আমি কান পেতে রই : শেষ পর্ব
নয়.
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা হয়ে গেলো রিমির। রাহাতের ছেলেমি আর দুষ্টুমি মাঝে মাঝে অসহ্য লাগলেও সময়টা কিন্তু দারুণ কেটেছে আজ। রাহাত অবশ্য আজকে আসতেই দিচ্ছিলো না ওকে। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কালকে আবার ওর সাথে সারাদিন থাকার প্রমিজ করে তারপরে ছাড়া পেয়েছে সে। হাসান অবশ্য ওদের বন্ধুত্বের ব্যাপারটা জানে। তবে দু’জনের সম্পর্ক যে এতো গভীর এটা জানে না সে। এনিয়ে কোনোদিন আলোচনাও হয়নি খুব বেশি। এক জীবনে একটি মানুষের কতো কিছুই তো গোপন থাকে। আমরা তার কিইবা জানি! থাক না রিমির এই ভালো লাগাটুকু একান্ত নিজস্ব। এখানে তার যা ইচ্ছে তাই করবে সে। এটুকু আলো আছে বলেই তো এখনো এই সংসারে টিকে আছে রিমি। শুধু কোথায় একটা শক্ত বাঁধন যেন তৈরি করে দিয়েছে শোভন। সে কারণেই হয়তো সংসারে হাসানের প্রেফারেন্সটা বেশি!
রিমিকে বাসায় ঢুকতে দেখে মুক্তা আপা খুশিতে বিহ্বল হয়ে গেলেন। ‘তুই আসলি? এতক্ষণ বাইরে কী করলি?’
‘পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করে এলাম। তাও আবার পুরান ঢাকায়। যা জ্যাম রাস্তায়। কাঠের ব্রিজটা পার হতেই দুই ঘণ্টা লাগলো।’
‘শোন, ফার্নিচার সব নিয়ে গেছে। এই নে টাকা।’
রিমি এতক্ষণে বাসার ভেতরে তাকায়। কীরকম মন খারাপ লাগে। ফাঁকা ফাঁকা লাগে ঘরটা। শোভন বেরিয়ে আসে। তার দুই চোখে পানি।
‘মা, দেখো- আমাদের সব জিনিসপত্র বিক্রি হয়ে গেছে। এভরিথিং সোল্ড আউট।’
‘কোনো অসুবিধা নেই বাবা। আমাদের তো আরেকটা দেশে নতুন বাড়ি হচ্ছে। সেখানে তোমার সবকিছু থাকবে।’
‘সত্যি মা।’
‘অফকোর্স সত্যি বাবা। খেয়েছো?’
‘না।’
‘চলো আমরা খেয়ে নেবো।’
রিমি নিজের ঘরে ঢোকে। হাসানকে ফোন দেয় সে।
‘হ্যালো হাসান। কী খবর?’
‘খবর নাই।’
‘মানে?’
‘মানে কোনো খবর নাই। ব্ল্যাক হোল নিয়া আছি! এখন অবশ্য রবীন্দ্রসংগীত শুনবো!’
‘মানে? তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘পরে কথা বলবো। চার্জ নাই। এসব এলাকায় কারেন্ট থাকে না ঠিকমতো। তোমাদের কী অবস্থা?’
‘এই তো আজকে ফার্নিচারগুলো নিয়ে গেছে। কালকে ইলেকট্রনিক জিনিসগুলো নিয়ে যাবে।’
‘গুড। ভালো প্রোগ্রেস। দুলাভাইকে বলো তো গাড়িটার একটা ব্যবস্থা করতে!’
‘ওমা তাই তো! বলবো। এই শোন না, আজকে রাহাত ভাই ফোন করেছিলো।’
‘তাই না কি?’
‘হুম। তোমার প্রমোশন হয়েছে শুনলাম। কংগ্রাটস হাসান। আমাকে জানাওনি কেন?’
‘আরে রাখো। ওসবে আর কাজ নেই। এসেই চাকরিটা ছেড়ে দেবো।’
‘সত্যি? বাবা কি রাজি হয়েছে?’
‘দেখা যাক না! লেগে আছি তো! পরে জানাবো।’
বেশ খুশি খুশি ভাব নিয়ে ফোন ছাড়ে রিমি।
রাতের বেলায় জঙ্গলের পথ বেয়ে ইব্রাহিম মিয়ার বাড়িতে যাচ্ছে হাসান। চারিদিকে এতো অন্ধকার যে তার ভীষণ অস্বস্তি লাগছিলো। ইব্রাহিম মিয়ার হাতে লাঠি। মুখটা অন্ধকারের মতো কালো। হাসান বললো, ‘একটুও আলো নেই যে আজ ইব্রাহিম।’
ইব্রাহিম আকাশের দিকে তাকিয়ে নির্বিকারভাবে বলে, ‘চাঁদের অন্ধকার পিঠ পৃথিবীর দিকে যখন পড়ে, তখনই আসে অমাবস্যা। আজ অমাবস্যার রাত। একটু অন্ধকার লাগবে স্যার।’
‘আমি স্যার না। তুমি আমাকে ভাইজান বলে ডাকলেই চলবে।’
‘জ্বি স্যার।’
ইব্রাহিম মিয়ার চোখ ঘোলা হয়ে আসছে। ‘স্যার, আপনাকে কিছু কথা বলবো। আপনি কীভাবে নেবেন- সেটা আপনার বিষয়।’
হাসানের মনটা এলোমেলো লাগে। হেসে বলে, ‘তুমি কি অতিলৌকিক কিছু বলে আমাকে চমক দিতে চাচ্ছ!’
‘না স্যার। আমি সত্যি বলতেছি। সস্তা কথা বলি না।’
‘ঠিক আছে, বলো।’
ইব্রাহিম মিয়া চোখ দু’টো বুঝেই অন্ধকারের মধ্যে হাঁটতে থাকে। মিনিটখানিক নীরবতা। হাসান কৌতূহলী হয়ে তাকায়।
‘ভাইজান। আপনার যে ঘর ভাইঙা গেছে।’
‘মানে?’
‘খবর নিয়া দেখেন, ভাবি তো অন্য একজনের সাথে ঘর করতেছে।’
ইব্রাহিম মিয়া দাঁড়ায়। হাসানও। হাসানের সারা শরীর কাঁপতে থাকে। ‘লোকটা কে? তোমার রাডারে ধরা পড়ছে?’
ইব্রাহিম মিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘স্যার?’
‘হুম, বলো।’
‘আরো খারাপ খবর আছে।’
হাসানের বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। ইব্রাহিম মিয়া বলে, ‘আপনার ছেলেটারে সাবধানে রাইখেন। ভাবি তাকে একা বাড়িতে রেখে বাইরে যায়। তাকে এই ফাঁকে অপহরণের সুযোগ খোঁজা হইতেছে। ব্যবস্থা না নিলে খুব শিগগিরই দুর্ঘটনা ঘটবে। বড় দুর্ঘটনা।’
‘ঠিক আছে, দেখছি।’
‘শেষ খারাপ খবর!’
হাসান এবার আঁতকে ওঠে, ‘কি বলো ইব্রাহিম মিয়া?’
‘স্যার, আপনি বিদেশ যাওয়া বাদ দেন।’
‘কেন?’
‘আপনার খুব ঝামেলা হবে। আমি এই ঝামেলার কথা নিজের মুখে বলতে পারবো না। ভাইজান বেয়াদবি নেবেন না!’
ইব্রাহিম মিয়ার বাড়িতে এসে হাসানের মন কিছুটা ভালো হয়ে যায়। ইব্রাহিমের মতো অগোছালো লোকের এতো সুন্দর একটা মেয়ে। তাও আবার এই গ্রামে! নুরজাহান এবার মেট্রিক পরীক্ষা দেবে। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে। চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গায়। নুরজাহান ওই ভরা অমাবস্যার রাতে গান ধরলো, ‘আমি কান পেতে রই ও আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে/ কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে-- বারে বারে॥’
হাসানের পুরো মগজজুড়ে তখন অন্য চিন্তা। ইব্রাহিম মিয়া কি তার চোখ খুলে দিয়েছে? কি জানি? হঠাৎ করেই শোভনের কথা মনে হতে থাকে খুব। শোভনের জন্য এই প্রথম অস্থির লাগে হাসানের। সারা বাড়িতে আর কোনো লোকজন দেখা যাচ্ছে না। হাসান এদিকে-ওদিকে তাকায়। ইব্রাহিম মিয়া কি বুঝতে পারে বিষয়টা? সে হেসে বলে, ‘আমার পরিবারও আমারে রাইখা চইলা গেছে। সেই থেইকা একা থাকি ভাইজান।’
নুরজাহানের গান শেষ হতেই সে ঘরের ভেতর দৌড়ে চলে গেলো। হাসান বাড়ির উঠানে বেঞ্চির উপর অন্ধকারে একা বসে রইলো। অনেকক্ষণ।
দশ.
সকালবেলা জামান ঘুম থেকে উঠে বললো, ‘দোস্ত, ছুটি তো শেষ আমাদের। তুই বরং থাক। আমি ঢাকায় যাই। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। সবকিছু সেটেল হলে তারপর আসি?’
জামানকে না বলা দুঃসাধ্য। তাছাড়া ঢাকাতে বেশকিছু পেন্ডিং কাজ হাসানেরও ছিলো। কিন্তু এই আনসেটেল অবস্থায় হাসানই বা ফিরে যায় কীভাবে? তবু সে বললো, ‘ঠিক আছে দোস্ত। পারলে অফিসে আমার ছুটিটা একটু এক্সটেন্ড করিস।’
‘ঠিক আছে।’
জামান সকালে ব্রেকফাস্ট না করেই ওর গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হলো। জামানকে বিদায় দিয়ে সকালে আর এক প্রস্ত ঘুমের ভেতর ডুব মারে হাসান।
সিদ্ধান্তটা নিতে বেশকিছু সময় লেগে গেলো রাহাতের। এতদিন অবশ্য রিমিই না না করছিলো। দু’দিন লিভ টুগেদার করে অবশ্য সে-ও সেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে। এতদিনে রাহাত তার পুরনো জায়গা লন্ডনে ফিরে যেতে চাইছে। রাহাত দুর্দান্ত। যেই কথা সেই কাজ। রিমির হ্যাঁ বলা ছাড়া উপায় যে নেই! এজন্যই মিথ্যাকে উগরে ফেলতে চাইছে সে প্রাণপণে। এতটা দিন হাসান আর শোভনের সাথে কি বিশ্বস্ত ভালোবাসায় মেতেছিলো সে! নিজেকেই চিনতে পারে না রিমি। আজ বিকেলে তার ফ্লাইট। অথচ শোভনকে ছেড়ে যেতে কী যে কষ্ট হচ্ছে তার! শোভন সকাল নয়টা পর্যন্ত তার বুকের ভেতর মাথা গুঁজে ঘুমুলো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বলল, ‘মামণি, আজকে তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না তো!’
‘না মামণি। তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। শুধু এক ঘণ্টার জন্য মার্কেটে যাবো।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। বাবা আসে না কেন? বাবা কোথায় গেছে?’
‘তোমার বাবা দাদাবাড়ি গেছে। খুব শিগগিরই চলে আসবে। আমি আজকেই বলবো।’
‘থ্যাংক ইউ মা। ইউ আর মাই বেস্ট মম এমং অল।’
‘থ্যাংক ইউ বাবা।’
শোভনকে ছেড়ে ঘরটা সুন্দর করে পরিষ্কার করে রিমি। নিজের ব্যাগ গোছায় যত্ন করে। দু’বার ফোন করে হাসানকে। পাওয়া যায় শেষ পর্যন্ত।
‘হাসান, একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হলো। আই ফিল সরি ফর দিস।’
‘কী হয়েছে?’
‘আমি চলে যাচ্ছি।’
‘মানে?’
‘হুম। রাহাতের সাথে আমি চলে যাচ্ছি। তবে শোভনকে আমি দিয়ে যাচ্ছি। ও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।’
‘তুমি কেন যাচ্ছ? কী কারণে যাচ্ছ? এর কোন কিছুই কি জানবার অধিকার নেই আমার?’
‘অফকোর্স। তুমি আগেও জানতে, উই হ্যাড রিলেশনশিপ। তাই আমাকে সঙ্গত কারণেই চলে যেতে হচ্ছে।’ ‘তাই বলে এরকম একটা ক্রুসিয়াল সময়ে?’
‘অতসব ভাবার সময় আমার নেই হাসান। আই অ্যাম নট ইভেন ইন এ পজিশন টু ক্লারিফাই! মিথ্যার সাথে আমি আর থাকতে চাচ্ছি না।’
‘কোনটা মিথ্যে?’
‘আমাদের ভালোবাসা মিথ্যে। এইসব সংসার মিথ্যে। সরি হাসান। তোমাকে এতো ব্যাখ্যা দেবার কিছু নেই। আমি জামান ভাইকে আসতে বলেছি বাসায়। হি ইজ অন দ্য ওয়ে।’
হাসানের সারা শরীর কাঁপতে থাকে। কীরকম একটা রাগ, অভিমান তাকে আরো কঠিন করে তোলে। হাসান হেসে বলে, ‘ওকে গুড লাক। যেখানে থাকো ভালো থাকো। বাই দ্য ওয়ে, আমাদের আর শেষ দেখা হবার চান্স নেই!’
‘না। আমি আজ বিকেলেই চলে যাচ্ছি। বাসার চাবি, অন্য অন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জামান ভাইকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবো। ডিভোর্স লেটার ফাইল করেছি। তুমি সময়মতো পেয়ে যাবে।’
‘আর কিছু বলার নেই তোমার?’
‘না।’
‘তোমার ছেলের জন্যও কিছু বলার নেই?’
এতক্ষণে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। হাসান নিশব্দে ফোন রেখে দেয় সেকেন্ডখানিক পর। তারপর কাউকে কিছু না বলে ঢাকায় রওয়ানা দেয় সে। ইব্রাহিম তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ইব্রাহিম মিয়া বলে, ‘স্যার, আমারে সাথে নিয়া যান! আমারে আপনার লাগবে স্যার।’
‘কেন, বাবার অসুবিধা হবে না?’
‘না। আমজাদ তো রইলো।’
গভীর রাতে বাসায় পৌঁছলো হাসান আর ইব্রাহিম মিয়া। বাসায় কথামতো জামান আর জামানের বউ রোচি পৌঁছে গেছে। জামান রাত জেগে অপেক্ষা করছিলো। রিমির দুলাভাই আর মুক্তা আপা গতকালই চলে গেছেন। তারা কীভাবে গেছেন, কেন গেছেন- এগুলো নিয়ে মাথা ঘামালো না হাসান। শোভন ঘুমিয়ে ছিল। সে জানে তার মা বাবাকে আনতে গ্রামে গেছে। রাতেই দু’জনে ফিরে আসবে। বাবাকে দেখেই ঘুম ভাঙলো শোভনের। ‘বাবা, মাই সুইট বাবা, কখন এলে? মা আসেনি?’
‘না বাবা। মায়ের আসতে দেরি হবে।’
‘কেন বাবা? তোমাদের দু’জনকে একসাথে পাচ্ছি না বাবা।’
হাসান পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। হেসে বলে, ‘অপেক্ষা করো। এভরিথিং উইল বি অলরাইট বাবা।’ ইব্রাহিম মিয়া কোথা থেকে একটা ফুটবল নিয়ে আসে। ‘আরে শোভন বাপ, বল খেলবা নাকি?’
শোভন ভ্রূকুটি দেয়। হেসে বলে, ‘বল না এটা ফুটবল আঙ্কেল।’
‘ওই তো কথা একই। যে লাউ সেই কদু।’
দু’জনে ফুটবল খেলা শুরু করে দেয় ঘরের ভেতর। হাসান বাইরে আসে। একটা সিগারেট ধরায়। মনে মনে ভাবে সে, হি ইজ রিয়েলি ডিলিং সামথিং ভেরি ডিফিকাল্ট থিং। ভালো লাগছে না তার। অস্বস্তি হচ্ছে। মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা আগুনের মতো পোড়ে। এসবই অনুতাপের কষ্ট। বঞ্চনার কষ্ট। আশ্চর্য! হাসানের সাথে শেষবারের মতো দেখাটুকুও করলো না রিমি?
জামান পাশে এসে দাঁড়ায় এতক্ষণ পরে। ‘আমাদের অফিসের বিগ বস বি অং ব্যাপারটার জন্য নিজেই লজ্জিত হয়েছেন। তোকে দেখা করতে বলেছেন।’
হাসান জামানের হাতটা ধরে। ‘দোস্ত, এই ছোট বাচ্চাটাকে আমি কি বুঝ দেই বল তো? শুড আই টেল ট্রুথ অর লাই?’
জামান ঠান্ডা মাথায় বলে, ‘ওকে সত্যি কথাটাই বুঝিয়ে বলতে হবে দোস্ত। বাচ্চারা সত্যিটা এডপ্ট করে ফেলে খুব তাড়াতাড়ি। চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া তোর ঝামেলা না মেটা পর্যন্ত আপাতত আমরা আছি। তোর ভাবিই শোভনের দেখাশোনা করবে দোস্ত। ডোন্ট ওরি।’
হাসান কোনো উত্তর দেয় না। আর একটা সিগারেট জ্বালায় সে।
এগারো.
বি অং মানুষটা দেখতে ছোটখাটো। কিন্তু ধীর-স্থির। হাসানকে সে নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানালেন। তারপর বললেন, ‘হাসান, তোমার কন্ট্রিবিউশন আমাদের কোম্পানির গ্রোথ বাড়িয়েছে। আই রিয়েলি মিন ইট। আবার একইসাথে তোমার পার্সনাল ইনসিডেন্টের কথা শুনে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। বলো তোমার জন্য আমরা কি করতে পারি!’
হাসান হাসে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। বলে, ‘ও নিয়ে ভেবো না তুমি। আমি একদম ঠিক আছি। নিয়তির উপর কারো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।’
‘ঠিক বলেছো হাসান। তোমার তো একটা প্রোমোশন হয়েছে। রাইট?’
‘জ্বি।’
‘উই আর রিয়েলি প্লানিং সামথিং সিরিয়াস অন ইউ। বাই দ্য ওয়ে, আমরা কিন্তু রাহাতকে টার্মিনেট করেছি।’
‘ও আচ্ছা। জানতাম না।’
‘যাই হোক। তোমার যা লাগবে বলো। ইভেন ইফ ইউ নিড লিভ, ইউ ক্যান টেক অ্যানিটাইম।’
হাসান হাসে। তারপর একটা অ্যাপ্লিকেশন বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। বি অং একটু অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলেন। ততক্ষণে আরো দুজন কলিগ ঢুকেছে রুমে। হাসান খুব স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়, ‘স্যার, আমার পক্ষে আর যে কন্টিনিউ করা সম্বব না! আই ফিল সরি ফর দ্যাট।’
‘তাহলে তুমি কি প্ল্যান নিয়েছো?’
‘এখনও কোনো কিছু চিন্তা করিনি স্যার!’
হাসান উঠে আসে তার রুম থেকে। মিস্টার বি অং অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বাইরে তখন ফুরফুরে হাওয়া। হাসান রাস্তার দিকে পা বাড়াতেই ইব্রাহিম মিয়ার ফোন- ‘ভাইজান আপনি কই?’
‘আমি বাইরে ইব্রাহিম মিয়া। কেন কি সমস্যা?’
‘আপনি একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি আসেন। শোভন বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। খুব জ্বর তার।’
হাসান কথা শুনে কীরকম ঘাবড়ে যায়। তড়িগড়ি করে ড্রাইভার বেলাল মিয়াকে খোঁজে সে।
সোলায়মান মিয়ার কাছে খবরটা আসে বিকেলে। জামানই ফোন করে ডিটেইল বলে তাকে। সকাল থেকেই তার অস্থির লাগে। তিনি মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডাকলেন। বললেন, ‘একটু দোয়া করেন আমার ছেলে আর নাতির জন্য। তাদের বড়ই যন্ত্রণা।’
‘আল্লাহ পাককে ডাকলে নিশ্চয়ই তিনি সকল সমস্যা দূর করবেন জনাব।’
‘নিশ্চয়ই।’
ইমাম জোরে জোরে পবিত্র কোরান শরীফ পাঠ করতে শুরু করলেন। সোলায়মান মিয়াও একমনে আল্লাহকে ডাকছেন। তার মন মানছে না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আমজাদকে বললেন, ‘আমজাদ গরম পানি দে। গোসল করবো।’
‘স্যার কোথাও যাইবেন?’
‘হুম। একটা প্রাইভেট গাড়ি ঠিক কর। আমি ঢাকায় যাবো।’
‘কেন স্যার?’
‘তুই এখনও শুনিস নাই?’
‘জ্বি শুনেছি স্যার। আমিও যেতে চাই স্যার। আমারেও নিয়া চলেন।’
সোলায়মান মিয়া সেকেন্ডখানিক কিছু ভাবেন। তারপর মাথা নাড়েন।
বাসায় এসে হাসান অবাক। শোভনকে একদমই চেনা যাচ্ছে না। সারা শরীরে জ্বর। চোখ দুটো বন্ধ। শুধু ঘন ঘন গরম নিশাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। জামানের স্ত্রী রোচি বললো, ‘হাসান ভাই। চলেন বাবুকে খুব দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া দরকার।’
জামান কয়েকটা হাসপাতালে ফোন করে দ্রুত। স্কয়ার হাসপাতালের শিশুবিশেষজ্ঞ আফতাব ইউসুফ সাহেবকে ছোটবেলায় দেখাতে আসতো রিমির সাথে। সেই ডাক্তারকে পাওয়া গেলো। এমনকি একটা কেবিনও পাওয়া গেলো কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই। গাড়িতে করে জামান আর হাসানই ভর্তি করিয়েছে তাকে। খুবই স্ট্রেট-কাট প্রসিডিউর। হাসানের টেনশনটা যাচ্ছিলই না। সে বাইরে এক কোণায় এসে জামানকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কেঁদে ফেললো। জামান খানিকটা হতবাক। তবুও খুব আলতো করে ছাড়িয়ে নেয় সে নিজেকে। ফিসফিস করে বলে, ‘ডাক্তার কি বলল?’
‘বলল বড় ধরনের ভাইরাল ফিভার হতে পারে। অথবা অন্য কিছুও। আজকের রাতটা না গেলে বোঝা যাবে না।’
‘রাতে কি তোর সাথে থাকবো?’
‘নারে দোস্ত। তুই বরং বাসায় থাক। ইব্রাহিমকে পাঠিয়ে দিস।’
জামানকে বিদায় দিতে নিচে নেমে এলো হাসান। জরুরি কয়েকটা ফোন করা দরকার। এই বিপদের সময় আত্মীয়দের পাশে দরকার। সিঁড়ির ঠিক উল্টোদিকে কোণায় একটা চমৎকার ক্যাফেটেরিয়া। হাসান ঢুকে একা একা একটা কফি অর্ডার করলো। সিগারেট খাবার সুবিধা থাকলে অব্শ্য ভালো হতো। হাসান কফি খেতে খেতে ফোন করলো ছোট খালাকে। ছোট খালার মেয়ে পরী ধরলো ফোন। পরীর ডিভোর্স হয়ে গেছে সম্প্রতি। এ সবই শোনা কথা। রিমিই বলেছিলো তাকে। পরীর গলা বেশ ভারি।
‘আরে হাসান ভাই? এতদিন পরে মনে পড়লো আমাদের।’
‘আসলে ঠিক তা নয় পরী! শোভন খুব অসুস্থ। স্কয়ারে ভর্তি করেছি। তাই তোমাদের ফোন করেছি।’
‘বলেন কী? কই রিমিতো কিছু জানায়নি?’
‘রিমি তো নেই পরী।’
‘মানে?’
‘ও তো চলে গেছে আরেকজনের সাথে।’
পরী আর কথা বাড়ালো না। শুধু বললো, ‘ফোন রাখছি হাসান ভাই। আমি আর মা আসছি। এক্ষুণি।’
হাসান এতো কষ্টের ভেতরও খানিকটা স্বস্তি বোধ করে। ইব্রাহিম মিয়া স্কয়ারে ঢুকেছে পাঞ্জাবি-পাজামা আর টুপি পরে। হাসান বললো, ‘কি, এই ড্রেস পরেছো কেনো ইব্রাহিম মিয়া?’
ইব্রাহিম মিয়া গম্ভীর। ‘পাক-পবিত্র হয়া আসলাম ভাইজান। সারা রাত বাপজানের জন্য দোয়া হবে। সোলায়মান চাচা আসতেছে। পথে আছে।’
হাসান আনন্দিত হয়। ‘ঠিক আছে, ফোন করবো বাবাকে।’
হাসান ইব্রাহিম মিয়াকে নিয়ে উপরে উঠতেই একজন ছুটে আসে, ‘আপনি হাসান সাহেব? আপনার পেসেন্ট ১২০১ এর?’
‘জ্বি, আমার ছেলে শোভন।’
‘আপনার একটা গুড নিউজ আছে।’
‘কি?’
‘আপনার বাচ্চার জ্ঞান ফিরেছে। সে বাবাকে দেখতে চাচ্ছে।’
‘জ্বর কমেছে?’
‘জ্বি, সারপ্রাইজিংলি এখন ওর কোন জ্বর নেই।’
হাসান আর ইব্রাহিম মিয়া দৌড়ে ওর কেবিনে যায়। শোভন বাবাকে দেখে একটা হাত বাড়িয়ে দেয়। হেসে বলে, ‘মা আর কখনো আসবে না বাবা?’
হাসান চুপ করে থাকে।
‘আমি বুঝতে পেরেছি। আমাকে সত্যিটা বলো বাবা।’
‘না, আসবে না।’
‘নো প্রবলেম বাবা। তুমি আবার আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো!’
‘না, কখনোই না বাবা।’
‘থ্যাংক ইউ বাবা। আই রিয়েলি লাভ ইউ বাবা। এখন একটা রিকোয়েস্ট করবো তোমাকে।’
‘কী বাবা?’
‘আমাকে এই রাতেই রিলিজ করে বাসায় নিয়ে চলো। আমি এক্ষণি বাসায় যেতে চাই।’
হাসানের মনটা অনেকদিন পর কীরকম আনন্দে ভরে ওঠে। সে হেসে বলে, ‘ডোন্ট ওরি বাবা। এখনও আটটা বাজেনি। লেট মি ট্রাই।’
হাসান দৌড়ে রিলিজ রুমে এলো। ভদ্রলোক বেশ বিনয়ী। পুরো প্রসেস শেষ করলেন কয়েক মিনিটে। তারপর একটা কাগজ হাতে দিয়ে বলেন, আপনি এখন যেতে পারেন স্যার! হাসান প্রায় হাসতে হাসতে শোভনের কেবিনে ঢোকে।
বারো.
সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাসান বললো, ‘বাবা আপনার সাথে আমার সিরিয়াস কিছু আলোচনা আছে।’
সোলায়মান মিয়া কৌতূহলী হয়ে তাকান। হেসে বলেন, ‘বলো।’
‘বাবা, আমি যদি আবার নতুন করে শুরু করতে চাই সবকিছু?’
‘কীরকম?’
‘আমি আমাদের গ্রামে ফিরে গিয়ে এন্টারপ্রেনারশিপ করতে চাই। দু’টো দীঘিতে মাছ চাষ করতে চাই। একটা ক্যাটল ফার্ম করতে চাই। গ্রামে ইন্টারনেট আনবো। তরুণ ছেলেদেরকে নতুনভাবে তৈরি করবো। মজিদ স্যারের লাইব্রেরিটাকে আরো আধুনিক করে তুলবো। শোভন অবশ্য এখানেই পড়বে। তবে সময় পেলে সে-ও এসে আমাদের সাথে যোগ দেবে।’
সোলায়মান মিয়া যেন স্বপ্ন দেখছেন। তিনি কথাগুলো শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন। হেসে বললেন, ‘শিওর বাবা, আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না!’
‘কোন নয় বাবা!’
‘আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।’ বাবা চুপ করে হাসেন।
সকালটা তখন ঝলমল করছিলো। চারদিকে ফুরফুরে হাওয়া। দু’টো ধানশালিক জানালার কার্নিশে খাবার খাচ্ছে। দূর থেকে উড়ে আসছে একঝাঁক নীল রঙের রোদ। সেই অসাধারণ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে নিজের ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছিলো হাসান।
এসইউ/জেআইএম