নজরুলের কবিতা-গানে আধ্যাত্মিকতা
হাবিব মোস্তফা
বাঙালি জাতির হাজার বছরের আধ্যাত্মিক ও অসাম্প্রদায়িক জীবন চেতনার মূর্ত প্রতীক হিসেবে অল্প ক’টি মুখশ্রী আমাদের চোখে ভেসে ওঠে– মধ্যযুগে চন্ডীদাস। তারপর লালন। তারপর? অবশ্যই নজরুল এবং কেবল নজরুল।
সাহিত্যের বিবিধ শাখায় সফল বিচরণ করলেও নজরুল সাহিত্যের যে দু’টি দিক তাঁকে অনন্য মাত্রায় উন্নীত করে, তা হলো তাঁর কবিতা ও গানে আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা– সুফিবাদে যার মহত্তম বিকাশ সাধিত হয়েছে। সুফিতত্ত্বের মূল বাণী হচ্ছে আত্মপরিচয় জানার মধ্য দিয়ে নিজের সবকিছু সৃষ্টির কল্যাণে বিলিয়ে দিয়ে সৃষ্টিকর্তার চির অস্তিত্বশীল অস্তিত্বের সাথে নিজেকে ফানা বা বিলীন করে দেওয়া, যেখানে আমিত্বের কোন অস্তিত্ব থাকে না, থাকে না বহুত্বের ধারণা, কিংবা খণ্ডের উপস্থিতি। সব মিলে এক অখণ্ড অস্তিত্ব। সবকিছুই এক সৃষ্টিকর্তার পরিবারভুক্ত। সব ধর্মেই তাগিদ রয়েছে আত্মপরিচয় জানার। হাদিসে বলা হয়েছে- ‘যে নিজের পরিচয় চিনেছে, সে তার সৃষ্টিকর্তাকে চিনেছে’। বেদে বলা হয়েছে- ‘আত্মানং বিদ্ধি’ অর্থাৎ নিজেকে জানতে পারলে সব জানা যায়।
নিজের ভেতরের দ্বৈতসত্তার দ্বন্দ্বের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে ভাবার আগে জানতে হবে আত্মপরিচয়। এককথায়, নিজ আরশিতে নিজেকে দেখা। চর্মচক্ষু বন্ধ হলে হয় হৃদয় চক্ষুর উন্মোচন। নজরুল আত্মপরিচয় জানতে পেরেছিলেন। নিজেকে চিনতে পারার অপার আনন্দে উদ্বেলিত, উন্মাদ কবি উচ্চারণ করেছিলেন–
‘এ কি উন্মাদ! আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি,
আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’
না, নজরুল সহসা নিজেকে চেনেননি। নীরব গোপন গহন প্রস্তুতি ছিল শৈশব থেকেই। পারিবারিক আবহের মধ্যেই ছিল ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা। কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ হঠাৎ কোন নাম না জানা সাধু-সন্ন্যাসী ফকির-দরবেশের সঙ্গে বেরিয়ে যেতেন বালক নজরুল। ফিরতেন বহু দিন পর। সেই সাধুসঙ্গ বৃথা যায়নি। লেটু দলে যে গান লিখেছেন, প্রতিপক্ষকে জর্জরিত করেছেন বাক্যবাণে, সেখানেও তার ঐশী প্রেমের বিচ্ছুরণ, দেহতাত্ত্বিক ভাবনার উদ্ভাসন:
‘নয়টা নালা আছে তাহার
ওযুর পানি সিয়াত যাহার
ফল পাবি নানা প্রকার
ফসল জন্মিবে তাহাতে।।
যদি ভাল হয় হে জমি
হজ্ব জাকাত লাগাও তুমি,
আরো সুখে থাকবে তুমি
কয় নজরুল ইসলামেতে।’
আশেকের প্রেমের খনি পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে: প্রতিটি বস্তু আল্লাহর প্রশংসায় তসবীহ পাঠ করে। মহাকবি শেখ সাদী বলেছেন: ‘গাছের একটি সবুজ পাতায় জ্ঞানীর চোখে হাজার রহস্যে ঘেরা।’ নজরুল অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করেছেন– জগৎ সংসারের সবকিছু বিধাতার প্রিয় নামের জপে ব্যস্ত। গাছ-পালা, নদী-নালা, পশু-পাখি সবাই আল্লাহর মধুর নাম জপছে, সবকিছু তারই রূপে রূপময়:
‘ফুলে পুছিনু, ‘বল, বল ওরে ফুল!
কোথা পেলি এ সুরভি, রূপ এ অতুল?
‘যার রূপে উজালা দুনিয়া’, কহে গুল
‘দিল সেই মোরে এই রূপ এই খোশ্বু।
আল্লাহু আল্লাহু/
ওরে রবি-শশী, ওরে গ্রহ-তারা
কোথা পেলি এ রওশন জ্যোতি ধারা?
কহে, আমরা তাহারই রূপের ইশারা
মুসা, বেহুঁশ হলো হেরি, যে খুব্রু
আল্লাহু আল্লাহু/’
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে কবি নজরুল বলেছিলেন:
‘আপনাদের কাছে আজ অজানা নেই যে ঘরে বাইরে, সভায় বা সমাধির গোপন গুহায় কোথাও আমার পতিত্ব করার ইচ্ছা বা সাধ আমার নেই। যিনি সকল কর্মের, সকল ধর্মের, জাতির, দেশের, জগতের একমাত্র পরম স্বামী– পতিত্ব বা নেতৃত্ব করার একমাত্র অধিকার তাঁর। ...অসুন্দরের সাধনা আমার নয়, আল্লাহ আমার পরম সুন্দর। তিনি আমার কাছে নিত্য প্রিয়-ঘন সুন্দর, প্রেম-ঘন সুন্দর, রস-ঘন সুন্দর, আনন্দ-ঘন সুন্দর। আপনাদের আহ্বানে যখন কর্মজগতের ভিড়ে নেমে আসি, তখন আমার পরম সুন্দরের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হই, আমার অন্তরে বাহিরে দুলে উঠে অসীম রোদন। আমি তাঁর বিরহ এক মুহূর্তের জন্যও সইতে পারি না। আমার সর্ব অস্তিত্ব জীবন-মরণ-কর্ম, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ যে তারই নামে শপথ করে তাকে নিবেদন করেছি। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই, আমার ক্ষমা-সুন্দর প্রিয়তম আমার আমিত্বকে গ্রহণ করেছেন।’
মানব প্রেম থেকে ঐশী প্রেমে উত্তরণের মাঝখানে অনেক চড়াই-উৎরাই, দহন-সহন থাকে। আমরা জানি, একের পর এক হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়িয়েছেন কবি, কোনটাই টেকেনি। প্রমীলাকে বিয়ে-সংসারে স্থিত হলেও কবির বৈরাগী মন কিন্তু তখনও অস্থির। বার বার তাঁর মনে হয়েছে: ‘...আরও বেশি ভালো কেহ বাসিছে গোপনে’। কে সে? কবি কি পরমের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন মনের গহনে– যে ডাকে মনোমোহন গেয়েছিলেন– ‘মন মাঝে যেন কার ডাক শোনা যায়’? সেই মায়াময় ডাকেই ভরা পূর্ণিমায় রাজপুত্র সিদ্ধার্থ হলেন গৃহত্যাগী? চৈতন্যদেব ছেঁড়ে গেলেন বিষ্ণুপ্রিয়ার বাহুডোর? রঙ্গরসে মত্ত হাসন রাজা হলেন বাউলা? দেহ থেকে দেহাতীত ভালোবাসায় উত্তরণের সেই অব্যক্ত অনুভূতির কথাই লিখেছেন নজরুল তাঁর গানে–
‘লায়লী! লায়লী! ভাঙিয়ো না ধ্যান মজনুঁর এ মিনতি
লায়লী কোথায় আমি শুধু দেখি লা এলা’র জ্যোতি।
পাথর খুঁজিয়া ফিরিয়াছি প্রিয়া প্রেম-দরিয়ার কূলে,
খোদার প্রেমের পরশ-মানিক পেলাম কখন ভুলে।
...
মজনুঁরে ও যে লায়লী ভোলায় সে যে কত সুন্দর
বুঝিবে লায়লী যদি তুমি তারে নেহার এক নজর
সাধ মিটিবে না হেথা ভালোবেসে
চল চল প্রিয়া লা এলা’র দেশে
নিত্য মিলনে ভুলিব আমরা এই বিরহের ক্ষতি।’
প্রথাসিদ্ধ ধর্মকর্মে নজরুল হয়তো নিষ্ঠাবান ছিলেন না। তাই বলে এ সম্পর্কে তার কোন তাচ্ছিল্যও ছিল না, বরং আক্ষেপ ছিল নিজের গাফিলতির জন্য যার পরিচয় রয়ে গেছে তাঁর বহু কবিতায়, বিশেষত গানে–
‘হে নামাজী! আমার ঘরে নামাজ পড় আজ
দিলাম তোমার চরণ-তলে হৃদয় জায়নামাজ।
আমি গুনাহ্গার বে-খবর
নামাজ পড়ার নাই অবসর
তব, চরণ-ছোঁওয়ার এই পাপীরে কর সরফরাজ।’
অন্য এক গানে বলেছেন:
‘ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর
তখনো জাগিনি যখন জোহর
হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর–
মাগরিবের আজ শুনি আজান
জমাত-সামিল হও রে এশাতে
এখনো জমাতে আছে স্থান।’
আত্মবিস্মৃত মুসলিম জাতিকে (এবং সাথে সাথে নিজেকেও) কবি বলছেন, ফজর-জোহর-আসর-মাগরিব; সব গেছে হেলায় ফেলায়। এশার নামাজও শুরু হয়ে গেছে। দৌড়াও, শেষ কাতারে এখনও দাঁড়াবার স্থানটুকু অবশিষ্ট আছে, শামিল হও!
জীবনের সবকিছু কবি সৃষ্টিকর্তার ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন। এমন দিনও গেছে বাজার খরচের টাকাও তার হাতে ছিল না, ঘরে অসুস্থ স্ত্রী; ওষুধ কিনবেন কী করে? কবি ভেঙে পড়েননি। দয়াময়ের প্রতি ছিল না তার কোন অভিযোগ। তিনি দয়াময়ের দেওয়া ‘কণ্টক মুকুট শোভা’ সানন্দে গ্রহণ করলেন। নিজেকে প্রবোধ দিয়েছেন এই বলে–
‘আহার দিবেন তিনি ও মন জীব দিয়েছেন যিনি
তোরে সৃষ্টি করে তোর কাছে যে আছেন তিনি ঋণী।’
অসহায় দাসত্ব নয়; সর্বপ্লাবি প্রেমের অঞ্জলি নিয়ে মাশুকের দরজায় টোকা দিতে হয়। অনিবার্য গঞ্জনা মেনে নিয়েই নামতে হয় অভিসারের পথে। মাশুক খোলা চুল পছন্দ করে, নাকি বেণী? চোখে কাজল দেব, কি দেব না– তা আগে থেকেই জানা প্রয়োজন। মাটির মানুষের সাথে তার সম্পর্ক কী? অযুত কোটি ফেরেশতার স্তব-স্তুতিতে তার মন ভরলো না? প্রেমের সম্বন্ধ পাতাতে হলো মাটির মানুষের সাথেই? সৃষ্টির কাছে তার প্রত্যাশা মূলত কী? জানতে হবে।
এসব প্রশ্নের উত্তর জানাতে গিয়ে তৈরি হয়েছে নানা পথ, নানা মত। যুগে যুগে সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে মানবমনে চলে আসছে নানা জল্পনা-কল্পনা, গবেষণা। কেউ আকারের মধ্যে নিরাকারকে ধরতে চেয়েছেন, কেউ সাকারের মধ্যে নিরাকারকে পেতে চেয়েছেন। কিন্তু আধ্যাত্মিক সাধকেরা নিজের মধ্যে সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পান। মানবদেহকেই মনে করেন আল্লাহর আবাসস্থল। সারা বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের কোথাও সৃষ্টিকর্তা স্থিত হতে পারেন না, শুধু মানব হৃদয়েই তার সংকুলান। তিনি পরম সৌন্দর্যময়, প্রেমময়। তিনি সপ্ত আকাশ পৃথিবীর আলো।
নজরুল সাধক এবং প্রেমিক। কবির অন্বেষণ পরমাত্মার অন্বেষণ। যুগে যুগে যে অন্বেষণ অগণিত পয়গম্বর, সুফি দরবেশ, মরমী সাধকের– নজরুল সেই পথেরই মুসাফির। তবে এত কাছে যার বসবাস, বাড়ির কাছে থাকে যে পড়শী, তাকে কেন খুঁজতে হবে দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথিকঙ্কালে? কবি বলেন–
‘মসজিদ এই, মন্দির এই, গীর্জা এ হৃদয়
এখানে এসে ঈসা, মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
...
এই কন্দরে আরব দুলাল শুনিতেন আহ্বান
এইখানে বসে গাহিলেন তিনি কোরানের সাম্যগান।
মিথ্যা শুনিনি ভাই
এ হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন কাবা মন্দির নাই।’
মানুষের গড়া মসজিদ-মন্দির, আর স্রষ্টার নিজ হাতে গড়া হৃদয়কাবা। কোনখানে তাঁর বাস? সুফি সাধনায় ভক্ত ও স্রষ্টা পরস্পরের সামনে দাঁড়িয়ে যান প্রেমিক-প্রেমিকার ভূমিকায়। সুরা-সাকি-পেয়ালা সব সেখানে একাকার। দৃশ্য-দৃষ্টা-দৃশ্যপট... আলাদা করে সাধ্য কার! সাধারণ ধার্মিকের ঈশ্বর থাকেন সাত আকাশের দূরত্বে, ভক্তের ঈশ্বর তাঁর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। শিল্পী তার শিল্পকর্ম সম্পন্ন করে যেভাবে তার দিকে অপলক চেয়ে থাকে, তেমনই নিজের সর্বোত্তম অবয়ব মানুষের মধ্যে রূপায়িত করে স্রষ্টাও অপলক তাকিয়ে থাকেন তার প্রিয় সৃষ্টির দিকে। নজরুল বলেন:
‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
তারে খুঁজি আমি আপনায়।
আমি শুনি যেন তাঁর চরণের ধ্বনি
আমারই তিয়াসী বাসনায়।।
...
আমারই রচিত কাননে বসিয়া
পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া
সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া
আপনারই গলে দোলে হায়।।’
স্বপ্নরাজ্যে যে মালা আমি পরালাম প্রিয়তমের গলায়, জেগে দেখি সে মালা আমার গলাতেই শোভা পাচ্ছে! তাহলে আমি কে, তুমি কে? ক্ষুব্ধ মুগ্ধ প্রেমিক সাধক মনোমোহন দত্ত তাই গেয়ে ওঠেন:
‘আমি-তুমি মাঝে
তফাত কিবা আছে
রফা করে দাও একেবারে।।’
কীভাবে হবে এ রফা? কীভাবে হবে আত্মদর্শন? তিনি বিশ্বব্যাপী বিরাজিত। এই বিশ্বাসে মন তো ভরে না। চোখের তৃষ্ণা যে বাড়তেই থাকে। ব্যাকুল কবি আকুল কণ্ঠে তাই জানতে চান:
‘আমার মাঝারে তুমি যদি রহো
তবে কেন এই অসীম বিরহ
বুকে কেন বাজে নিবিড় বেদনা
মনে হয় তুমি নাই।।’
এ বড় কঠিন অভিমান– ‘মনে হয় তুমি নাই!’ তুমি যদি থেকেই থাকো, তাহলে তোমায় দেখতে পাই না কেন? সবকিছু দেখার জন্য চোখ দিয়েছো আমাকে, সেই চোখ কেন তোমাকে দেখার সুখ থেকে বঞ্চিত? কবির ভাষায়–
‘ওগো সুন্দর, যদি নাহি দেবে ধরা
কেন প্রেম দিলে বেদনায় ভরা
রূপের লাগিয়া কেন কাঁদে প্রাণ
রূপ যদি তব নাই।।’
নজরুল কি দেখতে পেয়েছিলেন সেই রূপের ছটা? হয়তো বা। কেননা নজরুল হয়ে গেলেন নির্বাক, চিরতরে। বোবা কি তার স্বপ্নে দেখা আনন্দ-অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে পারে? বড় কষ্টের সেই অপারগতা। সেই বোবাযন্ত্রণার কথা কবি লিখে গেলেন নির্বাক হবার আগেই:
‘এ কোন মায়ায় ফেলিলে আমায় চিরজনমের স্বামী
তোমার কারণে এ তিন ভুবনে শান্তি না পাই আমি।।
...
