সৈয়দ হকের কবিতায় বাঙালির পরিচয়
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক নেই। জাগতিক সব মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন অনন্তের পথে। মঙ্গলবার বিকেলে সাড়ে ৫টায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে অমোঘ মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন। কবির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেই কিঞ্চিত আলোচনার দুঃসাহস করছি।
‘সব্যসাচী লেখক’ হিসেবে পরিচিত তিনি। যার দু’হাত সমান চলে, তিনিই তো সব্যসাচী। তার কারণ তিনি সাহিত্যের প্রায় সবগুলো শাখাতেই কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন। মঞ্চনাটক, গল্প এবং কবিতায় তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম এখনো মানুষের মুখে মুখে। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কিংবা ‘নুরলদীনের সারাজীবন’র মতো সৃষ্টিকর্ম তাঁকে আমাদের মাঝে অমর করে রাখবে।
সৈয়দ শামসুল হকের বহুলপঠিত একটি কবিতা ‘আমার পরিচয়’, যা বর্তমানে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। এই কবিতায় কবি বাঙালির পরিচয় তুলে ধরেছেন। কোনো এক সময় হয়তো বাঙালি তাঁর পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হতো, দ্বিধান্বিত হতো- আমি কে? তাই কবি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন-
‘আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?’
বাঙালির ইতিহাস লড়াই এবং বিবর্তনের। শোষন, শাসন আর জুলুমের হাত থেকে মুক্ত করেই বাঙালি শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কবি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন- প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালি তাঁর পরিচয় দিয়েছে গর্বের সাথে। কবি বলেন-
‘আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।’
তাঁর কবিতায় বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য বিধৃত হয়েছে। এসেছে বাঙালির শ্রেষ্ঠকীর্তি বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের কথা। বাঙালির যে স্বকীয়তা রয়েছে- তা তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন পরম যত্নে। একটি কবিতায় তিনি বাঙালির উত্থান থেকে ক্রমবর্ধমান অবস্থা পর্যন্ত চিত্রিত করেছেন সুনিপুণ হাতে। কবি বলেছেন-
‘এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।’
একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলার ছবি এঁকেছেন কবি সৈয়দ হক। যেখানে মসজিদ-মন্দির পাশাপাশি। অথচ তাতে কোনো হানাহানি নেই। এক নিগূঢ় ভালোবাসা কিংবা ভ্রাতৃত্বের নিরুপম গল্প শোনাচ্ছেন আমাদের।
বাঙালির ইতিহাস, নিজস্ব সংস্কৃতি ও বিপ্লবী মানুষের স্মৃতিচারণ করেছেন কবি। তাঁদের পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করতে পেরে কবি নিজেও গর্বিত। বাঙালি হতে পেরে তাঁর আনন্দের সীমা নেই। আমরাও কবির মতো আন্দোলিত হই। কবি তাই বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন-
‘আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’, ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।’
বাঙালি তোমার আছে কী? এমন প্রশ্ন যদি কেউ ছুঁড়ে দেয়। তার দাঁতভাঙা জবাব দিতে কবির কবিতার কিছু পঙক্তিই যথেষ্ট। পুরো কবিতা শুনলে প্রশ্নকর্তা হয়তো লজ্জায় দেশ ছেড়ে পালাবে অথবা শ্রদ্ধায় সারাজীবন বাঙালির কাছে মাথা নত করে থাকবে।
ইতিহাস সাক্ষী- বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে বাঙালির ভূমিকা অগ্রগণ্য। ক্ষুদিরাম-সূর্যসেনকে বাঙালি সারাজীবন মনে রেখেছে। তরুণ প্রজন্মকেও তা স্মরণ করিয়ে দিতে কবি নিম্নোক্ত চরণদ্বয়ের অবতারণা করেছেন। কবি বলেন-
‘এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।’
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়া বাঙালি ফিরে পেয়েছে তার মাতৃভাষা। একমাত্র বাঙালিই তাদের মাতৃভাষা রক্ষার্থে জীবন দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সেই ইতিহাস আজ বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধার সাথে পঠিত হচ্ছে। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালিত হচ্ছে। বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাঙালি অহংকার করতে পারে। তাই তো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাওয়া স্বাধীনতার ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেন কবি। কবির ভাষায়-
‘এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।’
বাঙালির প্রেরণার উৎস নানাবিধ এবং বিচিত্র। বৈচিত্র্যময় আমাদের সোনার দেশে গর্ব করার ইতিহাসের কোনো অন্ত নেই। যেখানে বীরত্বের গল্প শুনতে শুনতে শিশু তার মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। সেখানে তাই তো কবি বলেছেন-
‘এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
সবশেষে কবি সাম্যের আহ্বান জানিয়েছেন। সব বিভেদ ভুলে গিয়ে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ রেখে পথচলার তীব্র আকুতি জানিয়েছেন। কবি বাঙালির কাছে প্রত্যাশা করেন-
‘একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।’
বাঙালির দীর্ঘদিনের ইতিহাস-ঐতিহ্য কোনো ভাবেই যেন ক্ষুণ্ন না হয়। বাঙালি ঐক্যের প্রতীক হয়েই থাকুক।
বাঙালি তার পরিচয়ে গর্বিত। সাহসিকতায় অনন্য। যারা উদ্ধত কোনো খড়্গকেও ভয় পায় না। কারণ তাদের ইতিহাস লড়াইয়ের। বাঙালি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। এক হাতে অস্ত্র ধরতে জানে, অন্য হাতে শস্য ফলাতেও জানে। সুতরাং বাঙালি কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না। বাঙালির ইতিহাসে আপোষের কোনো স্থান নেই। বাঙালি হাসতে হাসতে বাঁশি বাজিয়েছে আবার হাসতে হাসতে গলায় ফাঁসও পড়েছে। তাই তো কবি বলতে চান-
‘পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করি নাকো আমি উদ্ধত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।’
বাঙালি অকৃতজ্ঞ নয়। বাঙালি তার বীরত্বের ইতিহাস, আত্মত্যাগের ইতিহাস কখনোই ভুলতে পারে না। তাই তো কবি পরক্ষণেই আবার বলেছেন-
‘সেই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।’
‘তুমি কে- আমি কে? বাঙালি বাঙালি’- মুক্তিযুদ্ধকালীন এই স্লোগান যেমন আমাদের এক নামে পরিচয় করিয়ে দেয়। ঠিক তেমনি কবি সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটি বাঙালির সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরে। কবির সাথে সুর মিলিয়ে আমিও বলতে চাই- আমার পরিচয়ে আমি গর্বিত, কারণ আমি বাঙালি।
‘আমার পরিচয়’র কবি সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আজ মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হকও একজন লেখিকা। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।
এসইউ/আরআইপি