ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

নারী ও জীবন

সাখাওয়াত হোসেন সুজন | প্রকাশিত: ১১:২১ এএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬

‘আইলাবিউ’ শব্দটা শুনে মুচকি হাসে তানু। দাদু মাঝে মাঝেই তাকে এ শব্দটা বলে নিজের ভালোবাসার প্রকাশ ঘটায়। ক্লান্ত বিকেলে বাসায় ফিরে দাদুর মুখের এ শব্দটা তার মনকে আনন্দ দেয়।

দাদুর হাসিটা দেখলেও মন ভরে যায়। মুখে দাঁত নেই তবু সে হাসি কী সুন্দর। হৃদয় ভোলানো হাসি। দুঃখ ঘোঁচানো হাসি। দাদুর প্রাণখোলা হাসি এক নজর দেখলেই অন্তর পর্যন্ত ঠান্ডা হয়ে যায়।

‘কী গিন্নি আইলাবিউ বুঝ না। আইলাবিউ কইলে আরেকবার আইলাবিউ কইয়া জবাব দিতে হয় হেইডা তুমারে শিখায়া দিতে হইবো। বালোবাসা বুঝ না। চেহারা গতর যা বানাইছো বর জুটায়া দিলে তো এক্কেরে জমজ বাচ্চা পয়দা করবা...’- এসব কথা বলে আবার হাসতে শুরু করলেন তিনি।

তানুও হাসতে হাসতে বললো, ‘ওই শব্দটা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছি দাদু। তোমাকে যে ভালোবাসি এটা কি নতুন করে বলতে হবে? সেই ছোট্টকাল থেকেই তো আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

‘হ, তা ঠিক। আমার মতন সুন্দর মানুষ খুঁইজা পাওন দায়। তয় তুই তোর দাদির মতন সোন্দর হইতে পারস নাই। মোটা হইছস। উঁচা-লাম্বাও ঠিক আছে। কিন্তু চেহারায় সে মায়া নাই।’ বললো দাদু।

‘ওরে বুড়ো দাদু। একটা মেয়ে মানুষের সামনে তারই নিন্দা! তোমার ওই বউ বেঁচে থাকলে আমার পাশে দাঁড় করায়া দেখতাম। যাকে খুব বেশি ভালোবেসেছ তার চেয়ে সুন্দরী কী আর এই পৃথিবীর কাউকে লাগবে।’ কিছুটা বিরক্ত হয়েই কথাগুলো বললো তানু।

আবার সেই হাসি। মুখে সাদা দাঁড়ি, মাথায় টুপি। দাদুর শ্বেতশুভ্র চেহারাটা আসলেই অসাধারণ লাগে তানুর। দুষ্টুমি করলেও দাদু নামাজ-কালামে খুব মনোযোগী। দাদির মৃত্যুর পর তো একেবারে মসজিদের সঙ্গে মনটা ঝুলিয়ে রেখেছেন।

‘আচ্ছা, হাত-মুখ ধুইয়া খাইয়া লও। আমি নামাজে গেলাম’ বলে বের হয়ে গেলেন তিনি।

তানু বাসার ভেতরে চলে গেলো। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে সে। ঢাকা শহরের বাড়িওয়ালার একমাত্র কন্যা। পড়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কথাগুলো রাজধানীর যেকোনো ব্যাচেলরের কাছে রাজকন্যা ও রাজত্বের সন্ধান দেয়ার মত সংবাদ। কিন্তু তা নয়। তানুর সেই অবস্থা নেই। নিজের হাত-খরচের টাকাটাও তার নিজেকেই জোগাড় করতে হয়। একটা ডিজাইন হাউসে খণ্ডকালীন কাজ করে। সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত তাকে কাজ করতে হয়। সপ্তাহে চারদিন। খাঁটতে হয় প্রচুর। টাকা পায় সামান্যই। বাসা থেকেও কাজ করে দিতে হয়। ফ্যাশন ডিজাইন আর বুটিকের কাজ সে ভালোই পারে।

পার্ট টাইম জবে গার্মেন্টসকর্মীর মত খাঁটলেও তো আর গার্মেন্টসকর্মী হতে পারবে না! পাশাপাশি মেয়ে মানুষ হিসেবে শত বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় তাকে। তানুর মাঝে উচ্ছ্বলতা-চঞ্চলতা সবই আছে। সেই সাথে আছে জীবনের বাস্তব প্রেক্ষাপটের নানা ভাবনা। বাইরে থেকে দেখলে তার এ অবস্থা কেউ অনুমানও করতে পারবে না। দুঃখগুলো সে হাসির আড়ালে যত্ন করে লুকিয়ে রাখে।

