বব ডিলান ও নোবেল পুরস্কারের বিতর্ক
রেডিওহ্যাডের বানানা কো গানে বিশ শতকে ল্যাটিন আমেরিকায় বানানা কোম্পানির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বলা দরকার এই গান তারা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই লিখেছেন। ডগলাস এডামসের হিচহাইকার গাইড টু গ্যালাক্সি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তারা প্যারানয়েড এনড্রয়েড গানটি সৃষ্টি করেছেন। পিঙ্ক ফ্লয়েড তাদের এনিমেল এ্যালবামের প্রায় সব গানেই জর্জ অরওয়েলের এনিমেল ফার্মের ছাপ রেখেছেন সচেতন ও সুস্পষ্টভাবেই। লেড জ্যাপলিনের মতো কড়া রক শিল্পী তো জেধারআর টলকিনের বিখ্যাত উপন্যাস লর্ড অব দ্য রিংস ভেঙেই তৈরিই করেছে তাদের রাম্বল অন গানটি। হেভি মেটাল ব্যান্ড আয়রন মেইডেন তো এক অর্থে বলা যায় সাহিত্যের ইজারাই নিয়েছেন। তাদের অসংখ্য গান সাহিত্য থেকে উপাদান কিংবা প্রেরণা নিয়েই সৃষ্ট। কয়েকটার উদাহরণ দেয়া যাক, ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড (আলডাস হাক্সলি), দ্য লর্ড অব দ্য ফ্লাইস (উইলিয়াম গোল্ডিং), দ্য ট্রুপার (এলফ্রেড টেনিসন), রাইম অব দ্য এনসায়েন্স ম্যারিনার (স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ), মার্ডার ইন দ্য রু মর্গ (এডগার এলান পো)। সাহিত্য থেকে প্রেরণা কিংবা উপাদান নিয়ে গান তৈরি ইতিহাস সারা বিশ্বেই আছে। কিন্তু গানের কি আলাদা করে সুযোগ আছে সাহিত্য হয়ে ওঠার?
এই প্রশ্নটা এখন ঘুরে ফিরে আসছে বব ডিলানের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে। সুপরিচিত, ভীষণ রকমের জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী এই রক গায়ক তার গানগুলো নিজেই লেখেন, নিজেই সুর করেন। গান লেখার জন্যই তিনি সাহিত্যের সবচেয়ে বড় পুরস্কার নোবেল পেয়ে গেলেন। তাতে অনেকেরই মনে প্রশ্ন উঠে গেলো, মূলধারার সাহিত্য চর্চা যিনি করেননি, মানে কি-না গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি যিনি লেখেননি তিনি কি করে নোবেল পুরস্কার পান। প্রশ্নটা কারো কাছে অবান্তর, অহেতুক আবার কারো কাছে প্রাসঙ্গিক। অবান্তর, অহেতুক বিষয় নিয়ে বলে কথা বলে লাভ নেই, আমি বরং প্রাসঙ্গিকতার জায়গায় যাই। প্রসঙ্গেক্রমেই বলে রাখা ভাল, নোবেল কমিটি বব ডিলানের গানকে কবিতার মর্যাদা দিয়েছে। তারা এগুলোর কাব্যগুণ বিচার করেই তাকে পুরস্কৃত করেছে বলে জানিয়েছে। বব ডিলানের পুরস্কার প্রাপ্তিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, এটা মাথায় রেখেই হয়তো কমিটি তাদের পুরস্করারের যৌক্তিকতা নিয়ে আগাম সাফাই গেয়েছে। আগ্রহীরা নোবেল কমিটির বক্তব্য পড়ে দেখতে পারেন।
অন্যদিকে শোনা যায় হারুকি মুরাকামির মতোই বিশ্বখ্যাত লেখকও গত কয়েক বছরের মতো এবারও তালিকায় ছিলেন। যদিও নোবেল মনোনয়নের হালনাগাদ কোন তালিকা প্রকাশ করা হয় না, বিতর্ক এড়ানোর ভয়েই, তবু শোনা যায় মুরাকামি এবার পুরস্কারটি পেতেন। নিঃসন্দেহে তিনি নোবেল পুরস্কারের যোগ্য। যোগ্য লোককে পুরস্কৃত করতে না পারলে সে পুরস্কার নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। বলে রাখা দরকার, শুধু নোবেল পুরস্কারই নয়, প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ পুরস্কারই বিতর্কিত। বব ডিলানকে পুরস্কার দেয়ার চেয়েও হয়তো তারচেয়েও বড় লেখক (?) তালিকায় রয়ে গেছে সে কারণেও বিরক্তি প্রকাশ করতে পারেন অনেকেই।