মুখ থাকিতেও বলিতে পারে না বোবা স্বপনের কথা;
বলিতেও নারি লুকাতেও নারি; তেমনি আমার ব্যথা।
যে দেখেছে প্রিয় বারেক তোমায়
বর্ণিতে রূপ– ভাষা নাহি পায়
পাগলিনী-প্রায় কাঁদিয়া বেড়ায় অসহায়, দিবাযামী।।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এক ভাষণে নজরুল বলে উঠেনঃ
‘আমি আল্লাহকে দেখেছি, কিন্তু সে সব কথা বলার সময় এখনো আসে নাই। সে সব কথা বলার অনুমতি যেদিন পাব সেদিন আবার আপনাদের সামনে আসব।’
হৃদয়ের আরশীতে দেখা অরূপ-রতনের স্বরূপ বর্ণনা কবি করে যেতে পারেননি। ‘ভালোবাসা যেখানে গভীর, থাকে না কথার ঢেউ সেখানে।’ চির আরাধ্যকে কাছে পাবার আনন্দে কবি মুখের ভাষা হারালেন, ভাষার আর তখন প্রয়োজনই বা কী? তখন শুধু ‘হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব।’ রাতজাগা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত কবি পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন। সমাধিস্থ হলেন মসজিদেরই পাশে, কেন? তিনি বলেন– ‘যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।’
নির্বাক হয়ে যাওয়ার কিছুদিন আগে এক অভিভাষণে নজরুল বলেন: যেদিন আল্লাহ তাঁর এই বান্দার অন্তর বাহিরের সর্বসত্তাকে তাঁর বলে গ্রহণ করবেন, আমার বলে কিছুই থাকবে না, যেদিন আমার পরম স্বামী পরম প্রভুর দরবার থেকে পাব ফরমান, সেই দিন আমি তাঁরই ঈঙ্গিতে কর্মে নামব, তার আগে নয়। আল্লাহ আমায় সকল প্রলোভন থেকে রক্ষা করুন। ...আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই- আল্লাহর রহমত আমি পেয়েছি, আমার পরমপ্রিয় আল গফুরুল ওদুদ (পরম ক্ষমাসুন্দর প্রেমময়) আমায় নাজাত দিয়েছেন।’
পরমারাত্মার সান্নিধ্য লাভের অনুভূতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন: ‘...আজ আমার সকল সাধনা, তপস্যা, কামনা, বাসনা, চাওয়া, পাওয়া, জীবন, মরণ তাঁর পায়ে অঞ্জলি দিয়ে আমি আমিত্বের বোঝা বওয়ার দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়েছি’।
সুফিরা প্রেমিক। ভক্তিই তাদের বল, নামই সম্বল। সোজা রাস্তা থাকতে আঁকা-বাঁকা সরু পথে যাওয়া কেন? নজরুলের ভাষায়–
‘বন্ধু কেন এ পণ্ডশ্রম মগজে হানিছ শুল
দোকানে কেন এ দর কষাকষি পথে ফোটে তাজা ফুল?’
দোকানে দর কষাকষি না করে পথে ফোটা তাজা ফুল দিয়েই কবি তাঁর প্রেমাঞ্জলি সাজিয়েছিলেন। পথে নেমেছিলেন নিজের দেহকে ‘দেউল’ জেনে–
‘আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল, আমার দেউল
আমারই এ আপন দেহ
আমার এ প্রাণের ঠাকুর নহে সুদূর
অন্তরে মন্দির-গেহ।’
একইসঙ্গে রাসূলের (স.) প্রশস্তি, আবার শ্যামার স্তুতি। হামদ-নাত আর কীর্তন-ভজনের এমন সহাবস্থান বাংলার সংগীতের ইতিহাসে আছে বলে মনে হয় না। তাঁর শ্যামা সংগীত আর ইসলামি গানের আবেদন সর্বাংশে এক ও অভিন্ন। সব ধর্মের প্রেরিত পুরুষদের সমানভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছেন তিনি। তাঁর সাহিত্যজীবন কিংবা জীবনসাহিত্য– যা-ই বলি; এর উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-মুসলমানের গালাগালিকে গলাগলিতে রূপান্তর করা, একইসঙ্গে ইসলামের সর্বজনীন শাশ্বত রূপ বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়া। তিনি মুয়াজ্জিনের আজানে শুনেছেন প্রিয়াহারা কারো কান্নার সুর, বিরহী পাপিয়ার গান।
নামাজ রোজার বদলাতে আবেদ চায় জান্নাত। নজরুল কী চেয়েছেন স্রষ্টার কাছে? নিছক করুণার দাবিদার নন কবি; তার একমাত্র চাওয়া প্রেম। প্রেমের শরাবে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হতে চান কবি:
‘দুনিয়াদারীর শেষে আমার নামাজ রোজার বদলাতে
চাইনে বেহেশত খোদার কাছে নিত্য মোনাজাত করে।।’
কী চান প্রিয় ‘হযরত’র কাছে? শাফায়াত, যা সবার কাম্য? কবি বলেন–
‘তুমি জানো হে মোর স্বামী
শাফায়াৎ চাহি না আমি
আমি শুধু তোমায় চাহি তোমার মুহব্বত
হযরত তোমার মুহব্বত।।’
নজরুল যখন শ্যামা সংগীত লিখেছেন, সেখানে উপমা অলংকার শব্দ চয়ন বদলেছে, যেটা বদলায়নি সেটা হলো পরম সত্তার কাছে তার নিঃশর্ত আত্মনিবেদন। কোন রকম লোভে, কোন ভীতিতে নয়; নিছক ভালোবাসার প্রেরণায় ভালোবাসা। স্বর্গে গেলে যদি তাঁকে ডাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তাহলে কী দরকার সেই স্বর্গে যাওয়ার, কেন তাঁকে ডাকার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবো:
‘...যেথায় গেলে তোমায় ডাকার প্রয়োজন আর নাই।।’
শরীয়ত বলে, শেষ বিচারের দিন আল্লাহ কাহ্হার (কঠোর) রূপ ধারণ করবেন। সে দিনের কথা ভেবে ভয়ে সবাই যখন অস্থির, ভক্ত নজরুলের মনে তখন আনন্দের বন্যা–
‘যে দিন রোজ হাশরে করতে বিচার আল্লা হবেন কাজী
সেদিন তোমার দিদার আমি পাব কি আল্লাজী।।
...
আমি তোমায় দেখে হাজারো বার দোজখ যেতে রাজি।।’
নজরুলকে চিনতে হলে, তাঁর ঐশী প্রেমের স্বরূপ বুঝতে হলে প্রেমিক হতে হবে। নিরস ধর্মাচারে যারা অভ্যস্ত, কিংবা নিছক তত্ত্বকথায় যারা তুষ্ট, তারা নজরুলকে, নজরুলের ঐশী প্রেমের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে ব্যর্থ হবেন। কবি নিজেই বলেছেন, ‘প্রেমিক দরবেশ আমায় চিনে, অরসিকে কয় বাতুল’।
এসইউ/জেআইএম