ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মানুষ কাঁদছে

প্রকাশিত: ০৫:১২ এএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

হাতের তাস ছুঁড়ে ফেলে রহিম বলল, কাউলা, সাফল দে।
কালু সবগুলো তাস একত্র করে ফরফর শব্দে সাফল দিল। হাতে সিগারেট ছিল, কায়দা করে ঠোঁটে গুঁজে দ্রুত নটা করে তাস বেটে দিল।
রহিম তিনটা তিনটা করে তাস তোলে। প্রথম তিনটা তুলে বেশ খুশি। চার পাঁচ ছয়, রান। পরের তিনটা তুলে দেখে দুটো গোলাম। সবশেষের তিনটা তোলার সময় রহিম মনে মনে একটু আল্লাহ খোদার নাম নেয়। এই দান না পেলে পকেট একদম ফাঁকা হয়ে যাবে। সকালবেলা নাশতা খাওয়া হবে না, খেলাও হবে না। আর যদি আল্লাহ আল্লাহ করে পেয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই। চার হাত খেলছে। কিট্টি। এক টাকা বোর্ড। একবার পেলেই তিনটাকা। তিন চারটা দান পেলে দিনের খরচা উঠে যাবে। তার ওপর আজ আবার মঙ্গলবার। নটা দশটার দিকে গোডাউন খুলবে। কন্ট্রাকটররা ট্রাক নিয়ে, ঠেলাগাড়ি নিয়ে আসবে সিমেন্ট নিতে। বখশিশ তো দু পাঁচ টাকা পাওয়া যাবেই। আর যদি আশরাফ মিয়ারে একটা ধরাইয়া দেওন যায়...
এসব ভাবতে ভাবতে শেষ তিনটা তাস খোলে রহিম। না কিছু হয়নি। ন’টা তাস একত্র করে তবু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাজানোর চেষ্টা করে রহিম। ওই। চার পাঁচ ছয়, রান। তারপর গোলামের জোড়া। শেষবার, কিচ্ছু না। বিবি টপ।
তবু খেলাটা চালিয়ে যায় রহিম।

প্রথমে তাস ফেলে নোয়াব। তিনের ট্রায়ো। দেখেই হয়ে যায় রহিমের। নিজের তাসগুলো সব ফেলে দেয়। বোর্ডে চারটা একটাকার নোট। একপলক টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে খালপাড় থেকে উঠে আসে রহিম। নোয়াব, কালু আর লাটমিয়া খেলবে সারাদিন। কারবারই এটা। এলাকার পুলিশের সঙ্গে লাইন করা আছে। ধরবে না। এসব ভাবতে ভাবতে স্টেক দেওয়া ইটের ফাঁকফোকর দিয়ে বটতলায় আসে রহিম।
বটতলায় একটা চায়ের দোকান। সামনে দুখান বেঞ্চ পাতা, ভিতরে চেয়ার টেবিল। লোকজন বাইরে বসে চা খায়, ভিতরে বসে খায়। বেশির ভাগই লেবার, রিকশাঅলা। কিছু আছে ড্রাইভার। কখনও দুচারজন কন্ট্রাকটরও বসে। চা খায়, সিগারেট খায়, তারপর চলে যায়।
রহিম আশায় আশায় চায়ের দোকানটায় যায়। যদি কোনও কন্ট্রাকটরের সঙ্গে দেখা হয় তাহলে বলবে, স্যার নাশতা করান।

কেউ খেতে থাকলে তার সামনে গিয়ে খাওয়ান বললে লোকে না খাওয়ায় কেমন করে!
এই কথাটা ভেবে রহিম বেশ খুশি। ভাবে, মাথায় কম বুদ্ধি না আমার!
তো রহিমের বরাত ভাল। দোকানের ভিতর বসে আছে তিনজন। শওকত সাবের ম্যানেজার, আরিফ সাব আর আশরাফ মিয়া। আশরাফ মিয়া তার সাইকেল রেখেছে বটগাছটার সঙ্গে ঠেস দিয়ে। সেখানকার মাটিতে দুটো কাক চড়ছে। আর গাছটার ওপর কা কা করছে কতগুলো। চারদিকে রোদ, কড়া রোদ। রহিম টের পায় এটুকু হেঁটেই গা জবজব করছে ঘামে।
চায়ের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস টানে রহিম। খালপাড়ের মাটিতে বসে খেলেছে, পাছায় লেপটে আছে সাদা মাটি। রহিম খেয়াল করেনি। দোকানের ভিতর থেকে আশরাফ মিয়া বলল, ও রহিম বাদশা, তোমার পাছায় কী?
শুনে চায়ের দোকানের যে ছেলেটা কড়াইয়ে টুপটুপ করে ডালপুরি ছাড়ছিল সে গলা খুলে হেসে ওঠে। হাসে রহিমও। অন্যসময় হলে হয়তো রেগে যেত। এখন রাগ করা যায় না। আশরাফ মিয়াকে পটিয়ে নাশতাটা খেতে হবে।
রহিম দোকানে ঢোকে। নাশতা খাওয়ান ভাই।
আশরাফ মিয়া চা খাচ্ছিল। বলল, একটা পাট্টি ধর।
ধরুম নে।
রহিম আশরাফ মিয়ার পাশে বসে। চায়ের দোকানের ছেলেটাকে বলে, চাইরডা ডাইল পুরি দে আর এককাপ চা।
শওকত কন্ট্রাকটরের ম্যানেজার বলল, কী রে রহিম, খবর কী?
রহিম ডালপুরি খেতে খেতে বলল, ভালাই।
তর বাড়ির ভাড়া পাছ না?
রহিম কথা বলে না। হাসে।
রহিমের চারটা বাড়ির গল্প সবাই জানে। এই নিয়ে টিটকারিও মারে, হাসাহাসি করে। রহিমের তাতে কিছু যায় আসে না। রহিম জানে সে চারটা বাড়ির মালিক। থাক না তাতে অন্যলোক, মালিক তো রহিম!
চা খেতে খেতে রহিম তারপর বাড়িগুলোর কথা ভাবে।
সামনের রাস্তা দিয়ে ঠিক তক্ষুণি লাল হোন্ডা চালিয়ে ওভারসিয়ার কেরামত যায়। পেছনে দুটো ট্রাক, কয়েকটা ঠেলাগাড়ি। কন্ট্রাকটররা আসছে। কেরামত ওভারসিয়ার এক্ষুণি গোডাউন খুলবে। তার পর শুরু হয়ে যাবে সিমেন্ট দেওয়া।

হোন্ডার শব্দ পেয়ে চায়ের দোকান থেকে বেরোয় শওকত কন্ট্রাকটরের ম্যানেজার, আরিফ সাব। সবশেষে আশরাফ মিয়া। রহিম ততক্ষণে আশরাফ মিয়াকে পটিয়ে একটা স্টার সিগারেটও জোগাড় করে ফেলেছে। এখন বেদমসে টানছে। চেহারায় ফুর্তি ফুর্তি ভাব।
খানিক আগে সামনের রাস্তা দিয়ে যে ট্রাকগুলো গেছে তার চিহ্ন এখন রোদে হাওয়ায় ভাসছে। রহিম উড়ন্ত ধুলোবালির দিকে তাকিয়ে কী জানি কী কারণে সিগারেট টানতে টানতে গভীর করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আরিফ সাহেব আর আশরাফ মিয়া অদূরে খুব নিচু গলায় কী কী সব আলাপ করছে। সেদিকে তাকিয়েই রহিম বুঝে গেল মাল কেনার লাইন করছে আশরাফ। আশরাফকে ধরতে হয়। দশ টাকার একটা নোট খসাতে হয়।