এ কথা তো জানাই, সুইডিশ নাগরিক আলফ্রেড নোবেল তার ডিনামাইট ফাটানো টাকার বৃহদংশ দিয়ে তার নামে নোবেল পুরস্কারের উইল করে গিয়েছিলেন। সেই উইল অনুযায়ীই তার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কারের প্রণয়ন করা হয় হয়। নোবেল পুরস্কারের শতবর্ষের সীমানা পেরিয়ে এসেও এ পুরস্কারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কেননা, শতাধিক বছরে তার স্বদেশে ৭টি পুরস্কার গেলেও সমগ্র এশিয়াতে ৭টি পুরস্কার আসেনি এবং তার চেয়েও বড় কথা তার দেশের যে সব লেখক পুরস্কার পেয়েছেন তার চেয়ে বহুমাত্রায় নামী-দামী [সর্বঅর্থেই] লেখকরা এ পুরস্কার থেকে বঞ্চিতই হয়েছেন। টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি, মার্ক টোয়েন, লু স্যুন, ইবসেন, স্ট্রিন্ডবার্গের মতো লেখকরা নোবেল পুরস্কার না-পেলে তাদের গৌরব কমে না, বরং নোবেল পুরস্কারেরই মানহানি হয়। শুরু থেকেই নিরপেক্ষতার প্রশ্নে স্বচ্ছতা দেখাতে পারেনি নোবেল কমিটি।
নোবেল পুরস্কারের শুরু থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রথম ৬০ বছরের পুরস্কারের মধ্যে ৩১টি পুরস্কার পেয়েছে স্ক্যান্ডিনেভীয় অর্থাৎ নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্কের লেখকরা, বাকি ২৮টি পুরস্কার গেছে ইউরোপ ও আমেরিকার লেখকদের কাছে। এরমধ্যে ব্যতিক্রম ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তি। এশিয়ার কোন লেখকের পক্ষে এই প্রথম নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। এরও ২০ বছর পরে [১৯৩৩ সালে] রাশিয়ার লেখক ইভান বুনিন নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৪৫ সালে লাতিন আমেরিকায় প্রথম নোবেল পুরস্কার পান গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রাল। পরবর্তীতেও সাহিত্যে এশিয়া, রাশিয়া, ও লাতিন আমেরিকায় নোবেল পুরস্কারের হার অত্যন্ত কম। শুধু ইউরোপ একাই সাহিত্যক্ষেত্রে যতগুলো নোবেল পুরস্কার পেয়েছে সারা বিশ্বের লেখককুল সমবেতভাবেও তার অর্ধেক পুরস্কারও পায়নি। স্বদেশে এবং ইউরোপে এই পুরস্কার সীমাবদ্ধ রাখার আগ্রহ কখনো অতিমাত্রাতেই ছিলো। সুইডিশ লেখক এরিক আক্সল কার্লফেলৎদকে ১৯১৮ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়ার কথা ঘোষণা করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন, অথচ তার মৃত্যুর পর ১৯৩১ সালে তাকে এই পুরস্কারটি আবার কেন দেয়া হয়েছিলো তার উত্তর আজও কেউ জানে না।
বব ডিলানের ভাষায়ই বলা যায়, ‘দ্য এনসার ইজ ফাই ফ্রেন্ড বেন্ডায়িং ইন দ্য উইন্ড।’ এইসব তর্ক-বিতর্ক বাতাসে ভেসে যেতে পারে। কিন্তু গান সাহিত্য কি-না, গান লেখার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার দেয়া যায় কি-না, বব ডিলান পুরস্কৃত হবার প্রেক্ষিতে সে প্রশ্নটি বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত বব ডিলানের গান নিয়ে দুটো কথা বলে নিতে চাই। ২০০৮ সালে পুলিৎজার কমিটি গানের জন্যে তাকে বিশেষ সম্মাননা দেয়। তার গান নিয়ে দুয়েকদশক আগ থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে উচ্চতর গবেষণা হয়ে আসছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তন অধ্যাপক ক্রিস্টোফার রিক বহু আগে থেকেই বব ডিলানের গানগুলোকে কবিতা হিসাবে আলোচনা করে আসছেন। বব ডিলানকে নিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ডিলান’স ভিশন অফ সিন’ বেশ আলোচিতও। কয়েক দশকের সঙ্গীত জীবনে ডিলান এমন কিছু গান দিয়েছেন যার সাহিত্য মূল্যও কম নয়। বলা দরকার বব ডিলান তার নিজের নামে ডিলান শব্দটা লাগিয়েছেন কবি ডিলান টমাস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই। কিংবদন্তীতুল্য রক গায়ক, কবি, সমাজ ও সংস্কৃতি সচেতন বব ডিলান এবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে সবাইকে অবাক করলেও তার গান নিয়ে কিন্তু কারো কোন প্রশ্ন নেই। তাই বব ডিলান কতোটা যোগ্য তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিচার্য হতে পারে, গান কতোটা সাহিত্য যোগ্য।
আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় গান অবশ্যই সাহিত্য। বলা দরকার, চাকভূম চাকভূম কিংবা কাটা-লাগা কিংবা কিস মি বেবি টাইপের গান নয়। সাহিত্য নামে যা কিছু ছাপা হয় তার সব যেমন সাহিত্য নয়, তেমনি গান নামে যা কিছু শুনি তার সবকিছুই গান নয়। গানটি যদি গান হয়ে ওঠে, অবশ্যই তার সাহিত্য মান নিয়ে আলোচনায় যাওয়া উচিত। গান যে স্বয়ং সাহিত্য তা বোঝার সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত বিশ্বের মধুরতম ভাষা বাংলাতেই যথেষ্ট আছে বলে মনে করি। বাংলা ভাষার যে আদিতম নিদর্শন চর্যাপদ তার সাহিত্য মান নিয়ে কারোই প্রশ্ন নেই। লুইপা, কাহ্নপাদের পদগুলো তো দোহা হিসাবেই পরিচিত। সোজা বাংলায় এগুলো গান। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি গান না কবিতা সে প্রশ্ন তো এখন আমাদের মনে জাগে না। এমনকি গীতবিতান আমাদের অনেকেরই নিয়মিত পাঠ্য। আমি কাউকে কাউকে চিনি যারা গীতবিতান পড়েন, মানুষ যেভাবে নিয়ম করে খবরের কাগজ কিংবা ধর্মগ্রন্থ পড়ে তেমন করে গীতবিতান পড়া যায়। নজরুলের বহু গানই উচ্চ সাহিত্য মূল্যের। পঞ্চকবির গানের কাব্য বা সাহিত্য মূল্য প্রশ্নাতীত। অতুল প্রসাদ, দিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন শুধু গীতিকার নন কবিও। তাদের গানও কবিতা। এমনকি জীবনান্দ দাশের বাংলার মুখ পুরোটাই গান হিসাবে কাজে লাগানো যায়।
লোরকা, নেরুদা, রিলকের কবিতায় গানের উপাদান প্রচুর। তারা নিজেদের অনেক কবিতাকেই গাথা, গীতিকা, গান শিরোনামে ছেপেছেন। অন্যদিকে পিট সিগার, জন ডেনভার কিংবা জিম মরিসনের বহুগানই কবিতা হিসাবে পাঠ্য। টুপাক শাকুরের র্যা পও তো কবিতা বলেই মনে হয়। আরো দুটো বিষয় মনে রাখা যায়। গান তো সুরে আর বাণীতে ছড়ায়। বাণীর সেই কাব্যিক গুণ থাকলেই তো তা যোজন যোজন দূর পৌঁছায়। ডিলানের গানের বোধহয় সেই কাব্যময়তা আছে। অন্তত আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে তা মনে হয়। অন্যত্র, কাব্য, গানের অতো কি বিরোধ বা ফারাক আদৌ থাকে? যদি কবিতা সাহিত্য হয়, গান কেন নয়! আমাদের শিক্ষাগুরু সেলিম আল দীন জীবিতকালে বহুবার আমাদেরকে শিখিয়েছেন, শিল্পের অভেদ আত্মার কথা। তার লেখাতেও আমরা পাই, শিল্প মাধ্যমের বিভাজন তিনি ভেঙে ফেলেছিলেন। তার নাটক, গদ্য-পদ্যর সীমারেখা ভেঙে দেয়। বিশ্বব্যাপী যেমন সীমানাটা স্রেফ রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ফায়দার কারণেই রাখা হয়, তখন আমরা না-হয় কোনটা গান কোনটা কবিতা সেই বিভাজন নিয়ে মাতামাতি বন্ধ রাখি। বরং ভেবে খুশি হই, বহুকালের মৌখিক সাহিত্যের যে ধারাবাহিকতা তার স্বীকৃত পথ ধরেই গানও আলাদা করে সাহিত্য মূল্যে বিবেচিত হোক।
এইচআর/এমএস