ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

বিজয়ের আর্তনাদ

প্রকাশিত: ০৯:২২ এএম, ০১ জানুয়ারি ২০১৭

হৃদয় বিদারক আর্তচিৎকারে চারপাশ কেঁপে উঠল! হানাদার বাহিনী বেয়নেট ঢুকিয়ে দিল কাকলীর বুকে। পাঁচ বছরের ফুটফুটে শিশু কাকলীকে আছড়ে ফেলে দেয়া হলো সিঁড়ির উপর! ছোট্ট শরীরের রক্তে ভিজে গেল সিঁড়ি আর মেঝে। ততক্ষণে ছোপ ছোপ রক্তের সাথে মিশে গেল কাকলীর অবুঝ প্রাণ, থেমে গেল শেষ ক্রন্দনরোল! পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে শহর থেকে গ্রামের আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন মনমথ কুণ্ডু। কিন্তু, শেষ রক্ষা আর হলো না। বর্বরোচিত নির্যাতনের এক পর্যায়ে ইতিহাস হতে হলো তাদের।

ডেডলাইনঃ ২৩ এপ্রিল, ১৯৭১। সকাল থেকেই গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসছিল চারপাশ থেকে। গুলির আওয়াজ পেয়েই মনমথ বুঝতে পারলেন শহর থেকে এবার হানাদার বাহিনীরা এই গ্রামেও হামলা চালানোর জন্য এগিয়ে আসছে। চোখের জল মুছতে মুছতে স্ত্রীকে বিস্ময়ের সাথে বললেন, ‘শেষ রক্ষা বুঝি আর হলো না তৃপ্তির মা! আমাদের কথা তো ভাবছি না; ছেলে-মেয়েদের কী অত্যাচার না পোহাতে হয়!’ নিকটাত্মীয় দুপচাঁচিয়ার ক্ষিতিশ চন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন মনমথ, মেয়ের জামাই কানাইলাল, ছোটভাই সন্তোষ ও তাঁদের পরিজন। বগুড়া শহরে পাকিস্তানি মিলিটারির আক্রমন হয় ২১ এপ্রিল, ১৯৭১। সেই রাত্রেই প্রাণভয়ে পালিয়ে আসেন মনমথ কুণ্ডু। পরদিন সকালে রাস্তায় বের হতে না হতেই আকস্মিক এক গুলিতে শহীদ হলেন ক্ষিতিশ চন্দ্র। তাঁর ছয় ফুট উচ্চতার বিশাল দেহ পড়ে রইলো রাস্তার ধারে মন্দিরের পাশে। ততক্ষণে মন্দিরে লুটপাট শুরু হয়ে গেছে হানাদার বাহিনী ও রাজাকার আজিজার রহমান এবং তার দোসর আব্দুল মজিদের নেতৃত্বে। স্বর্ণালংকার, কাঁসার তৈজসপত্র, অর্থকড়ি কিছুই আর বাঁকি রইলো না। শুরু হলো আশেপাশের প্রতিপত্তিশালী হিন্দু বাড়িঘর লুণ্ঠন। আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হলো সেসব বাড়িঘরে। যাকে পাওয়া গেল, তাকেই ঝাঁঝরা হতে হলো গুলিতে। অকাতরে ঝরে গেল কত প্রাণ! ইউপি দফাদার তহিরউদ্দিন শাহ, মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমান ও তার পরিবার কেউই রক্ষা পেলেন না।

অপরাশেন সার্চলাইট তখন ক্ষিতিশ চন্দ্রের পুরনো জমিদার বাড়িতে। একটানা গোলাগুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়া হলো মন্দিরের ফটক, চৌধুরী বাড়ির প্রবেশদ্বার। বুলেট বিদ্ধ করা হয় চৌধুরী বাড়ির ফটকে শোভিত স্বনামধন্য ভাস্কর্যশিল্পী নলিনীমোহন কুণ্ডুর হাতে গড়া কারুকার্যপূর্ণ বিভিন্ন দেব-দেবীর ভাস্কর্য। মনমথ কুণ্ডু ও তার পরিবার তখন ঠিক দাঁড়িয়ে মৃত্যুর সামনে। অস্ত্রসজ্জিত একদল মিলিটারি সিঁড়ি পেড়িয়ে উঠে পড়লো চৌধুরী বাড়ির দোতলায়। লাথি মেরে ভেঙে ফেললো দরজা। ততক্ষণে এক ভয়ার্ত পরিবেশ বিরাজ করছিল সম্পূর্ণ চৌধুরী বাড়িজুড়ে। এ এক মৃত্যুর হাতছানি! জীবন তখন প্রতিরোধহীনতায়, অকাতরে মৃত্যুকে স্পর্শ করার এক হৃদয়বিদারক সন্ধিক্ষণে। হানাদার বাহিনীর সাথে সেদিন নির্দেশক হিসেবে ছিল পাকিস্তানি দোসর মজিদ। মনমথকে মজিদ জিজ্ঞেস করলো, ‘সোনা-দানা, ট্যাকা-পয়সা যা আছে দিয়া দ্যান, তালে সবাক ছ্যাড়া দিমু, না হলে কলে সবাক ম্যারা ফ্যালাবে।’ কথামত তাই করলেন। মনমথ হাতজোর করে পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন প্রাণপ্রিয় নাতনী শিশু কাকলীর জন্য। পাকিস্তানি সেনারা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কানাইলালের স্ত্রী তৃপ্তির দিকে। নিজেদের মধ্যে নোংরা ভাষায় আলাপ করতে থাকে- ‘ইয়ে লাড়কি বহত কামাল কি হে। ইসে হামারে সাথ লে চালতে হে’। কিন্তু তাদের দলের কমান্ডার উত্তর দিল, আভি নেহি, বাদ মে দেখা যায়েগা’।

অবশেষে বারোজনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে বলল পাকিস্তানি আর্মি। আর পাঁচবছরের কোমলমতি ছোট্ট শিশু কাকলীকে ততক্ষণে হাতের উপর নিয়ে রাইফেলের বেয়নেটের তীক্ষ্ণ শূল ঢুকিয়ে সিঁড়িতে সজোরে আছাড় মেরে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি মেজর ইশতিয়ার খাঁ। স্বজনদের সামনে ওইটুকুন শিশুকে হত্যা করতেও হাত কাঁপেনি হায়েনাদের। কয়েক সেকেন্ডের ব্রাশফায়ারে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ওরা বারোজন। রক্তধারা বয়ে চলে সিঁড়ি বেয়ে। কারো অনুনয়-বিনয় সেদিন বাধ মানেনি মৃত্যুর পথ রুদ্ধ করতে। গুলি লাগার পর যখন সবাই মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো, সেইসাথে লুটিয়ে পড়ার ভান করেছিল কাকলীর মা তৃপ্তি রাণী। দূর্ভাগ্যবশতঃ তৃপ্তির শরীরে সেদিন কোন বুলেট লাগেনি! বলতে গেলে ভাগ্যের এ এক নির্মম পরিহাস! কিছুক্ষণের জন্য তৃপ্তি হয়ে উঠেছিল অনুভূতিশূন্য! জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধ্বে ছিল তার সকল অনুভব! নিজেই সে বুঝতে পারছিল না, সে জীবিত না মৃত! জীবিত অবস্থায় পড়ে থেকেও হৃদয়ে যে বুলেট বিদ্ধ হলো, তা কখনোই পৃথিবীর কোনকিছুর বিনিময়ে ফেরত আনা অসম্ভব। বুকের ধন তো আর কখনোই বুকে ফিরে আসবে না। এই ঘৃণিত হত্যাযজ্ঞের পর চারপাশে এক থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। এই বর্বরোচিত ঘটনার পরপরই দুপচাঁচিয়া উপজেলা শহরে একের পর এক চলতে থাকে পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঘরের মধ্যে তালাবদ্ধ রেখে পাকিস্তানি দোসররা আগুন লাগিয়ে দেয় ওষুধ ব্যবসায়ী সতীশচন্দ্র বসাককে। পুকুর পাড়ে হত্যা করা হলো শরৎ মজুমদার, অক্ষয় কুণ্ডু, আজিজুল হককে। লুটপাটের মহড়া চলে হিন্দুদের বাড়িতে। নির্বিশেষে হত্যা করা হয় হিন্দু-মুসলমানদের।

লাশগুলো সৎকারের জন্য নিয়ে আসা হলো চৌধুরীর পুকুর সংলগ্ন এলাকায়। নিজের প্রতিবেশীদের নিজেরাই মাটি খুঁড়ে সমাধিস্থ করলেন অনন্ত মোহন, নিমাই সুন্দর ও বীরেন্দ্রনাথ। তৃপ্তির ক্রন্দনরোলে ততক্ষণে এ খবর যুদ্ধ ক্যাম্পে রটে গেল চৌধুরী বাড়ির সুন্দরী ঐ রমনী মরেনি। অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে!

শোকের পাহাড় নিয়ে অন্তত বাঁচার তাগিদে তৃপ্তি বেড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। কিন্তু রাজাকার শিবিরে ওর বেঁচে থাকার খবর পৌঁছার কারণে তৃপ্তিকে রাস্তায় আটকে দেয় মজিদ রাজাকারের দোসর আফসার আলী। পরে খবর দিয়ে ডেকে আনা হয় মজিদকে। তৃপ্তিকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় মজিদ। নিজের শেষ রক্ষা আর হয় না তৃপ্তির! মজিদের লালসা থেকে রেহাই পায় না সে। মেজর ইশতিয়াক খাঁকে খুশী করতে তৃপ্তিকে উপহার হিসেবে স্কুল ক্যাম্পে রেখে আসে মজিদ। পর্যায়ক্রমে ছয় শকুন মিলে ব্যবচ্ছেদ করে। অজ্ঞান অবস্থায় ক্যাম্পের এক পাশে ফেলে রাখা হয় তাকে। রাত বাড়তে থাকলেও অবচেতন নারী শরীরের লালসা সামলাতে না পেরে মজিদ নিজের ঘরে তোলে তৃপ্তিকে।

মজিদ লোকদেখানো তৃতীয় স্ত্রীর মর্যাদা দেয় তৃপ্তিকে। দ্বিতীয়বারও মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসে তৃপ্তি। ব্যর্থ চেষ্টায় আত্মহত্যাও তখন বোধহয় অকার্যকরী হয়ে পড়েছিল ওর কাছে। কতটা ভয়ঙ্কর সময় সে অতিক্রম করছিল যে মৃত্যু তাকে তিলেতিলে যন্ত্রণা দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। কোন হত্যা কিংবা হত্যাচেষ্টাও তার প্রাণ কেড়ে নিতে পারছিল না! সবকিছু চলছিল জোরপূর্বক। শুধু যে তার প্রতি জোরপূর্বক চলছিল; তা নয়! বাংলা মায়ের প্রতিটি কন্যা সন্তানের প্রতি যা চলছিল তার সবটুকুই ছিল জোরপূর্বক। মৃত্যুর অনুভবে এক ধরনের প্রবঞ্চনা! মৃত্যু অনুভূতি হৃদপিণ্ডকে ভেঙে চুরমার করে দিলেও মৃত্যু যেন বাঁধ সাধতো প্রাণটুকু শরীর থেকে আলাদা করতে। এ যন্ত্রণা যে কতটা অসহ্যের- কতটা বিদারকপূর্ণ তা বোঝানো কঠিন। তা শুধু তৃপ্তির মত শত-সহস্র বীরাঙ্গনারাই জানে।

মুক্তির লড়াইয়ে শহীদের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি তৃপ্তির চোখের নিচে বেড়েই চলেছে কালো দাগের মজবুত ঘনঘটা। মজিদের বাড়ির নিরাপত্তার বলয় কয়েকবার ভেদ করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয় তৃপ্তি। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি! নাম অজানা বর্বর পুরুষের ঔরসে তৃপ্তির গর্ভের সন্তানের বয়স তখন আনুমানিক সাত মাস। একদিকে মজিদের চলমান নিপীড়ন অন্যদিকে মজিদের বড় বউ খাদিজার অত্যাচারে নিজেকে বিলীনের পথে তুলে দেয় তৃপ্তি। তৃপ্তির হৃদয়ে শুধুই ভেসে উঠতে থাকে ২৩ এপ্রিলের ক্ষতচিহ্ন। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে একাই শোকের পাহাড় বহন করা কী তা শুধু তৃপ্তির মতো শহীদ পরিবারের সন্তানরাই বুঝবে! মাতৃগর্ভে বেড়ে উঠছে ধর্ষকের সন্তান। ধর্ষকের সন্তান ধারণ করা যে নির্লিপ্তভাবে মৃত্যুকে ফেরি করা তা কয়জনইবা বোঝে! দেশের হৃদয়জুড়ে তখনো ধর্ষণ-নিপীড়ন-অত্যাচার-হত্যা-লুণ্ঠন চলছেই। চক্রান্ত থামেনি এদেশের আলবদর-আলশামস-রাজাকার ও এদের দোসরদের। হিন্দুদের স্বর্ণালঙ্কার, অর্থে ভরে উঠে মজিদের সিন্ধুক। আজিজার রহমান তালুকদার আর আব্দুল মজিদের মতো রাজাকারের সূচারু চক্রান্তে অনেক মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ ঝরে পড়ে অকাতরে। মজিদ হত্যা করে নাম না জানা অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে। হত্যা-ধর্ষণ মজিদের কাছে নিত্যদিনের খেলা হয়ে উঠে টানা প্রায় নয় মাস।

ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ! চারপাশে নতুন আভাসের সূচনা হতে যাচ্ছে। কয়েক মাস ধরে যা হৃদয়ের অগোচরে ছিল, চোখের কোণে অশ্রুতে মিশে ছিল, সেই প্রত্যাশা বাস্তবায়নের পথে। ততদিনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ভ্রাতৃত্বপূর্ণতায় বাঙালির আকাঙ্ক্ষিত বিজয় নিশ্চিতের পথে। একটা একটা করে দিন অতিক্রান্ত হয়। আর বাংলার আকাশে ভাসতে থাকে স্বাধীনতার উচ্বােরসে। তবে তৃপ্তির হৃদয়ে যে অনুভূতির সঞ্চার হচ্ছে তা কী সত্যিই স্বাধীনতা? তবে যে স্বাধীনতার কথা ওর মনে জাগছে, কী-ই বা লাভ সেই স্বাধীনতা বহন করে? স্বামী-সন্তান হারিয়ে ধর্ষকের সন্তান গর্ভে ধারণ করে কোনো স্বাধীনতা কী হৃদয়ের মাঝে অন্তর্নিহিত থাকে? কথাগুলো নাগর নদের শুকিয়ে যাওয়া পথচলার দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে ভাবছে তৃপ্তি।

১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বগুড়া জেলায় পাকিস্তানি হায়েনাদের পতন ঘটলো বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর কয়েকটি বিশেষ অপারেশনে। মুক্ত হলো দুপচাঁচিয়াও। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বদানকারী দলের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এবিএম শাজাহানের নেতৃত্বে সেদিন বন্দি করা হলো আলবদর মজিদ, মজিবর, আফসারসহ অন্যান্যদের। ভেঙে গুড়িয়ে, আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হলো পাকিস্তানি হানাদার ক্যাম্প। হাইস্কুল মাঠের গোলপোস্টের সাথে বেঁধে চাবুক পেটা করা হলো রাজাকার, আলবদরদের।

এদিকে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো মজিদের পরিবার! তৃপ্তিকে বাধা দেয়ার মতো আর কেউ রইলো না। অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো তৃপ্তি। হাঁটতে হাঁটতে বহু পথ অতিক্রান্ত হলো। গোধূলিলগ্নে অন্তঃসত্তা তৃপ্তির আর্তচিৎকার পশ্চিমাকাশের কোণে জমে থাকা কালো মেঘকে সরিয়ে দিল। প্রচণ্ড ব্যথায় যখন সে কাতরাচ্ছিল, তখন মানবিকতার স্বার্থে তাকে আশ্রয় দিতে এগিয়ে এলো সোনামুখী গ্রামের চঞ্চল মাঝির পরিবার। এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় কোন রমনীকে আগে তারা কখনো দেখেনি। বিজয়ের প্রাক্কালে চারদিকে যখন আনন্দ-উল্লাসের জোয়ার, ঠিক তখনও এক ধরনের মুক্তির সাধেও তৃপ্তির বিদীর্ণ অবসাদগ্রস্ত হৃদয়কে তছনছ করে দিচ্ছিল।

মুক্তিযোদ্ধা এবিএম শাজাহানের নেতৃত্বে ব্রাশফায়ারে যবনিকাপাত ঘটলো এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের। মজিদসহ অন্যান্য রাজাকারকে হত্যা করা হলো। কিন্তু কলঙ্কিত মজিদদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলেও কলঙ্কিত অধ্যায়ের দুঃসহ স্মৃতি কখনো মুছে ফেলা যায় না ইতিহাস থেকে, ব্যক্তি হৃদয় থেকে। তৃপ্তিরা যুগে-যুগে কালে-কালে শতাব্দীতে-শতাব্দীতে মজিদ ও এদের উত্তরসুরীদের কাছ থেকে পাওয়া কলঙ্ক বয়ে বেড়ায়।

১৬ ডিসেম্বর, সকাল বেলা। বাঙালির মহান বিজয় অর্জনের মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রচণ্ড শীতের কুয়াশা ভেদ করে পূব আকাশে উদিত হলো বাঙালির প্রতিক্ষীত স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সূর্য। চঞ্চল মাঝির বাড়িতে আশ্রিত তৃপ্তির কানেও ভেসে এলো বিজয়ের উল্লাস ধ্বনি। রেডিওতে আকাশবাণীর সংবাদ শুনে অর্জিত বিজয়ের অনুভূতি চোখের অশ্রুতে ব্যক্ত করলো তৃপ্তি। মুক্তিযুদ্ধে পরিবারের স্বজন হারানোর বেদনা, স্বামী-সন্তান হারানোর দুঃসহ অনুভব চারপাশের উচ্ছ্বাস তার কাছে পরিণত হলো বিজয়ের আর্তনাদে! বুকের ভেতরে জমে থাকা চাপা কান্নাগুলো সংঘবদ্ধভাবে তোলপাড় করে তুলছে বুকের মাঝখানে। দমবন্ধ করা অনুভূতি বিরাজমান মুক্তি নামের মরীচিকায়!

হঠাৎ তীব্র ব্যথা শুরু হলো তৃপ্তির গর্ভে। তার গোঙানো আর্তস্বর শুনে এগিয়ে এলো চঞ্চলের স্ত্রী মাহমুদা। সঙ্গে সঙ্গে ডেকে আনা হলো এক দাইমাকে। অবশেষে বিকেল গড়াতেই স্বাধীন দেশের ভূমিতে ভূমিষ্ঠ হলো পুত্রসন্তান। তবে নির্দিষ্ট সময়ের কিছুদিন পূর্বে জন্মগ্রহণের ফলে শারীরিকভাবে অসুস্থ ও অপরিপূর্ণ হয়ে জন্ম নেয় সে। সদ্যভূমিষ্ঠ যুদ্ধশিশুর ক্রন্দন পারেনি তৃপ্তির কর্ণকুহরে আঘাত হানতে। অবচেতন মনে তৃপ্তির হৃদয়ে তখন বাজছিল শিশু কাকলীর শেষ আর্তনাদ-আহাজারি। নিজের গর্ভে ধারণ করা শিশুপুত্রের মাঝেও সে কেবলই তার পাঁচবছর বয়সী কন্যাশিশুর অবয়ব দেখতে পাচ্ছিল। অনুভূতিতে মিশে ছিল শুধু কাকলীর অপরূপ মুখচ্ছবি।

তবে রাত্রির অন্ধকার না পেরোতেই প্রচণ্ড শীতের প্রকোপে জাগতিক বন্ধন ত্যাগ করে পুনরায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হয় সদ্য জন্ম নেয়া অপরিপূর্ণ যুদ্ধশিশুকে।

সকল অবলম্বন হারিয়ে ফেলে বীরাঙ্গনা তৃপ্তি। ইতিহাসের পাতাতেও ঠাঁই মেলেনি তার। কাঁদতে কাঁদতে তার মনের মাঝে শুধু একটি প্রশ্ন বারবার আঘাত হানতে থাকে। নারী হৃদয়ের বিশালত্বের কাছে অর্জিত বিজয় আর্তনাদ হয়ে বিরামহীন বেজে চলল। আর এভাবেই ধর্ষিতা পরিচয় নিয়ে মহাকালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায় স্বীকৃতিহীন এমন হাজারো বীরাঙ্গনা।

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন