ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

বাকরুদ্ধ জীবন

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ | প্রকাশিত: ০৬:৫৪ এএম, ৩১ আগস্ট ২০১৬

ফজরের পর পরই ঘাটে বাঁধা ট্রলারে ওঠে মজিদ। চারিদিকে তেমন আলো ফুটে ওঠেনি। ঢাকা থেকে লঞ্চ চলে আসবে যেকোনো সময়। তাই ট্রলারটা ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে। ঘাট থেকে ছাড়ার জন্য লগি হাতে ঠেলতে থাকে। এই ট্রলারই মজিদের একমাত্র আয়ের উৎস। তাই এটাকে সে নিজের চেয়েও বেশি যত্ন করে।

আড়িয়াল খাঁ নদীতে নতুন পানি এসেছে। ঢালু বেয়ে পানিতে ভেসে এসেছে কচুরিপানা। জমাটবাঁধা কচুরিপানা ঠেলে নদীর মাঝে যেতে একা খুব কষ্টই হবে। কচুরিপানা চতুর্দিক থেকে ট্রলারটিকে যেন ঘিরে ধরেছে। মাঝনদীতে যেতে হলে অনেক বাধা ঠেলে এগুতে হবে। ‘জোরসে ঠ্যালো, হেইয়ো’ বলে একা একাই শক্তি সঞ্চার করে।

হঠাৎ কচুরির মধ্য মানুষের ঘোঙানির আওয়াজ শুনতে পায়। আধো আলো আধো অন্ধকারে ভড়কে যায় মজিদ। ভুল শুনলো নাতো? ভয় কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। আশেপাশে কেউ নেই। বাঁশগাড়ি লঞ্জঘাটে তেমন ঘরবাড়িও নেই। সব নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। দু’একটা যা আছে তাতে তেমন মানুষ আছে বলে মনে হয় না।

ট্রলারের কুলুঙ্গি থেকে চার্জার লাইটটা বের করে মজিদ। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে চতুর্দিকে ঘোরায়। কচুরির মধ্যে কিছু একটা নড়ছে। নদীর কূল ঘেঁষেই ঘোঙানির আওয়াজ। ভয়ে এবার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। আবার আলো ফেলে। এবার নিশ্চিত হয়। সত্যিই মানুষ। মেয়ে মানুষ।

কাছে যেতে সাহস হয় না। একেই মেয়ে মানুষ। মজিদ আবার একা। কী করা যায়? মানুষটাকে বাঁচানোও ফরজ বলে মনে করে। ভয়ে চুপসে গেলেও হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি আসে। লুঙ্গির কোচর থেকে মুঠোফোনটা বের করে। খাসেরহাট তদন্তকেন্দ্রের পুলিশের ফোন নম্বর আছে এতে। ‘পুলিশরেই ফোন করি’ মনে মনে বলে নম্বর বের করে ডায়াল করে।
- হ্যালো, স্যার আমি মজিদ। ট্রলার চালাই।
- হু, কী অইছে কঅ।
-স্যার নদীর পাড়ে একটা মেয়েমানুষ পইড়া আছে। মনে হয় বাঁইচা আছে।
-বলিস কী? তাহলে কাছে গিয়ে উপরে উঠা।
- না স্যার, ভয় লাগে। পরে যদি কোনো ঝামেলায় পড়ি?
-কোনো ঝামেলা হবে না। তুই উপরে তোল। আমি ফোর্স নিয়ে আসছি।

মজিদ একা একাই টেনে তোলে মেয়েটাকে। দেখে পরিচিত মনে হয় না। এতো ঘাটে ট্রলার নিয়ে গিয়েছে। কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না। তবে মেয়েটার বয়স বেশি নয়। হয়তো পয়ত্রিশ হবে। শরীর অনেক ঠাণ্ডা। সারারাত পানিতে ভিজেছে। অবাক বিষয় হচ্ছে মেয়েটার গলাটা কাটা। কণ্ঠনালী দু’ভাগ হয়ে আছে। অথচ মেয়েটা দিব্যি বেঁচে আছে। তবে কথা বলতে পারছে না। কথা না বলুক তাতে কী? বেঁচে থাকলেই হলো।

