সাযযাদ কাদিরের কবিতা : শিল্পিত উচ্চারণ
শিল্প যাপিতজীবনের প্রতিকৃতি মাত্র নয়; সমাজজীবনের বিনির্মাণও। তাই বস্তুসত্যের সঙ্গে শিল্পসত্যের হুবহু মিল হয় না– সব সময়। কবিতা সেই শিল্পসত্যের সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রপঞ্চ। এই প্রপঞ্চের নিমগ্ন সাধক সাযযাদ কাদির। জন্মেছিলেন ১৪ এপ্রিল, ১৯৪৭ সাল। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হলো– যথেচ্ছ ধ্রুপদ, রোদ্রে প্রতিধ্বনি, দূরতমার কাছে, দরজার কাছে নদী, আমার প্রিয়, এই যে আমি, কবিতাসমগ্র, জানে না কেউ, বিশ্ববিহীন বিজনে এবং বৃষ্টিবিলীন।
কবি সমাজের ভাষ্যকার, অনুভূতির অনুবাদক এবং মানসিক সম্পর্কের চিত্রকর। সামাজিক বন্ধনের উষ্ণতায়ও মানুষ নিঃসঙ্গবোধ করে; আধ্যাত্ম সংকট মানুষকে করে তোলে মৌনসন্ন্যাস। মানবিক সংকট এবং আধ্যাত্মচেতনার যুগ্ম-স্বাক্ষর ‘কিং জর্জ ব্রিজে’। দুই স্তবকে সম্পন্ন ছোট কবিতা। পুরো কবিতায় রয়েছে দুটি চিত্রল্প, একটি প্রতীক, একটি রূপক। প্রথম স্তবক–
‘একটি অসম্ভব পাখি
মরমে পশেছে নাকি–
গান গায়, শুধু গান গায়
ক্ষ্যাপা এই রাত্রিকে নাচায়
সে-ও নাছে নাকি
একটি চরম পাখি’!
পাখি একই সঙ্গে প্রতীক এবং রূপক। এই পাখিকে আশ্রয় করে সৃষ্টি হয়েছে দুটি চিত্রকল্প– দুই চিত্রকল্পেই পাখি আত্মার প্রতীকাশ্রয়ী রূপক। মৃত্যু সেখানে মৌল অনুষঙ্গ। তাই শেষ স্তবকে কবির আর্তদীর্ণ উচ্চারণ–
‘মেঘনা পায় না বুকে
বিম্বিত আমার মৃত্যুকে’।
এরপর সেই অমোঘ আধ্যাত্ম নিয়তির প্রসঙ্গ পাখিটির জানা বলেই কবিতা সম্পন্ন হয়ে ওঠে।
মানুষ কখনো আত্মজিজ্ঞাসাতাড়িত হয়, কখনো আত্মজিজ্ঞাসায়পীড়িতও হয়। প্রথমজন আত্মউদ্বোধনের সাধক, দ্বিতীয়জন আত্মপীড়নে মূহ্যমান। সাযযাদ কাদির প্রথমজনের সমাত্মীয়। ফলে ‘ঘোড়সওয়ার’ কবিতায় দুঃসময়ে পলায়নপর সত্তাকে সতর্ক করে দেন এবং তার ব্যক্তিত্বের প্রমূর্তি সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। সে সঙ্গে পলায়ণপর মনোবৃত্তিকে করে নিরুৎসাহিত। একটি ছোট কবিতাও কী করে একটি বিশেষ মুহূর্ত ও প্রতিবেশের স্মারক হয়ে ওঠে তার প্রমূর্ত স্বাক্ষর ‘ঘোড়সওয়ার’–
‘তুমি একটা কাবু ঘোড়সওয়ার মধ্যরাতে
কোথায় যাও কোথায় যাও দূরের সড়ক ধরে?
সঙ্গে দেখি মত্ত দুটি ছায়া এবং ছায়া
যাচ্ছে তারা আঁধারভরা পাঁচিলঘেরা দূরের শহরে’?
এখানে আত্মজিজ্ঞাসায় উচ্চকিত স্বরই স্পষ্ট।
জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে জয়ীরাই সমাজে সংবর্ধিত, পরাজিতরা করুণার পাত্র– কখনো কখনো তিরস্কৃতও। কবি বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন গভীরভাবে। সে উপলব্ধিজাত সত্য প্রকাশে নিয়েছেন প্রতীক এবং পথিকের আশ্রয়। এই প্রশ্নশীল সত্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়েছেন ‘অচেনা’ কবিতায়। এ কবিতায় কবিকে পাই সম্পন্ন এক আত্মজিজ্ঞাসাতাড়িত কবি হিসেবে। যে কবি শুরু করেন, ‘আঁধার থেকে দীর্ঘ স্বরে ডাকলো আমায় কেরে’? সে কবি আমাদের জানান এক বিশেষ এবং গোপন সংবাদ। যে পাখি কখনো গান গায়নি প্রকৃতপক্ষে সে পাখিই ‘মোহন পাখি’।
মানব সভ্যতার ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে এগিয়েছে মানুষের আচরণ– মনস্তাত্ত্বিক রূপও বহুদূর বিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু যতই সভ্যতার অগ্রগতি হোক, সে অগ্রগতি কোনোভাবেই যেন মানবতার প্রকর্ষণায় সহায়ক হয়ে উঠছে না। বরং ক্ষেত্র বিশেষে মানুষকে করে তুলছে অধপতিত। ‘কংক্রিট বিষয় ও অনশ্লীলতা’ কবিতায় এরই চিত্র এঁকেছেন এভাবে–
‘সূর্যাস্তের পর শহরের
শ্রেষ্ঠতম নরগণ একত্রিত হলে সর্বসম্মতিক্রমে বিবেচনা করা হয়: আমরা হারাবো সকল রূপোলি টাকা ও মেয়ে মানুষ, সকল ঘড়ি ও টিকটিকি’।
এখানে ঘড়ির সঙ্গে টিকিটিকির সমান্তরাল দৃশ্য এঁকে প্রাগৈতিহাসিক এবং আধুনিক যুগের মধ্যে একটি সাধারণ ঐক্য স্থাপনের প্রয়াস খুঁজেছেন। কিন্তু ‘ছদ্মবেশী’র ‘শয্যাময় চিহ্ন তার, প্রথম আলোক, সে-ও এসে পেয়ে যায় অদিনে কার কালোবাজারি’ বলার পর সবশেষে যখন বলেন, ‘আবার এসেছে দেখ সেই ছদ্মবেশী, হাতে তার একখানি ইলেক্ট্রিক চেয়ার, একখানি সোনালি আঁধার’, তখন একই সত্তার ভেতর উপলব্ধ হয় দ্বৈতরূপের চিহ্ন। ‘কংক্রিট বিষয় ও অনশ্লীলতা’য় যে সভ্যতাকে কবি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, সে সভ্যতার বহুরূপী আচরণকে স্পষ্ট করে তুলেছেন ‘ছদ্মবেশী’ কবিতায়।
মধ্যবিত্ত বাঙালির সংকট অস্তিত্বের; বেঁচে থাকার দুর্মর বাসনাই তাকে তাড়িত করে। ফলে বেঁচে থাকার জন্য তাকে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। সে খাদ্যের ক্রমাগত চাহিদা বাড়ে, পাল্টায় সময় এবং রুচি। ফলে ‘সে খাদ্য সংগ্রহ করে/ ছায়াবৃত অতিকায় এক রক্তগন্ধ আলোকের ভাঁড়ার থেকে’। আলোকের ভাঁড়ার থেকে কী খাদ্য সংগ্রহ করে সে? সে খাদ্য মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায় সত্য; কিন্তু ক্ষুৎপিপাসা কতটা মেটাতে পারে? সেখানের ক্ষুধার্ত সত্তাটি আসলে ‘জ্যোৎস্নায় ধাবমান এক চিতা’। সঙ্গত কারণে যে কবিতার শুরু মানুষের খাদ্যাভ্যাসের বিবরণ দিয়ে, সে কবিতার সমাপ্তি শৈল্পিক তৃষ্ণায়।
সাযযাদ কাদির সময়কে চিত্রায়িত করেন খুব সন্তর্পণে। ফলে সমকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি তাকে যেমন আন্দোলিত করে, তেমনই মানবাচরণের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যও তাকে করে তোলে সংবেদনশীল। এসবই ‘একা’, ‘চৈত্রের চৈতন্যে’, ‘আমার মৃত্যুকে আমি’, ‘দরজার কাছে নদী’ কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। এ পর্বে একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা, ‘প্রতীক্ষা’।
‘ঘড়ির দুটি ছোট্ট সাদা হাতে
এখন কিছু কুসুম গুঁজে রাখি
আসবে তুমি, প্রহর তবু শেষ–
অচিনপুরে উড়েই গেছে পাখি।’
মানুষের তৃষ্ণার কাছে মানুষই অসহায়। তাই বারবার সে ফিরে যেতে চায় তার আকাঙ্ক্ষার জল পান করতে।
‘আমরা পাঁচজন’ মূলত যুথবদ্ধ স্বপ্নচারীর রাজনৈতিক ও শৈল্পিক কল্পনার প্রতিচ্ছবি। ‘বিপ্লব চাই! আমরা বিপ্লব চাই’ স্লোগান দেওয়ার পর প্রতিটি চরিত্রের মনে হয়, ‘আকাশে আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে অসংখ্য লাল পতাকা’। সমাজ বিপ্লবের একটি অতি পরিচিত চিহ্ন লাল পতাকা। এই পতাকা মূলত সর্বহারার রাজনৈতিক দর্শন প্রকাশের প্রতীক।
সাযযাদ কাদিরের কবিতায় বিষয়ের বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। প্রতিটি বিষয়কে বিন্যাস করেন সুচারুরূপে। তার বিষয় যখন বাংলাদেশ তখন তিনি ‘বাংলাদেশ’ কবিতায় উচ্চারণ করেন,
‘যতদিন উপভোগ রবে, তত দিন বিশ্বাস জীবিত
ব্যক্তিগত নাস্তিক্যের মহামৌন থেকে
হাতিয়ার তুলে নেয়া জনতার দুরন্ত উলাস পর্যন্ত’।
এ বহিরাগতদের প্রতি তীব্র ধিক্কার জানানো হয়েছে। সে সঙ্গে দেশীয় রাজনীতিবিদের অযোগ্যতার কারণে তার যে ক্ষোভ তা-ও ব্যক্ত করেন। করেন মৃদু তিরস্কারও– ‘হায় চণ্ডীদাস বাবু! আবার যে আমার সেই প্রেম আস্বাদন!। ‘শামসুর রাহমানের ভিখিরি’ কবিতায় ঘোষণা করেন, ‘সার্ত তো আমার কবি, বেঁটে বনমালী’। মাত্রাবৃত্তে লেখা ‘রশ্মিপাত’। প্রার্থনা এবং সব ধরনের চাওয়া শেষে কবির প্রশ্ন ‘কোমল যাতনা আনবে না হাহাকার’?
কবিতা শিল্প হয়ে ওঠার পক্ষে এর অনুষঙ্গগুলোর সুষম প্রয়োগ এবং বিন্যাসের ওপর নির্ভর করে। বর্তমান যুগ মিডিয়াশাসিত যুগ। ফলে মিডিয়ায় প্রচারিত তথ্যই সাধারণ্যে সত্য বলে আপাতত গৃহীত। কিন্তু সে তথ্যের সত্যতা নিরূপণের ভারও কেউ কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেন। সে স্বতঃস্ফূর্ত দায়ভার বহনকারীর মধ্যে কবিরা বেশি মান্য হয়ে ওঠেন। কারণ সংবেদনশীল মন এবং প্রশ্নশীল প্রজ্ঞার মিথস্ক্রিয়ায় কবিরাই পারেন সমাজের সঙ্গতি-অসঙ্গতির চিত্র আঁকতে। ‘পরস্পর’ কবিতায় তারই সংবেদ ‘হাতে মুখ ঢেকে সেইখানে আমাদের শোক/ শুয়ে আছে, রোদের আঙুর হয়ে নীলবর্ণ/ ব্যথা তবু কাছে যেতে চায়’ উচ্চকিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির দুঃখও নৈর্ব্যক্তিকতায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়। ব্যক্তির ভাবাবেগ যখন তার প্রজ্ঞার অনুশাসনে নিয়ন্ত্রিত হয়ে সংহত রূপ নেয়, তখনই তার আবেগ হয়ে ওঠে শিল্পের ফলক। আর তখন, ‘একুশ নম্বর বেড কোন ফুলের অন্তিম’? বলে যে প্রশ্ন একজন সাযযাদ কাদির করেন, সে প্রশ্ন হয়ে ওঠে হৃদয়ের সুলুকসন্ধানী প্রতিটি মানবতাবাদীর। আর ‘রোদের আঙুর’ একটি উজ্জ্বল চিত্রকল্প মানসপটে স্থান করে নেয় প্রেম-অপ্রেম এবং জাগতিক বিষয়-আশয়ের প্রমূর্ত চিত্রে। কাঙ্ক্ষিত মানুষের সাহচর্য মানুষকে করে তোলে সম্পূর্ণ অন্য রকম। একজন সাধারণ মানুষও নিজের ভেতর আবিষ্কার করেন একজন অতিমানবের অস্তিত্বের। ফলে স্পর্শের অতীত বিষয়ও তার কাছে ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি নিয়ে ধরা দেয়। দৃশ্যমান বস্তুও সময়ে হয়ে যায় অদৃশ্য। ‘তুমি যখন’ কবিতায় এরকম একটি উপলব্ধির মুখোমুখি পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন কবি–
‘তুমি যখন বললে
তখন পকেটে জোসনা পুরে
অকারণ বাজাতে-বাজাতে আমি
প্রেক্ষাগৃহের সামনে
অগ্রিম টিকিট কিনছি
পাঁচ দিন পরের ছায়াছবিটির’।
‘শীত সন্ধ্যার ফুল’ কবিতার শুরুর পঙক্তি– ‘আমি খুব একা ব্যথাহত চোখে তাকিয়ে থেকেছি/ শীতসন্ধ্যার জন্য পাঠানো ফুল হাওয়াতে সাজানো ছিল/ যেমন করে তোমাকে উড়ন্ত চুমু দিয়ে সাজিয়েছিলাম রেশমি আনন্দে’। তার পর দীর্ঘ আশাভঙ্গ এবং মানবাচরণের বিশেষ বৈশিষ্ট্য কবিকে আহত করে। পাঠক তার সঙ্গী হয় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কবি নিচু স্বরে জানান– মন ভালো নেই। তবু তার প্রেয়সীকে উদ্দেশ্য করে বলেন– অথচ তোমাকে মনে পড়লো। তাহলে মানুষের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে প্রিয়জনকে মনে পড়ে এবং সে কথা জানায় শীতের কোনো নিরানন্দ সন্ধ্যায়? কিন্তু কেন? তবে কবি ‘বিশাল জন্মের মুখে’ বলেন–
‘একজন মানুষীর কাছে একজন মানুষ
সারাক্ষণ শস্যের সমারোহ আনে’।
তখন মানবস্বভাবের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সাযযাদ কাদিরের সব সত্তা ছাপিয়ে প্রশ্নশীল সত্তাই বড় হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত চরাচরের প্রতিটি প্রপঞ্চ এবং বিষয় সম্পর্কে তার অনুসন্ধিৎসা পাঠককেও ভাবিয়ে তোলে। দেশের রাজনীতি যখন বেনিয়াদের করায়ত্ত, বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণী যখন তোষামোদীতে আক্রান্ত যখন তার প্রতিবাদও অনিবার্য। কিন্তু কে করবে সে প্রতিবাদ? একজন সাযযাদ কাদিরের মনে হতে থাকে– ‘আমার প্রথম শত্রু কে’, ‘আমার দ্বিতীয় শত্রু কে’, ‘আমার তৃতীয় শত্রু কে’? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর তিনি নিজেই দিয়ে রাখেন, যথাক্রমে– ‘প্রভুর পত্রিকা’, ‘মোসাহেবের কলম’ এবং ‘শূয়রগন্ধিসাহিত্য’ বলে। একটি সমাজে যখন পচন ধরে তখন কবিকেই এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। আর কবি-সাহিত্যিকরা যখন প্রতিশ্রুতিবিহীন সাহিত্য চর্চায় কালক্ষেপণ করেন তখন সে দায় তার সাহিত্যিক সততাকে প্রতিপন্ন করে না। সাহিত্য কেবল অর্থহীন কল্পনা সৌধ নয়; যাপিতজীবনেরও চিত্র।
‘মনিকা’ বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে রচিত ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা। একজন কবি যখন হাসিখুশি মনিকাকে একজন মানুষ মনে করেন, তখন একজন রাষ্ট্রপতি মনে করেন তার ভোগের উপচার। এভাবে তার করায়ত্ত সবকিছুকেই তিনি ভোগ্যপণ্য মনে করতে পারেন এবং করেনও। মনিকার দেহ-মন জয় করার পর তার মনে হতে পারে পৃথিবীর সর্বাঞ্চলই তার কাছে ‘আস্ত একটা মনিকা’।
মনোবিকলনের বিশেষ মুহূর্তে মানুষ কি কখনো কখনো অব্যবস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় যাপন করে? ‘স্নান ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে’ কবিতায় দেখেন,
‘সেদিন আকাশের মেঘ আমার ঘরের বিছানা।
সেদিন আমার ঘরে সুখ
কত সুখ কি যে সুখ!’।
কী দেখেছিলেন ‘স্নানঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে’ সেদিন? সেখানে কবি নিজেরই একাধিক সত্তার দেখা পান।
অনেক সময় দৃশ্যমান বিষয়ই মানুষের দেখায় অদৃশ্য হয়ে যায়, তাকেই গৌণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই কবির অনুভূতির অনুবাদ হয়– ‘মণিমালা নয়
মণিমালার আসা, মণিমালার যাওয়া
এই সব দেখি।
আমার মন কেমন কেমন করে’।
‘মুঠোভরা তারা’ একজন সীমাহীন স্বপ্নচারীর আত্মঅতিক্রমণের রেখাচিত্র। যেখানে প্রকৃতির অসীম রহস্যাবৃত্ত স্রষ্টাকে প্রশ্ন করার প্রত্যয় ব্যক্ত– ‘এখন কেমন...’?
সাযযাদ কাদিরের শেষ বই, ‘বৃষ্টিবিলীন’। এই বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা– ‘বৃষ্টিবিলীন’। ‘মণিমালা, তোমার বর্ষা এলো আজ এই শহরে’ বলেই কবি একটি সংবাদই দেন না কেবল, সঙ্গে প্রকৃতির সঙ্গে নারীস্বভাব ও নারীদেহের একটি স্কেচ এঁকে নেন মনে মনে। শেষপর্যন্ত নারীর কাছে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে স্বীকার করেন–
‘মণিমালা, এই মেঘভারনত আকাশের নিচে
এই শ্রাবণঘন সন্ধ্যায়
আর কোনও যোগ্য বর্ণমালা নেই
এই বৃষ্টিবিলীন তোমার
বর্ণনা-বৃত্তান্ত লেখার’।
সাযযাদ কাদিরের কবিতার ভাব, ভাষা এবং প্রকাশশৈলী তার নিজস্বতায় ভাস্বর। চিত্রকল্প এবং উপমা ব্যবহারে তার স্বাতন্ত্র্য উজ্জ্বল। নতুন শব্দগঠন এবং পঙক্তিবিন্যাসে তার সচেতনতা লক্ষণীয়। তার কাব্যভাষা যেমন কোমল, তেমনই গীতলও। এসবের যুগ্মস্বাক্ষরে তার কবিতা হয়ে উঠেছে শিল্পিত উচ্চারণ। যা তাকে অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে ভূমিকা রাখবে। কবির দায় সমাজ ও নিজের অন্তর্গত সত্য প্রকাশ করা, সে দায় পালনে সাযযাদ কাদির সফল– তার কবিতায় সে সত্যেরই প্রতিফলন স্পষ্ট। তার চিন্তার বিপুল অংশেই শিল্প ও জীবনের জয়গান উচ্চকিত।
এসইউ/এমএস