হাইওয়ে : গতিশীল জীবননির্ভর উপন্যাস
রুয়েট শিক্ষার্থী রায়হানুল ফেরদৌস রাজের প্রথম উপন্যাস ‘হাইওয়ে’। উপন্যাসটি গতিশীল জীবননির্ভর চমৎকার এক প্লটের উপর নির্মিত। হাইওয়েতে সবসময় মানুষ গতিশীল থাকে। জীবনগাড়িও অনুরূপ। বরং শেষযাত্রার আগ পর্যন্ত তা থামে না। ইঞ্জিনচালিত গাড়ির মত জীবনগাড়ি বিকল হয় না।
রাজের উপন্যাসটি এমনই একটি প্লটের উপর নির্মিত। উপন্যাসের পরিসর সীমিত। এতে ছোটগল্পের রেশ ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’ বলে আক্ষেপ আছে। বাস্তবতা হলো- হুমায়ূন প্রভাব বলয়ে বাংলাদেশের তরুণদের সাহিত্যচর্চা চলছে এরই প্রমাণ উপন্যাসটি। অনেকটা বড় গল্পের মতোই মনে হয়। তবুও যদি কোনো লেখক আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ কিংবা হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরক’র মতো ছোট পরিসরে একটা অনবদ্য উপন্যাস সৃষ্টি করতে পারে তাতে দোষ কী!
এ উপন্যাসে তারেক-রূপান্তির প্রণয়পর্ব বহু আগেই শেষ হয়েছে। দু’জন আজ দুই ভিন্ন সংসারের মানুষ। চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে ভাগ্যক্রমে একই বাসে পাশাপাশি বসে তারা। দু’জনের একসময় প্রেম ছিল গভীর। সেই না পাওয়া প্রেমই আজ দু’জনকে বিষণ্ন করে।
মাঝপথে গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় তারা পরস্পরের সঙ্গে দু’টো কথা বেশি বলারই সুযোগ পায়। শরীরী দূরত্ব কমলেও দু’জনের মনের দূরত্ব কমেনি। একজন আরেকজনের বোঝাপড়াটা ঠিকই আগের মতই আছে। তারেকের সঙ্গে ছিল তার অফিস সহকারী জলিল। এ উপন্যাসে জলিল চরিত্রের আধিপত্য কেন্দ্রীয় চরিত্রকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। জলিলের প্রেমের গল্পটা ব্যর্থতার। যে স্থানে আজ গাড়িটা নষ্ট হয়েছে সেখানেই তার প্রেমবৃক্ষ অঙ্কুরিত হয় এবং সমাধিও ঘটে। এজন্যই জলিল চরিত্রটা বেশ আধিপত্য বিস্তার করেছে এবং সবশেষ তা একটা বিরাট প্রশ্ন রেখেই শেষ হয়েছে। জলিলের মতো চরিত্রের মুখ দিয়ে যখন বের হয়, ‘খাদ্য শরীর টিকিয়ে রাখে আর স্বপ্ন টিকিয়ে রাখে মন’। তখন স্পষ্টতই বোঝা যায় এ চরিত্র কতটা শক্তিশালী।
অন্যদিকে তারেকের স্ত্রী সুচিতা দুই সন্তানকে নিয়ে বিষণ্ন প্রহর কাটায়। তারেক কখনো তার সঙ্গে ঝগড়া করেনি। ভালোবাসার ফসল দু’টো তাদের ঘরে। শরীর কাছে এসেছে; আসেনি মন। সংসার হয়েছে, সব হয়েছে- দূরত্ব ঘোচেনি। দাম্পত্যে সব হয়েছে; তবুও তারেকের মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ শব্দটি শোনেনি সুচিতা। সৌভাগ্যক্রমে এবার শুনতে পেল ফোনে।
রূপান্তি আজও তারেককে বোঝে আগের মতোই। তারেকের সামনে নিজের চঞ্চলতাই প্রকাশ করে সে। স্বল্পযাত্রায় নিজেকে অভিমানী প্রেমিকার ভূমিকাতেই রাখে। মাঝে জলিলকে রেখে তাদের দু’জনেরই সময় পার হয়। গাড়িটা আর ঠিক হয় না। সেই গাড়ির থেকেও আরো একটা ভালো গাড়ি পেয়ে যায় তারা। কিন্তু গন্তব্যে আর পৌঁছানো হয় না। লেখক নামকরণেই বোধকরি সেটা বলে দিয়েছেন। ‘হাইওয়ে’তে দুর্ঘটনা ঘটে না এমনটা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক! উপন্যাসের তিন চরিত্র তারেক, রূপান্তি ও জলিল চলে যায় না ফেরার দেশে।
তারেক-রূপান্তি একসময় একসঙ্গে মরতে চেয়েছিল। ভালোবাসা পরিণতি না পেলেও মৃত্যুভাগ্য তাদের একসঙ্গেই ছিল। যদিও জলিল চরিত্রটি দুর্ঘটনাতেই হারিয়ে যায়! বিধবা সুচিতা সন্তানদের নিয়ে ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার হয়। মেলেনি ভালোবাসা, হলো না দীর্ঘ সংসারযাত্রা।
কেবল রূপা আর ঋদ্ধরই নয় উপন্যাস শেষে একটা প্রশ্ন আমাদেরও- সব চরিত্রের মৃত্যুই কী পরিণতির জন্য দরকার ছিল? নাকি ভিন্নভাবেও ভাবা যেত! পরিসর বড় হলে হতো। যদিও এটা লেখকের স্বাধীনতার বিষয়। তবে গল্পে কোনো মৃত্যুই অনিবার্য না হলে ঘটানো উচিত নয়। তাতে শিল্প মান নষ্ট হয়। তারপরও লেখকের ভাষায় বলছি- ‘অতৃপ্তির মাঝেও তৃপ্তি আছে।’
কাহিনির বাইরে বিবেচনা করতে গেলে বইয়ে বানানের বিষয়ে আরেকটু সতর্ক হওয়া জরুরি ছিল। ‘মুহূর্ত’ বানানটা শেষ মুহূর্তে শুদ্ধ হয়েছে। ৭ নম্বর পৃষ্ঠার শেষ প্যারায় চারবার ‘কিন্তু’ শব্দটা ব্যবহার করায় একটু বেমানান লেগেছে। পৃষ্ঠা নম্বর ১৮-তে ‘তারেক অপলক দৃষ্টিতে ফোন হাতে নিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল’ বাক্যটা সংক্ষেপ ও সুন্দর করা যেতে পারে। ২০ পৃষ্ঠাতেও এমন একটা বাক্য আছে- ‘যাকে মেয়েটিকে ভালোবেসেছিলে তাকে বিয়ে করনি কেন?’ ২৪ পৃষ্ঠায় লক্ষ্য/লক্ষ এ দুটোর পার্থক্য হয়নি। ২৭ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারায় ‘তারেক’ নামটি আটবার এসেছে। এখানে সর্বনাম ব্যবহার করা উচিত ছিল। ৩৩ পৃষ্ঠায় বলা আছে- ‘তেমন বেশি কথা বলত না, কিন্তু সবার সাথেই কথা বলতো।’ এখানেও সচেতন হওয়া দরকার ছিল। ভাবটা ভাষায় আসেনি।
তারেক-রূপান্তির প্রথম সাক্ষাত তথা- কথা বলার প্লটটি আরেকটু শক্ত হওয়া জরুরি ছিল। তবে সবমিলিয়ে সমালোচনাকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে উপন্যাসটিকে চমৎকারই বলতে হবে। যে লেখকের প্রথম সৃষ্টি এমন সুন্দর; সামনে তার হাত দিয়ে আরো কিছু নান্দনিক সাহিত্যকর্ম আশা করা যেতেই পারে।
প্রকাশনী : পূর্বা প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : হাজ্জাজ তানিম
মূল্য : ১৪০ টাকা
এসইউ/জেআইএম