পুলিশ এসে কিছু আলামত সংগ্রহ করে। সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। একটা ভ্যান ডেকে বাজার পর্যন্ত নিয়ে যায়। সেখান থেকে ইজিবাইকে তুলে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে মজিদের মনে। পুলিশ মেয়েটির কাছে পরিচয় জানতে চায়। মেয়েটি মাথা নাড়ায়। কথা বলতে পারে না।

পুলিশ একটা কাগজ ও কলম দেয় মেয়েটির হাতে। মেয়েটি কাপা কাপা হাতে লেখে- রেবা, বাবা- হামেদ মাদবর, উড়ারচর।

অভাব দেখতে দেখতে বড় হয়েছে রেবা। সংসারের বড় মেয়ে। গায়ের রঙটা কালো। রেবার পরে চার ভাই এক বোন। অভাবের সংসারে বর্ধিষ্ণু সন্তান। বড় ভাইটা সহজ-সরল। কারো সাতে-পাঁচে নেই। মেজ ভাইটা অকালেই চলে গেলো অভিমানে। ছোট দুইটাকে টেনেটুনে ঘুম থেকে তোলা যায়। কাজের কাজ বালাইসাট।

তবুও চলছে সংসার। পরের জমিতে হাল চাষ করেই আয় বাবার। যেদিন দুপুরে খাবারের বন্দোবস্ত হতে দেরি, সেদিন দোকান থেকে একটা বনরুটি আর দুধ চা। এত অভাবের মাঝেও পরম যত্নে আগলে রেখেছেন সন্তানগুলো।

বড় মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে যা হয়। গ্রামেরই এক পরিবারে পাত্রস্থ করে। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার অতোসতো ভাবার সময় থাকে না।
শাশুড়িরা নাকি বরাবরই দজ্জাল হয়। রেবার কপালেও জুটেছে তা-ই। স্বামী বেচারা হাবাগোবা ধরনের মানুষ। কওমী শেষ করে মসজিদের ইমামতি করে মুন্সিগঞ্জ। রেবা থেকে যায় শাশুড়ির সাথেই। দুটি পাতিল একসাথে থাকলে ঠোকাঠুকি হয়- বলে সান্ত্বনা দেয় রেবার বাবা-মা। কী আর করা।

উঠতে-বসতে বকুনি। যৌতুকের জন্য চাপ প্রয়োগ রেবাকে রীতিমত তটস্থ করে রাখে। মায়ের মুখের ওপর কথা বলার সাহস হয় না স্বামীর। `একটু ভালো অবস্থা অইলেই তোমারে নিয়া যামু`- স্বামীর এমন আশ্বাসে দিন গোনে রেবা।
অনাদর-অবহেলায় কেটে যায় সময়। কোলজুড়ে আসে আদরের ধন। সংসারের মায়া বাড়ে, জীবন হয় দুর্বিষহ। `মরার বালাই দূর হয় না` বলে আফসোস হয় শাশুড়ির।

গরিবের মেয়ে সহসা ঘর ছাড়ে না। শত দুঃখেও অক্টোপাসের মতো কামড়ে পড়ে থাকে। শাশুড়ির গাত্রজ্বালা বাড়ে।
বেশ কিছুদিন যাবৎ অসুস্থ রেবা। শাশুড়ি বললেন ফকির দেখাবো। আমার সাথে আমার মেয়ে বাড়ি চলো। রেবা সরল মনেই রাজি হলো। সেই সরলতাই কেড়ে নিলো বাকশক্তি। এখন বেঁচে থাকাটাই কেবল সান্ত্বনা।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন