ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

`দেশ` এখন স্ক্যান্ডাল, গুজব আর পুরুষবাজির পত্রিকা: তসলিমা নাসরিন

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৭:৩২ পিএম, ২৩ মার্চ ২০১৫

কলকাতার দেশ পত্রিকা একসময় ছিল খুব উন্নতমানের সাহিত্যের পত্রিকা। এখন হয়ে গেছে গুজব, স্ক্যান্ডাল, কাতুকুতু, নাক সিঁটকানো, খোঁচা মারা, দলবাজি, পুরুষবাজি, মাস্তানি, শয়তানি, মিথ্যে আর অপবাদের পত্রিকা। আর এগুলোর জন্য বেছে নেওয়া হয় আমাকে। কারণ আমার সম্পর্কে কুৎসা রটালে মার খাবার ভয় নেই, মামলায় ফেঁসে যাওয়ার ডর নেই।

সাগরময় ঘোষ মারা যাওয়ার পর একসময় অমিতাভ চৌধুরী নামের এক চরিত্রহীন লোককে দেশ এর সম্পাদক করা হয়েছিল। ওই সম্পাদক আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য একবার ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন। কী, না, দেশ পত্রিকায় তিনি আমার সাক্ষাৎকার ছাপাতে চান, সাক্ষাৎকারটা নেবেন সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে আমার হোটেলে এক সকালে তিনি চলে এলেন। তাজ বেঙ্গলের লাউণ্জে বসে ব্রেকফাস্ট করতে করতে কথা বলছিলাম। সাক্ষাৎকার চলাকালীন অমিতাভ চৌধুরী শ্যামলকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে দিয়ে সেক্স নিয়ে প্রশ্ন করার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। সেক্স নিয়ে যে প্রশ্নই তাঁরা করছিলেন, আমি খুব নিস্পৃহ নির্লিপ্ত কণ্ঠে সেসবের উত্তর দিচ্ছিলাম। জীবনে ক’জনের সঙ্গে সেক্স করেছি- ওঁদের ওসব বিদঘুটে প্রশ্ন আমাকে লজ্জা দিচ্ছিল না, আমাকে বরং লজ্জা দিচ্ছিল আমার সামনে বসে থাকা ওই দুই বুড়োর জিভ বেরিয়ে আসা, চোখ বেরিয়ে আসা চেহারা। আমার সঙ্গে আমার ফরাসি প্রেমিক ছিল। ও বুঝতে পারছিল না আমরা কী নিয়ে কথা বলছি।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেওয়া ‘অশ্লীল’ সাক্ষাৎকারটি অমিতাভ চৌধরী ‘দেশ’-এ ছাপিয়েছিলেন। যৌনতার বিষয় ছিল বলে ওটিকে অশ্লীল বলছি না। বরং যৌনতাকে অশ্লীল বলে বিচার করা হচ্ছিল বলে ওটিকে অশ্লীল বলছি। একজন নারী, যে নারী নারীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, এমন কী যৌন স্বাধীনতায়ও (যে যৌন স্বাধীনতার অর্থ ‘যত্র তত্র শুয়ে বেড়ানো’ নয়, বরং এক অর্থে ‘যত্র তত্র শুয়ে না বেড়ানো’, এবং যৌনসম্পর্কে হ্যাঁ বলার মতো না বলারও স্বাধীনতা) তাকে লোকসমক্ষে একটা বিকট যৌন রাক্ষুসী রূপে দেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন দেশ’এর সম্পাদক, সাগরময় ঘোষের সঙ্গে রুচিতে যাঁর এক পাহাড় সমান ফারাক।

এরপর লোকটি ফের পরের বছর আমি কলকাতায় পৌঁছলেই উন্মাদ হয়ে উঠলেন। আমার সঙ্গে নাকি ভীষণ জরুরি কথা আছে। তাজ বেঙ্গলের এক বারে এক সন্ধ্যাবেলায় দেখা করতে চাইলেন। আমি কলকাতায় ওই হোটেলেই উঠেছিলাম। বারে গিয়ে দেখি তিনি হুইস্কি অর্ডার দিচ্ছেন দুজনের জন্য। না, আমি তো হুইস্কি খাবো না। তিনি পিড়াপিড়ি করতে লাগলেন। আমি বললাম, খেলে বড় জোর একটা কোক খাবো। শুনে তিনি চুপসে গেলেন। এরপর ইনিয়ে বিনিয়ে শুরু করলেন সেক্স প্রসঙ্গ। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য কথা বলি। দেশ টেশ নিয়ে। তিনি সেক্স ছাড়া আর কিছুতে উৎসাহী নন বুঝে, গ্লাসের কোকটুকু শেষ করে, ‘আমার বাবা এসেছেন দেশ থেকে, তিনি রুমে একা আছেন’ বলে উঠে যাই। তিনি চুপসে বসে থাকেন। তিনি ভেবেছিলেন আমি যৌন স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, সুতরাং তিনি আমার সঙ্গে যৌনতা নিয়ে কথা বললে আমি মহা উৎসাহে শুনে যাবো। আমার ওই না শুনতে চাওয়াটা যে আমার যৌন স্বাধীনতার মতোই আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সেটা বুঝতে ম্যাগসেসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রাকৃতির খোঁড়া সম্পাদকটি পারেননি।

এরপরই দেশ পত্রিকায় অমিতাভ চৌধুরী ছাপিয়েছিলেন আমার বিরুদ্ধে লেখা সমরেশ মজুমদারের কুৎসারচনা, যে কুৎসারচনার প্রতিটি বর্ণ মিথ্যে। এই মজুমদারকে, আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে, যখন বাংলাদেশে খুব কম লোকে ওঁকে চেনে, আমার প্রকাশকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। ওঁর বই ছাপানোর জন্য অনুরোধ করেছিলাম। বাংলাদেশে আমি তখন জনপ্রিয় লেখক, আমার অনুরোধ রেখেছিলেন প্রকাশকরা। উপকারীর উপকার স্বীকার তো করেনইনি, বরং মজুমদার আমার কুৎসা রটিয়েছিলেন, যে কুৎসা অমিতাভ চৌধুরী অত্যন্ত সযত্নে ছাপিয়েছিলেন, ২০০০ সালের ১০ জুন-এ।

ওই সময়টা এমন যখন কলকাতা আমাকে ভীষণ ভালোবাসছে। অনেক বছর পর ভারতের ভিসা পেয়ে ইউরোপ থেকে কলকাতায় ছুটে গিয়েছি। কলকাতা-বইমেলায় আমাকে দেখার জন্য, আমার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ভিড় উপচে পড়ছে। পুলিশকে লাঠিচার্য করতে হচ্ছে ভিড় সামাল দিতে। ওসব দৃশ্য কলকাতার অনেক লেখকদের বড় পীড়া দিয়েছিল।

মজুমদার সেই লেখকদের মধ্যে একজন। তাছাড়াও বাংলাদেশে তিনি দ্রুত জনপ্রিয় হতে চেয়েছিলেন। তাঁর বই বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশে, চাইছিলেন আরও বেশি বিক্রি হোক। তিনি টের পেয়েছিলেন, বাংলাদেশের নারীবিরোধী মুসলিম সমাজ প্রচণ্ড তসলিমাবিদ্বেষী আর দেশ পত্রিকা বাংলাদেশের লোকরাও পড়ে, সুতরাং ওই পত্রিকাটিতে তিনি যদি আমার কুৎসারচনা প্রকাশ করেন, তবে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে, পশ্চিমবঙ্গে আমার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে প্লাস বাংলাদেশে আমার নিন্দুক হিসেবে তাঁর সমাদরও বেশ হবে।

এরপর জানি না আর কোন কোন নিবন্ধ প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল কিনা আমার চরিত্র হনন করে। তবে কিছু না ছাপা হলেও ঈর্ষান্বিত তসলিমাবিদ্বেষী লেখককূল দেশ পত্রিকায় তসলিমার লেখা বন্ধ করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে তসলিমার বই বেরোলে ইভেন নট এ সিঙ্গল ওয়ার্ড সে বই নিয়ে, এই কর্তব্যটি দেশ সুষ্ঠুভাবে গত কয়েকবছর যাবৎ পালন করছে।

আমাকে পাঠকের মন থেকে ভুলিয়ে দিতে চাইছো, ভালো কথা, তবে আমাকে কেন নিজেরাই তোমরা ভুলতে পারছো না হে? এই সেদিন, ১৭ ফেব্রুয়ারিতে, আমার বিরুদ্ধে বাদল বসুর করা এক গাদা কুৎসা ছাপিয়েছো। তারপর ১৭ মার্চে আবারও ঢেলেছো মিথ্যে-আর কুৎসার ডালি।

‘দেশ’ এর এমনই মন্দা চলছে যে ছোটলোকদের দিয়ে গুজব লিখিয়ে তা বিক্রি করতে হয়? কলকাতার পাঁড় মাতালরা অন্য একজনকে ‘মাতাল’ বলে গালি দিচ্ছে, বাংলা ভাষার ‘শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকা’য় তা অত্যন্ত গুরুত্বসহ ছাপা হচ্ছে! আমি কবে মদ খেয়েছি, কবে মদ খেয়ে মাতাল হয়েছি, রাত ক’টার সময় ঘরে ফিরেছি, ভেতর-ঘর থেকে কে আমাকে গালি দিয়েছে এসব লিখে নারীবিদ্বেষী ছোটলোকরা দেশের নারীবাদী লেখককে হেনস্থা করতে চাইছেন, চাইছেন পাঠকসমাজে যেন সে তার সম্মান হারায়। মজুমদার আর বসু নিচুমনের নিচুমানের লোক। কিন্তু ‘দেশ’ কেন এত নিচে নামলো?

এসআরজে