ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

নজরুল : এক বিপুল বিস্ময়

সাদাত হোসাইন | প্রকাশিত: ০৬:০৬ এএম, ২৫ মে ২০১৭

নজরুলের সঙ্গে আমার পরিচয় একটু বিব্রতকরভাবে। নজরুল আমাদের সহপাঠী। আমরা কেউ নজরুলের সঙ্গে কথা বলি না। প্রাণন্তকর প্রচেষ্টা থাকে নজরুলকে এড়িয়ে চলার। নজরুলের নাম শুনলেই আম্মা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন। আমরাও আতঙ্কিত হয়ে উঠি। দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির বাংলা শিক্ষক মোজাম্মেল স্যার ক্লাসে এসে একদিন বললেন, ‘আইজকা তোগো নজরুল ইসলামের কথা হুনামু’। আমরা এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি, ‘ছারে এইগুলান কী কয়? নজরুইল্যারে কয় নজরুল ইসলাম?’

মোজাম্মেল স্যার নজরুল ইসলামের গল্প শোনালেন— নজরুল ইসলামের প্রথম পরিচয় সে মুসলমান, সে বিশ্বসেরা কবি, কিন্তু হিন্দুকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ষড়যন্ত্র করে তাকে কী এক ফল খাইয়েছেন, সেই ফল খাওয়ার পর থেকে নজরুলের মাথা আউলা। সে হয়ে গেল পাগল। ফলে সে আর নোবেল প্রাইজ পেতে পারল না, পেল রবীন্দ্রনাথ। এই ঘটনা না হলে নজরুল থাকতেন আজ বিশ্বকবি। মুসলমানদের গর্ব। বিশ্বের গর্ব। (সেকালে গাঁও-গ্রামে অশিক্ষিত মুসলিম সমাজে এই মিথ খুব প্রচলিত ছিল।

এই গল্প শুনে প্রথম আমরা আমাদের নজরুইল্যার প্রতি সত্যিকারের আগ্রহ এবং সমীহ বোধ করলাম। নজরুল কী একসময় বিরাট বড় কবি হবে না কি! আমরা আড়চোখে নজরুলকে দেখি। তার গালি-কাব্য মনোযোগ দিয়ে শুনি। কে জানে, কি বিরল প্রতিভা তার নামে, তার গালি-কাব্যে লুকিয়ে আছে!

তবে নজরুলের গালি-কাব্য প্রতিভা বিকশিত হল না। কী এক কারণে নজরুল আমূল বদলে গেল। সপ্তাহখানেক পর স্কুলে এসে কাউকে সামনে দেখলে মাথা নিচু করে কোমল কণ্ঠে বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম’। আমাদের খুশি হবার বদলে যেন মন খারাপ হয়ে গেল। মনে হল, একটা উদ্দাম, উত্তাল, ঝঞ্ঝা সমুদ্রকে হঠাৎ পুকুর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার নজরুলের জন্য মন খারাপ হতে লাগল। খুব মন খারাপ হতে লাগল।

নজরুলের সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার পরিচয় হল ক্লাস নাইনে। এ অন্য নজরুল, কাজী নজরুল ইসলাম। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে এক স্যার ডায়াসে গিয়ে দাঁড়ালেন। কবিতা আবৃত্তি করবেন, কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী’। নজরুল সম্পর্কে আমার তখন কোন আগ্রহ নেই। আমি বিভিন্ন ক্লাসে তার কবিতা পড়েছি, কিছুই আমাকে টানেনি। আগ্রহ জন্মায়নি। কিন্তু স্যারের কণ্ঠনালী টানটান করে আবৃত্তি করা ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনে আমার দমবন্ধ হয়ে এল, রক্ত ছলকে উঠল। কী বুনো, কী উদ্দাম, কী উত্তাল! আমি সপ্তাহখানেকের মাথায় বিদ্রোহী কবিতা মুখস্ত করে ফেললাম। কেউ জিজ্ঞেস করুক আর না করুক, আমি হড়হড় করে কবিতা শোনাতে থাকি, ‘বল বীর, বল চির উন্নত মম শির... আমি চির দুর্বিনীত, নৃশংস, আমি মহাপ্রলয়ের নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর...’

আমি তখন লুকিয়ে-চুড়িয়ে কবিতা লিখি। নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করি স্কুলে। একদিন কবিতা আবৃত্তির ডায়াসের তলায় দাঁড়িয়ে (সাইজ ছোট থাকায়, ডায়াসের উপর থেকে আমাকে দেখা যেত না) আমি আবৃত্তি করতে থাকলাম আমার নতুন কবিতা, কবিতার নাম ‘মহাবিদ্রোহী’।

আমি নজরুলকে একধাপ পেছনে ফেলে ‘বিদ্রোহী’ থেকে ‘মহাবিদ্রোহী’ কবিতা লিখে ফেলেছি! আমি ডায়াসে গিয়ে বললাম, ‘আমি একটি কবিতা আবৃত্তি করব, কবিতার নাম ‘মহাবিদ্রোহী’, লিখেছেন সাদাত হোসাইন!’ সেই কবিতা নিয়ে হাসাহাসি যেমন হল, দু’চারজন পিঠ চাপড়েও দিল। তবে নজরুল তখনও আমার কাছে ওই এক কবিতার কবি। এর বাইরের নজরুল আমার কাছে অচেনা। অজানা।

নজরুলের সঙ্গে আমার তৃতীয়বার এবং সত্যিকারের পরিচয় ঘটল ইন্টারমিডিয়েটে। কী এক প্রতিযোগিতায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে রচনা লিখতে হবে। আমি গাদাগাদা বই নিয়ে বসলাম, নোট নিয়ে বসলাম। গল্প, কবিতা, গান নিয়ে বসলাম। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ‘বিদ্রোহী’ লেখা সেই মানুষটা কী অদ্ভুত ক্লান্ত অভিমানে লিখেছেন—
‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে।
বুঝবে সেদিন বুঝবে...’
আবার সেই নজরুলই বললেন, ‘নব জীবনের গাহিয়া গান, সজীব করিব মহাশ্মশান’।

নজরুল লিখলেন, ‘আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ।’ আবার একে একে লিখলেন—
১. করিও ক্ষমা হে খোদা আমি গোনাহগার অসহায়।
২. ইয়া আল্লাহ, তোমার দয়া কত, তাই দেখাবে বলে রোজ-হাশরে দেখা দেবে বিচার করার স্থলে।
৩. দীন-ভিখারী বলে আমি ভিক্ষা যখন চাইবো স্বামী, শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে পারবে নাকো আর।
৪. আল্লাহ নামের নায়ে চড়ি যাব মদিনায়/ মোহাম্মদের নাম হবে মোর/ ও ভাই নদী পথে পূবাল বায়।।/ চার ইয়ারের নাম হবে- মোর সেই তরণীর দাঁড়/ কলমা শাহাদাতের বাণী হাল ধরিবে তাঁর।/ খোদার শত নামের গুণ টানিব/ ও ভাই নাও যদি না যেতে চায়।
৫. কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা/ দাড়ি মুখে সারি গান লা-শরিক আল্লাহ।

আবার নজরুলই লিখেছেন—
• মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়/ এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
• মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
• মানুষেরে ঘৃণা করি/ ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি, মরি,/ ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে/ যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব সেই মানুষেরে মেরে/ পূঁজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মুর্খরা সব শোনো/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন।

আবার তিনিই বললেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’ কী দোর্দণ্ড প্রতাপে এই নজরুল ব্রিটিশদের বলেছেন, ‘এদেশ ছাড়বি কি না বল, নইলে তোদের কিলের চোটে হাড় করিব জল।’ আবার কি প্রবল প্রেমে বলেছেন, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেব খোঁপায় তারার ফুল’। আবার সেই নজরুল বললেন, ‘মহা প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস আমি ভেঙে করি সব চুরমার’। সাম্রাজ্যবাদ ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে তিনি বলেন, ‘তোদের চক্ষু যতই রক্ত হবে মোদের চক্ষু ততই ফুটবে’।

নজরুল লিখেছেন, ‘শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল, এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল’। আবার কী অদ্ভুত বিষণ্ণতার রাগে সেই মানুষটিই বলেন, ‘এক জ্বালা এক ব্যথা নিয়া/ তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি কাঁদে মোর প্রিয়া’। আবার ফিরে আসেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নূন,/ বেলা বয়ে যায়, খায়নিক বাছা, পেটে তার জ্বলে আগুন’। কী ঔদ্ধত্যে বলেন, ‘রক্তে আমার লেগেছে আবার সর্বনাশের নেশা/ রুধির-নদীর পার হতে ঐ ডাকে বিপ্লব-হ্রেষা।/ প্রেমও আছে সখা, যুদ্ধও আছে, বিশ্ব এমন ঠাঁই/ কারুর পা চেটে মরিব না,/ …মরিব যেদিন মরিব বীরের বেশে/ আমার মৃত্যু লিখিবে আমার/ জীবনের ইতিহাস।’

আবার এই নজরুল কী হাহাকার নিয়ে বলেন, ‘থেমে গেছে রজনীর গীত কোলাহল, ওরে মোর সাথী আঁখি জল, এইবার তুই নেমে আয় অতন্দ্র এই নয়ন পাতায়’। অথবা ‘বিদায় হে মোর বাতায়ন পাশে নিশীথ জাগার সাথী,/ ওগো বন্ধুরা পান্ডুর হয়ে এল বিদায়ের রাতি।/ গুবাক বৃক্ষের দেহের মতই দীঘল প্রিয়ার কুণ্ঠিত বাণী গুবাক পত্রের হাওয়া,/ প্রিয়ার অঙ্গুলির মতই নিবিড় আদর পাওয়া’। কী অদ্ভুত উচ্চারণ, ‘হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা/ আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না’।

আমার হঠাৎ মনে হল, নজরুল কী ছিলেন? নজরুল যেন আমার উত্তর দিতেই লিখলেন— ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য!’ নজরুল, আমার বুকের ভেতরটা নাড়িয়ে দিলেন সমূলে। এ যেন অতল আদিগন্ত এক সমুদ্র, শান্ত, সুন্দর, সৌম্য, উত্তাল, ঝঞ্ঝা, মৃত্যু। আমি অপার মুগ্ধতায় নজরুলকে চিনলাম। আকাশের মত, খুব চেনা, অথচ সবচেয়ে বেশি অচেনা। ছোট্ট, এই ছোট্ট এক মানবজীবনের সাধ্য কি তাকে চেনে! কী অভিমান, টলমল বুক, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব/ তবু আমারে দেবো না ভুলিতে।’

নজরুলের সঙ্গে আমার এই পরিচয়, আমাকে হঠাৎ নিয়ে গেল আবার সেই ছেলেবেলার নজরুলের কাছে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে তার কবিতা পড়েছিলাম, ‘ভোর হল দোর খোল খুকুমণি ওঠোরে...’। আমাদের নজরুল এই কবিতায় ভয়ংকর সব শব্দ বসিয়ে গালি দিত। শেষের দিকের লাইন ‘আলসে নয় সে’কে সে বলত ‘আটসের নয়সের’... বাকিটা আর না বলি।

সেই আমি ক্লাসের পর ক্লাস পার করেছি, কিন্তু নজরুলের কবিতা বুঝিনি। আমি যেন এক দুর্বোধ্য লেখার দেয়াল টপকাতে না পেরে তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেছি সন্তর্পণে, অবহেলায়, উপেক্ষায়— সেই আমি, সেই দিনের সেই গভীর রাতে, অজস্র বই, পত্র, খাতার ভেতর তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। আমার চোখের ভেতর ভেসে উঠল ছেলেবেলার বইয়ের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। লেখার পর লেখা— সেই লেখার ভেতর থেকে, সেইদিন আমার চোখ আঁটকে গেল শৈশবের এক কবিতার লাইনে—
‘আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে মাগো, রাত পোহাবে তবে’

আমার কী হল জানি না, সারা শরীরজুড়ে যেন এক অদ্ভুত বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেল। মাত্র দু’টি লাইন, দু’টি লাইন— যেন এক জনমের সকল ভাবনা, সকল দর্শন, ক্লাস টু-থ্রির সেই পাঠ্যবইয়ের কবিতায়, যেন একজনমের সকল যুদ্ধ, সকল শঙ্কা, সংস্কার, দ্বিধা, হতাশা, বিষণ্ণতার কফিনে সজোরে পেরেক ঠুকে দেওয়া এক বিস্ময়কর মন্ত্র! আর সবকিছু ম্লান হয়ে মাত্র এই দু’টি লাইন, এই দু’টিমাত্র লাইন যেন নজরুলের সাথে শেষবারের মতন আমায় পরিচয় করিয়ে দিল—
‘আজন্মের অবিচ্ছেদ্য পরিচয়। জীবন, ভুবন ও ভাবনার পরিচয়।’

এসইউ/পিআর

আরও পড়ুন