ছোট ছোট সুখ
এয়ারপোর্টে নিপাকে নামাতে এসেছে সজীব। নিপার সঙ্গে চার বছরের টুপুল, ওদের ছেলে। নিপার চোখ ছল ছল করছে, যে কোন মুহূর্তে কেঁদে ফেলবে। বাবার কোল থেকে একটু অবাক হয়ে মাকে দেখছে টুপুল আর মনোযোগ দিয়ে আঙ্গুল চুষছে। ওর এই বদভ্যাসটা কিছুতেই সারানো যাচ্ছে না। কতো চেষ্টাই না করেছে নিপা।
`তুমি কিন্তু দুবেলা বাইরে জাঙ্ক ফুড খাবে না। আমি তোমার জন্য বাটিতে বাটিতে তরকারি আলাদা করে ডিপে রেখে এসেছি।`
সজীব ভাবলেশহীন মুখে শুনছে।
`যা ঠাণ্ডা, গ্লাভস ছাড়া বের হবে না। তোমার তো আবার কিছুই মনে থাকে না` বলতে বলতে নিপা একটু চিন্তায় পড়ে গেল। সজীব তো একা একা কিছুই খুঁজে পায় না।
`বাসা গুছিয়ে রাখবে, জামা কাপড় মোজা এখানে সেখানে ফেলে রাখবে না, অবশ্য তুমি যা অগোছালো।` এটা শুধু বলার জন্যই বলা, কোন লাভ নেই যদিও।
`আর আমাকে রোজ ফোন করবে। একটু রাত করে করলেই পাবে।` নিপার কণ্ঠটা খুব করুণ শোনায়।
সজীব এইবার হেসে ফেলে। `মাত্র তো সাত দিন, বিয়ে বাড়ির হই চইয়ে আমার কথা ভাবার তুমি সময়ই পাবে না। আমি একটু পরেই প্রফেসরকে পেপারটা জমা দিয়ে ছুটির কথা বলবো। তার পরেই তো চলে আসছি। তুমি এমন ভাব করছ যেন সারা জীবনের জন্যই চলে যাচ্ছ।`
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিপা সজীবের হাত ধরে বসে থাকলো। বিয়ের পর ছয় বছরে এই প্রথম ওরা দুজন আলাদা হবে। তাছাড়া, ওর যে কোন ছোট্ট আনন্দও সজীবকে ছাড়া পরিপূর্ণ হয় না, সেখানে দেশে যাচ্ছে ছোট ভাইয়ের বিয়েতে, এতো বিশাল ব্যাপার।
সজীব ওকে এক হাতে আলতো করে জড়িয়ে সিকিউরিটির কাছে নিয়ে যাচ্ছিল, নিপা আর পারলো না। শেষ মুহূর্তে ঠিক ঠিক কেঁদে ফেললো। `আমার মন বলছে তুমি আসবে না।` সজীব একথায় জোরে হেসে ওঠে, `আরে পাগল নাকি?` হাসতে হাসতেই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আলতো করে কপালে চুমু খায়। সব শেষে টুপুলকে ঠেসে ধরে দুটো চুমু দিয়ে নিপার কোলে দিয়ে দেয়। এইবার ওরও কেন যেন খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু নিপার সামনে কিছুতেই সেটা দেখানো যাবে না।
সজীব খুব সুন্দর গান করে। `বধূ কোন আলো লাগলো চোখে` আর `আমারও পরানও যাহা চায়` এই গান দুটো ওর সবচেয়ে ভালো লাগে। সজীবকে অনেক অনুনয় করে ওর কণ্ঠে এই গান দুটো রেকর্ড করে এনেছে নিপা। ভেবেছিল প্লেনে শুনবে, কিন্তু একেবারেই ফুরসৎ পাওয়া গেল না। টুপুল ভীষণ ব্যস্ত রাখল ওকে। সিটে বসতে চায় না একদম। অন্য যাত্রীদেরকে বিরক্ত করছে। একটু পর পর বাথরুমে নিয়ে যাও, খেলো। খাওয়া দাওয়া নিয়েও অনেক বায়না। হিথরো পর্যন্ত আসতেই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেছে নিপা। নেমেই বাথরুম থেকে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে ছুটল ফোন বুথের দিকে। পে ফোন থেকে দুরু দুরু বুকে বাসার নাম্বার ঘুরাল।
`হ্যালো` সজীবের কণ্ঠ।
`ছুটি পেয়েছ?` ওপাশে কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। যা বোঝার তাতেই বুঝে গেছে নিপা।
`আমাকে সামারে আরেকটা কোর্স নিতে বলেছে প্রফেসর। তুমি মন খারাপ করো না প্লিজ। সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। এনজয় করো।`
এক মুহূর্তে নিপার সমস্ত আনন্দ, ভাইয়ের বিয়ে ঘিরে উত্তেজনা সব উবে গেল।
নিপা বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে, তিন ভাইয়ের বড়। ওর তো অনেক দায়িত্বও আছে। ঢাকায় নেমে অনেক কষ্টে মুখের হাসিটুকু ধরে রাখল ও। বাবা, মাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না কিছুতেই। নিপা তবু যতটুকু ঠিক ছিল, কিন্তু বেঁকে বসলো টুপুল। বাবার সাথে তার ভীষণ খাতির। তাই বলে সে যে এমন অনশন শুরু করবে কে জানতো?
গায়ে হলুদের দিন তার জন্য সুন্দর এক ধুতি কেনা হয়েছে। সেটা তো সে কিছুতেই পরবে না, বরং ছেঁড়া একটা গেঞ্জি পরে ছিল, সেটা পরেই নাকি যাবে। আরেক্তু হলে নিপারই হয়তো যাওয়া হত না। বিয়ের দিন সবাই ফ্যামিলি পিকচার তুলছে, নিপার খুব একা একা লাগছিল। এতো সাজগোজ, সজীব কিছুই দেখল না। দেখলেও যে সবসময় প্রশংসায় গলে পড়ে তা না। তবুও কেন জানি দেখাতে ইচ্ছা করে। টুপুলকে অনেক জোর করেও ছবি তোলানো গেল না, এমনকি খাওয়ানো ও গেল না। একসময় হতাশ হয়ে, নিজেরও আর কিছু মুখে দিতে ইচ্ছা করছিল না নিপার।
আর কেউ বুঝতে না পারলেও ওর মন খারাপটা মা ঠিকই টের পেলো। ও যে গভীর রাতে না ঘুমিয়ে সজীবের রেকর্ড করা গান শুনে প্রতিদিন, সেটাও মা জেনে গেছে কেমন করে যেন। কথা ছিল নিপা এক মাস থাকবে। রবিনের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর, তিন সপ্তাহের মাথায় টিকিট বদলে ওদেরকে পাঠিয়ে দিলেন মা। ছোট ভাইয়েরা কিছুটা বিরক্ত হয়েছে ওর উপরে। হলে হোক। সজীবকে ছাড়া সব কিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগলে ওর কী দোষ? তাছাড়া টুপুল ও তো কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না। এ কদিনেই কেমন শুকিয়ে গেছে, বুকের হাড় বেরিয়ে গেছে।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে সজীবকে না দেখে ভীষণ অবাক হল নিপা। দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। আবার অভিমানও হচ্ছে। জ্যামে আটকা পড়লো নাকি? একটু সময় হাতে নিয়ে বের হবে না? অনেকক্ষণ ধরে ছটফট করে বাসায় ফোন করলো ফোন বুথ থেকে। নাহ, কেউ ফোন ধরছে না। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করে যখন খুব বেশি নার্ভাস হয়ে পড়লো, তখন মনে হল `ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাই, কোন বিপদ হল না তো আবার?`
চাবি দিয়ে বাসার দরজা খুলছে যখন ওর তখন রীতিমত হাত কাঁপছে। কী দেখবে কে জানে? ঘরে ঢুকে প্রথমেই মনে হল `এটা কী ওদের দু’বেড রুমের পুরনো এপার্টমেন্ট নাকি কোন দামি হোটেলের সুইট?` প্রতিটা ফার্নিচার ঝকঝক করছে। ছোট শো পিস গুলো পর্যন্ত। বাথ টাব, সিঙ্ক।এমনকি পুরনো পানির কল গুলো পর্যন্ত ঝকঝকে। মেঝেতে আলো পিছলে যাচ্ছে।নিপার কেমন যেন শীত শীত লাগছে, `তবে কী অন্য কেউ আছে সজীবের সাথে? কোন মেয়ে? ও তো দুনিয়ার অগোছালো। সেজন্যই নিপাকে আনতে যায় নি?` ওর কেমন যেন অসুস্থ লাগছে। কিন্তু সজীব কোথায়? ওর পা দুটো ভারী লাগছে। বেডরুমের কোথাও ওকে পেলো না তন্ন তন্ন করেও।
ও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, কোন মতে ফোনটা উঠিয়েছে, পুলিশকে ফোন করতে হবে। ঠিক সেই সময় কে যেন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। সেই পরিচিত গন্ধ, প্রিয় আলিঙ্গন।
নিপার সারা মুখে চোখের পানির মাখামাখি। `তুমি কী পাগল? আমাদেরকে আনতে যাও নি কেন?`
`আমাকে না দেখে কী করো আর তারপরে দেখতে পেয়ে কেমন খুশি হও সেটা দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিল খুব।`
`এই ঘর বাড়ি এভাবে সাজিয়েছে কে? ফুলদানিতে ফুল ও এনেছে?`
`আমি তো জানি তুমি কেমন খুঁতখুঁতে। একদিন বলেছিলে তোমার জন্য সবচেয়ে বড় উপহার হবে আমি যদি ঘর গুছিয়ে দেই। আমি দুই দিন ধরে পড়াশুনা ক্লাস সব বাদ দিয়ে মেঝে ঘষেছি, পানির কল গুলো স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলে মেজে মেজে পরিষ্কার করেছি। আমি জানতাম তুমি অনেক খুশি হবে। `নিপার চোখে রাজ্যের বিস্ময়।ওর সব কিছু স্বপ্নের মতো লাগছে।
`আমার খুব খিদে লেগেছে, টুপুলও খাবে তো। আছে কিছু বাসায়?`
`চল তো কিচেনে।`
রান্না ঘরে যেয়ে নিপার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। `এই সব কে রান্না করে পাঠিয়েছে?`
`কেউ পাঠায় নি। আমি রেঁধেছি।` সজীবের গলায় তৃপ্তির আমেজ। সে কিছুই বাদ দেয় নি, মাছ, মাংস, সবজি, শাক, ডাল, সব নিয়ে ছয় আইটেম। ফ্রিজ খুলে টুপুলকে যখন ওর জন্য কিনে রাখা ব্লু বেরি দেখাল ও ভীষণ খুশি।
`তুমি কেমন করে এগুলো রাঁধলে?`
`রান্না আবার একটা কাজ নাকি?` হাসছে সজীব, তৃপ্তির হাসি, ওর সেই ভুবন ভুলানো হাসি।
নিপার খালি অবাক হওয়ার পালা। বুকের ভিতরে সুখটাও অনেক সময় চিন চিন করে।
ভাইয়ের বিয়েতে না যাওয়ার অপরাধটা কখন যেন ক্ষমা করে দিয়েছে।
এইচআর/আরআইপি