতি জগতে বিরল। অসংখ্য পদকর্তার গান এবং গোবিন্দ দাস, চণ্ডীদাস বৈষ্ণব কবিদের গানের আদলে রচিত নিজস্ব ভাষার গান কীর্তনে গীত হয়ে থাকে। কীর্তনীয়াগণ (ঈশালপা) তা লিখিত আকারে সংরক্ষণ করে থাকেন।

৬. মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় অনেক লিখিত গান, নাটিকা, প্রবাদ-প্রবচন, ছড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যা কবি সাহিত্যিকদের মুখে মুখে কিংবা লিখিত আকারে সংরক্ষিত।

৭. খুমল পুরান পাণ্ডুলিপি পণ্ডিতবর্গের কাছে সংরক্ষিত। অনাদর-অবহেলায় অসচেতনতার কারণে এসব মূল্যবান পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যেতে বসেছে। এসব পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও অনুলিখনের কাজ শুরু করা গেলে ভাষার প্রাচীন তথ্য তথা ভাষাতত্ত্ব বিশ্লেষণ সহায়ক হবে।

ভাষা সংরক্ষণ
ভাষার মাধ্যমেই বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ তাদের জাতিসত্তার পরিপোষণ করে, সন্তান-সন্ততি, পরবর্তী বংশধারার মাঝে নিজ ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারা সঞ্চালন করে এবং পরম্পরাগত স্থানিক মনীষা ধারা সম্পন্ন করে। চিরন্তন জাতিজন শত শত বছর যাবৎ তাদের সমাজের পরিপোষণ করতে নির্ভর করে আসছে শ্রুতির উপর, যার ভরকেন্দ্র হচ্ছে ভাষা। ২০০০ সালে জাতীয় জাদুঘরে আন্তর্জাতিক ভাষা মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে দেশের প্রায় অধিকাংশ ক্ষুদ্রজাতিসত্তার ভাষার ইতিহাস, বর্ণমালা ও বিবর্তন প্রদর্শন হয়েছিল। এটা ছিল এক মহৎ উদ্যোগ।

সরকারি পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট দেশের ও বিশ্বের সব ভাষার সংরক্ষণ ও প্রদর্শনসহ ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভাষার সাহিত্য গ্রন্থমালা সংরক্ষণের উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য। একটি ভাষার অস্তিত্ব বিদ্যমান ওই ভাষায় যারা কথা বলেন, তাদের কাছে যারা রাত-দিন, খাওয়া-দাওয়ায়, হাসি-কান্নায়, উপাসনালয়ে, ঘরে-বাইরে এ ভাষা ব্যবহার করেন, তাদের কাছে। তবে সে ভাষা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে ওই ভাষার সাহিত্যের উপর। তার উৎস শৌরসেনী, না মাগধী না ভোট-বর্মী তার উপর নয়। বাংলা ভাষা মাগধী প্রকৃতজাত ভাষা হয়ে ও বহু গুণীজনের উন্নত চিন্তার ফসলের সমাহারে পরিপূর্ণ হয়ে আজ বিশ্বের উন্নত ভাষা শীর্ষ পঞ্চম স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু কতিপয় ভাষাতাত্ত্বিকের গবেষণায় ভাষা জননী গৌরবশালিনী হয়ে ওঠে তা নয়, বরং ভাষা জননীর বিরামহীন সেবকদের অর্থাৎ সাহিত্যিকদের দ্বারা মহৎ শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির দ্বারা তা গৌরবশালিনী হয়। সেটাতেই ভাষার আসল মঙ্গল নিহিত।

ভাষার সংরক্ষণ সম্ভব হবে; যখন সে ভাষার অনুশীলন ও প্রয়োগ করতে পারা যায়। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সন্তানদের প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে স্ব স্ব মাতৃভাষার মাধ্যমে পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করাটা জরুরি যা ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। শিশুরা স্কুলে নতুন ভাষায় প্রথমে শিক্ষা নেওয়াটা দুরহ। শিক্ষার উপকরণ ও পাঠ্যবই যা শিক্ষার্থীরা সহজে বুঝতে পারে তা প্রবর্তন করা, যাতে শিশুদের নিজেদের ভাষা ও অভিজ্ঞতা উপেক্ষিত না হয়ে তাদের গুরুত্ব দেওয়া হয়। মৌলিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে শিশুদের নিজ ভাষায় পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকারের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমিসমূহও এ কাজে সহায়তা করতে পারে। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও লোকপ্রথার পরিপোষণে ও পুনরুজ্জীবনে নির্বিঘ্নে নিজ ভাষা ব্যবহার করতে পারাটা সমাজ উন্নয়নের প্রেক্ষিত থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা জাতিসংঘের Endarger Language এর অন্তর্ভুক্ত ভাষা।

monipuri

সাহিত্যচর্চা
বাংলাদেশে সিলেট শহর থেকে প্রথম মণিপুরী মাসিক সাময়িকী বের হয় ব্রিটিশ আমলে ১৯২৫ সালে (১৩৩১ বাংলা) অবিভক্ত ভারতবর্ষে আসাম, ত্রিপুরা, সিলেট অঞ্চলের মণিপুরীদের প্রথম পত্রিকা এটি। তথ্যে-তত্ত্বে, গুণে-মানে প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য, পুরাতত্ত্ব, সারগর্ভ প্রবন্ধ-নিবন্ধ বর্ধিত কলেবরে এর আগে এতদ্ঞ্চলে আর কোনো মণিপুরী সমাজের পত্রিকা বেরোয়নি। মাসিক পত্রিকাটির নাম জাগরণ-১৩৩১ বাংলা, সিলেট, সম্পাদক- অর্জ্জুন সিংহ বি.এল। ১৩৪০ বাংলা মণিপুরী মাসিক পত্রিকা, মূল্য দুই আনা- বাংলা ও মণিপুরী ভাষায় প্রকাশিত হয়। এরপর বের হয় মেখলী মাসিক পত্রিকা, ১৩৪৪ বাংলা। উল্লেখ্য মণিপুরী ও মেখলী পত্রিকায় দু’জন সম্পাদক- একজন বিষ্ণুপ্রিয়া ও অন্যজন মৈতৈভাষি। উভয় ভাষার লেখা প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কবিতা প্রকাশিত হয়। (সূত্র: শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ ও পত্রিকা- ড. ঊষা রঞ্জন ভট্টাচার্য্য, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, গৌহাটী বিশ্ববিদ্যালয়।) ভারত-পাকিস্তান আলাদা ও স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান আমলে মণিপুরী সমাজের আর কোন সাহিত্য পত্রিকা বের হয়নি।

বাংলাদেশে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সাহিত্যের সূচনা ১৯৭৫ সালে। স্বাধীন দেশে নবজাগরণের স্বাধীন চিন্তার স্ফূরণ, নূতন আশা ও উদ্দীপনা মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের প্রাণে ঢেউ লাগে। এ জাগরণের আভায় সিলেট শহর ও ভানুগাছ (কমলগঞ্জ) অঞ্চলের মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া যুব-ছাত্র মিলে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করে- নাম ‘খঙচেল’ অর্থাৎ কণ্ঠস্বর। ১৩ চৈত্র, ১৩৮১ বাংলা সন। এই সাহিত্য পত্রিকায় ৭টি কবিতা, একটি ছোট গল্প, ছড়া বা গান দুটি, সম্পাদকীয় জুড়ে কয়েক পৃষ্ঠা। ২য় সংখ্যা বের হয় ১৩৮২ সনে বর্ধিত কলেবরে ৪টি কবিতা, পাঁচটি গান ও তিনটি প্রবন্ধ সম্বলিত সাহিত্য পত্রিকা। সম্পাদক কৃষ্ণ কুমার সিংহ। কিন্তু ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা বলে ঘোষণা দিয়েও ৩ বছরে ৩টি সংখ্যা বের হয়ে আর প্রকাশিত হয়নি পত্রিকাটি।

আরও তিন বছর পর ১৩৮৬ সনে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পত্রিকা ইমার ঠার বা মায়ের ভাষা বের হয় ভানুগাছ থেকে। এই সাহিত্য পত্রিকাটি দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত হয় এবং বাংলাদেশের মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাভাষি কবি-সাহিত্যিকগণ এ পত্রিকায় লেখালেখি করেন। সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি প্রয়াত নন্দেশ্বর সিংহ মহোদয়। বেশ কিছুসংখ্যক কবিতা ও প্রবন্ধ লেখার মাধ্যমে নব্য লেখক বের করার পেছনে এ পত্রিকাটি অবদান রাখে। ১৯৭৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তারিখ থেকে বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রে মণিপুরী অনুষ্ঠান নামে একটি অনুষ্ঠান সরকার চালু করে, যাতে মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় কথিকা, গান, কবিতা প্রচারিত হয়। এতে গীতিকার ও কবি-সাহিত্যিকরা এ অনুষ্ঠানে স্ব স্ব ভাষায় লেখা জোগান দেন। অদ্যাবধি মৃদঙ্গ নামে এই অনুষ্ঠানে মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার গান, কবিতা, নাটিকা, মৃদঙ্গ সংগীত প্রচারিত হচ্ছে। প্রচুরসংখ্যক গান, কথিকা, কবিতা বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রে অদ্যাবধি সংরক্ষিত।

১৯৮১ সালে সাহিত্যনুরাগী ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে ছোট পরিসরে গঠিত হয় বাংলাদেশ মণিপুরী (বিষ্ণুপ্রিয়া) সাহিত্য পরিষদ। এ পরিষদের সাহিত্যপত্র রণজিত সিংহের সম্পাদনায় সত্যম ৩টি সংখ্যা প্রকাশনা ছাড়া ও এ যাবৎ ১৫টি ছোট আকারের নানা স্বাদের কবিতা, প্রবন্ধ, নাটিকা, গানের বই প্রকাশিত হয়। এখানকার কিছু বইয়ের সাহিত্য সমালোচনা আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আসাম রাজ্যের নূয়া এলা বা নব সংগীত ৭ম বর্ষ ১১ অক্টোবর ১৯৮৮ সংখ্যায় ‘বাংলাদেশে সাহিত্যচর্চা : থাম্পাল’ শিরোনামে একটি সাহিত্য সমালোচনা বের হয়। রণজিত সিংহের থাম্পাল বা পদ্মফুল কাব্য গ্রন্থের সাহিত্য সমালোচনা এটি। ‘কবিতাগুলো পড়ে আধুনিক কবিতার উষ্ণরস পাওয়া নাও যেতে পারে। জাকজমক করে সাজিয়ে সুরছন্দে আলোকিত নাও হতে পারে; তাই বলে কাব্য রসিকজনের অন্তর ভেঙে মুচড়ে ফিরিয়ে দেবে এমন তো নয়। কবিতাগুলোর একটুখানি মৃদুহাসি, একটি আলাদা আকর্ষণ রয়েছে যা গ্রাম-গঞ্জের কসমেটিক লেপনবিহীন কোন ও গ্রাম্য যুবমহিলার কাছে থাকে। নিজস্ব স্বকীয় চেহারায় সৌন্দর্যে, স্বকীয় আবেদনে কবিতাগুলোর নিজস্ব ভঙ্গিমায় কাব্য রসিকজনকে কাছে টানতে বাধ্য করে।’ ১৯৮৯ সালে পৌরী নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের হয় উত্তম কুমার সিংহের সম্পাদনায়। পত্রিকাটি ও অনিয়মিতভাবে বের হয়। বাংলাদেশে এ যাবৎ মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় প্রায় ৫০টি গ্রন্থ বা পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া শিশুতোষ কবিতার বইও প্রায় ৫টি বেরিয়েছে। ত্রিপুরা রাজ্য সরকার প্রাইমারি সরকারি স্কুলসমূহে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া সুযোগ দান করে ১৯৯৫ সালে। রণজিত সিংহের একটি শিশুতোষ কবিতা ৪র্থ শ্রেণীর পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কবিতার নাম মিঙাল বা আভা। বসন্তের স্পর্শে একরাতে গাছে গাছে ডালে ডালে যেরূপ নতুন পাতা গজে উঠে তেমনি একটি অনুকূল হাওয়া এসে দেখতে দেখতে বাংলাদেশের মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সাহিত্য গাছে গাছে ফুলে ফুলে মঞ্জুরিত হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে এ ভাষা শক্তি সঞ্চার করছে। হঠাৎ সে শক্তি অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেছে। ভোরের আকাশে নাম না জানা নানা পাখির কুজনে যেভাবে সুরের কাকলি বেজে ওঠে, তেমনি নানা কবির রচনায়, নানা স্বাদের কবিতার সুর ধ্বনিত হচ্ছে অহরহ। পরিশেষে এ ভাষার চারণ কবি গোকুলানন্দ গীতিস্বামীর কবিতার সুরে বলি-
‘অজ্ঞনো আধারে ইমা ঘুমিতায় কতি
উঠো আজি হাবিহান জ্বালেয়া চেই জ্ঞানর বাতি।’
অর্থাৎ-
অজ্ঞান অন্ধকারে মা আর কত ঘুমাবি বলো,
উঠো আজ সবেমিলে জ্বেলে দেখ জ্ঞানের আলো।
রাষ্ট্র ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাসমূহের সাহিত্য সংস্থাগুলোকে আর্থিক সহায়তা দান করে এ ভাষার সাহিত্যচর্চাকে বেগবান করতে পারে। আবার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমিসমূহ ভাষা সাহিত্য চর্চা ও প্রকাশনার দায়িত্ব নিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘শত ফুল প্রস্ফুটিত হোক আমাদের এ বাগানে, মোহিত হোক পুষ্পে গন্ধে চারিদিক।’

