ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

সৌরভ

প্রকাশিত: ০২:০১ এএম, ১০ মার্চ ২০১৭

সন্ধ্যার পর থেকেই পুরো বাড়ি অতিথিতে গিজগিজ করছে। হলরুমে উচ্চস্বরে গান বাজছে। মাঝে মাঝেই ক্যামেরার ফ্লাশ লাইটের আলো জ্বলছে। পুরো হলরুম, গেস্টরুম আজ কানায় কানায় পূর্ণ। অতিথিদের অনেকেই সেলফি তোলায় ব্যস্ত। অনাগ্রহ সত্ত্বেও রাহাকে তাদের সঙ্গে হাসিমুখে সেলফি তুলতে হলো। রাহা মনে মনে ভাবতে থাকলো কেন যে মানুষের মুখের উপর না বলতে পারাটা শিখলাম না। না বলতে পারলে বেশ ভালোই লাগতো।

আজ রাহা আর অপুর দশম বিবাহবার্ষিকী। আজকের এই আয়োজনের মধ্যমণি রাহা। বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে অপু তার সব বন্ধু, অফিসের বস এবং কলিগদের দাওয়াত করেছে। অপুর বস, কলিগ আর বন্ধুদের স্ত্রীরা জটলা পাকিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবন নিয়ে রসালো গল্পে মেতে উঠেছে। এ গল্গ শুনতে রাহার কিছুতেই ভালো লাগছে না। কেমন যেন বিব্রত বোধ করছে রাহা। আস্তে আস্তে সে শোবার ঘরে চলে গেলো। বাতিটা নিভিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো।

আয়োজনের কোনো কমতি রাখেনি অপু। জাঁকজমকপূর্ণভাবেই সে প্রতিবছরের মতো বিবাহবার্ষিকী পালন করছে। রাহার এতে ঘোর আপত্তি। কিন্তু কিছুতেই সে রাহার কথা কানে তুলবে না। যেন বিশাল কেক কেটে আর পার্টি করে নিজেকে শাহজাহান প্রমাণ করতে চায়। একদিনে লোক জড়ো করে যেন স্বামীর দায়িত্ব পালন করতে চায়। সবাইকে দেখাতে চায়- দেখো, আমি রাহাকে কতো ভালোবাসি। অথচ বাকি দিনগুলোতে অপু তার কাজ নিয়েই মহাব্যস্ত থাকে। চোখ বন্ধ করে রাহা এসবই ভাবতে লাগলো।

কিন্তু অপুকে বিয়ে করে রাহা বেশ সুখেই আছে। স্বামী হিসেবে সে খুবই সংসারী। নিজের ভালো-মন্দ বুঝে। মোটকথা মেয়েরা যে নিরাপত্তা চায়, অপু সেই নিরাপত্তাটা রাহাকে দিয়েছে।

মাঝরাত পর্যন্ত পার্টি চলবে। প্রথমে কেক কাটা হবে। খাওয়া-দাওয়ার পরে অপুর কলিগ আর বন্ধুরা আকণ্ঠ পান করবে। একদিন অপুর জোরাজুরিতে রাহাও একটু পান করার পর তার গলা প্রচণ্ড জ্বলছিলো। রাহা বুঝতে পারে না, তারা এসব পান করে কীসের এতো মজা পায়!

এসব ভাবতেই রাহা শান্তার গলার স্বর শুনতে পেলো। শান্তা অর্থকে কী যেন করতে নিষেধ করছে। অর্থ রাহা আর অপুর একমাত্র সন্তান। সে ইংলিশ মিডিয়ামে স্ট্যাডার্ন্ড ওয়ানে পড়ছে। রাহার দরজার সামনে এসে শান্তা নিচু কণ্ঠে বললো, ‘আপু, আপনার কি মাথা ব্যথাটা বেড়েছে? বাতি নেভানো যে।’ ‘নারে।’ রাহা উত্তর দিলো।
‘দুলাভাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনি গেলেই কেক কাটা হবে।’
‘তুই যা, তোর দুলাভাইকে বল আমি কাপড়টা চেঞ্জ করে আসছি।’ রাহা শান্তাকে বললো।
নামের সঙ্গে শান্তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বেশ মিল পাওয়া যায়। খুবই চুপচাপ স্বভাবের সে। বিয়ের আগে শান্তা রাহাদের বাড়িতে থাকতো। বিয়ের পর রাহাকে সাহায্য করার জন্য মা তাকে পাঠিয়েছেন।

রাহা বিছানা থেকে উঠে বাতিটা জ্বালিয়ে আলমারিটা খুললো। কি পরবে সে- তা ভাবতে লাগলো। শাড়ি পরবে না গাউন পরবে? তা নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। আলমারি ভর্তি শাড়ি, গাউন আর অন্যান্য পোশাকে। হঠাৎ রাহার চোখ একটা শাড়ির দিকে আটকে গেলো। শাড়িটা ধরবে না করেও কী যেন ভেবে শাড়িটা আলমারি থেকে বের করলো। শাড়ির ভাঁজ খুলেই দেখলো একটা শুকনো বকুল ফুলের মালা। মালাটা কবেই শুকিয়ে গেছে। কিন্তু তার সৌরভ সারা শাড়িজুড়ে। শাড়ি দেখেই রাহার চোখের সামনে একটা মুখ ভেসে উঠলো। হ্যাঁ, রাহা এতোদিন পরেও সামিরের মুখটা চিনতে ভুল করলো না।

সামির আর রাহা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সেরা বন্ধু ছিলো। বন্ধুত্বের গণ্ডি পেরিয়ে তাদের মাঝে প্রেমও হয়। শাড়িটা সামিরেরই দেওয়া। বকুল ফুলের মালাটা সামিরই রাহার খোঁপায় গুঁজে দিয়েছিলো। সামিরের পছন্দেই রাহা মাঝে মাঝে শাড়ি পরতো।

শেষপর্যন্ত বাবার করা পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করতে হলো রাহাকে। রাহার বিয়ের কয়েক বছর পর্যন্ত নাকি সামির উল্টা-পাল্টা অনেক কিছুই করেছে। রাহা শুনেছে, সামির বিয়ে করে নাকি নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। সামির তার বিয়ে করা স্থূলকায় বউকে নিয়ে নাকি আজকাল বেশ কবিতাও লিখছে। অথচ একদিন সামিরের সব কবিতাই ছিলো রাহাকে নিয়ে। যে রাহা সামিরকে প্রত্যাখ্যান করে পরিবারের পছন্দমতো বিয়ে করেছিলো; সেই রাহাই সামিরের বিয়ের খবর শুনে সারারাত বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছিলো।

হায়রে মানব মন! এসব ভাবতেই রাহার চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠলো। নিজেকে সে খুব তাড়াতাড়ি সামলে নিলো। নাহ, কেঁদে বুক ভাসালে তাকে চলবে না।

চোখ-মুখে পানি দিয়ে সে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। মুখে ফাউন্ডেশন মেখে নিলো। ক্লান্তি ঢাকতে চোখে মাশকারাও এঁকে নিলো। তবুও যেন রাহার শরীর থেকে বকুল ফুলের গন্ধ বের হচ্ছে। এ যেন সামিরেরই শরীরের গন্ধ। যেভাবেই হোক রাহাকে এ গন্ধ দূর করতে হবে। রাহা প্রাণপণে সারা গায়ে দামি প্রসাধনী মেখে নিলো। কিন্তু কিছুতেই যেন ঘ্রাণটা যাচ্ছে না। রাহার চোখে-মুখে কীসের যেন একটা কালো ছায়া পড়লো।

দশ বছর ধরে ভালো থাকার অভিনয়টা আজ বুঝি সবার সামনেই ধরা পড়বে। ভাবতে ভাবতে রাহার বুক ফুড়ে বেড়িয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।

এসইউ/পিআর

আরও পড়ুন