পাপড়ি
আমরা ছিলাম তিন বন্ধু। এর মধ্যে কায়েস খুব চটপটে। মুরাদ কম কথা বলে। আর আমি এ দুটোর মাঝামাঝি। যে কারণেই বন্ধু হিসেবে আমি ওদের মাঝামাঝিই থাকতাম। সব সময়।
আমাদের শিমুলতলি গ্রাম থেকে ব্রহ্মপুত্রের দিকে বয়ে যাওয়া রাস্তাটি তখনও ইট পাথরের পরশ পায়নি। বৃষ্টি হলেই কাদায় একাকার হয়ে যেতো। কখনো কখনো যাত্রী নিয়ে রিক্সা চালক এতোটাই বেকায়দায় পড়তো যে, আমাদের প্রায়ই সহযোগিতা করতে হতো। কাদার মধ্যে ঢুকে যেতো চাকার অর্ধেক পর্যন্ত। তখন আমরা ধাক্কা দিয়ে রিক্সাকে তুলে দিতাম। দিনের বেশিরভাগ সময়ই আমাদের কাটতো ওই রাস্তায়। সেখানে একটি ব্রিজ ছিল। যে ব্রিজে আড্ডা না দিলে যেন কী একটা মিস করতাম। ব্রিজে আড্ডা দিতে গিয়েই এসব রিক্সার সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতে হতো। সবুজ ঘাস, ধূলো কাদার রাস্তা, নীল আকাশ আমাকে খুব টানতো।
হঠাৎই লক্ষ্য করতে থাকলাম কায়েস কেমন যেন একটু নির্জীব হয়ে যেতে থাকলো। কম কথা বলে। কম হাসে । কথা কেড়ে নিয়ে কথা শুরু করে দেয় না। একদিকে উপকারই হলো। আমি আর মুরাদ কথা বলার সময় বিরক্ত করার আর কেউ রইলো না। কিন্তু ক’দিনের মাঝেই টের পেলাম আমরা কী যেন একটা মিস করছি। আড্ডা দিয়ে আগের মতো মজা পাচ্ছি না। কায়েসটা মুখ ভার করে কী যেন ভাবে সারাক্ষণ। কিছুদিন আগে তার মায়ের অসুখ হয়েছিল। কিন্তু তাতো সেরে গেছে। এর পরও সে এমন করছে কেন তা বের করতে পারছিলাম না।
গায়ের পাশেই একটা বাজার। বাজারের পাশেই একটি মন্দির। একদিন দেখি মন্দিরের সামনের রাস্তা দিয়ে তিন ছাত্রী বই হাতে নিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছে। সেদিন মুরাদটা ছিল না। আমি আর কায়েস কিছুটা দূরে রস্তায় ঘাসের উপর বসে আখ খাচ্ছিলাম। কয়েসই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল। হঠাৎ আমার চোখ পড়লো কায়েসের চোখের দিকে। সে আখটাকে এমনভাবে ধরে আছে যে, হাতে আখ আছে কি নেই তা বুঝা দুঃসাধ্য। সে পলকহীন তাকিয়ে আছে ওই মেয়ে তিনটির দিকে। আমি বেশ মজাই পেলাম দৃশ্যটি দেখে। একবার আমি কায়েসের চোখের দিকে তাকাই আরেকবার মেয়েদের দিকে। আমার কেন জানি এ দৃশ্য দেখে অদ্ভুদ রকম ভাল লাগছিল।
-‘কায়েস’ পিঠে হাত রেখে বললাম। ডাক শুনে হকচকিয়ে উঠলো সে। চোখ ফিরিয়ে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যে, তার পাশে এতোক্ষণ ধরে কেউ বসে আছে তা সে ভুলেই গিয়েছিল।
‘ও তুই?’ কায়েস এমন ভাবে বললো যে, এই মাত্র সে আমাকে দেখেছে। কায়েস দাঁড়িয়ে গেল, ‘চল চলে যাই’
‘কেন? এখানে বসে থাকতে ভালোইতো লাগছে।’
‘আমার লাগছে না।’
‘বারে তোর না লাগলেই হলো। আমারতো লাগছে’।
‘দোস্ত, এখন আমার বাড়ি যেতে খুব ইচ্ছে করছে।’ কায়েসের কথা শুনে আগের চেয়ে বেশি চমকালাম। বলে কি এই ছেলে। যে বাড়িকে সব সময় কারাগারের সঙ্গে তুলনা করে। মাকে বলে কারারক্ষী। আর সেই কি না...। আমি কায়েসের মন খারাপের কিছু বিষয় আন্দাজ করতে পারলাম। পুরোটা পরিস্কার হতেই হবে আমাকে- এমন পনই যেন মনে মনে করে নিলাম।
‘আচ্ছা কায়েস, বলতো তোর কি হয়েছে?’ কায়েস কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল।
‘কই কিছু হয়নিতো।’
‘তোর সঙ্গে আমি আজ ৪-৫ বছর চলি। তোকে আমি চিনি না ভাবছিস?’
‘হুম অনেক চিনিস। চল এবার। কলেজ ফাঁকি দিয়ে আর কতো দিন আড্ডাবাজি চলবে বল? আমি ভাবছি কাল থেকে নিয়মিত কলেজে যাবো।’
‘ওরে আমার ভাল ছাত্ররে। আমাদের যেন কলেজে যাওয়ার আগ্রহ নেই। ওই বেটা এতো কলেজ করে কি হবেরে? তার চেয়ে চল প্রতিদিন এই জায়গাটায় এসে সকাল ১০ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত আড্ডা দেই।’
‘এর মানে কি?’ হাসি মুখে বললো কায়েস। কায়েস বুঝলো। এরপরও সে ভান করলো কিছুই না বোঝার। আমিও নাছোরবান্দা। তিন মেয়ের মাঝে কোন জন আমার বন্ধুটির মনে বাসা বেঁধেছে তা না জানলেতো আমার পেটের ভাত হজম হতে চাইবে না। বেশ রসিয়ে টসিয়ে অবশেষে সেদিন উদ্ধার করতে পেরেছিলাম পাঁপড়ি নামের মেয়েটিই তাকে জাদু করে ফেলেছে।
পাপড়ি দশম শ্রেণিতে পড়ে। আগামীবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। এর আগেই আমার বন্ধু পরীক্ষা দিতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাবতে গিয়ে হাসি পাচ্ছিল আবার করুণাও হচ্ছিল তার জন্য। কারণ, পাপড়ি এমন কি যে তাকে ভাল লাগলে রাস্তায় বসে বসে সেটা জানাতে হবে। সরাসরি বলে দিলেই পারে। পাপড়ি আমাকে কত শ্রদ্ধা করে তার ইয়ত্তা নেই। তাদের বাড়িতে গেলেই আমার জন্য নাস্তা আসে। বেশিরভাগ সময় পাপড়িই নিয়ে আসে। আমি তাকে খুব একটা পাত্তাই দেই না। কতবার সে আমার কাছ থেকে অংক শিখতে চেয়েছে-আমি এড়িয়ে এসেছি। তার মা কতবার আমাকে বাবা বাবা বলে ধরেছে তার মেয়েকে ঠিক প্রাইভেট নয় মাঝে মাঝে পড়াটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। আমাকে রাজি করাতে পারেনি। আর সেই পাপড়ির জন্য কায়েসের মন খারাপ। হাসি পাওয়াটাইতো স্বাভাবিক।
দায়িত্বটা আমিই নিয়ে নিলাম। কিন্তু কোনভাবেই পাপড়ির কাছে আমি কায়েসের বিষয়টা তুলতে পারি না। কেমন যেন সংকোচ লাগে। পাপড়ি আমার দুই বছরের জুনিয়র। বলতে গেলে ও আবার কী মনে করে বসে। তবে বিভিন্ন বিষয়ে পাপড়ির সঙ্গে কায়েসের প্রশংসা করতে থাকি। আমি যতোই প্রশংসা করি পাপড়ি দেখি ততোই অনাগ্রহ দেখায়। কথায় কথায় সে বলে, কায়েস ভাইয়ের কথা বাদ দেন। ভাল লাগে না।
বিষয়টাকে আমার কাছে খুব সহজ মনে হয়েছিল। কিন্তু সেটা যে এতো জটিল জীবনে প্রথম টের পেলাম। কায়েসও যেন কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিল। সে আমাকে খুব একটা ঘাটাল না। শুধু একদিন বললো,
‘নিলয় তুই পৃথিবীতে সব কিছু সহজভাবে দেখিস। আসলে এতো সহজ নয়।’ তার কথার অর্থ কি তা নিয়েও আমি সেদিন প্রশ্ন করিনি। বিষয়টা মুরাদকে বললাম। ও আবার জ্ঞানি টাইপের কথা বললো-
‘শোন, পাপড়ি আর কায়েসের প্রেম ভালবাসার মধ্যে তোর থাকার দরকার নাই। এসব নিয়ে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়।’ কথাটার মানে আমি বুঝিনি। আমার কাছে মুরাদকে তখন ফালতু বন্ধু মনে হয়েছে। বন্ধুর জন্য বন্ধু যদি কিছু করতেই না পারে তা হলে এমন বন্ধু থাকার দরকারই বা কী। সেদিন আমি মুরাদকে বুঝিয়ে আমাদের লাইনে আনতে পেরেছিলাম।
পাপড়িদের বাড়িতে আমার যাতায়াত বেড়ে গেলো। আগে মাসে দু’একদিন যাওয়া হতো। পাপড়ির মা আমাকে খুব আদর করতেন। শুধু ঐ কারণেই। গেলেই আমার জন্য স্পেশাল কিছু করে দিতেন খালাম্মা। যেন আমি ওনাদের কত আপনজন। এমন সুন্দর করে উপদেশ দিতেন মন্ত্রমুগ্ধের আবেশে কান পেতে শুনতাম। পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো পাপড়ি। মিটমিট করে হাসতো। যেন তার হাসিতে মুক্ত ঝরতো। এমন হাসি যার তাকেতো আমার বন্ধুর ভাল লাগতেই পারে। এতে কোনো অন্যায় নেই। কোনো খাদ নেই।
নানা স্বাদ ও পদের খাবারের লোভেই আসলে পাপড়িদের বাড়িতে আমার যাওয়া হতো। আমার বাবা নেই এই কারণেই হয়তো পাপড়ির বাবা মা আমাকে এতোটা ভালবাসেন বলেই মনে হতো।
অনেক করে চেষ্টা করলাম পাপড়ির মনে কায়েসকে ঢুকিয়ে দিতে। সরাসরি না বলতে পেরে ইশারা ইঙ্গিতে বুজানোর চেষ্টা করলাম। আমার কেন জানি মনে হয় ও সেটা বুঝতেও পেরেছে। বুঝতে পেরেই বারবার কায়েসকে নিয়ে নেগেটিভ কথা বলতো। কিন্তু আমিও ছাড়ার পাত্র নই। যে করেই হোক কায়েসের সঙ্গে পাপড়ির মিলন ঘটিয়েই দেবো। মহা পরিকল্পনা আটতে থাকলাম। জীবনের প্রথম একটা কাজ হাতে নিয়েছি সেটা যদি করতে না পারি এর চেয়ে ব্যর্থতা আর নেই। বারবার আমার মনে সেটাই খেলা করছিল। মনে হচ্ছিল একটা যুদ্ধে নেমেছি। মন জয় করার যুদ্ধ। সত্যিই এত দুরূহ আগে জানা ছিল না।
গ্রামের বাজারে চায়ের স্টলে ক’জন কথা বলছিল। সেখানে গিয়েছিলাম আমি। একাই। হঠাৎ শুনতে পেলাম একজন আরেকজনের সঙ্গে বলছে যে, যদি কেউ মনে প্রাণে কোনো মেয়েকে চেয়ে বাঁশি বাজায় তা হলে সে তার হতে বাধ্য। এ কথা শুনে আমার মন নেচে উঠলো। যেন যুদ্ধ জয়ের অস্ত্র এখন আমার হাতে। এ অস্ত্রে পাপড়িকে ঘায়েল হতেই হবে। কায়েস ও মুরাদকে ডেকে জানালাম। তারা দু’জনও খুব বিশ্বাসযোগ্য বলেই মত দিল।
বিপত্তি হলো তখনই তিনটি বাশি কিনে যখন বাজাতে গেলাম। কেউই ভাল করে বাজাতে পারছিলাম না। বাঁশি বাজানো শিখতেই এক মাস পার হয়ে গেল। তিন জনই বাঁশি বাজানো শিখলাম। আমাদের সাহায্য করলো পাশের পাড়ার মতিন ভাই। ভাল বাঁশি বাজাতে পারেন। কিন্তু তার ঘরে কুৎসিত বউ কেন এটার হিসাব মেলাতে পারলাম না। মতিন ভাই বাঁশিতে যে সুর তোলেন তা শুনেতো সব অপ্সরীদের হুমড়ি খেয়ে পড়ার কথা ছিল।
বাঁশি বাজানো শেখা হলো। এখন আর আমরা ব্রিজে আড্ডা দেই না। বাঁশি বাজানো নিয়ে ব্যস্ত। বাঁশিটা এমন জায়গায় বাজাতে হবে যেখান থেকে তার সুর পাপড়ির কান পর্যন্ত যায়। তা না হলেতো সবই ব্যর্থ। ঠিক করলাম যে রাস্তায় সে যায় তার কয়েক ক্ষেত পরেই একটি ঝোপের মতো আছে। সেখানে ক’টি রেইনট্রি গাছ আছে। তার ডালে বসেই বাশি বাজানো যাবে। দূর থেকে আমাদের দেখাও যাবে না।
যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন সকালে ১০ টার দিকে তিনজন বাঁশি নিয়ে উঠে পড়লাম গাছের ডালে। ডালগুলো এমন ছিল যে, একটিতে বসে অন্য আরেকটি ডালে হেলান দিলে দুটো হাতই ব্যবহার করা যেতো বাশি বাজানোর কাজে। সকাল সোয়া ১০ টার দিকে পাপড়ি এই রাস্তায় স্কুলে যেতো সেটা আমাদের জানা। প্রতিদিনের মতো পাপড়ি তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে আজও স্কুলে যাচ্ছিল। দূরে রাস্তায় দেখেই আমাদের বাশি বাজানো শুরু হয়ে গেল। তিনজনে মিলে বাঁশি বাজাচ্ছি আর তাকিয়ে আছি ওদের দিকে। পাপড়িসহ তিন জন বারবার তাকাচ্ছিল ঝোপের দিকে। আমাদের দেখতে পাচ্ছিল বলে মনে হয় না। পাপড়িসহ তিনজনই হাসছিল বলে মনে হচ্ছিল। মনে মনে খুব খুশি আমি। কাজ হয়ে গেছে। এই হাসির মানেই হলো বাঁশির জাদু। আমি নিশ্চিত হলাম আজ সন্ধ্যায় পাপড়ির সঙ্গে দেখা হলে পাপড়ি আমার হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলবে এটা কায়েস ভাইকে দেবেন।
সত্যিই এমনটা হবে ভাবতে পারিনি। সন্ধ্যায় যখন পাপড়িদের বাড়ি গেলাম খালাম্মা আমার জন্য শরবত নিয়ে এলেন। অন্যরকম শরবত। জানালেন এটি নাকি মার্কিন মুল্লুকের শরবত। পাপড়ির বড় ভাইকে অফিস থেকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। তিনিই এই শরবত তৈরির গুঁড়ো নিয়ে এসেছেন। আমি মার্কিনি শরবত খেয়ে কৃতজ্ঞ। যখন ফিরছি ঠিক তখনই দেখি পাপড়ি হাতে করে একটি বই নিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি নিশ্চিত কায়েসের জন্য লেখা চিঠিটি সে কায়দা করে বইয়ের ভেতর ভরে দিতে চাচ্ছে। খুশিতে আমি ডগমগ। কিন্তু পাপড়িকে বুঝতে দিতে চাই না।
বইটি হাতে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লাম। এটি একটি কবিতার বই। পাপড়ির জন্ম দিনে উপহার দিয়েছিলাম। সেটি আমাকে ফেরত দিয়ে বলেছিল-
‘এটি আমার কাজে আসেনি। আপনি পড়বেন কাজে আসবে। অবশ্যই পড়বেন কিন্তু। এই বইয়ের ১৬ নম্বর পাতার যে কবিতাটা আছে সেটি আমার খুব ভাল লেগেছে। আমার ধারণা আপনারও ভাল লাগবে।’ কোন কথা বললাম না। তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। পাপড়ি মায়াবী মুখ করে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন কতদিন পর দেখছে আমাকে।
প্রথমবার পাপড়ির চোখে চোখ পড়লো আমার। এতো সুন্দর ওর চোখ। মুচকে হাসিটা যেন হার মানায় ভিঞ্চির মোনালিসাকেও। এই সময়ে ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার কথা নয়। এরপরও এতো লাল দুটো ঠোঁট। দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে সাদা ঝকঝকা দাঁতের কিছু অংশও চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে একটা মানুষের মুখ এতো সুন্দর হতে পারে প্রথমবার টের পেলাম আমি। কেন জানি অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছিল। পাপড়ির চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। মনে মনে ভাবছিলাম সত্যিই রুচি আছে আমার বন্ধু কায়েসের।
এক পর্যায়ে নিজেকে সামলে নিলাম। পাপড়িকে বললাম-
‘পাপড়ি যাই। আমার জন্য কায়েস হয়তো অপেক্ষা করছে।’ পাপড়ি খানিকটা যেন রেগে গেল।
‘কায়েস, কায়েস, কয়েস- এই নামটা ছাড়া আপনার জীবনে আর কিছু নেই?’ প্রশ্নটা আমাকে আঘাত করলো। এও বুঝতে কষ্ট হলো না যে, বাঁশিতে আসলে কাজ হয়নি। একদিনে হয়তো কাজও হয় না। সাধনার ব্যাপারতো। এতো সহজেতো হওয়ারও কথা নয়।
কথা না বাড়িয়ে কবিতার বই হাতে নিয়ে সেদিন ফিরেছিলাম বাড়িতে। বইটি খুলে দেখার ইচ্ছে হলো না। পুরনো কিছু বইয়ের সঙ্গে রেখে দিলাম। সারারাত ঘুম হলো না। ব্যর্থ হওয়ার কষ্ট কুরে কুরে খাচ্ছিল। কিন্তু আমরা দমে যাওয়ার পাত্র নই। বাশি বাজানো অব্যাহত থাকলো। মাস খানেক বাঁশি বাজিয়েও কোনো কাজ হলো না।
এবার কি করা যায়। পাপড়ির উপর কিছুটা ক্ষিপ্তও হলাম আমরা। পরিকল্পনা করতে থাকলাম যে করেই হোক তার মনের ভেতর কায়েসের নাম খোদাই করে দিতে হবে। এই কারণে তিনজন মিলে এক ব্যতিক্রমি পদ্ধতি বের করলাম।
একদিন চাদনি পশর রাত। ওই রাতের ৯ টার দিকে গ্রামের মানুষ যার যার বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর আমরা তিনজন তিনটে কাস্তে নিয়ে নেমে পড়লাম রাস্তায়। পাপড়িদের বাড়ির কিছু দূর থেকে মাটির রাস্তা কেটে লিখতে শুরু করলাম কায়েস + পাপড়ি। কায়েস + পাপড়ি। তিন জনে মিলে সারা রাতে মাইল খানেক রাস্তায় মাটি খোদাই করে লিখলাম। ফজরের আজান দেওয়ার পর আমরা ফিরে গেলাম যার যার বাড়িতে।
সকালে এমন সব কাণ্ড হবে ভাবতে পারিনি। গ্রামবাসী কীভাবে জানলো যে এই কাজ আমরা করেছি তা আজও বোধগম্য নয়। মা যখন ঘুম থেকে পিটিয়ে তুললো তখনই বুঝতে পারলাম আসলে কতটা প্রতিক্রিয়া হয়েছে গ্রামবাসীর মাঝে। পরে জেনেছিলাম ধরা পড়ার পর কায়েসই নাকি আমার বিরুদ্ধে বলেছে যে, তার কোনো দোষ নেই। আমার পরিকল্পনাতেই সব হয়েছে। আমি জানি কায়েস মিথ্যা বলেনি। কিন্তু যার জন্য এতো করলাম সেই যখন আমাকে ফাঁসিয়ে দিলো তা হলে এমন বন্ধুত্বের কোনো মানে হয় না।
মায়ের মার ও বকুনি খেয়ে সত্যিই সেদিন আমি এলোমেলো হয়ে পড়েছিলাম। এর মধ্যেই খবর পেলাম পাপড়ি লজ্জায়, অপমান সইতে না পেরে গলায় ওড়না পেচিয়ে মরতে গিয়েও মরতে পারেনি। ঘরের আড়া থেকে ওড়না ফসকে নিচে পড়ে গেছে।
খবরটা শুনে আমার মন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। পাপড়ির সুন্দর মুখটা ভেসে উঠেছিল আমার চোখের সামনে। ও মরে গেলে আমার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। সেদিনই প্রথম অনুভব করলাম কায়েস তাকে কতটুকু ভালবাসে জানি না। কিন্তু কোন ফাঁকে পাপড়ি আমার হৃদয় দখল করেছে টেরই পেলাম না। আত্মহত্যায় ব্যর্থ হওয়ার খবর শুনে সেদিন স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল।
আমার মা আর আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিল না। ওই দিনই একটি চিঠি লিখে ঢাকার মালিবাগে আমার খালার বাসায় পাঠিয়ে দিল। গ্রামের কলেজ থেকে এসে ভর্তি হলাম ঢাকার একটি কলেজে। একই দিন পাপড়িকেও ঢাকায় তার বড় ভাইয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিল তার বাবা মা।
আমি ঢাকায়ই থেকে গেলাম। আর পাপড়ি মেট্রিক পাশ করার পর তার ভাই তাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেয়। আমি সে ঘটনাটি জানতাম না। বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম সব কিছু থেকে। কায়েস ও মুরাদ বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। আর আমি সরকারি চাকরি করে ঢাকা শহরে জীবন চালাচ্ছি। এখনো আমাকে টানে গ্রামের সেই সবুজ ঘাস ধূলা-কাদার রাস্তা, নীল আকাশ।
২৫ বছর পর সেদিন ট্রেনে চেপে বাড়ি যাচ্ছিলাম। আমার উল্টো পাশের সীটে এসে বসলো পাপড়ি। না আমি তাকে চিনতে পারিনি। সেই আমার কাছে জানতে চাইলো আমি শিমুলতলি গ্রামের নিলয় কি না। নতুন করে পরিচয় হওয়ার পর কোন কথা রেখে কোন কথা জিজ্ঞেস করবো ঠিক করতে পারছিলাম না। প্রথমেই কেন জানি জানতে ইচ্ছে করলো তার স্বামী সন্তানের কথা। কিন্তু পাপড়ি যা বললো তাতে না চমকে পারলাম না। ইউরোপ, আমেরিকা ঘুরলেও নাকি কাউকে তার মনে ধরেনি। ফলে জীবন সঙ্গী ছাড়াই কাটিয়ে দিয়েছে এতোটা বছর। যেমনটা আমি নিজেও।
সে জানতে চাইলো আমি কবিতার বইয়ের ১৬ নম্বর পাতার কবিতাটা পড়েছিলাম কি না। সেই কবিতার কথা বলায় আমি না চমকে পাড়লাম না। একজন মানুষের এতো কিছু মনে থাকে কী করে? পড়িনি বলে জানালাম। শুনে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলো। ট্রেন থেকে নেমে আলাদা রিক্সায় ফিরে গেলাম যার যার বাড়িতে।
একটি বস্তায় ভরে রেখেছিলাম আমার ইন্টারমিডিয়েটের বই খাতা। সেখানে রেখেছিলাম কবিতার বইটিও। বাড়িতে গিয়ে খুঁজে পেলাম সেই বস্তাটি। বের করলাম সেই কবিতার বই। ১৬ নম্বর পাতা উল্টাতেই দেখি একটি চিঠি রয়েছে। মাত্র তিনটি লাইন লেখা। পাপড়ি লিখেছে, নিলয়, জীবনে তোমাকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। কেন তুমি বোঝ না? কেন অন্যর জন্য আমার কাছে এসো?
চিঠি পড়ছিলাম আর চোখ গড়িয়ে পানি পরছিল। চিঠি লেখা কাগজটি ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম আমার সামনে ভেজা চোখে বসে আছে পাপড়ি।
এইচআর/এমএস