কান্না
বারান্দার গ্রিলের সাথে লেপটে আছে আড়িকা। পিঠময় এলোমেলো চুল, মাখন রঙা শরীরে একাকার হয়ে লেপটে আছে অফ হোয়াইট লিলেনের তুলতুলে রাত পোশাক। এই দুপুরে ধাক্কা লাগার মতই ব্যাপার। অন্তত আড়িকাকে চিনলে। ভোরে উঠে পোশাক পাল্টে ব্যায়াম করে স্নানের পর আরো একদফা পোশাক পাল্টে সাজ পাট সেরে তারপর নাস্তা করে দিন শুরু হয় তার! পেছন থেকে দেখে মনে হচ্ছে বাইরের ধুম বৃষ্টি দেখছে, আর হাত বাড়িয়ে ছুঁয়েও নিচ্ছে বেশ করে। তার যা স্বভাব, বৃষ্টি নিয়ে আদিখ্যেতা বিসদৃশ। আজ কী স্বভাবের বিপরীতে চলার দিন নাকি! তবে গত চার পাঁচদিনের তীব্র দাবদাহের পর এই বৃষ্টি সবাইকেই মাতাল করেছে বলা যায়।
তারপরেও আড়িকা আসলে বৃষ্টি উপভোগের জন্য নয়, দাঁড়িয়ে আছে কান্না সামলানোর জন্য। উদগত কান্নার কাঁপন বাঁচাতে শরীরটাকে গ্রিলে চেপে ধরেছে শক্ত করে আর হাত বাড়িয়ে তালুতে খানিকটা করে জল জমিয়ে নিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে অবাধ্য অশ্রুর ওপর। কাউকে সে তার কান্না দেখাবে না। দেখায়ও না। আসলে সে কাঁদেই না অনেক কাল। সেই যে পনের বছর বয়সে ক্লাশ নাইনের ফাইনাল পরীক্ষার পর তার চেয়ে চব্বিশ বছরের বড় ড. মুজাম্মেল হকের সাথে তার বিয়ে হলো। যেদিন বিয়ে হয় সেদিনও তার ডাগর চোখের কোল বেয়ে এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি।
ড. মুজাম্মেল আড়িকার বড় চাচার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ছাত্রাবস্থায় প্রতি ছুটিতেই আড়িকাদের বাড়িতে চলে আসতো মা হারা বাড়িতে মন লাগতো না বলে। আড়িকার দাদী অপত্য স্নেহে তাকে কাছে টেনে নিতেন, নানারকম সুস্বাদু খাবার তৈরি করে তাকে আনন্দ দিতে চেষ্টা করতেন। পাশ করার পর তিনি স্কলারশিপ নিয়ে জাপানে চলে যান এবং দীর্ঘ সময় সেখানেই কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন বছরখানেক আগে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন প্রফেসর হিসেবে, গৃহ পেয়েছেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার, তাতে একজন গৃহিনী প্রয়োজন। তিনি খুঁজছিলেন, বন্ধু হিসেবে আড়িকার চাচাও সেই দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
সেই সময়ে আড়িকার বাবা মারা গেলে পিঠেপিঠি দু’বোন ও শিশু ভাইটিকে নিয়ে আড়িকার মাসহ পুরো পরিবার গাড্ডায় পড়ে। গাড্ডা কারণ আড়িকার বাবার কোনো সম্পদ বা সঞ্চয় ছিল না, যা দিয়ে শহরে চলে আসা যায় বা মেয়েদের হোস্টেলে রেখে পড়ানো যায়। গাড্ডা কারণ গ্রামে দুটি সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী মেয়েকে অভিভাবকহীন রাখা যায় না। অভিভাবকহীন কারণ যুবতী মা এবং বৃদ্ধ দাদা সমর্থ অভিভাবকরূপে গণ্য নন। এমতাবস্থায় আড়িকার বাবার কুলখানিতেই ঢাকাবাসী একমাত্র চাচার ওপর এই সমস্যা সমাধানের ভার পড়লো। সুতরাং চাচা ঢাকায় ফিরে ড. মুজাম্মেলের কাছে ছুটে গেলেন এবং পরিবারটিকে উদ্ধারের দায়িত্ব তার সবল কাঁধে চাপালেন।
একমাসের মাথায় চাচা যখন বাড়িতে আবার আসেন এবং প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন আড়িকার দাদা দাদী একমত হন যে মুজার চেয়ে ভাল ছেলে আর হয় না। বয়স বেশি তো কী আজকাল বয়স কোনো ব্যাপার নাকি। তারা শুনেছেন কত মেয়ে নাকি নিজের পছন্দেই তাদের চেয়ে চল্লিশ বছরের বড় পুরুষকে সতীনসহই বিয়ে করে। মুজার তো সেই সমস্যা নাই তাছাড়া তাকে সেই কত আগে থেকে জানেন। তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করেন যে এমন নিরীহ ছেলে হয় না। আড়িকার মা অবশ্য অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তাতে চাচা চাচী খানিকটা বিরক্ত হলে দাদী জানান এটা কিছু না আড়িকার মা এখন প্রায়ই অজ্ঞান হন বা অজ্ঞানবস্থাতেই থাকেন।
ড. মুজাম্মেলকে আড়িকা বিয়ের দিনই দেখে। তার চেয়ে বিঘতখানেক বেঁটে গাট্টাগোট্টা মানুষটিকে দেখে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। এতে অবশ্য ছন্দপতন হয় না। ড. মুজাম্মেলের মানসিক সমস্যা ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয় না যেহেতু নববধূ চোখ বন্ধ রাখতেই পারে। আর আড়িকা মেনে নেয় সে একটু বেশিই ঢ্যাঙা। তার মনে আছে বড় মামা একবার মাকে বলেছিল, তোর মায়াটা এমন ঢ্যাঙা হইতেছে এই বাইট্টার দেশে অর জন্য পাত্র পাওয়াই তো সমস্যা হইব। আড়িকার অবশ্য এ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা ছিল না। পত্রিকা পড়ে পড়ে সে জেনে গিয়েছিল লম্বা হলে মডেল হওয়ার চান্স পেতে সহজ হয়। সে স্বপ্ন দেখতো মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় চাচার বাসায় যেয়ে সে লাক্স ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবে। সে আর হলো না তবে সংসার বেশ আনন্দ নিয়েই শুরু হলো। এই প্রথম অনটনহীন জীবন দেখলো সে। যা কিনতে ইচ্ছে করে কেনা যায়, ভাই বোনদের আবদার মেটানো যায় বেশ ভাল লাগে এসব। ড. মুজাম্মেল জাপানেও ঘুরিয়ে আনলো একবার। তারপরে বললেন পড়াশুনা শুরু করতে। গান শেখার ব্যবস্থাও করলেন। সম্ভবত এতবড় স্কলারের শুধুমাত্র সুন্দরী স্ত্রীতে মর্যাদা রক্ষা হয় না।
ড. মুজাম্মেল ছাত্র পড়ানো ও তার নিজের পড়ায় ব্যস্ত হলেন, আর আড়িকা ভাইবোনদের অভিভাবকত্ব আর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ত্রুটিহীনভাবে সংসার টেনে নেয়ায় নিজেকে সমর্পণ করলো। কেবল রাতে যেদিন ড. মুজাম্মেল রোমান্টিক হয়ে ওঠেন সেদিন খেদের সাথে একটি মন্তব্য উচ্চারিত হয়, এই বয়সে এতো শীতল তুমি! তোমার ফিগার দেখলে ভাবাই যায় না এমন পাথরের মতো পড়ে থাকো! নিস্তরঙ্গ সংসারে এটুকু অসন্তোষ কালো মেঘ হয়ে ঝড় তোলে না বরং বুদ্বুদের মতো দ্রুতই মিলিয়ে যায় কারণ এরপর তিনি নিজেই আবার বলেন, বাংলাদেশের মেয়েরা অবদমন করতে করতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় আসলে। এছাড়া যেহেতু ড. মুজাম্মেলের সব কিছু গুছিয়ে নেয়ার তাড়া খুব তাই সন্তানও চলে এলো একবছর পরেই।
তিন জনের সংসারে একদিন সিফাত আসে খুব স্বাভাবিকভাবে, সংসারের নিয়মে। কিন্তু ওর মুখোমুখি আড়িকা আমূল কেঁপে ওঠে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই। সিফাত আড়িকারই বয়সী অথবা সামান্য ছোট বা বড়। মেডিক্যাল কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। একবছর আগে ওকে ভর্তি করে ওর বাবা ড. মুজাম্মেলের লতাপাতায় ভাই বা ভাই কম বন্ধু বেশি সিফাতের বাবা আড়িকাদের ইউনিভার্সিটির প্রফেসর কোয়ার্টারে এসেছিলেন ছেলের খোঁজ খবর রাখার দায়িত্ব ড. মুজাম্মেলকে বুঝিয়ে দিতে। ছেলেকে আনেননি কেন ড. মুজাম্মেলের জিজ্ঞাসায় তিনি বিব্রত হেসে বলেছিলেন, বন্ধু পেয়ে গেছে একজন। তার সাথে শহর চিনে নিচ্ছে। আমাকে বললো, তুমি যাও আঙ্কেলের বাসায় আমি একাই যেতে পারবো; শহরটা চেনা হয়ে গেলে। আড়িকা বলেছিল, বিশ্ববিদ্যালয় তো শহরে না গ্রামে। তিনি হেসে ফেলে বলেছিলেন, না না ও আসতে পারবে। কঠিন কিছু তো না, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেনে উঠে বসলেই হলো।
সিফাতের অবশ্য সহসা ট্রেনে উঠে বসা হয়নি। তবে ড. মুজাম্মেল শহরে গেলে মাঝেমধ্যে মেডিক্যাল কলেজে গিয়েছেন বা ফোনে খোঁজখবর নিয়েছেন। আড়িকার কোনো যোগ ছিল না তাতে। একবছর পর সিফাত ট্রেনে উঠে বসলো কারণ তার হাত ভেঙেছে। হাতের চিকিৎসা অবশ্য মেডিক্যালেই ভাল চলছিল কিন্তু রোজা শুরু হওয়ায় ডাইনিংএ খাবারের রুটিন বদলে যাওয়ায় আর ঈদের ছুটির পরে ফাইনাল পরীক্ষা বলে ড. মুজাম্মেলের পরামর্শে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেনে চড়ে বসলো। বড় কোয়ার্টারের নিরিবিলি কোণের ঘরটি তার জন্য বরাদ্দ হলো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার তার হাত ড্রেসিং করে দেবে। সুচারু ব্যবস্থা। শুধু আড়িকা আর সিফাতের মধ্যে অসহজতার পর্দা ঝুলে থাকে।
আড়িকা দরজা খুলে সিফাতের মুখোমুখি হলে মুগ্ধ বিস্ময়ে সিফাত তাকিয়েই থাকে আড়িকাকে ওলোটপালট করে। একটু পরে সিফাতের ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ড. মুজাম্মেল তোমার আন্টি বলে আড়িকাকে পরিচয় করে দিলে সিফাত বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে একবার ড. মুজাম্মেল এবং একবার আড়িকার দিকে তাকিয়ে রক্তিম হয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। এরপর থেকে ভাববাচ্যে কথা বলে তারা। তবে দু’পক্ষের প্রবল আকর্ষণে নানা ছুঁতোয় সখ্য গড়ে ওঠে সহজেই। এক বিকেলে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের জঙ্গলে ঢুকে যায় এবং ক্লান্তিহীন কথা বলা আর পাহাড় ভাঙার একপর্যায়ে সিফাত হঠাৎ একটি পা আড়িকার সামনে দিয়ে পেঁচিয়ে পেছনে নিয়ে আর একটি হাত পেছন থেকে ঘুরিয়ে ওর মুখের ওপর চেপে একই সাথে ওর কথা আর হাঁটা থামালে আড়িকা অবাক হয়ে তাকায়। সিফাত ইশারায় চুপ বলে কানে কানে সামনের দিকে তাকাতে বলে, সেখানে পাতার ওপর মৈথুনরত ফড়িঙ দেখায়। নিষ্পলক দেখে তারা ফড়িঙও কী নিষ্ঠায় কী তীব্রতায় মৈথুন সম্পন্ন করে! একটি আরেকটির মাথা কামড়াচ্ছে আর আকুল হয়ে লেজ পেঁচিয়ে ধরছে, একটি যেন আরেকটির ভেতর বিলীন হয়ে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছে!
সিফাত পা সোজা করে একমাত্র হাতটি দিয়ে আড়িকাকে কাছে টেনে ঠোঁট আকড়ে ধরে। ড. মুজাম্মেল কথিত আড়িকার পাথর শরীর এক অচেনা অনুভবে জেগে উঠতে থাকে। সিফাতের এক হাত গলায় ঝুলানো কিন্তু তাতে কোনো বিঘ্ন ঘটে না, এমনকি কেউ দেখে ফেলার ভয় বা সাপ বিচ্ছুর কামড় সব বিস্মৃত হয়ে আড়িকা নিপুণ দক্ষতায় মৈথুনের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে। ফেরার পথে সন্ধ্যার আবছা আলোয় অপার ভালোলাগা নিয়ে যেখানে চোখ ফেলে তাই তার মনোহর মনে হয়। চেনা মানুষ, পুরোনো ক্যাম্পাস সব কিছুর জন্য মায়া লাগে। এমনকি ড. মুজাম্মেলের দিকেও সে হাসিমুখে তাকাতে পারে। আর সেই প্ররোচণায় অথবা নিজস্ব তাগিদেই ড. মুজাম্মেল রোমান্টিক হয়ে উঠলে বরাবরকার মতো আড়িকা চোখ বন্ধ করে ফেলে প্রবল বিতৃষ্ণায়। কিন্তু সেদিন অদ্ভুত ভাবে সে বন্ধ চোখের পাতার সিফাতের ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করে জেগে উঠতে থাকে তীব্রভাবে। যখন বুকের একপাশে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে ড. মুজাম্মেল এবং চোখ একসময় খুলতেই হয় আড়িকাকে তখনই আবারও আড়িকার বিতৃষ্ণা জেগে ওঠে। ইচ্ছে করে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়; তীব্র আনন্দের সেই অনুভব আবারো ফিরিয়ে আনে, আরো কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকে। কিন্তু ড. মুজাম্মেলের ঘুম ভাঙতে পারে ভেবে নিঃশ্বাস পর্যন্ত সাবধানে নেয় সে। এই মুহূর্তে তার সাথে একটি বাক্যও বিনিময় অসম্ভব যেন।
পরদিন সকাল থেকেই সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ বিশ একুশ বছরের দুই তরুণ-তরুণীর পায়ে নুপুর বাজতে থাকে। নানা ছুঁতোনাতায় পরস্পরের মুখোমুখি, চোখাচোখি, ছোঁয়াছুয়ি অদম্য হয়ে ওঠে। শুধু ড. মুজাম্মেলের যাওয়ার অপেক্ষা। তাই নাস্তার টেবিলে ড. মুজাম্মেল সিফাতকে হাতের ব্যান্ডেজ বদলাতে তার সাথে যেতে বললে সিফাত বিষম খায়। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর একটু স্বাভাবিক হয়ে সে জানায়, পানি খেয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে। একটু পরে নাস্তা খেয়ে নিজেই ড. মুজাম্মেলের চেম্বারে চলে যাবে। ক্লাশের দেরী হয়ে যাবে বলে ড. মুজাম্মেল আর দেরী করে না। সিফাতকে বিশ্রাম নিতে বলে। তারপরে জিজ্ঞেস করে তুমি নিজেই যেতে পারবে তো নাকি আমি আসবো? সিফাত তাড়াতাড়ি ঘাড় নেড়ে জানায় সে নিজেই যেতে পারবে।
একদিন সিফাতের হাত ভালো হয়ে যায়, আরেকদিন ছুটি শেষ হয়। তখন সিফাতকে ফিরতেই হয় সাপ্তাহিক ছুটিতে চলে আসবে কথা দিয়ে। কিন্তু কলেজ খুলতেই পরীক্ষার বিভীষিকা। পুরো বন্ধ লেখাপড়া হয়নি। তাই আড়িকার সাথে আর যোগাযোগ হয় না ঠিকঠাক। আড়িকাই বরং একদিন চলে আসে এবং তারপর মাঝে মাঝে আসাটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। একদিন ড. মুজাম্মেলও সাথে আসে। কিন্তু তাতেও তাদের মিলনে বিঘ্ন ঘটে না। সিফাতের বন্ধুরা ড. মুজাম্মেলকে চা খাওয়াতে নিয়ে যায়। ড. মুজাম্মেল তাদের সাথে চা খেয়ে ফেরত আসার সময় সিফাতের জন্য আরো কিছু বিস্কিট চানাচুর নিয়ে আসে। তারপর আড়িকাকে নিয়ে সবার কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নেয়। রাতে সে আড়িকার সাথে আরও ঘনিষ্ঠ আচরণ করে, তাকে বেশি বেশি কামনা করে। আড়িকা বুঝতে পারে না লোকটা নিরেট নাকি ধূর্ত! এমন একটি অবস্থায় ড. মুজাম্মেলকে আড়িকার ধর্ষক মনে হয়। সে ড. মুজাম্মেলকে আশে পাশে ঘেঁষতে দেয় না ড. মুজাম্মেল ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত মেয়েকে ছাড়ে না। তবে বিরক্ত লাগলেও সিফাতে ডুব দিলেই সব যন্ত্রণার উপশম ঘটে তার।
আড়িকা সিফাতের উৎসাহে আবার পড়াশুনা করে, ভোরে ঘুম থেকে উঠে রেওয়াজ করে, যোগব্যায়াম করে করে ফিগার আরো ধারালো করে তোলে, নতুন নতুন রান্না শেখে আর রান্না করে বাটিতে ভরে মাঝে মাঝেই ট্রেনে চেপে শহরে চলে আসে সিফাতকে খাওয়ানোর জন্য। কোথাও কোনো ছন্দপতন ঘটে না। তবু একবছর পর সিফাত ময়মনসিংহ মেডিক্যালে ট্রান্সফার হয়ে যায়। সিফাত নয়, ড. মুজাম্মেলের কাছ থেকে আড়িকা প্রথমে জানতে পারে। সাথে এও জানে যে সিফাতের বাবা এখানে ভর্তি করার পর থেকেই নাকি চেষ্টা করছিল। তো এতোদিনে সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু আড়িকা এখন কী করে? প্রবল অভিমানে, অপমানে সে সিফাতকে ফোন করে না, সিফাত ফোন করলেও ধরে না ক’দিন। এরপর যদিও বা ধরে উন্মত্তের মতো ঝগড়া করে সিফাতকে কিছু বলতে না দিয়েই। সিফাতের অনেকগুলো নতুন বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করে সে। সেগুলো দু’একটি করে ছুঁড়ে দিতে দিতে জানায় সে জানতো সিফাত এমনি। এসব ছেলেদেরকে খুব চেনে সে। তারপর হতভম্ভ হয়ে লক্ষ্য করে, সে চিৎকার করলে সিফাতও চিৎকার করে। ড. মুজাম্মেলের মতো কুঁকড়ে যায় না, মাফ চায় না, তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে না এমন কী ‘সরিও’ বলে না। কিছুক্ষণ তুমুল ঝগড়া করে দুজনে তারপর সিফাতই ফোন কেটে দেয়। আড়িকা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে ফোনটা চোখের সামনে ধরে রাখে, তারপর ছুঁড়ে ফেলে কাজের মেয়ের কোল থেকে মেয়েকে নেয় এরপর হাঁটতে থাকে ক্যাম্পাসের দিকে। তার মনে হয় ড. মুজাম্মেলই তাকে ভালবাসে, সে-ই তার আশ্রয়। এখন থেকে সে মন দিয়ে সংসার করবে, স্বামী সেবা করবে। কিন্তু কিছুক্ষণ হাঁটার পর তীব্র বিতৃষ্ণায় তার হাঁটার গতি কমতে থাকে। শ্লথভাবে আরো কিছুক্ষণ হেঁটে সে উল্টো পার্শ্বে ফেরে। চারদিকে তাকিয়ে সব তার পুরোনো আর বিবর্ণ লাগে। তার ইচ্ছে হয় পালিয়ে যেতে এবং তখনই আরো একবার অনুভব করে তার আসলে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
এইচআর/এবিএস