কিন্তু ওভারসিয়ার সাব এসে গেছে, রহিমকে একবার গোডাউনের দিকে যেতে হয়, চেহারাটা একবার দেখাতে হয়। চাকরি না!
যখন যাওয়ার কথা ভাবছে ঠিক তখুনি আশরাফ মিয়া ডাকল, হোন রহিম।
রহিম দৌড়ে যায়। পয়সাপাতির লাইন হইব মনে হয়।
আশরাফ মিয়া বলল, দুইডা ঠেলা লইয়া আয়।
কই যাইবো?
খিলগাঁও।
ভাড়া?
আবে তোর মাথায় ঘিলু নাই? দাম কইরা আনবি।
আইচ্ছা।
তাড়াতাড়ি যা।
রহিম একটু মাথা চুলকায়। পরনের খাকি শার্টটার খুঁট নাড়ে। যাওন লাগব তো টিকাটুলির মোড়ে। রিকশা ভাড়া দেও।
আমার সাইকেলডা লইয়া যা।
রহিম ভাল সাইকেল চালাতে পারে না। কোন ছেলেবেলায় ধুপখোলা মাঠে কয়েকদিন শিখেছিল। তারপর সারাজীবনে বার চারেক। রহিম কি পারবে!
কিন্তু আশরাফ মিয়া রিকশা ভাড়া দেবে না। হেঁটে গেলে যেতে আসতে আধঘণ্টা। ওভারসিয়ার রেগে যাবে। আর না গেলে আশরাফ মিয়ার কাছ থেকে লাল দশ টাকার নোটটা আদায় করা যাবে না।
রহিম আল্লাহর নাম নিয়ে বটতলা থেকে আশরাফ মিয়ার ঝরঝরে সাইকেলটা নেয়। বার দুয়েক চেষ্টা করে চড়তে যাবে, ডাকল শওকত কন্ট্রাকটরের ম্যানেজার। কই যাইতাছো রহিম বাদশা?
টিকাটুলি যামু।

হোন। বলে ম্যানেজার সাহেব তিনটা কড়কড়া দশ টাকার নোট বের করে। টাকাগুলো দেখেই রহিমের বুড়ো চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। কিছু আনতে দিলেই হয়, একটা টেকার কাম হইব।
ম্যানেজার সাহেব বলল, এক প্যাকেট ফাইভ ফিফটি ফাইভ আনবি।
রহিম হাসে। কার লেইগ্যা? আইজকাল ফিফটি ফাইব খান নি?
না বে। একজনরে দেওন লাগব।
রহিম বুঝে যায় ম্যানেজার সাব ঘুষ দিব।
টাকাটা পকেটে পুরে সাইকেলে চড়ে রহিম। কয়েকবার চেষ্টা করে চড়ে। দেখে আশরাফ মিয়া, ম্যানেজার আর আরিফ সাহেব খুব হাসে। রহিম গা করে না। টালমাটাল ভাবে সাইকেলটা চালিয়ে যায়। চালাতে চালাতে নিজের ওপর বেশ খুশিও হয়ে ওঠে একসময়। বা বা, কতদিন বাদে সাইকেল চালাইতেছি! ভালাই তো পারতাছি!

এসফল্ট প্লান্টের মিকচার মেশিনটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে রহিম বোটকা একটা গন্ধ পায়। দুনিয়ার পচাধচা মাল আইনা ফেলায় এহানে। এইডা কুত্তাপচা গন্ধ। টাউনের বেবাক কুত্তা মারতাছে সুঁই দিয়া। মাইরা গাড়ি ভইরা ফালাইয়া যায় এহেনে।
সাইকেলে বসে টালমাটাল অবস্থায়ও সামনের পচা ডোবাটার দিকে তাকায় রহিম। হ, যা কইছিলাম। দেহো কতডি মাইরা হালাইছে! পইচ্চা ফুইল্লা এহেকখান দারোগা হইয়া গেছে।
কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই সাইকেল নিয়ে কাত হয়ে পড়ে রহিম। একটু আনমনা হয়ে গেছিল। সামনে উঁচু টিবি ছিল, টাল সামলাতে পারে না। পড়ে একদম গড়াগড়ি খায়।

হলে হবে কী, পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে ওঠে রহিম। জামাটা লুঙ্গিটা ঝাড়তে ঝাড়তে চারদিকে চায়। কেউ দেখে ফেলেনি তো! দেখলে হাসাহাসি করবে। টিটকারি মারবে। দুয়ো রহিম বাদশা, সাইকেল চালাতে পারে না! পোলাপানে দেখলে আরও খারাপ। ইটা মারব।
রহিম আবার সাইকেলে চড়ে। পঁচা গন্ধ পিছনে ফেলে, রোদের ভিতর দিয়ে চালিয়ে যায়। ঠেলা ঠিক করতে পারলে নগদ টাকার কাম। আর ম্যানেজার সাবের সিগারেট থেকে একটাকা, তার ওপর ম্যানেজার সাহেবকে ধরে আরও একটাকা বখশিশ। মোট বার টাকার কাম। জুয়ায় হেরেছে ছটাকা আর এখুনি কামিয়ে নিচ্ছে বারো টাকা। আবার আশরাফ মিয়ারে একটা পাট্টি ধইরা দিতে পারলে বিশ ত্রিশ টেকার কাম। এই গোটা পঞ্চাশেক টেকা কামাইয়া হালাইতে পারলে...
এই অব্দি ভেবে সুখে বিভোর হয়ে যায় রহিম। তাইলে আইজ রাইতে মেথরপট্টিতে যামু, ভরপেট মাল খামু।
তখন রহিমের সাইকেল পাকা রাস্তায় পড়েছে। দুদিক থেকে শাঁ শাঁ করে আসছে ট্রাক রিকশা বেবিট্যাক্সি। খুব সাবধানে, নরম পায়ে ধীরে সাইকেলটা টেনে নেয় রহিম। আর মনে মনে বিশাল এক সুখে বিভোর হয়ে থাকে।

খানিক দূরে এসে রাস্তার মাঝখান দিয়ে যে রেললাইন চলে গেছে, কষ্টেসিষ্টে তার ওপর চড়ে রহিম। টের পায় ঘামে চিরবির করছে শরীর। বুড়ো বয়সে সাইকেল টানার কষ্ট কি কম! তবু কষ্টটা গায়ে লাগে না রহিমের। বিশ পঞ্চাশ টাকার কাম হয়ে যাবে আজ। আহা, রাতেরবেলা পুরা একটা বোতল!
এসব ভাবতে ভাবতে ঢালে নামে রহিম। ঢালে নামার সঙ্গে সঙ্গে টের পায় সাইকেলটা তার আওতায় থাকছে না, পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। কী করে, রহিম এখন কী করে! প্রাণপণে দাঁত মুখ খিঁচে ব্রেক চাপার চেষ্টা করে। কাজ হয় না।

তখনি উল্টাদিক থেকে দুপাশের বাতাস তীব্র বেগে ছিটকে দিয়ে ছুটে আসে মাল বোঝাই পাঁচটনি এক ট্রাক। মুহূর্তে হা করা বিশাল অজগরের মতো টুপ করে গিলে নেয় রহিমকে, সাইকেলটাকে। প্রথমে হজম করে, তারপর উগড়ে দিয়ে দিয়ে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পুরনো পৃথিবী জেনে যায় আজ থেকে তার সঙ্গে মিউনিসিপ্যালিটির পিয়ন, চারখান বাড়ির মালিক রহিম বাদশার সব সম্পর্ক শেষ।

দুই
আমাদের ট্রাকটা এসেছে বেশ সকালে। দুশো সিমেন্ট যাবে। কাজ চলছে রায়ের বাজারে। বেশ বড় কাজ। চার লাখ আশি হাজার টাকার একটা ডিপ ড্রেন আর ফুটপাত। ছ ইঞ্চি ঢালাই। কুচি পাথর নেয়া শেষ হয়েছে দশ দিন আগে। ড্রেনের বেড় আর সাইড ওয়ালের জন্যে ইট নেয়া বাকি আছে কিছু। হাজার আটেক নিতে হবে আরও। সাইটে রাখার জায়গা নেই বলে আপাতত নিচ্ছি না। কিন্তু প্রায় সবকিছু রেডি থাকার পরও কাজটা শুরু করা যাচ্ছে না। সিমেন্ট ছিল না গোডাউনে। সিমেন্ট উঠেছে পরশুদিন। সাড়ে ছ হাজার ব্যাগ। তিনদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। সিমেন্টের অভাবে কন্ট্রাকটররা সাইট বন্ধ করে বসে আছে। ইনডেন্ট পকেটে নিয়ে ঘুরছে।

এবার তাই সিমেন্ট ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লাইন দিয়েছে সবাই। আমরা সিমেন্ট পাব অনেক। পাঁচ সাতশো ব্যাগের মতো। কিন্তু পুরোটা একবারে দিচ্ছে না। দুচার দিনের মধ্যে আরও সিমেন্ট উঠবে। তখন পুরোটা দিয়ে দেবে। এবার দুশো ব্যাগ দিয়েছে শুনে আমার স্যার ভীষণ রেগে গেছেন। কাজটা ডিলে হয়ে গেল। একটা কাজ নিয়ে বসে থাকলে তো আর শওকত কন্ট্রাটরের চলে না। একটার পর একটা কাজ করার অভ্যাস তাঁর। কাজহীন থাকতে চান না ভদ্রলোক। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে বলেছিলেন, আপনি অর্ডার দিন স্যার, বাইরে থেকে সিমেন্ট কিনে কাজটা শেষ করে ফেলি। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব অর্ডার দিলেন না। স্যার আর কী করেন, নেংড়া ঘোড়ার মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই কাজটা চলবে।
স্যার বলেন কাজে ডিলে হলে লস। খরচা বেড়ে যায়। ধুমধাম কাজ শেষ করে ফেল, লাভ আছে।

এসব  কথার কথা। শওকত কন্ট্রাকটরের সব কাজেই লাভ। মাস্টার লোক। এই বাজারেও ফরটি পার্সেন্ট লাভ তুলে নেবেন যে কোনও কাজ থেকে। নিজে সাইটে থাকবেন না, কাজের দেখাশোনা সব আমি করি আর ওস্তাগার আছে কাদির। শওকত কন্ট্রাটরের বাঁধা। এই একজনের কাজ করেই কূল পায় না কাদির।

বছর ভর স্যারের সঙ্গে লেগে আছে কাদির। মাসে দুমাসে পাঁচসাত দিন ছুটি পায়। কখনও নাগাড়ে ছ মাস পায় না। সাইটে ইটের স্টেক দিয়ে তার ওপর ঢেউটিন ফেলে লোকজন নিয়ে থাকে। বাড়ি ফেরে না বহুদিন। টাকা পয়সার দরকার হলে কাদিরের ছেলে এসে নিয়ে যায়। পয়সা ভালই কামায় কাদির। ছোটখাটো কন্ট্রাক্টরদের চেয়ে বেশি কামায়। যাত্রাবাড়িতে দোতলা বাড়ি কাদিরের। বড় ছেলেটা কলেজে পড়ে। ছেলেটার কেতা দেখে মনেই হবে না কাদির ওস্তাগারের ছেলে।

তো কাদির বুদ্ধিমান লোক। রোজদরে কাজ করে না। সাবকন্ট্রাক্ট নেয়। সাব কন্ট্রাক্টে অর্ধাঅর্ধি লাভ। তাতে স্যারেরও সুবিধা। ইস্টিমেটটা কাদিরকে বুঝিয়ে দিয়ে, মালপত্র বুঝিয়ে দিয়ে খালাস। কাদির পাকা ওস্তাগার, ঠিকঠাক চালিয়ে নেয়। আমার কাজ হচ্ছে কাদিরের তদারক করা, কাজ ঠিকঠাক মতো হচ্ছে কিনা দেখা। আর সাইটে ইন্সপেক্টার ওভারসিয়াররা গেলে তাদের খাতির করা। ইঞ্জিনিয়ার আর বিলপত্রের ব্যাপার স্যারই দেখেন।

আজ সিমেন্ট যাবে দুশো বস্তা। কাল রাতেই ট্রাক ঠিক করে রেখেছিলাম। ঠিক করে রাখা মানে কি, ড্রাইভার এনায়েতকে বলে দেওয়া আর কি! এনায়েতও স্যারের বাঁধা। রোজ সন্ধ্যায় স্যারের অফিসে এসে খবর নিয়ে যাবে। ক্ষেপ থাকলে এনায়েতকে শুধু বলে দেওয়া। টাইমলি চলে আসবে, সাইটে মাল পৌঁছে দেবে। টাকা পয়সার ব্যাপারে স্যারের সঙ্গে কথা। আমার ধার ধারবে না। আমার কাজ সাইটে দাঁড়িয়ে থাকা, দরকার হলে আউটফলে আসা আর সন্ধ্যাবেলা স্যারের অফিসে গিয়ে সারাদিনের কাজের একটা ফিরিস্তি দেওয়া। সাইটে এক্সট্রা খরচাপাতি হলে তার হিসাব দেওয়া। এত পয়সাঅলা লোক স্যার, হলে হবে কি, পাই পয়সাটির পর্যন্ত হিসাব নেবে। একটা পয়সা বেশি খরচা হলে তার জন্যে কৈফিয়াত দিতে হবে। এই যেমন আজ একটা ঘাপলা হয়ে গেল। এনায়েত ট্রাক নিয়ে এসে বসে আছে সাতটা থেকে। তবু লাইন এড়াতে পারেনি। তার আগে আরও আটটা ট্রাক, পাঁচ ছয়টা ঠেলাগাড়ি। এগুলো ভরা হলে মাল পাবে এনায়েত। তার মানে চারটা বেজে যাবে। ওসব দেখেই এনায়েত এসেছিল আমার কাছে। ওভারসিয়ার সাহেবকে এক প্যাকেট সিগারেট দিলে মালটা আগে পাওয়া যাবে। নয়তো এই একটা ক্ষেপ দিয়েই এনায়েতের দিন কাবার। পাবে তো দুশো টাকা। দুশো টাকায় লেবার খরচ দিয়ে, তেল খরচ দিয়ে পোষায়! মহাজন কি বলবে! আমি বলি, সিগারেট কিনে দিলে স্যারের কাছে হিসাব দেবো কেমন করে?

আমি স্যাররে কমু নে।
ঠিক আছে। আমি তারপর রহিমকে সিগারেট আনতে পাঠিয়েছি। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল রহিম এখনও ফিরছে না কেন? গেল তো আশরাফ মিয়ার সাইকেল নিয়ে। অবশ্য আরিফ সাহেবের মাল যাবে চল্লিশ বস্তা। দুটো ঠেলাগাড়ি ঠিক করতে হবে রহিমকে। আজ তো সব ঠেলাগাড়ি আউটফলেই চলে এসেছে। রহিম এখন ঠেলা পাবে কোথায়! কিন্তু রহিম যেই মানুষ, ঠেলা না নিয়েও তো ফিরবে না! কতক্ষণ লাগে কে জানে!
আমি এনায়েতকে বলি, তুমি গিয়ে গাড়িতে বসো, রহিম সিগারেট নিয়ে আসবে।
আপনে গিয়া গেট পাসটা করান।
রহিম আসুক।
এনায়েত চলে যেতে আমি একটা সিগারেট ধরাই।
চায়ের দোকানের সামনে বসে আছে আরিফ সাহেব আর আশরাফ মিয়া। দুজনের চেহারাতেই উৎকণ্ঠা। বুঝতে পারি রহিমের ওপর রেগে যাচ্ছে ওরা। রহিম এত দেরি করছে কেন?

রহিমের ব্যাপারে আমার তেমন মাথাব্যথা নেই। যখন ইচ্ছে ফিরুক। আমাদের মাল সন্ধ্যায় গেলেই বা কী! লস হলে এনায়েতের হবে। সেটা দেখবেন আমার স্যার। এনায়েতের জন্য আমার এক প্যাকেট সিগারেট ব্যয়, সেটা আমি এনায়েতের নামে খাতায় লিখে রাখব। তখন দুশো টাকা থেকে সিগারেটের দামটা বাদ যাবে কি যাবে না সেটা স্যারের ব্যাপার, এনায়েতের ব্যাপার।
সিগারেট টানতে টানতে আমি বটতলা ছাড়িয়ে দূরে স্কুল বাড়ির মাঠটার দিকে হেঁটে যাই। সবুজ উদাস মাঠখানা চিরবিরে রোদে বোকার মতো পড়ে আছে। দূর থেকে গাঢ় সবুজ ঘাস দেখে আমার বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে। গ্রামের কথা মনে পড়ে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। আর মনে পড়ে বৈচির কথা।

আমি বৈচিকে বড় ভালবাসতাম। আর ভালবাসতাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
আমার নাম মানিক। পিতা মরহুম গফুর খাঁ। পৈতৃক নিবাস ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। থানা লৌহজং। গ্রাম মাইজগাঁও। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি। পেশা শওকত কন্ট্রাকরের ম্যানেজার। মাস মাইনে সাড়ে চারশো।
আমার বাবা ছিলেন সামান্য কৃষক। চার বোন এক ভাইয়ের সংসার আমাদের। চার কানি জমি ছিল মাইজগাঁওয়ের বিলে। আউশ আমনে সারা বছর ম ম করত আমাদের বাড়ি। বাবা লেখাপড়া জানতেন না। তবু আমাকে কৃষিকাজে না দিয়ে ব্রাহ্মণগাঁও হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে ছিলেন। কটোমটো করে এসএসসি পাসটা আমি করে ফেলি। তখনই শুরু হল দুর্দিন। দুটো মেয়ে বিয়ে দিতে বিলের দুকানি জমি গেল বাবার। আমার কলেজে পড়া হল না। সংসারে দেখা দিল অনটন। আমি তখন বেকার। ক্ষেতখোলা দেখাশোনা করব, পারি না। বাবা আমাকে শেখায়নি। ঘুরেফিরে দিন কাটে। সে সময় একদিন পুবপাড়ার তরফদারদের মেয়ে বৈচির সঙ্গে দেখা। বয়স খারাপ, দেখতে দেখতে  বৈচির সঙ্গে হয়ে গেল প্রেম। রূপ ছিল বৈচির। অন্ধকার রাতে সাপের মণি যেমন। আমি রাতবিরাতে বৈচির সঙ্গে দেখা করি। একদিন দেখা না হলে সারাদিন মন খারাপ। ভাতপানি খেতে ভাল্লাগে না। দেখেশুনে বাবা মা আমার বিয়ের কথা ভাবতে বসে। কোথায় কোথায় কনে দেখে বেড়ায়। কিন্তু আমার মন বলে বৈচি। আমি কার কাছে যাব?

সেই বৈচির সঙ্গে আমার বিয়ে হল না। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বৈচির বিয়ে হয়ে গেল ধাইধার ব্যাপারি বাড়ি। ব্যাপারিরা পয়সাঅলা, তরফদাররাও পয়সাঅলা। বৈচিকে সোনায় মুড়ে নিয়ে গেল। বিয়ের দুদিন আগে, একরাতে বৈচি আমার গলা জড়িয়ে কী কান্নাটা যে কাঁদল! বলল, চল আমরা পালিয়ে যাই।
আমি কাপুরুষ, পালাতে পারিনি। তরফদাররা দেশ গেরামের মাতব্বর, পয়সাঅলা। তাদের বংশের মেয়ে নিয়ে ভাগলে আমাদের বংশ নির্বংশ করে ফেলবে।
বংশের ভয়ে আমি বৈচিকে ছাড়লাম। বৈচির বিয়ে হয়ে গেল। বৈচির স্মৃতি বুকে নিয়ে আমার দিন কাটে।
তারপর কতদিন কেটে গেল। আমার বাপ মরল। বোনগুলো পুরনো সংসার ছেড়ে গেল নতুন সংসারে। এখন বুড়ি মা অন্ধকার বাড়ি আগলায়। আমি মাসকাবারি টাকা পাঠাই। দিন চলে যায়।
আমি কাপুরুষ, কথাটা সত্য। বৈচি চলে যাওয়ার পর আমি আর একজনকে ভালবাসি, তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
জাতির জনক। বঙ্গবন্ধু। আমি রাজনীতি করতাম না, রাজনীতি বুঝিও না। তবু মানুষটাকে ভালবাসি।
শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা লৌহজং মাঠে। দেখা মানে দূর থেকে দেখা। তিনি ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরে, শীতকাল ছিল, পাঞ্জাবির ওপর পরেছিলেন মুজিব কোট, ডানহাত তুলে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আমার বুক জুড়ে বৈচিকে হারানোর দুঃখ। সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যায় শেখ মুজিবকে দেখে আমি  বৈচির দুঃখ ভুলে যাই। মুহূর্তে বুঝতে পারি শেখ মুজিবের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা হলে আমি বৈচিকে একেবারে ভুলে যেতে পারব।
কী করি, কী করি!
চলে আসি শহরে। তার পর শওকত কন্ট্রাকটরের ম্যানেজারি। সে সময় আর একবার শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার দেখা। আমি রিকশা করে কাজে যাচ্ছি, হঠাৎ সামনে বেজে উঠল সাইরেন। প্রথমে একটা ছাদ খোলা জিপ, তাতে আর্মড পুলিশ, তারপর কতগুলো মোটর সাইকেলের মাঝখানে শেখ মুজিবের গাড়ি। তিনি বসেছিলেন জানালার ধারে। আমি রিকশায় বসে স্পষ্ট দেখি শেখ মুজিবরের চেহারায় খানিকটা বিষণ্ণতা। দেখে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়েছে, বঙ্গবন্ধু, তুমি কেমন আছ?
তার কয়েক দিন পর বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। সেই আমার দুঃখের শুরু। আমার সব গেল। বৈচি এবং বঙ্গবন্ধু দুজনেই। আমি কাপুরুষ, দুজনের একজনকেও ধরে রাখতে পারলাম না।

তারপর থেকে আমি গোপনে বঙ্গবন্ধুর একটা ছবি আমার মানিব্যাগের ভেতর রেখে দিই। রাতে ঘুমোনোর আগে একবার দেখি। ছবিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কাপুরুষ মনে হয়। বঙ্গবন্ধু, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।
হঠাৎ খেয়াল হয় এসব ভাবতে ভাবতে কাজের কথা ভুলে গেছি। আমি এসেছি সিমেন্ট নিতে। এনায়েত ট্রাক নিয়ে বসে আছে। রহিমকে পাঠিয়েছি সিগারেট আনতে। ইনডেন্ট আমার পকেটে। দুপুর হয়ে গেল, খিদে পেয়েছে। গেটপাস করিয়ে এনায়েতের হাতে দিয়ে চলে যাব।
আমি গোডাউনের দিকে হাঁটতে থাকি।

ফেরার পথে রিকশায় বসে আমার একবার রহিমের কথা মনে পড়ে। ত্রিশটা টাকা নিয়ে ভাগলো! নিশ্চয় কোথাও জুয়া খেলতে বসে গেছে। পেয়ে নিই হারামজাদাকে।
কিন্তু স্যারকে হিসেব দেব কেমন করে! ঝামেলা হয়ে গেল। খানিক পর সব ঝেড়েঝুড়ে ফেলে দিই, যা হয় হবে। এখন ওসব ভেবে মন খারাপ করার মানে নেই। স্যারকে বলব, ত্রিশ টাকা আমি খরচা করেছি।
রিকশাটা তখন আউটফল থেকে বেরিয়ে রেললাইন পেরিয়েছে। হঠাৎ দেখি সামনে অনেক লোকজনের ভিড়। রিকশাঅলা বলল, কে একজন ট্রাক চাপা পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে শেষ। শুনে বুকের ভেতরটা চিনচিন করে। নেমে একবার দেখে যাব। তখুনি শুনি ভিড়ের ভেতর মেয়েমানুষের কান্না। বুক চাপড়ে কাঁদছে কেউ। মনে পড়ে আমি বঙ্গবন্ধুর জন্য কখনও কাঁদিনি। আজ রাতে কাঁদব, মন ভরে কাঁদব। কাঁদলে অপরাধবোধ খানিকটা কমবে।
আমার রিকশা তখন দ্রুত ভিড় পেরিয়ে যাচ্ছে।

তিন
আশরাফ মিয়া বসেছিল বটতলায়। এখন রোদ হেলে গেছে বটগাছের পশ্চিমে। তলায় পড়েছে দীর্ঘ ছায়া। গাছে ছিল রাজ্যের কাক। সকাল থেকে টানা চিৎকার করছিল। এখন ক্লান্তিতে ঝিমাচ্ছে সব। চারদিকের পৃথিবী চুপচাপ হয়ে আসছে। এবার গরমটা পড়েছে খুব।
আশরাফ মিয়ার ঝিমুনি ধরছিল। এক জায়গায় তিনঘণ্টা বসে। ঝিমুনি তো ধরবেই! তাছাড়া আশরাফ মিয়া ওঠে খুব সকালে। প্রায় রাত থাকতে। অনেক দিনের অভ্যাস। ভোররাতে শুলেও ঘুম ভেঙে যাবে ঠিক আজানের সঙ্গে সঙ্গে। উঠে প্রশ্রাব  পায়খানা, হাতমুখ ধোয়া, নাশতা করা। এসব করতে করতেও বেলা ওঠে না। তবু আশরাফ মিয়া বারান্দা থেকে ত্রিশ বছরের সাইকেলটা নিয়ে বেরোয়। বেরিয়ে কত জায়গায় যে যায়! কত রকমের কাজ থাকে মানুষটার। ম্যালা লোকজনের কাছে টাকা পয়সা পাওনা, ম্যালা লোকজনকে আগাম টাকা দিতে হয়।

আশরাফের পার্টিরা সবাই কন্ট্রাক্টর। কিছু আছে দোকানদার, সিমেন্ট রডের কারবারি। আবার কিছু আছে দালাল। আশরাফের কাছ থেকে মাল কিনে অল্প লাভে বিক্রি করে। এইসব লোকজনের কাছে সকাল থেকেই যাতায়াত শুরু হয় আশরাফের। পুরনো সাইকেলটা আস্তে ধীরে, মাঝ বয়েসী শরীরে টেনে টেনে লোকজনের কাছে যায়। দুধারের বুক পকেটে জ্যাম হয়ে থাকে টাকা। আশরাফের ভাগ্য বটে, যেখানে হাত দেয় সেখান থেকেই উঠে আসে কড়কড়া নোট।
আশরাফ এত টাকা দিয়ে কী করে?
সংসারে বউ ছাড়া আর কেউ নেই আশরাফের। বিয়ে করেছে পঁচিশ বছর, ছেলেপান হয়নি। বাপের কালের বস্তিবাড়ি শিংটোলায়। একটা ঘরে আশরাফ আর আশরাফের বউ। বাকি চৌদ্দ পনেরটা ঘরে ভাড়াটে। সব রিকশাঅলা পান দোকানদার ওস্তাগার লেবার ধরনের মানুষ। মাসকাবারি পয়সা। ভাড়ার পয়সায়ই চলে যায় আশরাফের। তবু দালালিটা সে করে। ছেলেপান নেই, কার জন্যে করে কে জানে!

সকাল থেকে আজ আশরাফের মনটা খারাপ হয়েছিল। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। ফরাশগঞ্জের এক পার্টিকে দিয়েছিল দশ হাজার টাকা। গতকাল মাল দেবার কথা। সারাদিন বসে থেকে লোকটার পাত্তা পাওয়া গেল না। শালা টাকা নিয়ে ভাগলো! বলা যায় না! দশ হাজার টাকার ব্যাপার। চিন্তায় রাতে ঘুম আসেনি। কারবারে নামা ইস্তক লোকসান করেনি আশরাফ। ভারি হিসাবি মানুষ। হিসাবি মানুষ না হলে এত টাকা পয়সার মালিক হতে পারত না। বাপে তো টাকা পয়সা কিছু দিয়ে যায়নি। শিখিয়েছিল ওস্তাগারি। বউটার ছেলেপান হল না। আশরাফের টাকা পয়সার খরচা বাড়ল না। এ জন্য আশরাফের কী কোনও গোপন দুঃখ আছে!

প্রথম কিছুকাল ওস্তাগারি করেছে আশরাফ। বাড়িভাড়ার পয়সা তখন ছিল কম। তবু দুজন মানুষের সংসার চলে যেত ভালই। এসবের ফাঁকে ফাঁকেও আশরাফ টাকা পয়সা কিছু জমিয়ে ফেলল। তারপর শুরু করল দালালি। প্রথম কিছুদিন পার্টনার ছিল ফরাশগঞ্জের এক সিমেন্ট দোকানদার। লোকটা লাইন বুঝত। বছর দুয়েক করার পর আশরাফ নিজেও লাইনটা বুঝে গেল। পার্টনারশিপ দিল ছেড়ে।

সেই শুরু। দিনে দিনে পয়সা আসতে লাগল। লস নেই, ব্যবসায় লস নেই আশরাফের। টাকা লাগাতেই টাকা। কিন্তু এত টাকা দিয়ে আশরাফ কী করবে? তার কোনও ছেলেপান নেই। খাবে কে? বউটা মরলে, আশরাফ মরলে সব তো কাক চিলে খাবে!
তো আশরাফের ভেতরে ভেতরে একটা ইচ্ছা আছে। চারতলা একটা বাড়ি বানাবে। ওস্তাগারিটা তো জানেই। নিজেই করবে কাজটা। তারপর মরে যাবার আগে বউর গলা ধরে, ছেলেপানের দুঃখে একদিন খুব কাঁদবে।

কিন্তু চারতলা বিল্ডিং তুলতে কত টাকা লাগে আশরাফ জানে না। আন্দাজ করে, আরও বছর পাঁচেক দালালিটা করতে হবে। কিন্তু পাঁচ বছর আশরাফ বাঁচবে তো? বুকের ভেতর সময়ে অসময়ে আজকাল কেমন করে। রাতেরবেলা ঘুম হয় না। সাইকেল চালিয়ে শিংটোলা থেকে ফরাশগঞ্জ যেতে ক্লান্তি লাগে। শুনেছে মরার আগে মানুষের এরকম হয়। তাহলে আশরাফ কি আর বেশিদিন বাঁচবে না? শেষ ইচ্ছাটা কী...
এইটুকু ভাবতে বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। ফরাশগঞ্জের দোকানদারটার কথা মনে পড়ে। দশ হাজার টাকা আগাম দিয়েছে। মাল দেয়ার কথা ছিল কাল। দেয়নি। দিলে হাজার আড়াই টাকা লাভ। পার্টিও ঠিক করে রেখেছে আশরাফ। কিন্তু লোকটাকে পাওয়া যায়নি। হায় হায়, দশ হাজার টাকা না মেরে দেয় শালা।! তাহলে সময় যে আরও বেড়ে যাবে! পাঁচ বছরে কুলাবে না।

আজ একবার লোকটার কাছে যাবে আশরাফ। কাল রাতেই ভেবে রেখেছে। কিন্তু সকালে উঠেই মনে হয়েছে আজ মঙ্গলবার। মিউনিসিপ্যালিটির গোডাউন থেকে আজ সিমেন্ট সাপ্লাই দেবে। দুয়েকটা পার্টি ধরতে পারলে ভাল টাকার কাজ হবে। সকালবেলা তাই আশরাফ অন্য কাজে না গিয়ে এখানে চলে এসেছে। পার্টি অবশ্য একটা সকালবেলা এসেই জুটিয়েছে। আরিফ কন্ট্রাক্টর। মাল পাবে চল্লিশ ব্যাগ, বিশটাই ছেড়ে দেবে। খরচাপাতি বাদ দিয়ে আশরাফের কাজ হবে টাকা পঞ্চাশেকের। তার ওপর রহিম বলেছে পার্টি ধরে দেবে। কিন্তু হারামজাদার পাত্তা নাই। তিনঘণ্টা আগে গেছে ঠেলাগাড়ি আনতে। সঙ্গে নিয়ে গেছে আশরাফের সাইকেলটা। এত দেরি করছে কেন?
আরিফ সাহেবকে তিনটা ঘণ্টা ধরে বসিয়ে রেখেছে আশরাফ। একটু আগে মানুষটা বিরক্ত হয়ে উঠে গেছে গোডাউনের দিকে। বিরক্ত হোক আর যাই হোক আশরাফ ছাড়া উপায় নেই। আছে চল্লিশ ব্যাগ সিমেন্টের ইনডেন্ট। ওই দিয়েই কাজ চালিয়ে নেবে।

কিন্তু রহিমটা এতক্ষণ কী করছে? দুপুর শেষ হয়ে এল, ঠেলাগাড়ি আনতে এতক্ষণ লাগে! না, আশরাফের খুব লোকসান হয়ে যাচ্ছে। গোডাউনের কাছে থাকলে এতক্ষণে আরও দুয়েকটা পার্টি ধরে ফেলতে পারত। আরও কিছু টাকা আসত।
কিন্তু রহিম না এলে এখান থেকে যায় কেমন করে? হারামির বাচ্চায় সাইকেলটা নিয়ে গেছে। বাপের আমলের সাইকেল, ত্রিশ বছর ধরে চলছে, দুটো পয়সা খরচ করতে হয়নি। হারামির বাচ্চায় সাইকেলটা নিয়ে ভাগল? ঠিক বেচে দিয়ে জুয়া খেলতে বসে যাবে, রাতেরবেলা খাবে মাল। দশদিন ওর আর পাত্তা পাওয়া যাবে না।

এই অব্দি ভেবে রাগে বুক জ্বলতে থাকে আশরাফের। মামদার পুতে হগল সাইডেই লস করাইলো। পাইয়া লই চুতমারানির পুতেরে।
মুখে ঘাম জবজব করছিল, সাদা ফুল হাতা জামার খুঁটে মুখটা ভাল করে মোছে আশরাফ। চায়ের দোকানের ছেলেটাকে বলে, রহিম আইলে বাইন্দা থুইবি হালারে। আর আরিফ সাবে আইলে কবি আমি ঠেলা আনতে গেছি। থাকতে কবি।

আশরাফ আর দাঁড়ায় না। আউটফলের রোদ আর ধূলিবালি ভেঙে হেঁটে যায়। রহিমের ওপর রাগে গড়গড় করছে ভেতরটা। এখন রিকশা ভাড়া লাগবে। পারতে রিকশায় চড়ে না আশরাফ। নগদ পয়সা লাগে। হাঁটার অভ্যাস তো নেই। ত্রিশ বছর হাঁটেনি আশরাফ। সাইকেল চালিয়েছে। আজ এতটা দূর হাঁটতে আশরাফের পা টলমল করে। তবু হাঁটে আশরাফ। পয়সা লস করা যাবে না। লস করলে আশরাফের শেষ ইচ্ছাটা...
রেললাইনের কাছাকাছি এসে একটু ছায়া দেখে দাঁড়ায় আশরাফ। হাঁ করে শ্বাস টানে। বুকটা আইঢাই করছে। আশরাফ কি আর পাঁচ বছর বাঁচবে না! শেষ ইচ্ছাটা...
আশরাফ আবার হাঁটতে থাকে। দ্রুত সবকিছু করতে হবে আশরাফকে। পাঁচ বছর সময় নেয়া যাবে না। জীবনে ওই একটাই ইচ্ছা। ইচ্ছাটা পূরণ করতে হবে।
রেললাইনটা পেরিয়ে আসতেই, সামনে একদল লোক, সবাই হুতাশ করছে। দেখে আশরাফ একটু দাঁড়ায়। একজন লোক খুব দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছিল জায়গাটা। আশরাফ তার ডান হাতটা চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে, কী হইছে ভাই?
লোকটা ব্যস্তভাবে বলল, অ্যাকসিডেন্ট। বলেই চলে গেল।

আশরাফ ভিড় ঠেলে ততক্ষণে লাশটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কে একজন কাঁদছিল, প্রথমে তার দিকে তাকায় পরে লাশের দিকে। তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর হৎপিণ্ডটা গলাকাটা মুরগির মতো লাফঝাঁপ শুরু করে। চোখ ফেরানোর আগে তার ত্রিশ বছরের পুরনো সাইকেলটার দিকে তাকায় আশরাফ। দুমড়ে মুচড়ে জিলিপি হয়ে গেছে সাইকেল। ইচ্ছা করে সাইকেলটার গায়ে একবার হাত বুলায়। তখুনি ভয়টা চেপে ধরে। কেউ যদি জেনে ফেলে রহিমকে আশরাফই পাঠিয়েছিল, সাইকেলটাও আশরাফেরই, আশরাফ তখন কী করবে?
ভিড় থেকে বেরিয়ে লাফিয়ে একটা রিকশায় চড়ে। কোনও রকমে রিকশাঅলাকে বলে, শিংটোলা যাও। বুকের ভেতর হৎপিণ্ড লাফাচ্ছে। আশরাফের মনে হয় সে আর বাঁচবে না। পুলিশে ধরলে টাকা পয়সা সব যাবে। জেল। জেলে গেলে পাঁচদিনও বাঁচবে না সে। এসব ভেবে রিকশায় বসে কান্না পেতে থাকে আশরাফের। দুহাতে বুক পকেট দুটো চেপে রাখে সে। টাকা পয়সা বড় প্রিয় আশরাফের। এই টাকাগুলো নিয়ে পাঁচ বছর বাঁচতে চায় আশরাফ। তার একটা শেষ ইচ্ছা আছে। ইচ্ছাটা আশরাফ পূরণ করবে।

চার
গোডাউন বন্ধ হয়ে গেছে অনেক্ষণ। ওভারসিয়ার সাহেবও এইমাত্র অফিসরুম বন্ধ করে চলে গেলেন। তার হিসাব মেলানোর ব্যাপার থাকে। কন্ট্রাক্টররা চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ খাতাপত্র লেখা শেষ করে এইমাত্র লাল হোন্ডা চালিয়ে চলে গেলেন।
আরিফের যাওয়া হয়নি। সে বসে আছে অফিসরুমটার সামনে, ঘাসের ওপর। এখন আউটফলে লোকজন নেই। চারদিক নিঝুম হয়ে আছে। বিকেল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। দুয়েকজন পাহারাদার ছাড়া আউটফলে এখন আর কেউ নেই।
আরিফ বসে আছে আশরাফ মিয়ার জন্যে। দিনটা মিস হয়ে গেল। কাল থেকে কাজ ধরার কথা। ওস্তাগার ঠিক করা আছে। কিন্তু পয়সা নেই হাতে।

ছোটখাটো কাজ করে আরিফ। তার ওপর দুটো বিল আটকানো। ছাড়াতে কিছু টাকা লাগবে। টাকা ম্যানেজ হচ্ছে না। তার ওপর আবার কাজ। কাল থেকে না ধরলে ওভারসিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার রেগে যাবেন। রিপোর্ট যাবে একজিকিউটিভের কাছে। অসুবিধা হবে আরিফের। কোটেশানের ছোট ছোট কাজ তাও টাইমলি শেষ করতে পারে না। আগের দুতিনটা কাজে টাইম এক্সটেনশান করাতে হয়েছে। ওভারসিয়ার সাব এবার আগেই বলে দিয়েছেন, আর্জেন্ট ওয়ার্ক। টাইম দেয়া যাবে না। যদিও কাজ শেষ করার ডেট চলে গেছে তিনদিন আগে। কিন্তু তার জন্যে আরিফ কনস্ট্রাকশন দায়ী নয়। স্টকে সিমেন্ট ছিল না এই কজ দেখিয়ে এক্সটেনশনের চিঠি দেয়া যাবে। তা হলেই বা। আজ সিমেন্ট দেয়া হচ্ছে ওভারসিয়ার সাহেব জানেন। ইনডেন্ট দিয়ে রেখেছেন অনেকদিন আগে। তাছাড়া তাকে ইনফর্ম করা হয়েছে কাল থেকে কাজ ধরবে। আজ সকালেই আরিফ জানিয়ে এসেছে। কিছু টাকা পাওয়ার কথা ছিল। রাজ্জাক বলেছিল শ পাঁচেক টাকার কাজ চালাবে। আজ সকালেই দেয়ার কথা। আরিফ সেই আশায় ছিল। রাজ্জাকের কাছ থেকে আগেও বেশ কয়েকবার টাকা পয়সা নিয়েছে। কমিট করে রাজ্জাক ফেল করে না। কিন্তু এবার কেমন উলটপালট হয়ে গেল। রাজ্জাক মন খারাপ করে বলল, দোস্ত, পারলাম না।

এরপর আর কী কথা থাকে! আরিফ রিকশা নিয়ে আউটফল চলে এসেছে। পকেটে গোটা পনেরো টাকা আছে। ঠেলাগাড়ি ভাড়া দিয়ে সিমেন্টটা নিয়ে যে বাসায় রাখবে, উপায় নেই। আউটফলে আসতে আসতে রিকশায় বসে একটা প্ল্যান করেছে। আশরাফ মিয়ার কাছে বিশ ব্যাগ মাল বেচে দেবে। নগদ পয়সা দেবে আশরাফ মিয়া। পয়সা পেলে প্রবলেম সলভড। কাজটা কাল শুরু করা যাবে। অল্পকিছু পয়সা খরচা করে আগের বিল দুটো ছাড়ানো যাবে। অবশ্য আর একটা প্রবলেম হবে। কাজটায় লাভ হবে না। সিমেন্ট বাঁচানো যাবে না দু ব্যাগও। চল্লিশটাই লাগবে। কী আর করা যাবে, পরে বিশ বস্তা ব্ল্যাকে কিনে নেবে। আশরাফকে ধরলেই ম্যানেজ করে দেবে। পয়সা বেশি যাবে। যাক, কী করা!
সকালবেলা আউটফলে এসেই আশরাফকে পেয়েছে। চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। আরিফকেও খাওয়ালো এককাপ। তখন দোকানে আর কেউ ছিল না। চা খেতে খেতে আরিফ কথাটা বলল। আশরাফের তো কারবারই এটা। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। দরদাম ঠিক করে মনে মনে বিশ ব্যাগের দাম বের করে আরিফ। এক হাজার আশি। আশি টাকার চল্লিশ টাকা যাবে ঠেলাগাড়ি ভাড়া। দুপাঁচ টাকা পিয়নদের বখশিশ। পুরো এক হাজার টাকা হাতে রাখতে পারবে। ওই টাকায় কাজটা অর্ধাঅর্ধি শেষ করা যাবে। শুধু তো লেবার আর কেরিং চার্জ। এক ট্রাক ভিটি বালি কিনতে হবে। আর সব মালামাল তো অফিস থেকে সাপ্লাই দেবে।

সবকিছু ভেবে আরিফ মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিল, বাকি বিশ ব্যাগ সিমেন্ট কেনার আগেই বিল দুটো পাওয়া যাবে। হাজার চব্বিশেক টাকা। তখন আর আরিফকে পায় কে! চার মাসের সংসার খরচা দিয়ে মনোযোগ দিয়ে কাজটা করা যাবে।
ঘাপলা বাঁধালো রহিম।

আশরাফ মিয়া রহিমকে পাঠাল ঠেলাগাড়ি আনতে। তাড়াতাড়ির জন্যে সঙ্গে দিল নিজের সাইকেলটা আর শওকত কন্ট্রাক্টরের ম্যানেজার দিল সিগারেট আনতে ত্রিশ টাকা। সব নিয়ে রহিম যে গেল আর ফিরল না। আড়াইটা পর্যন্ত ঠায় বসে রইল আশরাফ। আরিফ এর মধ্যে বার কয়েক বটতলা আর গোডাউন করল। রহিমের পাত্তা নেই।

রহিমের একটু চুরিচামারির অভ্যাস আছে আরিফ শুনেছে। কিন্তু আশরাফ মিয়ার সাইকেল আর শওকত কন্ট্রাক্টরের ম্যানেজারের ত্রিশ টাকা নিয়ে ভেগে যাওয়ার সাহস পেল কই? ও কি মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরি করবে না?
তিনটার দিকে শওকত কন্ট্রাক্টরেরা সব ট্রাক ভরে সিমেন্ট নিয়ে যাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে আরিফ। আজকের দিনটাই খারাপ। সকালবেলাটাই শুরু হয়েছে খারাপ ভাবে।

আশরাফ গেল সাড়ে তিনটার দিকে। যাওয়ার সময় আরিফের সঙ্গে দেখা হয়নি। আরিফ তখন গোডাউনে। ভীষণ খিদে পেয়েছিল। মন মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তবু বাইরের প্রচণ্ড রোদ ভেঙে বটতলায় যায় আরিফ। আশরাফ মিয়াকে বলে নিজেই না হয় যাবে ঠেলাগাড়ি আনতে। পাঁচটায় গোডাউন বন্ধ হবে। তার আগে মাল বের করতে না পারলে ঘাপলা।

কিন্তু বটতলায় গিয়ে আশরাফ মিয়াকে না পেয়ে মন আরও খারাপ হয়ে যায় আরিফের। খিদে পেয়েছে, পকেটে পয়সাও নেই। তাছাড়া এখানে খাবেই বা কী! কিন্তু খিদে পেয়েছে, না খেলে চলবে কেন!
চায়ের দোকানে ঢুকে আরিফ দুটো পরোটা নেয় আর আট আনার ভাজি। খেতে শুরু করবে, তখুনি চায়ের দোকানের ছেলেটা বলল, আশরাফ ভাইয়ে আপনেরে বইতে কইছে। হেয় গেছে ঠেলা আনতে।

শুনে খুশি হয় আরিফ। মনোযোগ দিয়ে খেতে থাকে। আশরাফ মিয়া গেছে ঠেলা আনতে। আশরাফ মিয়া যখন গেছে সিওর ঠেলা নিয়ে ফিরবে। পাঁচটার আগে মাল খালাস করতে পারলেই হয়, গোডাউনের বাইরে রাখতে পারলেই হয়। পরে আস্তেধীরে ঠেলায় ভরে সন্ধ্যার মুখে মুখে আউটফল থেকে বের করে নিতে পারলেই হয়। সন্ধ্যা হয়ে গেলে পুলিশ ঝামেলা করবে।

কিন্তু পাঁচটা বেজে গেল আশরাফ মিয়াও আর ফিরল না। আরিফ চারটার দিকে এসে বসেছে এখানটায়। আস্তেধীরে সব কন্ট্রাক্টর গেল, গোডাউন বন্ধ হল, আধঘণ্টা হয়ে গেল ওভারসিয়ার সাহেবও চলে গেছেন। আরিফ বসে আছে, আশরাফ মিয়া ফিরবে সেই আশায়। এই লোকটা কথা দিয়ে মিস করে না। লোভী লোক। বিশ ব্যাগ মালের লোভ ছাড়তে পারবে না। শালা লাভ তো করবে একশো টাকা। এটা কি মিস করবে?
কিন্তু কেউ ফেরে না। না রহিম না আশরাফ মিয়া। রহিম না হয় ত্রিশ টাকা আর সাইকেল নিয়ে ভেগেছে, আশরাফ মিয়া ভাগলো কেন?
আরিফ কিছুই বুঝতে পারে না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আর কতক্ষণে বসে থাকবে?

আস্তেধীরে নিজের ওপর রেগে যেতে থাকে আরিফ। পকেটে একটা সিগারেট ছিল, স্টার। বের করে ধরাবে, তখন খেয়াল হয় ম্যাচ নেই। কাছেপিঠে লোকজনও নেই। রাগে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় আরিফ। শালার জীবনটাই বোগাস। বাপ শালা মরে গিয়ে বারো তেরো হাজার টাকা আর দশজনের সংসারটা চাপিয়ে দিয়ে গেল। আরিফের বিএ পাসটা হল না। সংসারে ঘানি টানছে। একটা প্রেমিকা ছিল, তরী। বাপ মরে যাওয়ায়, বড় সংসার দেখে ওই শালীও ভাগলো। এখন কোন এক ডাক্তারের বউ। লিবিয়ায় আছে। আর আমি শালা এখানে ছিঁড়ছি...
চারদিকের ঘনায়মান অন্ধকার ভেঙে উঠে দাঁড়ায় আরিফ। তখনি টের পায় রাগে দুঃখে কান্না পাচ্ছে তার। এখন কোথায় যাবে আরিফ? বেগমগঞ্জের গুমটি বাসায়! দশজন মানুষের কিলবিলে সংসারে!

ওখানে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না। আরিফ আবার বসে পড়ে। পকেট থেকে সিমেন্টের ইনডেন্ট বের করে। কুচি করে ছেঁড়ে কাগজটা। ছিঁড়ে হাওয়ায় অন্ধকারে ভাসিয়ে দেয়। কাগজগুলো উড়ে উড়ে পড়ে আরিফের চারপাশে। আরিফ খানিকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। তারপর সেই ছেঁড়া কাগজগুলোর ওপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদে। গুমরে গুমরে কাঁদে। অন্ধকারে আরিফের কান্না কেউ দেখে না।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন