তুমি আছো, তুমি নেই : ব্যর্থতার ব্যক্তিগত অনুভূতি
‘তুমি আছো, তুমি নেই’- কথাটার মধ্যেই যেন ইতিবাচকতা এবং নেতিবাচকতার অপূর্ব সমন্বয়। যেন পেয়েছি, আবার পাইনি। ঘোরলাগা দোলাচলবৃত্তি। যার পরিণতি নেই, সমাপ্তি নেই- অনন্ত আকাঙ্ক্ষার পিছু ছুটে চলা অনন্তকাল। তবু থেমে নেই জীবন, থেমে থাকে না। এগিয়ে চলে, যদিও গন্তব্য জানা নেই। নিজে ভাবে না, মানুষকে ভাবায়। একটি কুয়াশাচ্ছন্ন চরিত্র। উপন্যাসের নায়িকা নিশাত। কথাগুলো বলছিলাম কবি এবং ঔপন্যাসিক হাবীবাহ্ নাসরীনের উপন্যাস ‘তুমি আছো, তুমি নেই’ প্রসঙ্গে।
পড়া শেষ হওয়ার পর থেকেই উপন্যাসের কাহিনির ঘোরটা মগজের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের মতো দ্রুত গতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। বেদনাগুলো যেন থিতু হয়ে আছে অন্তরে। এক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে কবি হাবীবাহ্ নাসরীনের চেয়ে ঔপন্যাসিক হাবীবাহ্ নাসরীন অনেক বেশি সপ্রতিভ। অনেক বেশি সফল এবং সার্থক। তবে প্রশ্ন একটাই- এক জীবনে মানুষ এত দুঃখ কী করে বয়ে বেড়ায়? ব্যক্তি তো কোনো পাহাড় বা সমুদ্র নয়; তবে কী করে এতো যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখে মনের গহীনে? পাহাড় কিংবা সমুদ্রও নিশাতের কাছে ক্ষুদ্র মনে হয়। নিশাতের ধৈর্য আর সহনশীলতা পাঠককে বিক্ষুব্ধ করে।
`তুমি আছো, তুমি নেই` উপন্যাসের কোনো পরিণতি নেই। নিশাতের জীবনেও আসে না ফাগুন। বসন্ত ছুঁয়ে যায় না শাড়ির আঁচল। ফলে মনে হয়, উপন্যাসের নামের মতোই নির্মাণের সার্থকতা। কিন্তু পাঠকের আকাঙ্ক্ষা জিইয়ে রেখেছেন ঔপন্যাসিক। কৌশলে শুনিয়েছেন ব্যর্থতার গল্প। সফলতা ছোঁব ছোঁব বলে যতই হাত বাড়িয়েছি; ব্যর্থতা এসে আবার হটিয়ে দিয়েছে অগ্রসরমান দু’হাত। লেখকের নির্মাণশৈলী এভাবেই সার্থক হয়ে উঠেছে।
লেখকের জবানীতে হাবীবাহ্ নাসরীন অনর্গল গল্প বলে গেলেন। যেন ব্যর্থতার ব্যক্তিগত অনুভূতি। লেখকের জীবনে এমন ঘটনা না ঘটলেও সমাজের কারো না কারো জীবনের আলেখ্য হতে পারে এটি। আমাদের জীবনেও ঘটতে পারে এমন ঘটনা। তবে অবাক করার মতো একটি বিষয় হচ্ছে- তার একটি গল্পের বিস্তারে আরো অনেক গল্প ডানা মেললেও মূল গল্পটিই উড়ে গেল একা। ঘটনা-অনুঘটনার পাশ কাটিয়ে নিশাত হয়ে উঠলেন কেন্দ্রবিন্দু। তার কষ্টে আমরা হতাশ হই- তার সুখে আশার আলো দেখি। যা কি না মিলনপিপাসু বাঙালির অন্তরকে একেবারে নাড়িয়ে গেল।
ঘটনাবহুল বর্ণনাত্মক উপন্যাসটির কেন্দ্রবিন্দু নিশাত ও পাভেল জীবনটাকে কোনো এক ঘোরের মধ্যেই অতিবাহিত করলেন। ভালোবাসা আসে, আবার চলেও যায়। দোদুল্যমান সত্তার হাহাকারে পর্যবসিত নিশাতের জীবন কোনো পরিণতির জন্য অপেক্ষা করে না। পাঠকের আবেগকে জলাঞ্জলি দিয়ে নির্লিপ্ত মনের নিরাসক্ত অনুভূতিই জয়লাভ করে। চিরাচরিত ‘হ্যাপি এন্ডিং’ বা ‘অবশেষে তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’র মতো সস্তা ‘মধুরেণসমাপয়েৎ’ লক্ষ্য করা যায় না।
পোড় খাওয়া মানুষের সমাজবাস্তবতা কতটা রূঢ় হতে পারে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে এখানে। সমাজের চোখে কী হলে একটা মেয়ে অসুন্দর হতে পারে তার নিষ্কলুষ বর্ণনা নিজেই দিতে পারেন। নিজের রূপের বর্ণনা এমন অসুন্দর করে কেউ ফুটিয়ে তুলতে চান না। অথচ নিশাত তা করেছেন। নিজেকে কুৎসিত বলে উপস্থাপন করেছেন বারবার। অথচ বাহ্যিক সৌন্দর্য মানুষকে অহংবোধ দান করে। অন্তর্গত সৌন্দর্য তাই এখানে প্রকট হয়ে ওঠে।
হাবীবাহ্ নাসরীন গল্প বলতে পেরেছেন। পাঠক ধৈর্য নিয়ে পড়েছেন, আপাত সান্ত্বনা শুধু এটুকু নয়। পাঠককে তিনি ভাবিয়েছেন, উদ্বেগাকূল করেছেন- সার্থকতা এখানেই। পাঠক সমাধান খুঁজেছেন। উত্তরণের পথ খুঁজেছেন। কিন্তু ভাগ্য যেখানে বিড়ম্বিত চেষ্টা সেখানে নিষ্ফল তো হবেই। কপালের লিখন ভেবে পাঠক এগিয়ে যাবেন ঘটনার পরবর্তী পরিচ্ছদে।
তিনি উপন্যাসে কোনো ভালোবাসারই পরিণতি দেননি। অনেকটা নির্দয়ের মতো কলম চালিয়েছেন। হয়তো জোর করে ভাগ্যলিপি নির্মাণ করেছেন। কেবল করুণার ঝনঝনানি কর্ণকুহর ভেদ করে গেছে। কোনো জুটিকেই সফল হতে দেখা যায় না- এমন বাস্তবতা নির্মমতাকে প্রলুব্ধ করেছে।
লোভী যুঁথী আর নিরুপায় নাজিমের প্রেম পরিণতি না পাওয়ারই কথা। অন্যের লোভের ফসল নিয়ে রাশেদের বুকে আসে তার স্ত্রী। কতটা সহজেই তা মেনে নেয়া যায়। পাভেলকে ঠকায় হৃদিতা, নিশাতকে না পেয়ে শোয়েবের বুকে জমে হাহাকার- কোথাও কোনো ইতিবাচকতা নেই। তবুও প্রত্যেকটি মানুষ স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফল। ব্যর্থতা কেবল ভালোবাসায়। চিরদিনের জন্য হয়তো একা ব্যর্থ একটা মানুষ নিশাত। উপন্যাসের সার্থকতা এখানেই।
তবে কিছু কিছু ঘটনার অসঙ্গতি পাঠককে ভাবায়। আমাদের দেশে নিয়মিত নিয়মে ষাট বছর বয়সে অবসরে যান চাকরিজীবীরা। অবসরে যাওয়ার এক বছর আগে জন্ম হয় নিশাতের। সে হিসেবে নিশাতের মায়ের বয়স দশ বছরে পার্থক্য হলেও পঞ্চাশ বছর। এ বয়সে সন্তান ধারন কতটা যুক্তিসঙ্গত। যদিও ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটতেই পারে। গল্পটি যেহেতু সমসাময়িক; সেহেতু নিশাতের বাবার বয়স আশির বেশি। মূলত উপন্যাসের এক পর্যায়ে অকার্যকর একটি চরিত্র।
কোনো কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে সংলাপে বা বর্ণনায় হাস্যরস আনার চেষ্টা করেছেন লেখক। তবে অতোটা মানানসই কিছু হতে পারেনি। পাঠককে ছুঁয়ে যেতে পারেনি। যতটা ছুঁয়েছে দুঃখের বিবরণে। উপন্যাসে সময়, স্থান, চরিত্রের ঐক্য বজায় রাখাও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বানানের ত্রুটিগুলো নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলার নেই। প্রকাশনীর অব্যবস্থাপনাকেও এ ক্ষেত্রে দায়ি করা যায়। যথাযথ সম্পাদনা বা প্রুফরিডারের হাতে উপযোগী পরিচর্যার অভাবে বেশিরভাগ বইতেই আমরা এমন হ-য-ব-র-ল ভাব লক্ষ্য করি। যা সাহিত্যের যথাযথ মান বিচারে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে প্রতিভাত হয়।
সবমিলিয়ে হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পেরেছে উপন্যাসটি। কিছু ত্রুটিও উতরে গেছে কাহিনি বর্ণনায়। তার ক্ষুরধার লেখনি পাঠককে আরো বেশি মুগ্ধ করুক। কথাসাহিত্যে যুক্ত হোক নতুন পালক। হাবীবাহ্ নাসরীনের সফলতা কামনা করে পাঠকের হাতেই তুলে দিতে চাই ‘তুমি আছো, তুমি নেই’।
এসইউ/আরআইপি