সে
রোজকার মতো সেদিনও বসেছিল বারান্দার এক কোণে গদিওয়ালা কাঠের চেয়ারটায়। আসা-যাওয়ার পথেই মানুষটাকে চোখে পড়ে। যেন বা কারো প্রতীক্ষায় বসে আছে। আসলে সে বিশেষ কারো জন্যই অপেক্ষা করে না। দেখলে মনে হয়, কথা বলার মতো একজন সঙ্গী হলেই বুঝি চলে তার। আসলে এটা ঠিক নয়। তারও কিছু বিশেষ মানুষ আছে, যাদের দেখলে ছুটে যায়। তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে খুশি হয়। তার চেয়ারের পাশে আরো একটা চেয়ার রাখা আছে। সাধারণত সেখানে বসেই তার সঙ্গে আলাপ করা যায়। তার সঙ্গে আলাপে আমার তেমন আগ্রহ নেই। তার বলারই বা কী আছে? তার জীবনের একটুখানি গল্প সে তো আলাপের প্রথম দিনেই জানা হয়ে গেছে। আমি তাই বিড়ালছানাদের ছবি তুলতে থাকি। এল প্যাটার্নের বিশাল বারান্দায় ঘুরে ঘুরে। এই বিড়ালটা এখানকার নতুন অতিথি।
ক’দিন আগে এখানে একটা রোয়া ওঠা কুকুর দেখেছিলাম। সারাক্ষণ এ টেবিল ও টেবিলে ছোটাছুটি করছিল। আজকে আর ওই প্রাণিটাকে দেখতে পাচ্ছি না। যেভাবে এসেছিল; সেভাবেই চলে গেছে। তার বদলে সপরিবারে হাজির হয়েছে এই বাঘের মাসি। তবে সে কি এই আবাসে ছানাগুলো সমেত এসেছে? নাকি এখানে আসার পর তার ডেলিভারি হয়েছে- এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। সবমিলিয়ে চারটা বাচ্চা। সবগুলোর সঙ্গেই সাদার মিশেল আছে। মানে লাল-সাদা, কালো-সাদা, সাদা-কালো। আর একটা শুধু সাদা। দেখতে দারুণ হলেও ওরা কিন্তু খুব চঞ্চল। এক জায়গায় থাকতেই চায় না। বাধ্য হয়ে ওদের পিছন পিছন আমাকেও ছুটতে হচ্ছে।
এখন তার পাশে বসে আছে সাবিহা। দু’জনে টুকটাক গল্প করছে।
- তোমরা তো আমার জন্য কিছুই করলা না। বললা বেড়াইতে নিয়া যাবা তার কি হইল?
- আমরা কক্সবাজার যাওয়ার সময় আপনারে নিয়া যাব।
- কবে যাবা?
- সেইটা তো তাসলিমা জানে।
- ওর কথার কোনো বিশ্বাস আছে!
আমি মাঝখানে ফোঁড়ন কাটি
- কেন, ও তো খুব ভালো মেয়ে। খুব মিশুক। সবাই ওকে পছন্দ করে।
- হ্যাঁ, তা তো করবেই! তুমি জানো, ও আমারে একদিনও বাসায় নিয়া যাইতে চাইছিল। পরে নেয় নাই। ওর কথার ঠিক নাই।
- আপনি ওর বাসায় যাইতে চান কেন? ওর জামাই শুনলে তো ওরে ধইরা মাইর দিব।
- কেন, মাইর দিব কেন? ভাই কি বইনের বাড়িতে যাইতে পারে না!
- কিন্তু ওর জামাই তো আপনারে চেনে না, চেনে?
আমার কথায় উনি চুপ হয়ে যান। উনি আমাদের কমন ভাই। আমরা তাকে ডাকি ‘সাইফুল ভাই’ বলে। আমরা ক্লাবের মেয়েরা তাকে সমীহ করি, সময় দেই। এজন্য সে বেশ খুশি। আমাদের কারো কারো সঙ্গে তার হৃদ্যতা একটু বেশি। সে তাদের ওপর মাঝে মাঝে অভিমান করে। ব্যস্ততার কারণে কারো সঙ্গে কিছুদিন দেখা না হলে সে অনুযোগও করে। ঠিক একটা বাচ্চা ছেলের মত। আজ যেমন সাবিহার সঙ্গে করছে।
- সাবিহা, তুমি তো আমার জন্য মেয়ে দেখলা না।
- মেয়ে দেখবে মানে। মেয়ে দিয়ে আপনি কী করবেন?
- এইটা সাবিহা জানে।
- কেবল সাবিহা জানলে তো কাজ হবে না। আমারও জানতে হবে।
তিনি চুপ করে থাকেন। আমিই ফের তাকে রাগানোর চেষ্টা করি।
- আচ্ছা সাইফুল ভাই, আপনি কি বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছেন?
- না, বিয়ের জন্য না। আমার খুব একা লাগে। একজন সঙ্গী দরকার।
- কেন আমাদের ভাল্লাগে না বুঝি। আমরা কি কম সুন্দরী!
- দেখছো সাবিহা, অজন্তা কি বলে? আরে তোমরা তো আমার বইন। আমার একজন সুন্দরী বান্ধবী দরকার।
- আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে কে? আপনার তো টাকা নাই। বাড়ি নাই। গাড়ি নাই। আজকালকার মেয়েরা এমনি এমনি কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না। বুঝছেন?
মানুষটা কি কষ্ট পেয়েছে! হঠাৎ চুপ হয়ে গেছে। নির্ধারিত চেয়ারটায় এখন চুপচাপ বসে আছে। এসময় তাকে কেমন অসহায় লাগে। এখন কি সে কোনো প্রিয় মানুষের কথা ভাবছে, যাকে পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু পরিস্থিতির কারণে নিজের করে পাওয়া হয়নি। নাকি, নিজের দেশের কথা ভাবছে; যেখানে পাহাড় থেকে সমতলে আছড়ে পড়ছে বাধনহারা জলরাশি। সেই ঝরনা, সেই উপত্যাকা কিংবা বনতলে ঝরে পড়া চিনাবের তামাটে পাতা, আপেল বনের মৌ মৌ গন্ধ- এইসব কিছু কি তাকে আন্দোলিত করে! তার কি কখনো ফিরে যেতে ইচ্ছে করে নিজের দেশে? আমার মনে একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন ভিড় করে। কিন্তু আমি মুখ ফুটে কিছুই জানতে চাই না। নীরবতা ভেঙে সাবিহা বলে, ‘আপা, আমাদের দু’জনের ছবি তোলেন।’
আমি সাবিহার ছবি তুলি। দু’জনের যুগল ছবিও তুলি। আমার মোবাইলে তার কিছু সলো ছবিও তুলি। একজন নিঃসঙ্গ মানুষের ছবি। যে মানুষটার আপন বলতে কেউ নেই। যে কারণে পরদেশে এভাবে একা একা পড়ে আছে। তবে তারও স্বপ্ন আছে, আছে ভালোবাসা। কেবল সুযোগ আর সামর্থ্য নেই। ছবি তোলা শেষে আমরা দু’জন ফিরতে থাকি। সে বসেই থাকে তার গদিওয়ালা আর হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারটায়। হয়তো বা অপেক্ষায় থাকে। আবার কেউ তার কাছে আসবে, খানিক আলাপ করবে, তারপর চলে যাবে। এই অপেক্ষার কোনো শেষ নেই। আছে কি? কে জানে, হয়তো আছে!
এসইউ/পিআর