বাবা-মায়ের সংসার জীবনের দীর্ঘ ১৬ বছর পর জন্ম হয় তানুর। বাবা সরকারি কর্মকর্তা। সেইসঙ্গে ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা। পাঁচতলা একটা বাড়ির মালিক। মোটকথা সোনার চামচ মুখেই জন্ম তার। কিন্তু দুর্ভাগ্য এক নিমেষেই সব শেষ করে দেয়। দেশের ঘাড়ে চেপে বসা দু’বছরের একটি অনির্বাচিত সরকারের আমলে তারা দেখতে পায় তানুদের বাসাটি রাস্তার জমিতে পড়েছে! সেই বাড়ির উপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ হবে। অতএব স্বল্প সময়ের নোটিশে বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়। সেদিক দিয়ে এখন চলাচলের রাস্তা। যদিও ম্যাপে সেখানে কোনো রাস্তাই ছিল না।

তাৎক্ষণিক পরিবার নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন তানুর বাবা জামাল সাহেব। তখনো শক্ত ছিলেন তিনি। কারণ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন। যদিও কোনো দলীয় সরকার থাকলে তার বাড়িতে কেউ হাত দিতে পারতো না। সরকার ছিল নির্দলীয়। তানুর বাবা রাজনীতির ধার ধারেন না। তারপরও যখন সরকার পরিবর্তন হয় তখন স্থানীয় রাজনীতিবিদরা তাকে বিরোধী দলের তকমা দিয়ে তার বাড়ির জমি উদ্ধারের পথ একেবারে বন্ধ করে দেয়। কারণ, ওই রাস্তাকে কেন্দ্র করে আশেপাশে অনেক বড় বড় ভবন গড়ে উঠেছে। রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদদের ম্যানেজ করে সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি এখন ম্যাপেও ওই জায়গায় রাস্তা দেখা যায়!

হাল ছাড়েননি জামাল সাহেব। তিনি আদালতে গেছেন। তার মামলা গত ১৫ বছর ধরে চলছে। কত বছরে তা শেষ হবে তার ঠিক নেই। এদিকে চাকরির বয়সও শেষ হয়। অবসরের পর পেনশনের সমস্ত টাকা নিয়ে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেন। তরতর করে এক হাত থেকে দুই হাত দুই থেকে চার এভাবে চক্রবৃদ্ধির হারে টাকা বাড়তে থাকে। কিন্তু বিধিবাম। সেই কোম্পানির বেশ কিছু কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়। কোম্পানির মালিক গ্রেফতার হন। সরকার ধীরে ধীরে পুরো কোম্পানিটার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ডুবে যায় কোম্পানি। জামাল সাহেবের সমস্ত টাকা সেখানে আটকে যায়। এরপর ব্যাংকে থাকা কিছু টাকার মাসিক মুনাফা আর পেনশনের মাসিক টাকাটায় সংসার চলে তাদের। বাড়িও নেই। বাড়ি ভাড়া থেকে আয়ও নেই। বরং নিজেদেরই অন্যের বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতে হয়।

তানু ততদিনে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয় না তার। একটি মধ্যম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সেমিস্টার ফি বাবা দেয়। কিন্তু হাতখরচ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের টাকাটা তাকে জোগাড় করতে হয়। যেদিন টাকা না থাকে; সেদিন ক্লাসও করতে পারে না। মোবাইলে মাঝে মাঝে মিসকল দেয়ারও টাকা থাকে না।  

তানুর জীবনে বিশৃঙ্খলা নেই। পড়াশোনা, কাজ, পরিবার সবকিছুই তাকে ম্যানেজ করতে হয়। নিয়ম করেই সে সবকিছু করে। বাবার একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। মাঝে মাঝেই ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। মা ব্লাড প্রেসার ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে দাদু সুস্থ মানুষ। রোগ-বালাই নেই বললেই চলে। ঢাকার নারায়ণগঞ্জে বাড়ি। তানুর বাবা একমাত্র সন্তান। এলাকায় কিছু জমিজমা থাকলেও ছেলের কাছে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। পরিবারের এই তিনজনের খোঁজ-খবর রাখতে হয় তানুর।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। তানু আপন মনে কম্পিউটারে একটি সালোয়ারের ডিজাইন করছিল। এখন এসব কাজও হাতে করতে হয় না। একমনে কাজ করছিল সে। এসময় কে যেন এসে পেছন থেকে তার চোখ চেপে ধরলো।
- কে?
- চিনতে পারিসনি।
- ওহ খুশি। তুই।
চোখ ছেড়ে দিয়ে চেয়ারটা টেনে নিয়ে পাশে বসলো খুশি-
- কিছু মনে করিস না। আমি কাজটা শেষ করে তোর সঙ্গে কথা বলছি। রাতে খেয়েই যাবি তাই তাড়াহুড়া করিস না। - কাল ক্লাস নেই। আমারও কাজ নেই। মাকে বললাম স্পেশাল কিছু রান্না করো। সন্ধ্যার পরই রান্না শুরু করবে।
-তুই কাজ কর। আমি বারন্দায় গেলাম।

তানু আপন মনে কাজ করছিল। খুশি বারান্দায় গিয়ে মোবাইলে আলাপ শুরু করলো। সন্ধ্যার পর বাসার পরিবেশটা ঠান্ডা। বিশ-পঁচিশ মিনিট পর চুক চুক শব্দ! কথা শেষ করে ফিরে এলো খুশি। দেখলো কম্পিউটার বন্ধ করছে তানু। সে কিছু বলার আগেই তানু বলল, ‘সন্ধ্যাবেলাই চুমুর শব্দে টেকা দায়! রাত হলে আরো কি করিস আল্লাহই জানে। তোর সেই খালাতো ভাই নাকি?’
খুশি বললো, ‘হুম, গ্রাম থেকে আমরা যারা শহরে এসেছি তারাই কালচারড আছি। আর তোরা দেখি এখানে বড় হয়েও ক্ষ্যাত। ওরে, প্রেম কি আর সেই পুরনো স্টাইলে চলে। ভাবছি আজ রাতে তোর সঙ্গেই থাকবো। তোকে ফোনসেক্স শেখাবো।’
‘ওসব আর শেখাতে হবে না। দেখ, এসব উল্টা-পাল্টা কাজ বাসায় করবি না। মা টের পেলে আমার খবর আছে।’ বিরক্ত হয়ে বললো তানু।
খুশি বললো, ‘নারে দোস্ত। মনটা অনেক খারাপ। বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করেছে। খুব বিপদে আছি। যার সঙ্গে রিলেশন তাকে কি আর বলতে পারি বিয়ে করো। সেও তো আমারই মত পড়াশোনা করছে।’
‘খারাপ কি? তোর এই খালাতো ভাই মাঝে মাঝে ড্রিংক করে। তোর সঙ্গে একটু কথা-কাটাকাটি হলেই গাঁজা খায়। তোর কি মনে হয় সে বদলাবে?’ জানতে চাইলো তানু।
‘আমি তাকে বদলে দেবো। আমার ভালোবাসা দিয়ে বদলাবো। তুই দেখে নিস।’ বললো খুশি।
‘আচ্ছা বাদ দে এসব কথা। চল মায়ের সঙ্গে রান্না করি।’ বলে খুশিকে নিয়ে মায়ের কাছে গেলো তানু।

মেয়ের বান্ধবীকে পেয়ে অনেক মজার মজার রান্না করলো তানুর মা। রাতে সবাই একসঙ্গে খেলো। দাদুতো দুই গিন্নির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তানুর বাবাও বেশ প্রশংসা করলো। রাতে সবার সঙ্গে গল্প করে দুই বান্ধবী একসঙ্গে শুতে গেলো। রাতে আজ ওদের ঘুমানোরও কোনো তাড়া নেই।
খুশি বললো, ‘কি আর ঘুমাবো। এই মোবাইল বন্ধ করলাম, চল গল্প করি। আগে তোর কথা বল। তোর নাফিসের খবর কি?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানু বললো, ‘কাজে এত ব্যস্ত থাকি, ওকেও সময় দিতে পারি না। ও আমার অবস্থা বোঝারই চেষ্টা করে না। ভাবে আমি ওকে ভালোবাসি না। এত বলি- পড়াশোনা করো, একটা চাকরি করো। আমি আছি এটা নিশ্চিত। কিন্তু সে আমার ভালোবাসার প্রমাণ চায়!’
‘মানে কি?’ জানতে চাইলো খুশি।
‘এটা কি তোকে বোঝাতে হবে। তুইও তো ওইসবে বেশ অ্যাকটিভ। ওর কথা হলো, মাঝে মাঝে ওর মেসে গিয়ে সময় দিতে হবে!’ বললো তানু।
খুশি বললো, ‘প্রেমটা একেবারে নিরস রাখাও ঠিক না। এখন যুগ বদলেছে। ইন্টারনেটে অনেক কিছু দেখা যায়। তাই বয়ফ্রেন্ডদের একটু সামলে রাখতে হবে। বাস্তবে না পারিস মোবাইলে তো তাকে একটু এন্টারটেইন করতে পারিস।’
‘তোর কি মাথা খারাপ? তুইও ওসব করিস নাকি? ইউটিউবে সার্চ দিয়ে দেখ, শত শত গোপন ফোনালাপ আর ভিডিও পাবি।’ বেশ বিরক্ত হয়েই বললো তানু।
‘আহা! সবাই কি অমন করে নাকি? বিশ্বাস ছাড়া সম্পর্ক টিকে থাকে নাকি?’ বলে যাচ্ছিল খুশি।
‘তুই থাম!’ খুশিকে থামিয়ে দিয়ে তানু বললো, ‘সব মেয়েই বিশ্বাস করে ঠকছে। ফিজিক্যাল ডিমান্ড মেয়ে-ছেলে সবারই আছে। কিন্তু সমাজ-সভ্যতা বলে কিছু আছে নাকি! আমরা তো ইংরেজ না, বাঙালি। অতএব ওদের মত হতে আমি রাজি নই।’
‘আচ্ছা বাবা বুঝলাম। রাখতো এসব। ওহ, তোর মোবাইলটা টুং টুং করছে। ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জারে দেখতো কে?’ বলে মোবাইলটা তানুর হাতে দিল খুশি।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে তানু বললো, ‘শুরু হলো যন্ত্রণা।’
‘কে, নাফিস?’ বলে বিরক্তি প্রকাশ করলো খুশি।
তানু হেসে বললো, ‘সে তো আছে। সেইসঙ্গে আরো বেশ কয়েকজন!’

আরো কিছু বলতে যাবে এ সময় ফোন এলো। তানু সালাম দিয়ে কথা শুরু করলো। খুশি চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। ফোনালাপ শুনে সে অবাক। হঠাৎ তানু ফোনে বললো, ‘ওহ ভাইয়া। আম্মু খেতে ডাকছে। এখন রাখি পরে কথা হবে।’ ফোনটা কাটতে না কাটতে আরেকটা ফোন। ‘হ্যাঁ, ভাইয়া কাজটা আমি করেছি। কি করবো বলেন, আমি অন্যভাবে করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার বসতো শারমিন আপু। ঊনি যা বলেন, তা-ই করতে হয়।’ এবার প্রায় পাঁচ মিনিট। ‘আমি রাখি ভাইয়া। শারমিন আপু ফোন দিচ্ছে।’ এই বলে ফোন রাখতে না রাখতে আরেকটা ফোন রিসিভ করলো। খুশি স্পষ্ট বুঝলো, এটা কোনো আপুর ফোন না।

কথা শেষ করে হাঁফ ছাড়লো তানু। ‘ওহ, কেন যে ফেসবুকে একটু চ্যাট করলাম না। তাহলে এই যন্ত্রণার ফোনগুলো আসতো না। বিড়বিড় করে বললো সে।’
‘কিরে এগুলো কি?’ জিজ্ঞেস করলো খুশি।
‘বিস্তারিত বললে অনেক সময় নষ্ট হবে। সংক্ষেপে শোন, যে অফিসে কাজ করি। এরা সে অফিসেরই। বিনা কাজে গাইড করার চেষ্টা করে সমবেদনা জানায়। এড়িয়ে চলতে পারি না। কিছু বলতেও পারি না। কী যে যন্ত্রণা! আসল জায়গায় সমবেদনা নেই। বলি, ভাইয়া বসকে একটু বলেন না আমাকে একটু বেশি টাকা দিক। তখন আর কেউ কথা বলে না। আমিও তাই ওটা বলেই তাদের থামাই।’
‘এজন্য বলি দোস্ত একটা কাকতাড়ুয়া দরকার।’ নিজের শরীরের দিকে আঙুল ঘুরিয়ে খুশি বললো, ‘এই ক্ষেত রক্ষা করতে একটা বয়ফ্রেন্ড নামের কাকতাড়ুয়া দরকার।’

হাসলো তানু। হেসে বললো, ‘কর্মক্ষেত্রটা একটু আলাদা। এখানে অনেক কিছু ম্যানেজ করে চলতে হয়। যদি কোনোদিন বসই তোকে বলে বসে তোমাকে ভালো লাগে। আমাকে খুশি করো। বেতন বাড়িয়ে দেব। তখন হয় তাকে খুশি করবি, নয় কাজ ছেড়ে দিবি। এরা ব্যাচেলর ছেলে নয় যে তোর বয়ফ্রেন্ড তাকে ফোন দেবে বা পেটাবে। আর সে বিরক্ত করা বন্ধ করবে। এরা বিবাহিত বদ! পদে পদে চলা মুশকিল। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার থেকে এসব দেখছি। মেয়েরা হয় মেনে নিয়ে শয্যায় যায়, নয়তো অন্যভাবে কষ্ট করে চলে! যদিও পার্ট টাইম কাজ করি তারপরও সব দেখছি আর বুঝছি। প্রমোশনও ওসবের উপর নির্ভর করে।’
খুশি বললো, ‘তোর এই অফিসের শারমিন আপু না অনেক ভালো বললি?’
‘হ্যাঁ, ঊনি ভালো বটে! সারাদিন ক্রিয়েটিভ টেনশন করেন আর খান। স্বাস্থ্যও বানিয়েছেন মাশাল্লাহ! আমারগুলো দিয়েই দেখি বেশিরভাগ কাজ হয়। তার কাজ দেখি খুবই কম। কিছু বলতে পারি না কারণ তার কাছে নিজের পারিবারিক দুর্বলতা প্রকাশ করেছিলাম। ওটাই তিনি সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন। তবে এই অফিসে হয়রানি কম। আর কেউ কিছু করলে তাকে সোজা করেন শারমিন আপু।’ বললো তানু।
‘তোর কপালটাই খারাপ। সব একসময় ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।’ সান্ত্বনার বাণী শোনালো খুশি।

এরই মধ্যে আবার ফোন বেজে উঠলো তানুর। খুশি মনে ফোন নিয়ে এবার বারান্দায় গেলো সে। খুশি একটু বাঁকা দৃষ্টিতেই তার দিকে তাকালো। বারান্দা থেকে হাসিমুখে ফিরলো তানু।
‘কিরে কে ছিল?’ জানতে চাইলো খুশি।
‘হাবীব ভাই।’ বললো তানু।
‘এটা আবার কে?’
‘ওহ, ঊনি বর্তমানে ফেসবুক ফ্রেন্ড। বুঝেছি, তুই আরো শুনতে চাইবি। আসলেই তারসঙ্গে এখন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই একটা লোক যিনি প্রেম নয় আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। আমার বাবা-মায়ের একজন ছেলে হতে চেয়েছিলেন। তাকে অনেক বকেছি। করুণা আমার ভালো লাগে না। যা হোক এরপরও ঊনি মাসে দুয়েকবার ফোন দেন। নিজের ভাবনায় পরিবর্তন এনেছেন। ওনার সাথে কথা বললে মনটা বেশ খুশি হয়। মজার মানুষ।’
খুশি বললো, ‘তোকে খেতে চায় না?’
‘ধুর, কী সব বলিস?’ লজ্জিত হয়ে বললো তানু।
‘তোর মত হটকেক যে ছেলে খেতে চাইবে না। তাকে মেডিকেল টেস্ট করানো উচিত। তোকে দেখে তো আমিই নিজেকে সামলে রাখতে পারি না। আয় তোকে নিয়ে শুই।’ বলে হাসতে হাসতে বিছানায় নিজেকে ছেড়ে দিল খুশি।
তানুকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘নাফিসকে তবে ভুলে যাবি?’
‘তা কেন? ওকে ভালোবেসেছি। কথা দিয়েছি। ও যদি আমার শর্ত মতে সব ঠিকঠাক মতো করে। ছোট-বড় যাই হোক একটা চাকরি নেয় তাহলে ওকেই বিয়ে করবো। তবে আগেই সবকিছু উজাড় করে দেব না।’ জবাব দিল তানু।
‘আচ্ছা, বাদ দে। চল ঘুমাই। একটা বেজে গেছে।’ লাইট অফ করে দিল তানু। খুশি আর কোন কথা বললো না। চুপচাপ শুয়ে থাকলো।

রাত প্রায় তিনটা বাজে ঘুম ভেঙে গেল তানুর। দেখলো পাশে খুশি নেই। ওয়াশ রুমের দরজাটা বিছানা থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। ওটা খোলাই। তাহলে কি দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে না পেরে বারান্দায় গেছে। এই ভেবে ওয়াশরুমে গেলো সে। ফিরে বারান্দায় গিয়ে তাজ্জব হলো। বারান্দার এককোণে বসে খুশি। পরনে কোনো কাপড় নেই। কানে হেডফোন। মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বলছে। যদিও বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। কিন্তু তার কাজ তানু ঠিকই দেখলো। প্রেমিকের সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করছে। লজ্জায় তাকে ডাকলো না বা তার কাছে গেলো না তানু। রুমে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। লাইটের আলো জ্বলার দুই-তিন মিনিটের মধ্যে তড়িগড়ি করে রুমে ফিরলো খুশি।

আবারো লাইট নেভানোর আগে তাকে একনজর দেখে নিল তানু। লাইট নিভিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো সে। খুশিও শুয়ে পড়লো। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তানু বললো, ‘ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। আর জামা-পায়জামা ঠিকঠাকমত পড়ে নিস।’ খুশি উঠে চলে গেলো ওয়াশরুমে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে তানু দেখলো খুশি চলে গেছে। রাতের বিষয়টা নিয়ে তানু নিজেই লজ্জিত। খুশি একাই এমন করছে তা নয়; এখন এসব অহরহ হচ্ছে। যা হোক যতটুকু পারবে তাকে বোঝাবে এই ভেবে আবার একটা ঘুম দিল। সপ্তাহে এই একটা দিন পুরোটাই পায় সে। বাকি ছয়দিন কাজ থাকেই। কোনোদিন অফিস, কোনোদিন ক্লাস। আর কোনোদিন দুটোই। তাই বিশ্রামের সময়টুকু সে নষ্ট করতে চায় না।

কাজ-ক্লাস সবমিলে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে তানু। দু’তিন দিন ভার্সিটিতে খুশির দেখা পেলো না। একদিন দুপুরবেলা অফিস থেকে তড়িগড়ি করে ক্লাসে যাচ্ছিল সে। ভার্সিটিতে প্রবেশ করার পরই নাফিসের বন্ধু শুভ তাকে ডাকল।
‘তানু শোনো।’
‘হ্যাঁ, শুভ ভাই বলেন।’
‘ওই যে মুরুব্বি লোকটা বসে আছে ঊনি খুশির বাবা। তুমি দয়াকরে তাকে একটু বুঝিয়ে বলো। খুব সহজ-সরল মানুষ। তুমি একটু বোঝাও দেখ সব বুঝবে।’ বললো শুভ।
‘কী বোঝাব?’ বললো তানু।
‘মানে কি! তুমি কিছুই জানো না? নাফিস খুশিকে নিয়ে পালিয়েছে। ওরা এখন কক্সবাজারে আছে।’ বললো শুভ।
আকাশ থেকে পড়লো তানু। সবচেয়ে কাছের বান্ধবীই তার ভালোবাসা কেড়ে নিল। তাহলে কি ওই রাতে ভিডিওতে নাফিস ছিল! বিস্মিত হলো সে। কষ্টও পেলো।
‘আচ্ছা, শুভ ভাই আপনি যান। আমি খুশির বাবার সঙ্গে কথা বলছি।’

শুভ চলে গেলো। খুশির বাবার দিকে এগিয়ে গেলো সে। কাছে গিয়ে সালাম দিল। খুশির বাবা সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে তুমি মা?’
‘চাচা, আমি তানু।’
‘ওহ, খুশির সঙ্গে তোমার কি কোনো কথা হয়েছে মা?’ কথার আগেই যেন তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে কান্নার কোনো শব্দ নেই, আছে সীমাহীন দুখের ভার।
তানু বললো, ‘কিছুই খাননি বোধ হয়। চলেন।’ বলে হাত ধরে উঠিয়ে তাকে ভার্সিটির পাশের একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলো।

বসেই একটা ফ্রুট জুস আনতে বললো। জুসের পর কেবল একটা ডিম আর একটা পরোটার অর্ডার করলো তানু। সবশেষে দু’কাপ চা চাইলো তানু। চা-টা দু’জনেই খেলো। মনে হয়, শরীরের দুর্বলতা কিছুটা কেটে গেছে। তিনি বললেন, ‘মা আমি গ্রামের মানুষ। উপজেলা সদরে একটা মুদির দোকান আছে। জমি-জমাও আছে। আল্লাহর রহমতে টাকার অভাব নেই। মেয়ে ঢাকায় পড়তে চাইলে সরল মনে তাকে পাঠালাম। যখন যা চেয়েছে তা-ই দিয়েছি। গত দুই মাসে সে আমার কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছে। আমি তো সরল বিশ্বাসে দিয়েছি। তুমিই বলো মা, সন্তানদের বিশ্বাস করাই কি আমাদের অপরাধ?’
তানু অবাক হয়ে বললো, ‘এক লাখ টাকা নিয়েছে। এত টাকা সে কি করবে?’
‘কি জানি মা, বললো ভার্সিটিতে লাগবে। তাই আমিও পাঠিয়ে দিলাম। ঢাকায় আমার কিছু আত্মীয়-স্বজন আছে। তাদের সঙ্গে না নিয়ে একা একা মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।’ ভারি কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন খুশির বাবা, চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছিল।
তানু বললো, ‘দুই-তিনদিন আগে ও আমাদের বাসায় এসেছিল। আমাকে বললো আপনারা নাকি ওর বিয়ের আলাপ করছেন। সত্যিই চাচা, আমি জানতাম না ওর সম্পর্ক নাফিস ভাইয়ের সঙ্গে।’

নাফিস কেমন এ বিষয়টা ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেলো সে। জানলে খুশির বাবা আরো বেশি দুশ্চিন্তায় পড়বেন। এখন তার কাছে পরিষ্কার নাফিস আসলে কেমন? নাফিসই খুশির সে খালাতো ভাই; যে নেশাও করে। আর অন্যদিকে তার সামনে ভালো সেজেছিল। তার আর বুঝতে ভুল হয় না- হয়তবা তাদের সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যেই খুশির সঙ্গে নাফিসের প্রেম হয়। আর খুশি সে প্রেমিককে নিজের খালাতো ভাই বলে পরিচয় দিত।

‘কি ভাবছো মা?’ খুশির বাবার এমন প্রশ্নে চেতনা ফিরে পেলো তানু।
‘ওহ চাচা, ঢাকায় আপনার কোনো আত্মীয়ের বাসা থাকলে আপনি সেখানে যান, বিশ্রাম নিন, আর আপনার ফোন নম্বরটা আমাকে দিয়ে যান। আমি কোনো খবর পেলেই আপনাকে জানাবো, আর ওকেও বোঝাবো।’ বললো তানু। সে ভালো করেই জানে তার কাছে কোনো খবর আসবে না! সান্ত্বনা পেয়ে চলে গেলেন খুশির বাবা।

একদিন তাকে ফোন দেয় তানু। কিন্তু ফোন বন্ধ পায়। তারপর আর খুশিকে নিয়ে ভাবার সময় পায় না সে। কাজ, ক্লাস, বাসা, জীবনযুদ্ধ তাকে সবকিছু থেকে বিরত রাখে। তবে জীবনের এ শিক্ষা কাজে লাগিয়ে সে ভার্সিটির কোনো বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় মাখামাখি করেনি।

প্রতিদিন কাজ-ক্লাস সেরে বাসার অদূরে এসে রিকশা থামিয়ে অহেতুক হেঁটে বাসায় যায়। সেই রাস্তাটা ধরে- যে রাস্তায় একটা বাড়ি ছিল, যেখানে জন্মের পর সে বড় হয়েছিল। বাড়িটা থাকলে হয়তোবা তাকে এত কষ্ট করতে হতো না। যে বাবা তার জন্মের পর বলেছিল, ‘ছেলের দরকার নেই মেয়েই আমার সব।’ অবস্থার পরিবর্তনে মেয়ের বাবা হওয়ার কারণে তিনিই আবার আফসোস করে বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে একটা ছেলে দিলেও ভরসা পেতাম।’

অনেক সময় চলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে তানু। চাকরির জন্য প্রচুর পড়াশোনা করে। একটি বেসরকারি ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগও দেয়। নানা কাজের অভিজ্ঞতা থাকার ফলে বাসার পাশে নিজেও একটি ছোট প্রতিষ্ঠান দেয়। তারই মত কয়েকজন মেয়ে ওখানে কাজ করে। যারা নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী আয় করে। সপ্তাহে যে দু’দিন অফিস বন্ধ থাকে সে দিনগুলো তানু পুরো সময়টা দেয় নিজের প্রতিষ্ঠানে। আর বাকি দিনগুলো অফিস থেকে ফিরে ২/১ ঘণ্টা সময় দেয়। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাকে যথেষ্ট পরিশ্রমী করে তুলেছে।

একদিন অফিস থেকে বের হয়ে রিকশা খুঁজছিল তানু। এসময় একটি রিকশা এসে তার সামনে দাঁড়ায়, তারই মত শাড়ি পরা এক নারী রিকশা থেকে নামে।
‘কেমন আছিস তানু?’
‘কে? খুশি তুই।’ বলে তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
তানুর বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেললো খুশি। ‘তুই আমাকে ক্ষমা করে দে তানু’।
তানু বুঝলো রাস্তায় এমনটা খুব খারাপ দেখাবে। তাই সে তাকে নিয়ে পাশের একটি কফি শপে ঢুকলো। নুডলস আর কফি অর্ডার দিয়ে তাকে নিয়ে বসলো।
খুশির হাতে টিস্যু দিয়ে তানু বললো, ‘বাদ দে তো ওসব। বল নাফিস কেমন আছে? বাচ্চা-টাচ্চা কিছু নিয়েছিস?’
খুশি বললো, ‘তুই এখনো ভেবে বসে আছিস, নাফিস আমাকে বিয়ে করেছে?’
‘কি বলিস তুই?’ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো তানু।

নিজের মুখে হাত চেপে অঝোরে কাঁদছে খুশি। কাঁদতে কাঁদতেই সে বললো, ‘তোর জন্য ওকে ম্যানেজ করতে চেয়েছিলাম ভার্সিটিতে পড়া অবস্থায়। কিন্তু ওর ফাঁদে পা দিয়ে ফেলি। একদিন ও আমাকে ওর মেসে নিয়ে যায়। যা হবার তাই হয়। আমিও ঢাকায় এসে মর্ডান মাইন্ডেট হই। তাই ওসব কিছু মনে করিনি। একদিন ও আমাকে ওর মোবাইলে একটি ভিডিও দেখায়। আমি আকাশ থেকে পড়ি। ওর আর আমার মধ্যে যা হয়েছে তা সে ভিডিও করে রেখেছে। এরপর ও যা চাইতো, যেমনভাবে বলতো, তা-ই করতাম। যখন-তখন নিজের মেসে ডেকে নিতো। সময়ে-অসময়ে ফোনে ভিডিও কল দিয়ে আমার শরীরের যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখতে মনে চাইতো, তা-ই দেখতো। এসব থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য ওকে বিয়ের কথা বলি।’

চোখ মুছে আবার বলতে থাকে খুশি, ‘ও জানায়, এখন টাকা পাবে কই? আমি বাবার কাছ থেকে লাখখানেক টাকা নেই। সেদিন তোর ওখানে গিয়েছিলাম। ওর আর তোর সম্পর্কের গভীরতা জানতে। তোর কথায় বুঝি- ও তোকে কিছুই করতে পারেনি। সে রাতে নিরুপায় হয়ে তোদের বারান্দায় বসে ওর সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করি। যা তুই দেখে ফেলিস।’
একটু থেমে খুশি বলে, ‘ভেবেছিলাম সকালে তোকে বলবো। কিন্তু সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেন ওর মেসে যাই এ হুকুম করে সে। তাই সকালে তার কাছে যাই।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তানু। ‘কিন্তু ও তো তোকে নিয়ে কক্সবাজার গেলো। বিয়ে করতেই তো তোরা পালিয়েছিলি তাই না?’ জানতে চাইলো সে।
খুশি বললো, ‘আমি ভেবেছিলাম। যা-ই হোক, সব ঠিক হয়ে যাবে। স্ত্রীর মতই যখন আমাকে ব্যবহার করছে তখন বিয়েটা করেই ফেলি। আর আমার বাবা সরল মানুষ। ওকে নিয়ে গেলেই মেনে নিত। কিন্তু তা না, ও একটা পশু। কক্সবাজারের বিচে আমাকে বলে চাঁদকে সাক্ষী রেখে বলছি, তুমি আমার স্ত্রী। কাগজপত্র পরে হবে।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলে খুশি, ‘তারপর বিচ, বাথরুম, বেড সব জায়গায় আমাকে পর্নো সিনেমার নায়িকার মতো ব্যবহার করতো। তাকে ভালো করার জন্যই সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলাম। কিন্তু একদিন সে আরো কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে এলো আমাকে ভোগ করার জন্য! সব বুঝে আমি পালিয়ে ঢাকা চলে আসি। আমার সব টাকাই তার হাতে। নিজের ডেবিট কার্ডে হাজার পাঁচেক টাকা ছিল। কোনোমতে ব্যাগটা নিয়ে এক কাপড়ে পালিয়ে আসি। পথে ওর ফোন পাই। ফোনে ও হুমকি দেয়- আমার সঙ্গে যা হয়েছে সব ভিডিও করা আছে। ওগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবে। আমিও বলি, ও ভিডিওতে নিশ্চয়ই আমি একা নই! যদি আমাকে মারিস তোকে সঙ্গে নিয়েই মরবো।’

উদাস ভঙ্গিতে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুশি। একটু দম নিয়ে বলতে থাকে, ‘এরপর ঢাকা এসে বাবাকে ফোন দেই, ক্ষমা চাই, ঘটনা খুলে বলি। বাবা আমাকে বাড়ি যেতে বলেন। পরদিন সকালে ভাইয়া ফোন করে বলে, তুই আর কোনোদিন বাড়ি আসবি না। তোর জন্য বাবা হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। আমি এতটাই দুর্ভাগা যে, বাবাকে শেষ দেখাও দেখতে পারিনি।’

এবার কান্নায় ভেঙে পড়ে খুশি। তানু বললো, ‘আমার জন্য রাখা বিষ তাহলে তুই খেয়েছিস! তোর প্রতি আমার তখনো রাগ হয়নি, এখনো না।’
‘অমনই হয়েছে রে।’ কান্না থামিয়ে বললো খুশি।
‘এখন কি করছিস?’ জানতে চাইলো তানু।
‘পরে খালার মাধ্যমে মা টাকা দিত। তোদের একবছর পর বোরকা পরে ভার্সিটি শেষ করি। এখন ছোট একটা চাকরি করছি মন্ত্রণালয়ে। তুইতো ব্যাংকে আছিস গলার আইডি কার্ড দেখেই বোঝা যাচ্ছে।’ বললো খুশি।
সে আরো বললো, ‘আর দুঃসংবাদ না। এবার একটা সুখবর দেই। সামনে বিয়ে করছি।’
তানু অবাক হয়ে বললো, ‘আবার বিয়ে!’
‘আবার কই? এটাই প্রথম। চাঁদ-তারা সাক্ষী রেখে কী বিয়ে হয়?’ বললো খুশি।
‘কাকে বিয়ে করছিস?’ জানতে চাইলো তানু।
খুশি বললো, ‘অতীত না জানিয়ে কাউকে বিয়ে করলে তাকে ঠকানো হবে। আমার অফিসেরই একজন আছেন। তবে বয়স একটু বেশি। বিবাহিত ছিলেন। বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে তার স্ত্রী-সন্তান মারা যায়। তিনি আমার প্রতি একটু দুর্বল হলে তাকে সব খুলে বলি। তিনি বলেন, ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। আসো আমরা নতুন করে শুরু করি।’
তানু হাসতে হাসতে বললো, ‘তোর কপাল খারাপ কই? ভালোই তো- সেকেন্ড টাইম হয়ে যাচ্ছে। আর আমার এখনো কিছু হলো না।’
‘কেন, তোর সেই ভাইয়ের কি হলো?’ জানতে চাইলো খুশি।
‘তুইও পারিস মনে রাখতে। আরে হাবিব ভাইয়ের এখন বউও আছে বাচ্চাও আছে। তিনি ভালো মানুষ ছিলেন এটা মানি। কিন্তু আমাদের মন-মানসিকতা এক ছিল না। হয়তো আমি আগ্রহ দেখালে তিনি না করতেন না। তবে আমিও চাইনি। আর ঊনিও জোর না করে নিজের পরিবারের পছন্দ মত বিয়ে করেছেন।’ বললো তানু।
‘বিয়ে কি করবি না?’ জিজ্ঞেস করলো খুশি।
তানু ফিসফিসিয়ে বললো, ‘আর সহ্য হয় না দোস্ত। মনে হয় কেউ এসে আমাকে ভেঙে চুরমার করুক। মনে মনে বর খুঁজছি।’
‘পেয়ে যাবি। তোর জীবনটা অনেক কষ্টের, সংগ্রামের। তুই ঘর-বর পেয়ে সুখে থাক, এটা সবসময় চাই।’ বললো খুশি।

আরো কিছুটা সময় ব্যয় করে খাওয়া-আড্ডা শেষ করে দুই বান্ধবী হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে বিদায় নিল। কয়েক বছর আগে ভেঙে যাওয়া বন্ধুত্বটা আবার জোড়া লাগলো। তানু রিকশা নিয়ে চলে গেলো, নামলোও যথাস্থানে। রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আজ প্রথমবার একটু দাঁড়ালো। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার। যে জায়টায় তাদের বাড়ি ছিল; সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। ভাবলো, এই পথটা তৈরি না হলে জীবনের পথ কেমন করে চলতে হয় তা বুঝতেই পারতাম না।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন