ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

পরকীয়া

সাখাওয়াত হোসেন সুজন | প্রকাশিত: ০৮:৪৭ এএম, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬

‘যে কথাগুলো মুখে উচ্চারণ না করলে তোমার কাছে একজন ভালো মানুষ হিসেবেই বিবেচিত হতাম। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে সে কথাগুলো বলা যৌক্তিকই ছিল। তোমার কাছে সাধু কিংবা সন্ন্যাসী সেজে কী লাভ? মানুষের মাঝে পশুত্ব না থাকলে মনুষ্যত্বও টেকে না। কোনো সাধু পুরুষ কিংবা সাধ্বী রমণীই তো আর ফুলশয্যায় নিজেকে গুটিয়ে রাখে না। সেখানে নিজের পৌরুষত্বকে জাগিয়ে তোলার মধ্যেই রয়েছে মানুষ হিসেবে স্বার্থকতা।

আমার অনুভূতি প্রকাশের সুরটুকুও ভিন্ন ছিল না। তোমাকে তো কেবল শয্যাসঙ্গীনি হতে বলিনি, বলেছি জীবনসঙ্গীনি হতে। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত তোমার সুদৃষ্টিতে পড়িনি। রাজ্যের যত অপবাদ পুরুষ জাতিকে দেয়া যায় তার সবই তুমি আমাকে দিয়েছ। যদিও কখনো সেগুলো মুখে বলনি। তোমার দিকে একনজর তাকালেই চরম বিরক্তি রেখা ফুটিয়ে তা স্পষ্ট করে দিতে।

অথচ দু’জন পুরুষসহ এক রিকশায় যখন তোমাকে দেখা যেত; তখন তোমাকে আত্মবিশ্বাসীই মনে হত। একইভাবে আমার রিকশায় কোনো মেয়ে থাকলে তোমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমাকে বিদ্ধ করতো। আর দৃষ্টিই বলে দিত, অসহ্য এ ছেলেটাকে এ জন্যই আমি পাত্তা দেইনি!

রাত ১২টার পর তুমি ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাসের লেকচার কিংবা নোট আদান-প্রদান করতে। আর আমি কোনো অন্ধকারের রানির সঙ্গে আদিরসে মেতে উঠতাম বলেই ধারণা তোমার। কিন্তু অমনটা আমি কখনোই ছিলাম না। যদিও তোমার মতে, আমার হাতে ফুল থাকলে তা ছিল ডেটিংয়ের আলামত! আর তোমার হাতে ফুল উঠতো কেবল বন্ধু কিংবা বান্ধবীর জন্মদিন তথা অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য।

পৃথিবীতে তোমার দেখা সবচেয়ে খারাপ মানুষ আমিই ছিলাম। ভাবতে ভালোই লাগে, ওই শান্তিপূর্ণ চোখ দুটিকে যেন শান্তিতে নোবেল দেয়ার কথা বিবেচনা করা হয়। সেগুলো অনুসন্ধানী চোখও বটে!

তোমার এক মাদকসেবী বন্ধু একবার গোপনে আমার কাছে এসেছিল ক’টা লাল ট্যাবলেটের জন্য। প্রথমে আমি বুঝিনি, সে কেন এসেছে? তাই যখন সে ইশারায় আমাকে ডেকে নেয় তখন ভেবেছিলাম- হয়তো তোমার মনোভাব কোমল হয়েছে তাই তাকে দিয়ে কোনো গোপন খবর পাঠিয়েছ। কিন্তু যখন জানলাম, ও তোমার কাছে শুনেছে- আমি নাকি ইয়াবায় অভ্যস্ত! বেচারাকে কোনো দোষ দেইনি। দোষ আমার কপালের।

কয়েকদিন ধরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছি। তাই এ আবোল-তাবোল ভাবনাগুলো লিখছি। তুমি তোমার মত করে ভেবেই সুখী থাকো। নির্ঘুম রাতে লেখা এ চিঠিটি আমি সকালেই ছিঁড়ে ফেলবো। যেহেতু এ চিঠিটা কেউ পাবে না, আর এটা লিখেছিও কেবল নিজের জন্য। তাই আর নিবেদকের নিবেদন সম্পর্কিত সমাপ্তি আর টানলাম না।’

চিঠির প্যাডটা পাশে রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো রিফাত। কাকের কা-কা শব্দ আর হাসপাতালের জানালা দিয়ে আসা রোদ ঘুম ভাঙিয়ে দিলো তার। ঘুম থেকে উঠে সবার আগে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলবে। ছেঁড়ার আগে আবারো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লো। ছিঁড়তে যাবে এই মুহূর্তে চিঠির শেষ দিকটা দেখে চমকে উঠলো। সেখানে আরেকটা চিঠি শুরু হয়েছে-
‘রিফাত,
আপনার চিঠিটা পড়ে কিছুটা ব্যথিত হলাম। আপনাকে জানার আগ্রহও মনে জন্মেছে। যদি সময় থাকে নিচের ফোন নম্বরটিতে রাত ১০টার পরে ফোন দিয়েন।
নিবেদিকা,
আপনারই শুভাকাঙ্ক্ষী’।

রিফাত অবাক হলো। যে কথাগুলো কাউকে জানাতে চায়নি; সে কথাগুলোই তার অজান্তে অন্যকে জানিয়ে দিলো।

হাসপাতালের নার্স কিংবা ডাক্তার কেউ হবে হয়তো। ফোন দেবে কি দেবে না ভাবতে ভাবতে ওয়াশ রুমে গেল। কাজ শেষে দরজা খুললেই চোখের সামনে একজন তোয়ালে ধরে আছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। ভাবলো সে বুঝি এসেই গেছে! কিন্তু না, সে তার স্ত্রী রুবিনা।

রিফাতকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে রুবিনা বললো, কাল রাতে কষ্ট হয়নি তো? আসলে কালকে অফিস থেকে ফিরে আমারও শরীরটা খারাপ ছিল। তাই খাবারটা পাঠিয়েছিলাম। আমি আর আসিনি।
রিফাত বিছানায় শুতে শুতে বললো, বেশ করেছ। এখন থেকে তোমার আর এখানে থাকার দরকার নেই। আজো তুমি অফিস শেষে সোজা বাসায় চলে যেও। বেশ কিছুদিন তোমারো শরীরের উপর ধকল গেলো।
রুবিনা বললো, ডাক্তারও তাই বললো। এখন তুমি অনেকটা সুস্থ আছ। সাথে থাকার দরকার নেই। কাল-পরশুই ওরা তোমাকে রিলিজ দিয়ে দেবে।

বিছানাটা একটু ঠিক করে দিতে যাচ্ছিল রুবিনা। হাতটা রিফাতের হাতে লাগতেই সে চমকে উঠলো। বিছানা থেকে ঝট করে উঠে রুবিনার কপালে হাত দিয়ে দেখলো তার জ্বর এসেছে।
কী ব্যাপার, তোমারো আমার মত ভাইরাস জ্বর এলো নাকি? জিজ্ঞেস করলো সে।
আরে না, ভাইরাস জ্বর না। রাতে ঠান্ডা লেগেছিল তাই হালকা জ্বর এসেছে। এ এমন কিছু না। রাতে আসবো, এখন অফিসে গেলাম। শিং মাছের ঝোল করে এনেছি, খেয়ে নিও। কথাগুলো বলে আর দেরি না করে বেরিয়ে যাচ্ছিল রুবিনা।
রিফাত বললো, একটু দাঁড়াও।
থেমে গেল রুবিনা। রিফাত বললো, যা এনেছ আমি খেয়ে নেব। তবে তোমার রাতে আসার দরকার নেই। অফিস থেকে পারলে একটু আগেভাগে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যেও।
দেখি, বলে রুবিনা চলে গেল।

সে চলে যাওয়ার পর রিফাত সকালের নাস্তাটা খেয়ে নিল। এরপর প্যাডটা হাতে নিয়ে সেই নম্বরটিতে ফোন করল। টিঅ্যান্ডটি নম্বর ছিল। অনেকক্ষণ রিং হলো কেউ রিসিভ করলো না। এজন্যই বুঝি রাত ১০টার দিকে ফোন দেয়ার কথা বলা হয়েছে ভাবলো সে। আর এটাও নিশ্চিত হলো এ হাসপাতালেরই ডাক্তার অথবা নার্স হবে হয়তো! তবে লেখা দেখে সে বুঝলো কোনো সুন্দরী ডাক্তারই হবে। কারণ, বিজ্ঞের মতো দেয়া চিঠির জবাব কোনো ডাক্তারেরই দেয়ার কথা। নার্সরা নির্দিষ্ট কাজগুলো সেরেই চলে যায়। আর ডাক্তাররা অনেক বিষয় খেয়াল করে।

এভাবেই উতলাভাবে দিন কাটলো রিফাতের। সন্ধ্যাবেলা রুবিনাকে ফোন দিয়ে জানলো, সে ঠিকই আজ অফিস থেকে আগেভাগে বেরিয়ে বাসায় ফিরে বিশ্রাম নিয়েছে। গায়ে জ্বরও নেই। রিফাত তবু তাকে রাতে আসতে নিষেধ করে দিল। রাতের খাবারটা পাঠিয়ে দিতে বললো।

বাসায় গ্রাম থেকে আসা একজন মধ্যবয়সী বুয়া থাকেন। রান্না-বান্না সেই করে। আর রিফাতের এক দূর্সম্পর্কের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ভাতিজা বাসার অদূরেই থাকে। তাকে দিয়েই মাঝে মাঝে খাবার পাঠায় রুবিনা। আজো তার হাতেই খাবার পাঠিয়ে দিতে বললো রিফাত।

সময় যেন কাটতেই চাইছে না। অজানা সে আকর্ষণই আজ তাকে বড় বেশি টানছে। রুবিনাকে আসতে না করার কারণটা একমাত্র সে-ই জানে। মনের কাছে কিছুটা হলেও সে অপরাধী হলো।
নানা ভাবনায় ডুবে ছিল সে। এরই মধ্যে রাতের খাবার এলো। তখনো ৯টা বাজেনি। খাবার নিয়ে আসা ভাতিজার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করলো সে। তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিল।
এরপর হাত-মুখ ধুয়ে রাতের খাবারটা খেয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার-নার্স দুজনেই এলো। তাকে চেক করে রাতের ওষুধটুকু খাইয়ে তারা চলে গেলেন। ডাক্তার পুরুষ ছিলেন কিন্তু নার্স অল্পবয়সী। নার্সের দিকে কিছুটা ভ্রু কুঁচকে তাকালো রিফাত। মনে মনে ভাবলো, এটা হলে সর্বনাশ! বয়স কম হলেও তার চেহারায় খুব একটা মাধুর্য ছিল না।

ফোন দেয়ার সময় তখনো হয়নি। চিঠি লেখা সেই প্যাডটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরই পায়নি। অনেকটা ভাতঘুম দিয়েছিল সে। উঠে দেখে পৌনে এগারোটা বাজে।
ঝটপট ওয়াশ রুম থেকে ফিরে সেই টিঅ্যান্ডটি নম্বরটিতে ফোন দিল। দু’বার রিং হলো কেউ ধরলো না। তৃতীয় বারে ওপাশ থেকে একটা নারীকণ্ঠ শোনা গেল।
আমি রিফাত কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে খিল খিল করে হাসির শব্দ শোনা গেলো।
রিফাত বললো, হাসছেন যে?
না, আপনি তাহলে ফোন দিলেন। এটা ভেবেই হাসছি। ওপাশ থেকে জবাব এলো।
আচ্ছা আপনি কি এই হাসপাতালের স্টাফ, ডাক্তার কিংবা নার্স? জিজ্ঞেস করলো রিফাত।
ও আপনি ভেবেছেন আমি ডাক্তার বা নার্স। এ কথা বলে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছিলেন ওই নারী।

দু’বছর হলো বিয়ের, নিজের বউকেও এতো হাসতে দেখেনি রিফাত। মেয়েমানুষ এত হাসতে পারে তা তার ভাবনার বাইরে।

তাহলে আপনি কে? আর হাসপাতালে এসে আমার চিঠি পড়লেন কীভাবে? বিস্মিত হয়ে প্রশ্নগুলো করলো রিফাত।
আমি সাবরিনা আক্তার। আর আমি হাসপাতালের কেউ নই, রোগীর লোক। আজ সকাল পর্যন্ত আপনার পাশের রুমেই ছিলাম। আমার এক আত্মীয়া সেখানে ভর্তি ছিল।
রিফাত বললো, তাহলে আমার কেবিনে এসে প্যাড পেলেন আর লিখলেন কী করে?
সাবরিনা বললো, সকালে আমার রোগীর রিলিজের ব্যাপারে ডাক্তারের একটা সাইনের দরকার ছিল। ডাক্তার যখন আমাদের কেবিনে ছিল তখন ওটা আমাদের মনেই ছিল না। কিন্তু আপনার রুমে গেলে মনে হয়। তাই আপনার কেবিনে গিয়ে তার সাইন নিয়ে আসি। আপনি বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলেন। আপনাকে না ডেকে ডাক্তার কাগজপত্র দেখে আপনাকে চেক করছিলেন। ডাক্তার আমার কাগজটা আপনার ওই প্যাডের উপর রেখেই সাইন করেছিলেন। আর ওটাসহ আমাকে দিয়ে দেন। আমিও দুটো নিয়েই চলে আসি।
রিফাত বললো, ও তাহলে এই ঘটনা।

সাবরিনা বললো, হ্যাঁ। রুমে এসে দেখি প্যাডটাও নিয়ে এসেছি। ওটা খুলতেই আপনার চিঠিটা পাই। আর জবাব লিখে ওটা আবার ফেরত দিয়ে আসি। তখনও ঘুমাচ্ছিলেন আপনি। তবে চিঠিটা পড়েছেন তাই ফোন দিলেন, একথা বলে ফের হাসতে শুরু করলো সে।

মনে যখন ভালোবাসার উদ্রেক হয় তখন অপরিচিত কণ্ঠস্বরকেও মনে হয় কতদিনের চেনা! তেমনি মনে হচ্ছিল রিফাতের। তাই ১১টার গল্প আর থামলো না, চললো প্রায় ১টা পর্যন্ত।

সাবরিনা বললো, একটা বাজতে আর বেশি দেরি নেই। সকাল বেলা অফিস আছে।
রিফাত বললো, ওহ দুঃখিত আমি। তবে আপনি কি করেন এটা কিন্তু জানা হলো না।
সাবরিনা বললো, বন্ধুত্ব যখন হলো কথা তো আরো হবে। দেখাও হবে। তখন না হয় বিস্তারিত জানবেন। আর হ্যাঁ, আমার মোবাইল নম্বরটা রাখুন। পরে কথা হবে।

দুজন মোবাইল নম্বরসহ শুভেচ্ছা বিনিময় করে শুয়ে পড়লো। রাতে দারুণ ঘুম হলো রিফাতের একেবারে চাঙা ভাব। ‘চা-টা খেয়ে নাও’ কথায় ঘুম ভাঙলো তার। রুবিনা এসেছে চায়ের সঙ্গে সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার নিয়ে। উঠে বসে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে রুবিনার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো রিফাত। আজ অসামান্য সুন্দর লাগছে তাকে। স্বভাবমতই শাড়ির সঙ্গে বড় ওড়না ও স্কার্ফ পরেছে সে। খোলা চুল হলে আরো সুন্দর লাগতো।

রুবিনা বললো, কি ব্যাপার? চা না খেয়ে তাকিয়ে আছো যে!
তোমাকে দেখছি রুবি। আজ তোমাকে অনেক অনেক সুন্দর লাগছে। জবাব দিলো রিফাত।
বাদ দাও তো, চা-টা শেষ করে ফ্রেশ হয়ে আসো। তুমি নাস্তাটা করলেই আমি অফিসে যাবো। বললো রুবিনা।

রিফাত উঠে বাথরুমে গেলো। বেসিনের সামনে দাঁড়াতেই তার চোখের সামনে আয়নায় ভেসে উঠলো রুবিনার মুখ। এমন সুন্দর স্ত্রীকে পেয়েও সে কেন অন্য একটা অজানা-অচেনা মেয়ের প্রতি ঝুঁকছে?

বেশ কিছুটা সময় নিয়েই বাথরুম থেকে বের হলো সে। তাকে দেখে কিছুটা চিন্তিত হলো রুবিনা। কী ব্যাপার, তোমার চোখ লাল কেন? উদ্বিগ্নকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো সে।
না, তেমন কিছু না। মুখে পানির ঝাপটা বেশি দিয়েছি তো, তাই এমন লাগছে। তোমার অফিসে দেরি হয়ে যাবে, চলে যাও তুমি। আমি খেয়ে নেব। বললো রিফাত।
তুমি খেয়ে নাও। তারপর যাবো। আর হ্যাঁ কাল তো শুক্রবার, ওরা কাল বিকেলেই তোমাকে রিলিজ দিয়ে দেবে। বললো রুবিনা।
রিলিজের কথা শুনে খুব একটা খুশি হলো না রিফাত। তার মুখ দেখেই সেটা বুঝলো রুবি। কারণটা যদিও তার বোধগম্য নয়।

রিফাতকে সকালের নাস্তায় গরুর মাংসের ঝোল ও রুটি খাওয়ালো সে। জ্বরের মুখের তেঁতো ভাবটা এখনো আছে। তাই খাওয়ার রুচিও নেই। তাই অনেকটা জোর করেই তাকে খাইয়ে অফিসে চলে গেলো রুবিনা। সে চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ চিন্তা করে ফোনটা হাতে নিল রিফাত। তবে অফিসের সময় কাউকে ফোন দেয়া উচিত হবে না ভেবে আর ফোন দিল না।

রিফাতের শরীরটা দুর্বল, খাওয়ার রুচি নেই। আর সবই ঠিক আছে। তবে কোনো প্রকার চিন্তা-ভাবনা করতে ভালো লাগছে না। তাই টিভি অন করে একটা সিনেমা দেখতে শুরু করলো। সিনেমাসহ কয়েকটা অনুষ্ঠান দেখতে দেখতেই দুপুর হয়ে গেল। প্রথম প্রথম জ্বরের তীব্রতায় কিছুটা অনিয়মিত হলেও এখন নিয়মিতই গোসল করছে সে। তাই উঠে গোসল-খাওয়া দু’টোই শেষ করলো।

শুয়ে শুয়ে একটা উপন্যাসের পাতা ওল্টাচ্ছিল রিফাত। পড়ার অভ্যাস তার খুবই কম। তবে হাসপাতালের দিনগুলোতে সময় কাটতেই চায় না। তাই যত উপায় আছে সময় পার করার, তার সবই করেছে সে। বই পড়াটাও তারই অংশ।

ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। সাবরিনার ফোন। ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছেন? খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তো?
রিফাত বললো, ভালো আছি। খাওয়াও সেরেছি। আপনার কী অবস্থা?
আমি ভালোই আছি। কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। বললো সাবরিনা।
হ্যাঁ, অবশ্যই। বলে ফেলুন ঝটপট জবাব দিল রিফাত।
সাবরিনা বললো, দয়াকরে রাতে আর ফোন দেবেন না। আমি একটা রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে। বোরকা পরে চলাফেরা করি। ফুফুর বাসায় থাকি! কাল রাতে অপরিচিত এক পুরুষের সঙ্গে কথা বলায় ফুফুর কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে।
রিফাত বললো, ঠিক আছে। আমারও একটা কথা শুনুন, আমি বিবাহিত। আমার মনে হয়- আমাদের দু’জনের কথা বা মেলামেশা বন্ধ রাখাই ভালো।
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ শোনা গেলো।
হাসছেন যে? আমি কি মন্দ বলেছি? কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললো রিফাত।
না, আমি কর্মজীবী কুমারি এটা ঠিক। তবে আমরা তো আর প্রেম করছি না। কিংবা পরকীয়ায় জড়াচ্ছি না। বলে এবার আরো হাসতে শুরু করলো সাবরিনা।
হাসিটাতে কী যে মায়া জড়ানো, তাই রিফাত আর কিছুই বলতে পারছিল না।
সাবরিনাই বললো, আমরা বন্ধু থাকি। এই ভালো। একটা কথা মনে রাখবেন, পৃথিবীতে সবার সঙ্গে সবার পরিচয় হয় না। কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় যেটা জীবনেরই একটা অংশ। তাই আমরা এই পরিচিতিটা ধরেই রাখি। মাঝে মাঝে দিনের বেলা একটু আধটু খোঁজ-খবর নেব। গল্প করবো, এই যা।
রিফাত বললো, আপনি না রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের বোরকা পড়ুয়া মেয়ে। পরপুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব কেমন করে রক্ষা করবেন।
বাদ দেন তো। সব বিধি-নিষেধ কি মানুষ মানতে পারে? আইন তো এজন্যই করা। আইনপ্রণেতারা জানেন যে মানুষ আইন ভাঙবে।
হাসলো রিফাত। ঠিক আছে। তাহলে দুপুরে একটু বিশ্রাম নেই। ভালো থাকবেন বললো রিফাত।
ভালো থাকুন- সুস্থ থাকুন। বলে সালাম দিয়ে ফোন রেখে দিল সাবরিনা।

ঘুমের রাজ্যে ডুব দিলো রিফাত। বিকেলে উঠেই দেখলো রুবিনা অফিস থেকে সোজা হাসপাতালে এসেছে। রাত ৮টা পর্যন্ত থাকলো। সকালের মত নিরস নয়; প্রাণখুলেই তার সঙ্গে কথা বললো রিফাত। রুবিনা চলে গেলে খেয়ে ১০টার মধ্যে শুয়ে পড়ে রিফাত। সত্যিই রাতে আর ফোন দিল না সে।

পরদিন হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে বাসায় ফিরলো। দিনে কেবল একবার সাবরিনার সঙ্গে কথা বললো। শারীরিক দুর্বলতার কারণে আরো সাতদিন বাসায় বিশ্রাম নিলো। এরপর নিজেও যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হলো। সাবরিনার সঙ্গে তার বন্ধুত্বও বেশ জমে উঠলো। তবে তা গোছানো বন্ধুত্ব। যদিও তারা এখন পরস্পরকে তুমি বলে সম্বোধন করে। তারপরও সম্পর্কের অবক্ষয় ঘটেনি। রুবিনার সঙ্গেও স্বাভাবিক সম্পর্কই বজায় রেখেছে রিফাত।

তিন-চার মাস পর তারা দেখাও করলো। সেদিনটা ছিল একটা মজার দিন। কোনো কারণ ছাড়াই এক পশলা বৃষ্টি হয়। দিনটি ছিল শনিবার। বিকেল বেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রিফাত ও সাবরিনা দেখা করে। কিন্তু দু’জনে দেখা করলেও দেখাটা রিফাতের জন্য একপাক্ষিক ছিল। কারণ তাকে দেখেছে সাবরিনা, সাবরিনাকে সে দেখেনি। সাবরিনা পুরোপুরি বোরকার সঙ্গে চোখে চশমা পরেছে। তাই রিফাতের ধারণা তাদের দেখা একপাক্ষিক হয়েছে কিন্তু কথা দ্বিপাক্ষিকই ছিল।

সেখান থেকে তারা শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের একটি রেস্টুরেন্টে বিকেলের নাস্তা করে। কিন্তু সেখানেও রিফাত ষোলোআনা ব্যর্থ হয়। বোরকার ভেতর দিয়েই কৌশলে খেয়ে নেয় সাবরিনা। তাই তাকে দেখার আশা অপূর্ণই থেকে যায়। সন্ধ্যার পরই দু’জন দু’জনার কাছ থেকে বিদায় নেয়। রাতে আর কথা হয়নি।

সেদিন রাতে বাসায় ফিরতে একটু সময় নেয় রিফাত। বাসায় ফিরতে দেরি হল কেন জানতে চাইলে রুবিনাকে কয়েকটা কটূ কথা শুনিয়ে দেয়। রুবিনা অবাক হয়! যদিও খাওয়া শেষে ঘুমানোর আগে তার কাছে দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নেয় রিফাত।

পরদিন সাবরিনার সঙ্গে কথা বললে তাকে না দেখাটাকে একটা অপূর্ণতা হিসেবে বর্ণনা করে রিফাত। সাবরিনা হাসতে হাসতে বলে কিছু বিষয় এমন অপূর্ণই থাকে বন্ধু!

রাতে তারা কথাই বলে না। কেবল দিনেই কথা হয়। আর খুব একটা দেখা হয়নি। কিন্তু মোবাইলে সম্পর্কটা একটু বেশি গাঢ় হয়। দুজন দুজনার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলোও আলোচনা করতে শুরু করে। একটু-আধটু বাকযুদ্ধও হয়। সেইসঙ্গে ফেসবুক, স্কাইপে চ্যাট এবং কথা হয়। সেখানে দেখাও হয়। বন্ধুত্ব যেন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।

সাবরিনার চালচলনে খুব একটা পরির্বতন আসেনি। কিন্তু রিফাতের মনে আবেগ দানা বেঁধেছে। বন্ধুত্ব বাসনায় পরিবর্তিত হয়েছে। পুরুষ মনে জেগেছে সাবরিনাকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
তোমাকে আমি সম্পূর্ণরূপে পেতে চাই সাবরিনা। একদিন এ কথা বলে ফেললো রিফাত।
মানে কী! বিয়ে ছাড়া কোনোরূপ সম্পর্কে জড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু তোমার তো স্ত্রী আছে। কীভাবে সম্ভব? জানতে চাইলো সাবরিনা।
রিফাত বললো, কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। তুমিই বলো।
সাবরিনা বললো, আমার মনে হয় আমাদের বন্ধুত্বটাই অনুচিত। নারী-পুরুষ বন্ধুত্বে ঠিকই একদিন শরীরী চাওয়া-পাওয়া জেগে ওঠে। আমাদেরও তাই হয়েছে। তাই বলছি, বন্ধুত্ব এখানে শেষ হোক।
তুমি কি বলতে চাইছো- আমরা আর একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করবো না। জানতে চাইলো রিফাত।
এখন নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করাই জরুরি। সব ভুলে গিয়ে স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী হও। আজ নয়, এখন থেকেই আমাকে আর কোথাও পাবে না। সাবরিনার সাফ জবাব।
তুমি বোধহয় একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করছো। একটু ভেবে দেখ। কাতরকণ্ঠে বললো রিফাত।
ভালো থেকো রিফাত। নিজের মত করে সুখী হও। বলেই ফোন কেটে দিল সাবরিনা।

রিফাতের জীবনে সাবরিনা পর্বের সমাপ্তি এভাবেই ঘটে যাবে তা সে বুঝতেও পারেনি। আর সত্যিই কখনো সাবরিনাকে সে পায়নি। না ফোনে না অন্য কোনো যোগাযোগমাধ্যমে।

জীবন থেকে চরম একটা শিক্ষা পায়। সাবরিনাকে নিজের বাসা-অফিস সবকিছুর ঠিকানা দিয়েছে। তার যে কয়টি ফোন নম্বর ছিল সবই দিয়েছে। কিন্তু তার ক্ষেত্রে কেবল একটি ফোন নম্বর আর স্কাইপ আইডি। যেগুলো প্রায় সপ্তাহখানিক বন্ধ। তবে এ কারণে রুবিনার সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হয়নি। কয়েকদিন চুপচাপ ছিল সে। এরপর স্বাভাবিক হয়েছে। যদিও মনে একটা হাহাকার থেকেই গেছে।

রুবিনা তার স্ত্রী হলেও সাবরিনার মতো বন্ধু তো আর নয়! একরাতে খাওয়ার পর ড্রয়িং রুমে বসে এসবই ভাবছিল রিফাত। খালা বসে বসে টিভি দেখছিল। সেদিকে তার কোনো খেয়ালও নেই। স্বামী-স্ত্রী কর্মজীবী হওয়ায় গ্রামের দূর্সম্পর্কের এ বিধবাকে বাসায় রেখেছে। তিনি সম্পর্কে রিফাতের খালা। বাসার সব কাজ তিনিই করেন। রাঁধেনও ভালো। তবে রুবিনাও যথেষ্ট পরিশ্রমী। অফিস শেষ করে বাসায় ফিরে অন্তত তরকারিটা নিজে রেঁধে খাওয়ায়।

ভাবনায় ডুবে থাকা রিফাতের মাথায় হাত দিল রুবিনা। তোমার কি শরীর খারাপ? জিজ্ঞেস করলো সে।
না, শরীর খারাপ না। চলো ঘুমাই। বলে রুবিনাকে নিয়ে ঘরে গেলো রিফাত।
বিছানায় শোয়ার আগে রুবিনা বললো, আমরা একটা বেবি নিলে কেমন হয়? দু’বছর তো হয়ে গেলো।
রিফাত বালিশে মাথা রাখতে রাখতে বললো, ঠিকই বলেছ। মিছেমিছি দেরি করছি। থাক, এসব কথা পরে হবে। এখন ঘুমিয়ে পড়ি।
রুবিনা বললো, ঘুমাতে চললে যে! বেবি নেবে না। তার মুখে দুষ্টুমির হাসি।
রিফাত ওপাশ থেকে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। অনেকদিন পর মন থেকে হাসি এলো তার। রুবিনাও হাসতে হাসতে লাইট অফ করে বিছানায় গেলো।

স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো রিফাত। যদিও তার জীবনে সাবরিনার শূন্যতা পূরণ হবার নয়। তার জীবনে সাবরিনার মতো চঞ্চলতা কেউ সৃষ্টি করতে পারেনি। তারপরও কেটে যাচ্ছে দিন আপন গতিতে। এদিকে রুবিনাও গর্ভবতী। বেশ কয়েক মাস হলো।

একদিন রিফাত অফিসের কাজে মগ্ন। এ সময় একটা ফোন এলো। রুবিনা ফোন দিয়ে জলদি তাকে বাসায় ডাকলো। কোনো কারণ সে বলেনি। রিফাতও জানতে চায়নি। অফিস থেকে বের হয়ে ঝটপট বাসায় চলে গেলো সে। বাসায় ঢুকে চমকে উঠলো। ড্রয়িংরুমে বসে আছে সেই বোরকা পরা সাবরিনা!
সাবরিনা, তুমি এতদিন পরে। আমার বাসায়। রুবিনাকে কী বলেছ? সে কোথায়? একসঙ্গে কথাগুলো বললো রিফাত।
এত ব্যস্ত হতে হবে না। রুবিনা নিচে গেছে। অল্প সময়েই এসে যাবে। আগে বলো, কেমন আছো? জানতে চাইলো সাবরিনা।
এমন পরিস্থিতির কথা কখনো চিন্তা করেনি রিফাত। তাই সে স্বাভাবিক হতে পারেনি।
আচ্ছা, তোমার বাসার টিঅ্যান্ডটি নম্বরটা বলো তো। জানতে চাইলো সাবরিনা।
ওটা আমার মনে নেই। শুকনো জবাব রিফাতের।
তাই নাকি! কচি খোকা। তুমি আমাকে গর্ভবতী করেছ। অত সহজে তোমাকে ছাড়বো না।

আকাশ থেকে পড়লো রিফাত। কথাটা ফোনে বললে সে না হয় হাসতে হাসতেই জবাব দিত। কিন্তু তার বাসায় দাঁড়িয়ে এ কথা বলছে। নিশ্চয়ই মনে কোনো কুমতলব আছে!
তাকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাবরিনা বললো, আচ্ছা ওসব কথা পরে হবে। ওই যে ওখানে রুবিনার অফিসের আইডি কার্ডটা আছে ওটা দাও তো।
ঝটপট তা এনে তার হাতে দিচ্ছিল রিফাত।
সে বললো, ওটা আগে নিজে দেখ।
এখানে আবার কি- বলে কার্ডের দিকে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো রিফাত। আইডি কার্ডে নামের জায়গায় লেখা, সাবরিনা তাবাসসুম রুবিনা।

ধপ করে সোফায় বসে পড়লো রিফাত। রুবিনা হাসতে হাসতে বোরকা খুলে ফেললো। খালা এই মুহূর্তে চা-নাস্তা নিয়ে এসে হাসতে হাসতে বললো, ‘তুমাদের নাটক শ্যাষ।’ রিফাত মনে মনে নিজেকেই দোষারোপ করল। কত বড় বোকা। সাবরিনা আর কেউ নয়- তারই স্ত্রী! অথচ এটাই সে বুঝতে পারেনি। অন্য নারী ভেবে পুলকিত হয়েছে। লজ্জায় রুবিনার দিকে তাকাতে পারছিল না সে।
আমাকে ক্ষমা করবে না রুবিনা। মুখ নিচু করেই বললো সে।

রুবিনা তার কাছে এসে বসে বললো, পুরো ফাঁদটাই তো আমার। আমি দুষ্টুমি করেছি। দেখ, আমরা দু’জনে সম্পর্কটাকে জটিল করেছি। তুমি আরেকজনকে ভেবে যতটা বন্ধুত্ব গড়েছ। ঠিক তেমনই বন্ধু হয়ে আজীবন চলতে পারি আমরা।
রিফাত বললো, আসলেই তাই। তারপরও যেহেতু আমার ভাবনায় ভিন্ন নারীই ছিল। তাই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।
বাদ দাওতো এসব। বাসায় বাজার নেই। এজন্যই তোমাকে ডেকেছি। বাজার নিয়ে আসো, যাও। হাসতে হাসতে বললো রুবিনা।

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন