তবু আমারে দেব না ভুলিতে
বাবা, আর মাত্র ১টা সেমেস্টার বাকি! এই মুহূর্তে টাকাটা না পাঠাতে পারলে আমার ডিগ্রি আটকে যাবে। আমি তো সব খরচ বরাবর স্কলারশিপ আর কাজ থেকে ম্যানেজ করেই... কথা শেষ করতে পারেনা নিঝুম। বাবার কাশির দমক বেড়েই যাচ্ছে। তিনি এখন কিছু শুনতে পাচ্ছেন না। কিছু বলতে প্রায় শুরু থেকেই পারছিলেন না। অসহায় বাবা! বয়স তার নিজস্ব নিয়মে সবরকম প্রতারণা শুরু করেছে- শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক সব। সামাজিক সক্ষমতাটা কোনোদিনই ছিল না, তাই কেড়েও নিতে পারেনি। বুথের ফোনে তার শেষ কলিং কার্ডের শেষ মিনিট চলছে। কার্ডের মিনিট, সেকেন্ড গুনতে গুনতে বাবার কাশি থামার অপেক্ষায় তার হাত পা কাঁপছে। বাইরে গায়ের চামড়া কেটে বসে যাওয়া শীতের ধারালো চাবুক। কিন্তু তার কাঁপুনির জন্ম বাবার অসহ্য নীরবতায়। বাবার এই নীরবতাকে সে বেশ ছোট থেকেই পড়তে জানে। নিম্ন মধ্যবিত্ত বাবাটাকে সে কয়দিন হাসতে দেখেছে আঙুল গুনে বলতে পারবে, কতবার রাগ করতে দেখেছে সেটাও। তারা ৪ ভাই বোন কোনদিন কারো অবাধ্য ছিলনা। বায়না আব্দার তাদের কোনোদিন নেই। তাই মৌলিক চাহিদার বাইরে কোনোদিন কিছু চাইলে বাবা যেভাবেই পারেন জোগান দিতো।
প্রথম এমন নীরবতা দেখতে পেয়েছিল তাদের ১ হালি ভাইবোনের সংখ্যাটাকে ৩ এ নামিয়ে হারিয়ে যাওয়া তাদের সবচেয়ে বড় ভাইটার শেষ সময়ে। থ্যালাসেমিয়ায় টাকা জলের মতো খরচ হচ্ছে। ভিটেমাটি বন্ধক দেবার জোগার। অন্য সন্তান তিনটির দিকে তাকিয়ে বাবা একসময় ক্ষান্ত দিল। সে রাতে অমাবস্যা ছিল কিনা মনে নেই, কিন্তু বাবার মুখ ছিল গ্রহণলাগা চাঁদের মতন ঘোর অন্ধকার। এমন আঁধার যেন সূর্যের তীব্রতাও শুষে নিতে পারতো র্যাকহোলের মতন। - কেন হাসপাতালে রাখবেনা? ছাড়িয়ে কেন আনলে? হঠাৎ এখন হোমিওপ্যাথিতে কেন? কিছু বলছো না কেন তুমি? মা প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন, আর বাবার অন্ধকার মুখ নিচু হতে হতে যেন বুক ছুঁয়ে যাচ্ছে। সব সন্তানই বাবা মার কাছে সমান, কিন্তু প্রথম সন্তান হলো ভালোবাসাবাসির প্রথম ফসল! কত স্বপ্ন, উত্তেজনা, কত মায়া! বাবাই কেবল জানতেন কি তুফান বাবার ভেতরে তখন চলছিল! অসহায় অক্ষম এক পিতা! নিঝুম সেই মুহূর্তটা ভুলতে পারেনা। তাড়া করে ফেরে তাকে সেই মুখ। সে এখন বোঝে মাও সেদিন বাবাকে অহেতুক প্রশ্নবাণে চিরে ফেলছিল। প্রশ্নগুলি ছিল তার হাহাকার, তার আর্তনাদ! বাবার গ্রহণগ্রস্থ চেহারায় এক সময় দুইফোটা নোনা জল নেমে আসে। মা স্তব্ধ হয়ে যায়। বাবা কি আজও তেমনিই গ্রহণগ্রস্থ চেহারায় ফোনের ও প্রান্তে স্থাণুর মতন দাঁড়ানো?
দ্রুত কার্ডের আয়ু ফুরিয়ে যায়। লাইন কেটে ব্যস্ত টোন শোনাতে থাকে। নিঝুম হ্যান্ডসেট কানেই ধরে রাখে। ও জানে বাবাও তাই করছে। বাবা আজ রাতে ঘুমোতে পারবে না। সারারাত বারান্দায় তার মতনই বুড়িয়ে যাওয়া ইজি চেয়ারটায় শুয়ে শূন্য দৃষ্টি মেলে রাখবে সাত আসমানের দিকে। আসমানে সারারাত মেলে শুকাবে তার চোখের জল। এ এমন জল যা দিনের রোদে মেলা যায় না। রাতের অন্ধকারের কাছে মেলে ধরতে হয়। নিঝুমের ফোনবুথ থেকে বের হতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অনেক রাত, আর আজকাল খুব বেকায়দায় না পরলে কেউ ফোনবুথ ব্যবহার করে না। নিঝুমকে করতে হয় কারণ বাবা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন না আর নিঝুমের স্কাইপের ব্যালেন্স কেনা বা অন্য কোথাও ব্যবহার করার মত অবস্থা নেই ক্রেডিট কার্ডের। নতুন কলিং কার্ড কেনার পয়সাও নেই, অনেক বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে হিসেব কষে শেষ কার্ডটি খরচ করতে হয়েছে। বাইরে কনকনে শীত। তুষারপাত হচ্ছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। দিনকয়েক বাদেই বছর শেষের ছুটি শুরু। ইউনিভার্সিটির সব ছেলে মেয়েদের বাড়ি যাবার আনন্দে দ্বিগুন উদ্দীপনায় ছুটোছুটি, কাজের গতিও বেড়ে গেছে। কেবল নিঝুমের ঠোঁট শীতে ফাটা মুখের মতন কপাটবদ্ধ।
চায়নার পিকিং ইউনিভার্সিটিতে সুযোগ পাবার পর বাবা চোখ বন্ধ করে চলে আসতে বলেছিল। স্কলারশিপ আছে, উপরের সারির ইউনিভার্সিটি, সাবজেক্টও ভাল- ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং। তখন কে জানতো যে বিড়ালের ভাগ্যে কি শিকা ছিড়ে কোনোদিন! ভাগ্যের একটা নিজস্ব গড়নই থাকে, একেকজনের জন্য যেন একদম পৃথক পৃথক ছাঁচ। শেষ সময়েই তার যখন আজ হঠাৎ টাকার টান পরলো তখুনি বাবার অবসরকালীন টাকায় গড়া মাছের ঘেরে এমন করে মড়ক লাগলো যে সামান্য কিছু টাকার জোগাড়ও বাবার জন্য এখন অসম্ভব। বিপদ সমসময়েই আত্মীয় পরিজন নিয়েই আসে, একা আসে না! নিঝুমের সমস্ত পৃথিবীটা অসার লাগছে। কি করে কোথা থেকে যে পরীক্ষা ফি, ল্যাবের বাকি খরচগুলি জোগাড় করবে আর জীবনের মৌলিক খরচের দেনা মেটাবে তার কোন কূলকিনারাই তার জানা নাই! স্কলারশিপের অঙ্ক এখানে কম, খণ্ডকালীন চাকরিতেও এখানে পারিশ্রমিক পাশের দেশ জাপান বা কোন উন্নত দেশের চেয়ে অনেক কম। ক্লাসে কারোর কথা দূরে থাক স্যারের লেকচারও আজ মাথায় ঢুকছে না। ভোরে পার্টটাইম কাজ সেরে এমনিতেই অপর্যাপ্ত ঘুমে চোখ জ্বালা করতে থাকে। কফি খেয়ে ঘুম তাড়াতে হয়। আজ কফি কেনার পয়সাও নেই। অথচ এই থিওরিগুলি ক্লাসে না বুঝে গেলে পরে আর সামলাতে পারবে না। ক্লাসের পর আবার তার আরেক পার্টটাইম কাজ। শনি রবিবার সামান্য কয়েক ঘণ্টা ছাড়া পড়া নিয়ে বসার তেমন কোনো সময়ও নেই। আর সহপাঠী কেউই তেমন ইংরেজিতে দক্ষ না। বাংলাদেশের মতন গ্রুপ ডিস্কাশনের আশা নেই। তার একার জন্য ইংরেজি আউড়ে কেউ সার্কিট বুঝাবে না। লিউ পাশ থেকে একটা চিরকুট পাস করলো। “Is anything wrong?” চশমার কোণা দিয়ে দেখেই ঠেলে সরিয়ে দিল। না দেখেও বুঝতে পারছে লিউ তার দিকে তাকিয়েই আছে লেকচার বোঝা বাদ দিয়ে। এমনিতেই মেয়েটা খুব বোকা, নিঝুমই তাকে ক্লাসের ফাঁকে পড়া বুঝিয়ে দেয়।
এখন সেও যদি ক্লাস ফলো করে লেকচার টুকে না রাখে তবে খুব কঠিন হয়ে যাবে পড়া ধরতে। নিঝুম বিরক্ত চোখে লিউয়ের দিকে ফিরে স্যারের লেকচারের দিকে ইশারা করলো। লিউ ফিরলো, কিন্তু একটু পর পর তার দিকে ফিরে ফিরে তাকিয়ে গেল। ক্লাস শেষ হতেই নিঝুম লিউয়ের প্রশ্ন এড়াতে ছুটে বেড়িয়ে গেল। লিউও পেছন পেছন ছুটলো। - কি? পেছন পেছন আসছ কেন? - তুমি ওমন ছুটছো কেন? - আরে ! পার্ট টাইম আছে না? - আছে সে তো লাঞ্চ খেয়ে যাবে, না? - লাঞ্চ খাবো না। - খাবে না? কেন? ব্রেড কিনে নিয়ে বাসে বসে খাবে? - না। - না মানে কি? -আরে না মানে না! ব্রেড কিনবো না। বাসে যাচ্ছিনা, দৌড়ে যাব। পয়সা নেই। হলো? লিউ থমকে গেল। -১০ কিলোমিটার দৌড়ে যাবে মানে? আমার সাইকেলটা নিয়ে যাও। ব্রেডটা না হয় আমিই কিনে দেই! - কেন? ব্রেড কিনে দেবে- চুকাবো কবে এই পয়সা, হ্যা? সাইকেল নিয়ে গেলে তুমি ডর্মে ফিরবে কিভাবে? -একটা ব্রেড কত পয়সা? আমাকে ক্লাসের ফাঁকে প্রাইভেট লেসন দাও যে তার ফিই দিলাম ধরে নাও। আর আমার ডর্ম তো মাত্র সোয়া কিলোমিটার। প্লিজ সাইকেলটা নাও। নিঝুম লিউয়ের দিকে ফিরে মুহূর্তখানেক দেখলো। মেয়েটা এখনো কাঁচা বয়সের ঘোরে মোহাবিষ্ট। নিঝুমের বন্ধুতা তার জন্য এতো কোন অপরিহার্য কিছু না। সে স্থানীয়ই প্রায়। বরঞ্চ নিঝুম যে তাকে পড়া বুঝিয়ে দেয় তা নিঝুমের নিজের কনসেপশন ঝালাই করে নেয়া হয়, ক্লাসের ফাঁকে নগদ নগদ ঝালাই। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে এই মেয়ে একে প্রেম ভেবে বসে আছে বা ভাবতে চাচ্ছে। সবসময় সে নিঝুমের জন্য কি করবে এক পড়া বোঝানোর বিনিময়ে তাই খুঁজতে থাকে, ছায়ার মত পায়ে পায়ে চলে। মাঝে মাঝেই নিঝুম ধাক্কা দিয়ে মেয়েটার বোকার স্বর্গ ভেংগে ফেলতে চায়। টেনে হিঁচড়ে বাস্তবে নিয়ে আসতে চায়। নিজের জীবনে তার স্বপ্ন দেখারও অবকাশ নেই, রাতঘুমেও দুঃস্বপ্ন কেবল।
সারাদিনে রুটিন হলো কাকডাকা ভোরে পার্টটাইম কাজ সেড়ে বাসে ব্রেড কলা খেতে খেতে ক্লাস নোটে চোখ বুলাতে বুলাতে ক্লাসে ঢোকা। ক্লাস, পরীক্ষা এটেন্ড করা। সেড়ে আবার আরেক কাজে ছুট। সেই কাজ সেড়ে রাত করে ডর্মে ফিরে কোন রকমে শাওয়ার নিয়ে লাশের মতন খাটিয়ায় মিশে যাওয়া মরণ ঘুমে। দেশে থাকতে তার ঘুম খুব পাতলা ছিল। সামান্য আওয়াজ বা আলোতেই তার ঘুম নষ্ট। ছোট বোন দুইটা এজন্য প্রচুর বকা চাটি খেয়েছে। আর এখন বোধহয় কানের কাছে ড্রাম বাজালেও তার ঘুম ভাংবে না! গরজ কত বড় বালাই! টেবিলে বসে গরম খাবার রেডি না পেলে মেজাজ চড়ে যেত, আজ লজ্জায় কুকড়ে যায় মাকে কত জ্বালিয়েছে এক জীবনে এই ভেবে। দেশ থেকে এসে অব্দি আর সাড়ে তিন বছরে দেশের কথা ভাবার পরিস্থিতিই হয়নি। ছুটিতে কত বেশি কাজ করে সেমিস্টার ফিসটা জমিয়ে রাখা যায়, খরচগুলি কিভাবে এগিয়ে রাখা যায় ভেবে নাকে মুখে বেশি বেশি করে কাজ করতে ছুটেছে। আর এমন জীবনে একটা মেয়ে অহর্নিস প্রেমের আহবান নিয়ে এসে দাড়াতে থাকলে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় কই! তার এই কয়বছরের জীবনে সব মুখ খিস্তি লিউ একা হজম করে গেছে। মাকে সে বরাবর “ভাল আছি, খুব আরামের কাজ করছি, ঈদের দিন ছুটি করছি পোলাও মাংস খাচ্ছি”।
জাতীয় মিথ্যায় ভুলিয়ে তার সব কষ্ট, যন্ত্রণা, হাহাকার বালিশের বুকে ঢেলে দিত। কেন যেন এই বোকা মেয়েটা সেধে সেধে এই বিষ পান করতে হা করে ছুটে আসে! এতো দুর্ব্যবহার মেয়েটাকে দমাতে পারেনা কেন সে বুঝতেই পারেনা। এতো ধৈর্য্য তো দেশের মা- নানীদের এক যুগে থাকতো জানে, চাইনিজ মেয়েরা তো সবাই স্বাবলম্বী! ধর্মহীন, তাই অন্য বিধিনিষেধও নেই! কি আক্কেলে মেয়েটা তার পেছনে ছুটছে সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। হতাশ শ্বাস ছেড়ে মুখ খুললো, - লিউ তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। -চলো লাঞ্চে বসে কথা বলি! - না। ব্রেড নিয়ে পার্ক বেঞ্চে বসবো। লিউ উজ্জল চোখ মুখে একাই ব্রেড আনতে ছুটে গেল। নিঝুমের হঠাৎ খুব মায়া লাগলো। মেয়েটা বোধহয় ভাবছে অন্তত সাড়ে তিন বছর পর হলেও নিঝুম আজ তাকে খুব বিশেষ কিছু বলবে। সিনেমার ফ্লাশব্যাকের মত রিল ঘুরতে লাগলো তিন বছরের অলিগলিতে। মেয়েরা এতো মায়াবতী কেন হয়? এতো মায়ার উৎস কোথায়? ছোট খাটো এই মেয়েটা কি অপরিসীম মায়া আর ভালবাসার শক্তি দিয়ে তাকে অনড় অটল সাপোর্ট দিয়ে এসেছে। এতো ধারণ ক্ষমতার উৎস কি? - চলো। তোমার কাজে আবার দেরি হয়ে যাবে। হাসি মুখে হাতে ব্রেডের প্যাকেট এনে হাপাতে হাপাতে তাড়া দেয় লিউ। নিঝুম পার্ক বেঞ্চে বসে স্থির দৃষ্টি পাতা ঝরা চেরি গাছের শুকনো ডালে নিবদ্ধ রাখে। চেয়েই থাকা কেবল, দেখা না। পেটে রাজ্যের ক্ষিধে থাকে এই সময়টায়। আজ তার মাথার ভেতরটাও একেবারে শূন্য ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ব্রেডের কোন স্বাদও পাচ্ছেনা। ঘাস চিবিয়ে যাচ্ছে। -তোমার পছন্দের আপেল পাই আনলাম। ভাল লাগছেনা? নিঝুম লিউয়ের দিকে দৃষ্টি ফেরালো। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুরু করলো, - লিউ-আমার ডিগ্রিটা বোধহয় হবেনা! লিউ ব্রেডে কামড় বসাতে গিয়ে থমকে গেল। প্রশ্ন করার সাহস করতে পারছে না। নিঝুমই আবার শুরু করলো বলা, - তুমি তো জানো গত সেমিস্টার ব্রেকে পিঠের ব্যথায় বেশতী কাজ তো দূর, আমি নিয়মিত কাজও অনেকদিন করতে পারিনি। শেষ মেশ গোডাউনে মাল তোলার অমানবিক কষ্টের কাজটা ছেড়েই দিতে হয়েছে। জানিনা পিঠ ব্যথাটা ক্রনিক হয়ে গেল কিনা! ভাবার অবস্থাতেই নেই। কিন্তু কাজটায় ঘন্টা প্রতি টাকাটা অনেক ভাল দিত, তেমন কাজ আর জুটাতে পারিনি। অন্য কাজের চাপও বেশি নিতে পারছিনা।
গ্রেজুয়েশনের পেপার সাবমিশনের জন্য লেখায় সময় দিতে হচ্ছে। স্কলারশিপ ধরে রাখতে গ্রেড পয়েন্টেও টানা স্ট্যান্ডার্ড রাখতে হয়েছে। এমন না যে হেলাফেলা করে পাশ করে পার পেয়েছি। রাতে ঘুমও সেক্রিফাইস করতে হয়েছে। টানা কত বছর সারাদিনে ৪/৫ ঘন্টার বেশি ঘুমানোর সময় পাই না। শরীর এখন বিদ্রোহ করছে। -শরীরে না কুলালে কিভাবে করবে? আগে তো শরীর সারতে হবে। ডিগ্রির টাকা জোগাড় করতে করতে জান চলে গেলে ডিগ্রি কি এপিটাফে বাঁধাই করে রাখবে? ডিগ্রির রিকয়েরম্যান্ট তো শুধু সেমিস্টার ফি না, পাস তো করতে হবে! সব রিকয়েরম্যান্ট মেটাতে হবে। পেপার, এসাইন্ম্যান্ট সব ঠিক মতো না হলে তো ডিগ্রি হবে না! - হুম্- পড়াটা আর এসাইনম্যান্টটা হাসপাতালের বেডে শুয়েও করেছি। তোমার সাথে হাসপাতালে রোজ ডিসকাশনও হতো। কিন্তু, পুরো সেমিস্টার ব্রেকে কয়দিন হাসপাতালে ছিলাম বলে অন্য কাজগুলিতেও তেমন সঞ্চয় হয়নি।
হাসপাতালের বিল বাবদও গেছে অনেক। অথচ এই দুই মাস গ্রীষ্মের ছুটির পয়সাই আমার টাকার প্রধান উৎস। স্কলারশিপে আর কতটা কভার করে? এখন সেমিস্টার ফিদর টাকায় টান পড়েছে, ল্যাবেরও। ডর্মেটরির মাসের ভাড়া আটকে রাখা যায় না। সেটা জুনে দিয়ে দিতে হয়েছে আর সেটা মেটাতে গিয়ে অন্য অনেক বেসিক খরচ আটকে গেছে, বিল বকেয়া হয়েছে। দুই বেলার খাওয়ার টাকা জোগাড় করাই কষ্টকর হয়ে গেছে। কিন্তু না খেয়ে এতো শারীরিক ধকল কিভাবে টানবে শরীর? শেষতক বাবাকে বলেছি, কিন্তু তিনি মনে হয় পুরোপুরি নিরুপায়। - আমি কি কিছু ধার দিতে পারি? - না পারনা , কারণ আমি জানি লিউ এই টাকা দেয়ার কোন সোর্স তোমার নাই। -কোন কাজ করে যদি - কোন কাজ করে এই সময়ের মধ্যে তুমি টাকাটা জোগাড় করতে পারবেনা। আর টাকার পরিমাণটাও অনেক! - দেখো আমার নামে কিছু টাকা আলাদা করে রাখা আছে ব্যাঙ্কে, কিন্তু সেটা বাবা তুলতে দেবে না। কোন উপায়ে যদি টাকাটা বের করতে পারি তবে আর কোন ভাবনা থাকতো না। তোমার গডের কাছে প্রার্থনা করো। -গডের কাছে প্রার্থনা করেছি। তিনি হয়তো আমার ডিগ্রি না হওয়াটাই নিয়তিতে লিখেছেন! সেমিস্টার ফিদর লাস্ট ডেইট আগামী সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস, মানে কাটায় কাটায় ১ সপ্তা। এই শেষ সময়ে কি তিনি লটারি মেলাবেন নাকি টাকা আসমান থেকে ফেলবেন বলো? - আকাশ থেকে টাকা এলে কি তুমি সেটা নেবে? - আরে !! জাহান্নাম থেকে আসলেও নেব! - নিঝুম! তুমি জাহান্নামের টাকা নেবে? চুপ করো তুমি, চুপ করো! লিউ আর্তনাদ করে চোখ বন্ধ করে কানে আঙুল দিলো, যেন আর কিছু শুনতেও চায় না। বিরক্ততে নিঝুমের মেজাজ খিঁচড়ে গেলো। এতো ন্যাকামীর কি হলো? তার এখন যে কোন ভাবেই টাকা লাগবেই। কার কাছে হাত পাতা যায় সেটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মেজাজ সামলে সে উঠে দাঁড়ালো, - আমার কথা শেষ। আমি উঠছি। তুমি আমার মুশকিল আসান করে দেবে এই আশায় আমি তোমাকে কিছু বলিনি। প্রতিটি মানুষের একটা শ্বাস নেবার জায়গা লাগে; বদ্ধ ঘরে, দরজা জানালাহীন বন্দিশালায় ঘুলঘুলির মতন। সব চাঁপা, অব্যক্ত কষ্ট যেই ঘুলঘুলিতে ফিরে ফিরে নিঃশ্বাস নেবে। তুমি আমার এমনি একটা জানালা। এই বোধটা এভাবে আজকের আগে আমার নিজের কাছেই অজানা ছিল। তোমাকে সমস্যাটা বলতে পেরেও কিছুটা হালকা লাগছে। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে এমনভাবে পাশে থাকার জন্য। যদিও সামনে ঘোর অন্ধকার। আমার সাড়ে তিন বছরের অমানুষিক কষ্টে আরো হয়তো ১ বছর যোগ হবে, তাও যদি ততদিনে ব্যাক পেইনটা কিছু সেড়ে ওঠে, আবার যদি কিছু বেশতী টাকার জোগাড় হয়! লিউ আস্তে আস্তে চোখ খুললো, মুখের ওপর থেকে হাত সরালো। সে কাঁদছিল! কি অদ্ভুত তো! চোখ নামিয়ে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে লিউ মৃদু স্বরে বললো, - আমি টাকাটা জোগাড় করে দেব। ২/১ দিন সময় নেবে। কিন্তু যেভাবেই হোক জোগাড় হয়ে যাবে। তুমি কিচ্ছু ভেবোনা। অবিশ্বাস্য কথা। নিছক স্বান্তনা! নিঝুম মুখে কিছু বললো না, কিন্তু মনে মনেই উড়িয়ে দিল। শনি - রবি নিঝুমের সারাদিন কাজ থাকে। রবিবার অঝোরে বৃষ্টি ভিজিয়ে গেলো সারাটাদিন। হাড় কাঁপানো শীতের ভেতর বৃষ্টির মতন ভোগান্তি আর কিছুতেই নাই। রেইনকোট ছাপিয়ে চুল-মুখ, পায়ের জুতো -মোজা, ট্রাউজারের নিচ অবধি ভিজে একাকার। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কাঁদায় ল্যাত প্যাতে অবস্থা। অসহ্য জীবন! আর এই বৃষ্টি নিয়েই কবি সাহিত্যিকদের কত কাব্য চর্চা!
নিঝুমের মনে হয় বৃষ্টি কেবল বাড়িতে অলস সময়েই ভাল লাগতে পারে। আর পারে গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহে তাপিত প্রাণের, খড়াগ্রস্থ কিশানের। তার আজীবন বৃষ্টিকে এক উপদ্রপই মনে হয়েছে। পা চালিয়ে ভিজে কাক হয়ে বাড়ি ফিরছে হচ্ছে। ডর্মেটরি নিস্তব্ধ, নিঃশ্চুপ। রবিবার রাতে শিক্ষার্থীরা আগেই শুয়ে পড়ে, সপ্তাহ শুরুর প্রস্তুতিতে। শুনশান রাতে কেবল বৃষ্টির পানিতে নিজের পায়ের ছ্প ছ্প শব্দ নিজের কানেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ডর্মে তার বিল্ডিং এ ঢোকার মুখে অন্ধকারে সিঁড়ির গোড়ায় ছায়ামূর্তি দেখে থমকে দাঁড়ায়। রাত প্রায় বারটা, এই সময়ে কে এখানে? মূর্তির চেহারা দেখা যাচ্ছেনা শুধু আকৃতি আর ছাতার রং দেখে ধারণা হলো কোন নারী মূর্তি। হন হন করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, মূর্তি খপ করে তার ডান বাহু চেপে ধরলো। নিঝুম আঁৎকে উঠে প্রায় চিৎকার করে উঠছিল। এক ঝটকায় ছাতা সরাতে লিউ এর চেহারা স্পষ্ট হলো। নিঝুম বিস্মিত হয়ে দাড়িয়ে গেল। -তুমি? এখানে? এতো রাতে? -তোমার টাকাটা। প্লাস্টিক ব্যাগে মোড়ানো টাকার বান্ডিল রেইনকোটের আড়াল থেকে বের করলো। -এই দেবার জন্য এতো রাতে তুমি এখানে এসেছ? কাল ক্লাসেই তো দিতে পারতে! তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? - ক্লাসে যেতে পারবোনা। তাই এখানে নিয়ে এসেছি। একটা চেক পোস্ট করেছি। ইউনিভার্সিটির ঠিকানায়। তোমার নামে। ইউনিভার্সিটিতে কাল সকালেই পেয়ে যাবে। সেমিস্টার ফির টাকার চেয়ে অনেক বেশি অংকের। ওতেই তোমার সব বকেয়া চুকে যাবে। ভয় পেয়োনা, আমার কিচ্ছু হবে না। আর কোন ভয় নেই। - লিউ , ধন্যবাদ জানিয়ে আমি এক জীবনেও তোমার ঋণ শোধ করতে পারবোনা। তাই বলে তুমি এতো রাতে এই ঠাণ্ডা- বৃষ্টির মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? তুমি এসেছ কিসে? এতো রাতে তো বাসও বন্ধ হয়ে গেছে। সাইকেলে? - আমার কোন সমস্যা হয়নি, একটুও কষ্ট হয়নি বিশ্বাস করো! এখানে রাতের বাস আছে, রাত সাড়ে ১১টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত চলে। আসলে - তোমার নিশ্চিন্ত মুখটা দেখবার অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। তাই এমন রাতেই ছুটে আসলাম। আসি। ভাল থেকো। নিজের যত্ন নিও। - তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? ক্লাসে যেতে পারবে না মানে? আমি এগিয়ে দেই দাঁড়াও। - না না প্লিজ অনেক রাত হয়েছে, তোমার ভোরে আবার কাজ আছে। ঘরে যাও, জলদি শুয়ে পড়। প্লিজ - লিউ আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে খুব দ্রুত অন্ধকারে চোখের আড়াল হয়ে গেল। ও যাবার পর কেমন অদ্ভুত কাঁপনি দেয়া শীতটা যেন চলে গেল। ঘরে ফিরে ভেজা জামা, রেইন কোট , মোজা , জুতা মেলে দিয়ে দ্রুত গরম জলে শাওয়ার নিয়ে নিল। লেপের নিচে যেতে যেতে একবার বান্ডিলটা খুলে দেখে নিতে গিয়ে হতবাক!
এ কেমন সব নোট! এতো বড়, সোনালী হলুদ রঙের। এতো বছরে তো এমন নোট কোনদিন দেখেনি। নকল নোট না তো! যাহ , তাই বা কি করে হয়? নকল নোট দিতে এতো কষ্ট করে আসবে মেয়েটা? এমন বৈরি পরিবেশে! হতে পারে সে আগে দেখেনি বা নুতন ছেড়েছে বাজারে। সংগে আবার একটা চেকও পোস্ট করেছে। সেমিস্টার ফির টাকার চেয়ে অনেক বেশি অংকের; বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য বকেয়ার টাকাও জোগাড় করে দিয়েছে। কিন্তু চেকের পরে আবার তাহলে এই টাকা - এতো কিছু কেন? কি করে এতোটা জোগাড় করলো লিউ? আহারে মেয়েটা! অপরিশোধ্য ঋণের বোঝায় আর কৃতজ্ঞতায় নিঝুমের চোখ ভিজে যাচ্ছে। দুটো মিষ্টি কথাও সেভাবে মেয়েটাকে বলা হলো না কোনদিন, আজও না! বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে আধঘুমে লেপ মুড়িয়ে মুখ ফেরালো জানালায়। ঘুম ছুটে চোখ আটকে গেল তার তিনতলা জানালার সরাসরি উল্টো দিকে ডর্মের সীমানা প্রাচীরের ধার ঘেষে ডেইজী ফুলের গাছে। সে কি চোখে ভুল দেখছে? তড়াক করে লাফিয়ে উঠে জানালার পর্দা ভাল করে সরিয়ে জানালার স্লাইড খুলতে খুলতেই নেই! অথচ সে স্পষ্ট দেখলো যেন লিউ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে! দুইবার সজোরে ওর নাম ধরে ডাকবে কিনা ভাবতে ভাবতে অন্য রুমমেটদের কথা ভেবে দমে গেল। স্লাইড টেনে বিছানায় এসেও বার বার চোখ চলে গেল ডেইজী ফুল গাছটার দিকে।
লিউ কি সত্যিই এখনো ওখানেই ছিল? তা না হলে চোখের এমন ভুল হবে কেন? হিসেবে খুব গড়মিল হচ্ছে তো আজ, সব কিছুতেই! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত শরীর একসময় ঘুমের কাছেই সমর্পিত হলো। ভোরে কাজ সেড়ে ক্লাস এটেন্ড করে ব্রেক টাইম হতেই এডমিশন সেন্টারে ছুটলো। লিউয়ের চেক এসেছে। ইউনিভার্সিটির ব্রাঞ্চে লিউয়ের দেয়া চেক ভাঙ্গিয়ে টাকাও তুলে এনেছে। প্রথমে বান্ডিলে মোড়ানো বড় নোটগুলি মেলে ধরলো। ক্যাশিয়ার ভূত দেখার মত আঁৎকে উঠে নোটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। নিঝুম থতমত খেয়ে ঢোক গিললো। মানে যা ভেবেছিল তাই! নকল নোট নিশ্চয়ই। কি দরকার ছিল লিউয়ের চেকের বাইরে আবার এই টাকাটা দেয়া? বেশ খানিক্ষণ পরে নোটগুলি থেকে চোখ সরিয়ে ভীত আতংকিত ফ্যাকাশে চেহারায় ওর দিকে তাকালো ভদ্রমহিলা। চেহারা থেকে কেউ যেন সিরিঞ্জ দিয়ে সব রক্ত শুষে নিয়েছে মহিলার। চোখ যেন গর্তে ঢুকে গেছে এই অল্প সময়েই। পাশের জনকে চোখ না সরিয়েই হাত ইশারা করলো। পাশের ভদ্রলাক নোটের দিকে তাকিয়েই “ওহ জেসাস, জেসাস” করে আর্তনাদ করে উঠলো। বুকের ক্রসে হাত রেখেই অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে লোকটি বাইরে বেরিয়ে এলো। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়েই আপাদমস্তক নিঝুমকে পর্যবেক্ষণ করলো তীক্ষ্ণ চোখে। কিছুক্ষণ পর বেশ বিরক্তি ঝেড়ে ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো, - এই টাকা তুমি কোথায় পেয়েছ? নিঝুম বুঝতে পারছেনা নকল টাকা নাকি ব্যাঙ্ক লুটের টাকা এগুলো, কিন্তু বুঝতে বাকি নেই সে খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। সবসময়ে সে বাবার শেখানো সততাই সর্বত্তম পন্থা মেনে চলে।
এবারেও সত্যিটাই বললো, - আমার সহপাঠি লিউ ওয়েইজুন টাকাটা দিয়েছে! আবারো আৎকে উঠলেন মহিলা। “ লিউ ওয়েইজুন!!! কবে? কোথায়?” নিঝুম প্রমাদ গুনলো! তোতলাতে তোতলাতে উচ্চারণ করলো, - ইয়ে এই তো কাল রাতে -রাত প্রায় ১২টায় আমার ডর্মের নিচে দাঁড়িয়েছিল আমার কাজ থেকে ফেরার অপেক্ষায়। আমি পৌছুতেই - তুমি কি ড্রাঙ্ক ছিলে? নাকি কোন ড্রাগ বা সিডেটিভ নাও? - ন - না না , আমি এসব কিছুই নেই না। আসলে কি সমস্যা হয়েছে একটু বলবেন প্লিজ? - তুমি তাকে জিজ্ঞেস করোনি এই টাকা সে কোথায় পেয়েছে? - না, আমি ও যাবার পর বান্ডিল খুলেছি। বৃষ্টি পরছিল, অনেক রাত - তাই ওর খুব তাড়া ছিল। এছাড়া ও আমাকে ২ দিন আগেই বলেছিল ওর নামে ওর বাবা ফিক্সড ডিপোসিট জাতীয় কিছু করে রেখেছে; ভাবলাম এই টাকাই হবে সেটা! - সেই টাকা তো আসল টাকা হবে, ব্যাঙ্কে গিয়ে তুলে আনতে পারবে। কিন্তু এই টাকা? - কি সমস্যা এই টাকায়? এই টাকা কি অন্য কিছু? - তুমি চেনোনা এই টাকা কি? নিঝুম মূঢ়ের মতো মাথা ডানে বামে নাড়ালো, - না জানি না, কোনদিন দেখিনি। কি টাকা এটা একটু বলবেন? অফিস এফেয়ার্স এর মহিলা থমথমে কন্ঠে জবাব দিলেন, - এ হলো “হেল মানি”! জাহান্নামের টাকা। কোন জীবিত মানুষের কাছে এই টাকা থাকেনা। এই টাকা মৃতের আত্মীয় বান্ধবেরা নির্দিষ্ট কিছু দোকান থেকে কিনেই নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গোল চক্র করে পুড়িয়ে দেয় আর মৃতের আত্মা টাকাটা অন্য জগতে পেয়ে যায়। মৃত ব্যক্তি পরপারে তার প্রয়োজনীয় বা পছন্দের জিনিস যেন কিনতে পারে এ ধারণা থেকে এই রীতি চলে আসছে। নিঝুম বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। - তাহলে লিউ এই টাকা পেলো কিভাবে? সে কি আমার সাথে এমন নির্মম রসিকতা করার জন্য ওমন দোকান থেকে কিনে দিয়ে যাবে? অসম্ভব! মহিলা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, - তোমার কি আজকে ক্লাসে কারো সাথে কথা হয়নি? - নাহ , আমি একেবারে কাটায় কাটায় বা কখনো একটু দেরিতেই ক্লাস ধরতে পারি, ভোরে কাজ করে ক্লাসে আসি। এমনিতেও সহপাঠিদের মধ্যে লিউয়ের সাথেই কেবল নিয়মিত কথা হয়। আজ ক্লাস শেষ করেই এখানে এসেছি , কারণ নেক্সট ক্লাস শেষ করে আরেকটা কাজে যাবার তাড়া থাকে।
মহিলা তার পুরুষ সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন। ফের বললেন, - তুমি কি লিউয়ের বয়ফ্রেন্ড? তুমি কি ওকে টাকাটার জন্য খুব চাপ দিচ্ছিলে? - আমরা খুব ভাল বন্ধু, আর আমাদের দুজনেরই অন্য তেমন কোন বন্ধু নেই। কিন্তু বয়ফ্রেন্ড না। আর টাকার খুব সমস্যায় আমি ছিলাম এবং অন্য সব কথার মতোই এটা ওর সাথে শেয়ার করেছিলাম, স্রেফ শেয়ার করবার জন্য। ও জানতে চাচ্ছিল খুব। এই - ! ওকে টাকা দেবার জ্ন্য চাপ আমি কোন অধিকারে দেবো? তবে ও খুব স্ট্রেসড হয়ে গেছিল এবং বলছিল ও টাকাটা যেভাবে হোক জোগার করে দেবে, আমি যেন চিন্তা না করি। আমি আমলে আনিনি। কিন্তু ও সত্যিই এনে দেবার পর প্রচন্ড অবাক হয়েছিলাম। - হ্যা লিউ আসলেই তার শেষটুকু দিয়েই টাকাটা জোগার করেছে। ভাবতে কষ্ট লাগছে তুমি তাকে ভাল বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছুই ভাবোনি। আর সে তোমাকে তার সর্বস্ব ভেবেছিল। - সর্বস্ব ভেবেছিল? পাস্ট টেন্সে বলছেন কেন? আপনি কিভাবে জানেন ও কি ভেবেছে? - জানি কারণ শুধু তোমার জন্য টাকার জোগার “যে কোন ভাবেই করতে” লিউ প্রাণ দিয়ে দিল। হেল মানিদর সাথে এই চিরকূট সেটে দিয়েছে যেন ব্যাংকে তোমাকে চেক ভাংগাতে না দিলে এই টাকাগুলি দেখে আমরা বুঝি লিউই তোমাকে টাকার জোগাড় করে দিয়েছে, তুমি ওকে খুন করে চেক বাগাওনি বা ধাপ্পাবাজি করছোনা। নিঝুমের পায়ের তলার মাটি টলে উঠলো। মাথা ঘুরে সরাসরি নিচে বসে পড়লো সে। ভদ্রলোকটি দ্রুত এসে নিঝুমকে ভেতরে নিয়ে বসালো। গ্লাসে করে পানি দিল। নিঝুমের চেতনা পুরোপুরি কাজ করছেনা। অচেতন অবস্থাতেই সে যেন স্থানুর মতন বসে থাকলো। ডিপার্টমেন্ট প্রধানকে খবর জানানো হলো। লোকের ভীড় বেড়ে গেল। সবাই আতঙ্কিত চোখে হেল মানি, লিউ এর চিরকূট দেখে যাচ্ছে। কে কি বলছে করছে নিঝুমের কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। ঘন্টাখানেক পর লিউ এর বাবা এলেন। নিঝুমের ওপর প্রায় ঝাপিয়ে পরতে যাচ্ছিলেন। ক্ষোভে, ক্রোধে তিনি ফেটে পড়ছেন। চায়নায় ১৯৮০ থেকে একটি সন্তান রীতি। বৃদ্ধ বয়সে তিনি একমাত্র সন্তানকে তার গ্রেজুয়েশনের দ্বারপ্রান্তে হারিয়েছেন এই ভীনদেশি এক ছেলের জ্ন্য। তাঁর তো স্বাভাবিক আচরণ করাই অস্বাভাবিক। সবাই ধরে তাকে অনেক ঝামেলা করে সামলালেন। পুলিশে খবর দেয়া হলো। তাদের দুইজনকেই ডিপার্টমেন্টের প্রধানের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। এরপর পুলিশের কাছে।
সবার প্রশ্নের মুখে নিঝুম একই কথাই বার বার বলে গেল। এবার লিউ এর বাবা মুখ খুললেন, - আমার মেয়েটা খুব বোকা ছিল কিন্তু খুব লক্ষ্মী ছিল। এতো ভাল ইউনিভার্সিটি ওর সুযোগ পাওয়া কেবল প্রচণ্ড অধ্যাবসায়ের জোরে। বোকামির জন্য ওকে প্রায়ই বকাঝকা দিতাম। খুব সামলে রাখতাম যেন যার তার সাথে না মিশে ভুল না করে বসে। ওর জন্য রাখা ব্যাঙ্ক এর টাকাটা ছিল ওর জন্য বাঁচিয়ে রাখা একমাত্র সঞ্চয়। নাহলে ইউনিভার্সিটির টাকা জোগাড় করতেই আমরা হিমশিম খাচ্ছিলাম। ও প্রায়ই এই ছেলেটার কথা বলতো। বলতো ও কত কষ্ট করে পড়ে, কত পরিশ্রম করে, এর পরেও কিভাবে লিউকে পড়া দেখিয়ে দেয়। আমরা বুঝতাম ও ছেলেটাকে ভালবাসে। আমাদেরও তেমন কোন আপত্তি ছিলনা। কয়েকবার বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছিলাম নববর্ষে। ছেলেটার নাকি একেবারেই সময় হয় না। সেদিন শুক্রবার হঠাৎ বাড়ি ফিরলো। ও ডর্মেই থাকে , কারণ আমাদের বাড়ি এখান থেকে গাড়ীতেই প্রায় সোয়া ১ ঘন্টার পথ। শনিবার সন্ধ্যায় আমাকে বললো খাবার পরে একটু হাঁটতে যাবে আমার সাথে। আমি আন্দাজ করতে পারলাম ও কিছু বলতেই তাহলে বাড়ী এসেছে, কিছু বলতেই বাইরে যেতে চাচ্ছে। হাঁটতে হাটতে বললো, “ বাবা আমার ডিপোসিটের টাকাটা কি একটু তুলতে দেবে? আমার ভীষণ দরকার, খুব জলদি !” আমি বললাম যে ঐ টাকায় হাত দেয়া যাবেনা , ওটা তার বিয়ের জন্য তুলে রাখা হয়েছে। বললো পাশ করে চাকরী করেই ঐ টাকা জোগাড় করে দেবে। আমি জানতে চাইলাম কেন দরকার, মেয়ে উত্তর দেয়নি। মাথা নিচু করেছিল। ওর ১৮ বছর হয়ে গেছে। ও ইচ্ছে করলে নিজেও টাকাটা তুলতে পারবে নিয়মমাফিক। চেক বইও কোথায় আছে ও জানতো। তবুও সে বরাবরের মতোই আমার অনুমতি চাইছিল বারবার। আমি ওকে সারাজীবনে কোনকিছুর জ্ন্য এমন জেদ করতে দেখিনি। শেষে খুব ক্ষেপে গিয়েই বলেছিলাম, “ এই টাকা যদি তোমার সেই ছেলে বন্ধুর জন্য নিয়ে থাকো এবং সেই বন্ধু যদি পাশ করার পরপর ভাল একটা কাজ জুটিয়ে তোমাকে নিঃশর্তে বিয়ে করতে না আসে তবে জেনে রেখো এই টাকার জন্য তাকে আমি কবর খুড়ে হলেও বের করে শূলে চড়াবো !”
মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইতে আসছিল, শর্ত তুলে নেবার জন্য কাঁদছিল। আমি ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। রেগে গেলে আমার হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। মেয়েটা তবুও আমাকে আকড়ে ধরে মার খেয়ে গেল। বাবার কণ্ঠরোধ হয়ে আহাজারীর রূপ নিল, -- মা লিউ! তুই বাবার রাগটাই দেখলি? আর যেই মানুষ তোকে তার জীবনে ঠাঁই দেবে কিনা তুই সেও জানিস না তাকে ভালবাসতে তুই জীবন দিয়ে দিলি? আর এই টাকাটা যে তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে সঞ্চিত ছিল, বাবা মাদর কত ঘামঝরা, রক্ত পানি করা কষ্ট, তুই সেই ভালবাসাটা দেখলি না? অনেক্ষণ আহাজারি আর আক্ষেপের পর শ্রান্ত হয়ে আবারো বললেন, - গতকাল সকালে দেখি ওর লাশ পড়ে আছে ওর বিছানার ওপর। স্লিপিং ড্রাগের ওভার ডোস। চেকবই এক একটা পাতা ছেঁড়া। আর সুইসাইড নোটে ক্ষমা চেয়ে বিদায় নেয়া। কোথাও উল্লেখ করেনি কেন তার টাকাটা এভাবে তখুনি দরকার পড়েছিল। একমাত্র সন্তান হারানোর পর আমি টাকার খোঁজ নেবার কোন অবস্থাতেই ছিলাম না। তবে আগের রাতে কিছু পোস্ট করতে বেড়িয়েছিল। আর হ্যা, দহেল মানিগুলিদ আমরা আর তার আত্মীয়রা ওর জন্য পুড়িয়েছিলাম। পুলিশ স্টেশনেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। কাজে আর যাওয়া হলোনা নিঝুমের। অনেকদিন পর খুব কাঙ্খিত, আরাধ্য অবসর খুব অনাকাঙ্খিতভাবে মিলে গেল। এই সাড়ে তিন বছরে এমন দিন মিলে গেলে হয়তো লিউয়ের সাথেই কোথাও ঘুরতে যাওয়া হতো। কতদিন মেয়েটা ম্যুভি দেখতে, সামান্য কোথাও ঘুরতে, ক্যাম্পাসের বাইরে কোথাও খেতে যেতে অনুরোধ করেছে! ডর্মে ফিরে লেটার বক্সে চিঠি দেখতে পেল। তার লেটার বক্সে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী লিফলেট, ফ্রি নিউজপেপার, বিলের পেপার ছাড়া তেমন কিছুই থাকেনা। বন্ধু, সহপাঠী সবাই ফেসবুক ব্যবহার করে। ভাগ্যিস চায়নায় ফেসবুক বন্ধ, তাদের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তারা, নাহলে তার এতো অমূল্য সময়ের কিছুটা হলেও ভীষণ বাজে খরচ হয়ে যেত। সবাই স্কাইপ, ভাইবার, হোয়াটস আপে ২/১ লাইন মেসেজ লিখে ওর হালনাগাদ নেয়। চিঠিটা খুব সুন্দর খামে ভরা। এই সুন্দর খামগুলি শপিং মলে কাজ করার সময় শেল্ফ গোছাতে গিয়ে তার ত্রস্ত হাত থমকে দিত। মাঝে মাঝেই বোকার মতন মনে হতো এমন একটা খাম যদি কোনদিন তার নামে আসতো, খামে কেউ যদি তাকে কিছু লিখে পাঠাতো!
আজ ঠিক তেমনি একটা খাম। খামের ওপর প্রেরকের নাম নেই। কিচ্ছু এসে যায় না। প্রাপকের নাম লিখেছে যে তার হ্স্তাক্ষর নিঝুমের পৃথিবীর সবচেয়ে চেনা হস্তাক্ষর। লিউ। গোটা জীবনে কারো হাতের লেখা এতো পড়তে হয়নি যা লিউয়ের ক্লাস লেকচার বোঝাতে, নিজের মিস করে যাওয়া লেকচার টুকে নিতে গিয়ে পড়তে হয়েছে। ও কোনদিন ঠিক ঠাক বলতে পারবে না কেমন ছিল লিউয়ের ত্বকের উজ্জ্বলতা, কতটা সুন্দর - অসুন্দর ছিল তার সরল মুখশ্রী, কেমন ছিল তার নাম মুখ ঠোঁটের ঠিক ঠাক গড়ন। কিন্তু রাস্তায় লিউয়ের লেখা একটুকরো কাগজ দেখেও ও বলতে পারবে এটা লিউয়ের ছাড়া আর কারো হতেই পারে না! রুমে ঢুকে খাটে বিধ্বস্ত শরীর আর ততোধিক বিপর্যস্ত মন এলিয়ে দিয়ে খাম খুলে চিঠিটা বের করলো। চিঠির কাগজটাও খুব বিশেষ; সুগন্ধী, রঙিন। - প্রিয় নিঝুম, যখন তুমি এই চিঠিটা হাতে পেয়েছ ততক্ষণে তুমি হয়তো জেনে গেছ আমি আর নেই। খুব কষ্ট করেও লিখতে পারলাম না “মরে গেছি”! যেই পৃথিবীতে তুমি থাকবে সেই পৃথিবী ছেড়ে আমি কি করে চলে যাই বলতো! সপ্তাহ ঘুরে শনি - রবিবার আসবে বলে শুক্রবার সব ছাত্র -ছাত্রীরা কি উৎফুল্ল থাকতো! গ্রীষ্মের ছুটি, শীতের ছুটি! আর আমার কেবল হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসতো! ছুটির দিনগুলি যেন আসতো আমার ধৈর্য্য পরীক্ষা নিতে। ঘড়ির কাটায় চোখ রেখে রেখে আমার সময় কাটতো। সেই তোমাকে আর কোনদিন দেখতে পাবোনা এর চেয়ে কেউ আমার চোখের সামনে আমার হৃদপিণ্ডটা বের করে নিলেও হয়তো অনেক কম কষ্ট পেতাম! সুন্দর খাম, সুবাসিত রঙিন চিঠির পাতা দেখে মুগ্ধ হচ্ছো? জীবনের প্রথম প্রেমের চিঠি লিখছি, এবং একই সাথে শেষ চিঠিও। অন্তত সুন্দর গন্ধের লোভেও যদি তুমি কয়েকবার পড়ো, যত্ন করে রেখে দাও! নাহ, কোন অভিযোগ নেই। তোমার অমানুষিক জীবন তোমার বাবা- মাও জানেনি, আমি জেনেছি! রাত জাগা লাল চোখে ক্লান্ত বিধ্বস্ত তুমি ক্লাসে আসতে, মনে হতো এলোমেলো ঝাকড়া চুলগুলি আঙুল বুলিয়ে গুছিয়ে দেই! ওয়েট টিস্যু ঠেলে দিতাম বারবার, খুব ইচ্ছে হতো যত্ন করে নিজে মুছে দেই। লোশন, লিপজেল মেখে দেই শীতে ফাঁটা অনাদর অযন্তের ঠোঁটে মুখে।
হাতের লেখা আমার কখনোই তেমন ভাল ছিল না, শুধু তুমি পড়বে বলে যত্ন করে ক্লাস নোট তুলতাম, বাড়িতেও হাতের লেখা এই বয়সে নার্সারীর বাচ্চাদের মতন চর্চা করতাম। নাহ - ক্লাসের পড়াও আমি ক্লাসেই বুঝতে পারতাম, বোকা ছিলাম কিন্তু অতোটা অমেধাবী ছিলাম না, অন্তত পরিশ্রমের জোরে বুঝে নিতাম। তবুও ক্লাসের ফাঁকে তোমাকে আটকে রেখে বুঝতে চাওয়াটা ছিল তোমার যৎসামান্য সময়ের সবটা দখল নেয়া। যাতে তুমি এক মুহূর্তও চোখের আড়াল না হতে পারো, কেউ আমার সেই সময়ের ভাগ না বসাতে পারে। দেখতে দেখতে নাকি সবাই একসময়ে বাসী হয়ে যায়। আমার কাছে তুমি বাসী হতে না কেন? আমি তোমার কালো মলিন মুখটা থেকে কেন চোখ সরাতেই শিখলাম না? কেন মনে হতো এতো মায়াবী মুখ এমন মনকাড়া চেহারা কোন অন্য ভুবনের সৃষ্টি? আমার দিন শেষ হতো ভাইবারে তোমার ছবি দেখে, দিন শুরুও হতোই তাই দেখে দেখে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলেও দেখতাম তুমি কখন অনলাইনে এসেছিলে। আমার এক ছেলেবেলার বান্ধবী বলেছিল, প্রেমে যতদিন শরীর না এসে যাবে ততদিনই ভালবাসার মানুষটাকে ছুঁয়ে দেখবার এক প্রবল তৃষ্ণা ধারণ করবে। আমি জানিনা তোমার প্রতি আমার আকণ্ঠ তৃষ্ণার কারণ সেটাই ছিল কিনা। তবে খুব সৎ, নিখাদ একজন মানুষকে ছুঁয়ে দেখবার, ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকবার এক প্রবল আকাঙ্খা তীব্রভাবেই ছিল। সাড়ে তিন বছরের সেই প্রথম দিনটি থেকেই তুমি আমার সাথে বাস্তবে -পরাবাস্তবে প্রতি মুহূর্তে ছিলে। তোমার জন্য লিখতে পারি এক পৃথিবী, তোমার জন্য ছাড়তেও পারি এক পৃথিবী। বাবা-মার একমাত্র সন্তান হয়েও স্বার্থপরের মতন তাদের বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন না হয়ে পালিয়ে গেলাম। নাহলে তারা এই টাকা তোমাকে দিতে দিতেন না। আমি জানি তুমি ডিগ্রি পেয়ে একটা ভাল কাজ না জুটানো অবধি এই টাকা শোধ দিতে পারবে না। স্রেফ গ্রেজুয়েশনের পর ভাল কাজ জোটানো এই জনবহুল দেশে এখন প্রায় অসম্ভব। তোমাকে হয় মাস্টার্স করতে হবে; নয়তো স্বল্প বেতনের কাজে বা দেশে ফিরে কর্মজীবন শুরু করে এ টাকা শোধ দিতে অনেক সময় লাগবে। আর বাবাও ততদিন বসে থাকতেন না।
বাবার এক কঠিন শর্তও ছিল যা আমি তোমাকে আরোপ করবো এমন কোন বোঝাপড়া আমাদের সম্পর্কে কোনদিনও আসেনি। এক নরক থেকে উদ্ধার করে তোমাকে আমি আরেক নরকে ঠেলে দিতে চাইনি। জানি আমার মৃত্যুর জন্য বাবা তোমাকে অনেক হয়রানি করবে, তবুও তা বেশিদূর গড়াবে না। কিছুই করলাম না তাদের জন্য! যদি সম্ভব হয় তাদের হালনাগাদ নিও, খোঁজ রেখো, কাছে দূরে যেখানেই থাকো। যত রাগই থাকুক তোমার ভেতর তারা তাদের মেয়েকে দেখতে পাবে। তারা জানবে তাদের একমাত্র সন্তানের ভালবাসাটা অন্তত বেঁচে আছে! এইটুকুই থাকবে তাদের সান্ত্বনা। সাড়ে তিন বছর তোমার কাছ থেকে কাঙালের মতন সময় নিয়েছি, জানা প্রশ্ন বার বার করে কথা বলার ছুঁতো খুজেছি, সব একবারে শোধ দিয়ে গেলাম। দহেল মানিদটা দিয়ে তোমাকে বিব্রত না করলেও পারতাম, দিয়েছি যেন তারা আমার জীবদ্দশায় লিখে যাওয়া চেককে চ্যালেঞ্জ করলেও ওপাড় থেকে এপাড়ে এসে দিয়ে যাওয়া এই হেল মানিকে অস্বীকার করতে পারবে না। আর হ্যা, রোজ রাতে আমি চাইবো তোমার ডর্মের পাশের ডেইজী ফুলের গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখে যেতে। দেখতে পেলে ভয় পেয়ো না, ছুঁতে যেও না। মিলিয়ে যাব। আমার এইটুকু ভাল বাসার অত্যাচার সহ্য করতে পারবে না? ওহ বলা হয়নি! ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি- ঠিক ততটাই - যত ভালবাসায় ভালবাসাও দেউলিয়া হয়ে যায়! অন্তহীন তোমার- লিউ।
এইচআর/পিআর