বৃক্ষ জানে না মাটির কষ্ট
ছোট্ট একটা দুর্বল চারা। কোত্থেকে যেন উড়ে এসে পড়ল বাগানটায়। ভেজা মাটির খুব মায়া হল ওর জন্য।
মাটি বললো, ‘আহারে বেচারা, বাতাস তোমার এ কী হাল করেছে!’
আকুপাকু করে বেচারা বলল, ‘আমাকে খানিকটা জায়গা দে না রে মাটি।’
মাটি ভাবল, এইটুকুন একটা গাছ। কতখানি জায়গাই বা লাগবে ওর! এই ভেবে চারাটাকে আঁকড়ে ধরল মাটি। দো-আঁশ মাটির আশ্রয় পেয়ে বেঁচে গেল কঁচি গাছটা।
গ্রীষ্ম যায়, বর্ষা আসে। শরৎ গিয়ে আসে হেমন্ত। এভাবে কত ঋতু যায় আসে। যায় কত মাস-বছর। কে তার হিসেব রাখে? চারাগাছ এখন সতেজ সাবালক। মৃত্তিকার অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়ে কেমন লকলক করে বেড়ে উঠছে! এভাবেই বাড়তে বাড়তে একদিন এক শক্ত সামর্থ্য পুরুষ হয়ে উঠল সেদিনের সেই দুর্বল চারাগাছটা। তার এখন কত শাখা-প্রশাখা। বড় বড় ঘন সবুজ পাতায় ছেয়ে আছে সেইসব ডালপালা।
এখন আর বাতাস তাকে উড়িয়ে নেওয়ার সাহস পায় না। বরং ও-ই এখন দুরন্ত বাতাসকে নিয়ে মজা করে-
‘কী হে দস্যি বাতাস, লাগবি আমার সঙ্গে? দেখি তোমার কত শক্তি!’
সঙ্গে সঙ্গে নুইয়ে পড়ে বাতাস বলে, ‘না ভাই, যেতে দাও আমাকে। তোমার মত শক্তিমানের সঙ্গে লাগা কি আমার কাজ!’
আজকাল সূর্যালোকও বুঝি ওকে সমীহ করে চলে। কঁচি পাতাগুলোর ওপর রশ্মি ফেলেই চলে যায়। বেশি গভীরে প্রবেশের সাহস করে না। এদিকে বাগানের সমস্ত মাটিই সে গ্রাস করে নিয়েছে। ছোটখাট যেসব ফুল-ফলান্তির গাছ ছিল; সেগুলো ওর দস্যিপনা সইতে না পেরে মরে বেঁচেছে। তারপরও ওর আগ্রাসন বন্ধ হয় না। ক্রমাগত বেড়েই চলে।
সে যত বিস্তারিত হয়; ততই মাটির গভীর থেকে গভীরে প্রোথিত হতে থাকে তার শেঁকড়-বাকড়। তাই বুঝি, দিনে দিনে মাটির কষ্ট কেবল বেড়েই চলে। সে বলে, ‘থাম না বাপু। আর কত বাড়বি তুই? আমার যে বড় কষ্ট হয় রে।’ মাটির কথা শুনে বড্ড রাগ হয় বৃক্ষের। ভাবে, এই মাটি যত নষ্টের গোড়া। ওর জন্যই আমার আকাশে পৌঁছানো হচ্ছে না।
আরো কিছুদিন যায়। আরো বেশ খানিক বাড়ে গাছটা। এখন সে একটা মহীরুহের আকার নিয়েছে। ওর গা থেকে নেমে আসা ঝুড়িগুলোও প্রবেশ করেছে মাটির অভ্যন্তরে। তাই বিরক্ত হয়ে মাটি বলে, ‘আর কত উঠতে চাস তুই? আমি যে তোর ভার আর বইতে পারছি না। এবার আমাকে রেহাই দে।’
মাটির কথা শুনে রেগে যায় বৃক্ষ। ‘আকাশ ছুঁতে চাই আমি। কিন্তু তুমি আমায় আঁকড়ে ধরে আছো বলেই অতখানি উঁচুতে উঠতে পারছি না। তুমি কি জানো, নীল আকাশটা কোথায়? ওর দিকে চোখ তুলে তাকানোর ক্ষমতাও তো নেই তোমার।’
‘তাই! তাহলে এবার তোকে দিলাম ছেড়ে। যেখানে খুশি সেখানে যা।’ এই বলে মাটি তার বাঁধন দিলো আলগা করে।
ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে লাগলো বৃক্ষের পাতারা। দু’একটা শুকনো পাতা উড়ে যেতে লাগলো এদিক-সেদিক। কিন্তু বোকা বৃক্ষ তা টেরই পেল না। কিন্তু অনেকদিন ধরে এই অপেক্ষাতেই ছিল বাতাস। সেইদিন সে ঝড় হয়ে উড়ে এলো এবং সমূলে উপড়ে ফেললো অহংকারী গাছটাকে। অনেকদিন পর আরামে শ্বাস নিল মাটি।
এসইউ/জেআইএম