উপসংহার
বাংলাদেশের সব ক্ষুদ্রজাতিসত্ত্বার মানুষ দ্বোভাষি। একটি রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা, অন্যটি নিজস্ব মাতৃভাষায় তারা কথা বলে। মণিপুরীরাও দ্বোভাষি। মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় প্রকাশিত সাহিত্যের ব্যাপ্তি কম হলেও ভাষাভাষি লোকদের মধ্যে বিভিন্ন সম্ভাবনার প্রাপ্যতা বিদ্যমান। তারা নিজেদের মধ্যে ঘরে ও সমাজে এ ভাষা ব্যবহার করে আসছে। সমাজে মাতৃভাষা বেশ প্রভাবিত। কারণ এখনও এর বিস্তৃত প্রচলন রয়েছে। স্থানীয় ভাষার সীমানা সীমিত হওয়া সত্ত্বেও এ সমাজে দ্বিভাষার দক্ষতার মান ভালো। অর্থাৎ সমাজের প্রতিটি মানুষ তাদের ভাষার জন্য করণীয় পালন করে আসছে। প্রাথমিক স্তরে শিশুদের পড়া ও লেখার সুযোগ সৃষ্টিসহ রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষা সংরক্ষণ ও চর্চার উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এ ভাষার উন্নয়ন সম্ভব।

তথ্যসূত্র
১. Descriptive Ethnology of Bangal, E.T.Dalton, Printed for the Govt. of Bengal, under the Drection of the Council of the Asiatic Soceity of Bengal, Calcutta,1872.
২. কাছাড়ের ইতিবৃত্ত, উপেন্দ্র নাথ গুহ, কাছাড়, আসাম, পৃ:১৪২।
৩. মহাভারত, আদিপর্ব-২১৪ অধ্যায়।
৪. চিত্রাঙ্গদা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৫. বৃহৎবঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) দীনেশচন্দ্র সেন, ডি. লিট, প্রথম প্রকাশ-১৩৪১, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা-জানুয়ারি-১৯৯৩, পৃ:১০৯৬।
৬. সাংস্কৃতিকী (১ম খণ্ড) ড. সুনীতি কুমার চ্যাটার্জি, বাক্ সাহিত্য, কলকাতা-৯/৩৩ কলেজ রোড, প্রথম সং চৈত্র-১৩৬৮, পৃ:৬৩।
৭. The Background of Assamese Culture, Shillong, Assam, 1943, p.83
৮. আরণ্য জনপদে, আবদুস সাত্তার, জলি বুকস, ৪ রোকনপুর, থার্ড লেন, ঢাকা-১, জুন-১৯৬৬, পৃ:২১৫।
৯. Linguistic Survey of India, Vol:-V, Part-1,Dr. G.A. Grierson, Calcutta-1891, P-419.
১০. শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ ও পত্রিকা, ড. উষা রঞ্জন ভট্টাচার্য্য, ওরিয়েন্টাল বুক কো. প্রা. লি. কলকাতা-১৪০০ বাংলা, পৃ:১৬৯।
১১. বাংলাদেশের নানা ভাষা, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, মৈতৈ মণিপুরী (প্রবন্ধ)- মু. হাবিবুর রহমান, দৈনিক প্রথম আলো, সম্পাদক মতিউর রহমান, ১৪ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি-২০১৩, ঢাকা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, তাজপুর ডিগ্রী কলেজ, সিলেট এবং মণিপুরী সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে পিএইচডি।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন