বৃষ্টি নিয়ে তিনটি খুচরা গল্প
এক.
এই রকম ফাল্গুনী বর্ষায় সবাই যখন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে ব্যস্ত তখন শরীফ সাহেব তার সাত বছরের পুরনো শরীফ ছাতাটা বের করে অফিসের দিকে রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। সামনে তার বড় মেয়ের বিয়ে। কীভাবে কি করবেন তা ভেবেই হাঁটাচলার শক্তি হারিয়ে ফেলছেন তিনি। আরো দুই মেয়ে আছে তার। বড় মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে তারপর তাদেরও বিয়ে দিতে হবে। আর বিয়ের যা খরচ! কোথা থেকে জোগাড় করবেন এত কিছু?
মাথায় এসব চিন্তা নিয়ে শরীফ সাহেব রাস্তায় পা রাখেন। হেঁটে হেঁটে বাসস্ট্যান্ড যাবেন সেখান থেকে লেগুনা বা বাসে চড়ে অফিস। বয়সের ভারে আর কাজের চাপে শরীরটা ভেঙে পড়ছে। হাঁটতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু রিকশা ভাড়া যেভাবে বাড়তি তাতে রিকশা ভাড়া করা আর গাড়ি ভাড়া করা শরীফ সাহেবের কাছে সমান ব্যাপার। প্রতিদিন অফিসে যেতে দুই ঘণ্টা ফিরতি পথে তিন ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকেন তিনি। কম পয়সায় বাসা ভাড়া পাওয়া যায় বলে অফিস থেকে দূরেই থাকেন তিনি। সংসারে রোজগারের মানুষ তিনি একাই। সরকারি একটা ব্যাংকে একখানা অ্যাকাউন্ট আছে শরীফ সাহেবের। ডেবিট বা ক্রেডিট কোন কার্ড নেই তার নামে। কখনো তেমন একটা সঞ্চয়ও করতে পারেননি। ঋণে ঋণেই জীবন কেটে যাচ্ছে। মেয়ের বিয়ের জন্য আবার অফিসে লোনের জন্য বলতে হবে। খুব বেশি হলে ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম পেতে পারেন। বেতন থেকে সেই টাকা কাটতে কাটতে আবার মেজ মেয়ের বিয়ে চলে আসবে। তারপর ছোট মেয়ে।
৩০ বছর ধরে ঢাকায় আছেন শরীফ সাহেব। চোখের সামনে কত বড় বড় ঘরবাড়ি, ফ্ল্যাট উঠতে দেখলেন কিন্তু নিজে কখনো কেনার চিন্তা করেননি। যে টাকা বেতন পান তা দিয়ে ঢাকা শহরে একটা ইট কেনার সামর্থও তার হবে না। গ্রামের বাড়িতে টিনের ঘর আছে একটা। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাবেন। চাকরিটাও আর বেশিদিন করতে ইচ্ছে করছে না। প্রাইভেট ফার্মে ষাটোর্ধ্ব কর্মচারীকে রাখতে চায় না। শরীফ সাহেব পুরনো লোক, মালিক নিজে তাকে চেনেন, তাই এখনো করে যাচ্ছেন। গ্রামের বাড়ি গিয়ে একটা ছোটখাট মুদি দোকান দিয়ে বসবেন বলে ভেবে রেখেছেন শরীফ সাহেব। কিন্তু মেয়েদের বিয়ে দেয়ার পর আর কোন টাকা হাতে থাকবে কি না সেটাই ভাবছেন এখন।
রাস্তায় নেমে কাদা পেরিয়ে এসব কথা ভাবতে ভাবতে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যান মো. শরীফুল আলম। ছাতাটা বন্ধ করে একটা লেগুনায় উঠে পড়েন। আজকে ভিড় কম, শনিবার সকাল ৯টা, তার উপর বৃষ্টি। বৃষ্টির একটা সুফল পেলেন শরীফ সাহেব। সকালে একটু আরাম করে আজ অফিসে যেতে পারছেন।
দুই.
মঈনের ছেলেটার জ্বর। ছেলেটার বয়স মাত্র দুই বছর। বিয়ের পরপরই জমানো টাকা দিয়ে বন্ধুর সাথে ব্যবসা শুরু করেছিলো মঈন। প্রথম বছর ভালোই লাভ হলো। লোভ বেড়ে গেল। চাকরি আছে- সেই ভরসায় লাভের টাকা, জমানো টাকা সবই ব্যবসায় খাটিয়ে দিলো। ব্যবসাটা পড়ে গেলো। হতাশায় ডুবে গেল মঈন। ছেলেটা বড় হচ্ছে। ব্যবসা করে হাতে কিছু নগদ টাকা এসেছিল। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত হবার কথা ভেবেছিল। কিন্তু সেই ব্যবসা যে এভাবে নাই হয়ে যাবে একবারও মনে হয়নি তার। এখন তার চাকরিতে মন বসে না, ব্যবসা করার টাকা নেই। বাড়ি ভাড়া দিয়ে হাতে আর কোন টাকা থাকে না। ব্যবসাটা বড় হলে প্রথমেই ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কেনার কথা ভেবে রেখেছিলো মঈন। কিন্তু সবকিছু কেমন যেন উল্টে গেল গত ছয় মাসে। মঈনের মনে হচ্ছে, গত বছরটা কেমন যেন স্বপ্নের মত ছিল, হঠাৎ ঘুম ভেঙে চোখের সামনে বাস্তব মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে।
আজকে মাসের ২৫ তারিখ। বৃহস্পতিবার বিকেলের পর থেকে মঈনের ব্যাংকের বুথে টাকা থাকে না। আজকে তার টাকার দরকার। বাসায় বাজার নিয়ে যেতে হবে। এরমধ্যেই নামলো ঝুম বৃষ্টি। অথচ সারাদিন ছিল দগদগে রোদ। মঈনের ৫০০ টাকার শার্টটা ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এখন শার্ট থেকে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে। বাসের লাইনের মত বুথের সামনেও লম্বা লাইন। আশেপাশের কোন বুথে টাকা নেই। একটা বুথেই টাকা আছে, ছোট এই বুথটা সাধারণত কেউ ব্যবহার করে না। আজকে একমাত্র সচল বুথ হিসেবে কদর বেড়ে গেছে। সকালে ঘামে ভিজে আর এই এখন বৃষ্টিতে ভিজে মঈনের কাশি শুরু হয়ে গেছে। সামনে তখন আরো তিনজন দাঁড়িয়ে আছে টাকা তোলার লাইনে। ১৫ মিনিট পর টাকা তোলার সুযোগ পেল মঈন। ১৫শ’ টাকা তুলতে ১৫ টাকা খরচ। বাজারের ব্যাগটা নিয়ে আজকে এই বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতেই বাসায় ফিরতে হবে। বুথে ১৫ টাকা না কাটলে রিকশা নেওয়ার কথা ভাবা যেত। বাজার থেকে ২০ টাকার নিচে রিকশাওয়ালারা এখন আর যেতেই চায় না। অনেকটা হাতেপায়ে ধরেই রিকশাওয়ালাদের রাজি করায় সে। বাইরে আজ বেশ ঠান্ডা। বুথের ভেতর এসিতে আরো ঠান্ডা লাগছে মঈনের। কাঁশির সাথে হাঁচিও শুরু হয়ে গেছে। ১৫শ’ টাকা তুলে ফেলার পর অ্যাকাউন্টে থাকলো আর ২৭ টাকা।
দরজাটা ঠেলে এসির ঠান্ডা বাতাস থেকে বেরিয়ে বাইরের বৃষ্টি-বাতাসের দিকে মঈন যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ধাতব নারী কণ্ঠটা খুব কানে লাগলো তার, ‘থ্যাঙ্ক ইউ ফর ব্যাংকিং উইথ আস’।
তিন.
আজকে অফিসে দেরি হয়ে যাবে ভাবছিলো রনক। কালকে অফিস থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। একটা বড় কাজের দায়িত্ব ছিল রনকের উপর। সেটা নামিয়েই বাসায় ফিরেছে। তাই আজকে কোন কাজের চাপ নেই। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দুইটা বেজে গেছে। ঘুমাতে ঘুমাতে চারটা। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে সোয়া এগারোটা।
বারোটায় অফিস থাকলেও আজকে দুপুর নাগাদ ঢুকলেই হতো। কিন্তু বাড়তি সময় নিতে ইচ্ছে করলো না রনকের। চটপট রেডি হয়ে ছুট লাগালো। মিরপুর থেকে বনানী পৌঁছতে আধঘণ্টা লাগলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা আসার পথে মন ভালো করে দিলো। ১২টা ১০ মিনিটে পাঞ্চ করে অফিসে ঢুকেই সোজা ক্যান্টিনে। সিঙ্গাড়া খেয়ে কফির কাপটা হাতে নিয়ে ডেস্কে গিয়ে বসলো।
আজকে কোন কাজ নেই। অফিসের কেউ তাকে খুঁজবে না। মল্লিকারও কোন ফোন আসবে না আজকে। হয়তো আর কখনোই আসবে না। ডেস্কে বসার পর থেকেই নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে রনকের। আজকে তাকে কেউ খুঁজবে না। আজকে কোথাও তার কোন প্রয়োজন নেই। বড় একটা প্রজেক্ট কালকে রাতেই নামিয়েছে সে।
এবার মনে হয় কপি সুপারভাইজারের দায়িত্বটা তাকেই দেওয়া হবে। কালকে রাতেই ধুমধাম করে মল্লিকার বিয়ে হয়ে গেল। সেই কষ্টটা ঢেকে রেখেছে সে কাজের মধ্যে। আজকে তো কোন কাজ নেই। আজকে তাই প্রথম ঝিমুনি তারপর মনটা খারাপ হল রনকের।
আজকে রনকের কোন ওয়ার্ড ফাইল ওপেন করার কথা না। কিন্তু কফিটা শেষ করে একটা নিউ মাইক্রোসফট অফিস ওয়ার্ড ডকুমেন্ট ওপেন করলো সে। রনকের এখন দু’টা জিনিস লিখতে ইচ্ছে করছে। প্রথমত একটা রিজাইন লেটার, দ্বিতীয়ত একটা প্রেমের গল্প। রনকের ডেস্কের পেছনে ভ্যানিশিয়ান ব্লাইন্ডের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এ রকম আবহাওয়ায় কোনটা লেখা বেশি যুৎসই?
এসইউ/পিআর