নেশা
আকাশটা কালো হতেই মনটা ভালো হয়ে উঠতে শুরু করলো আমার। বৃষ্টি হবে। হঠাৎ করেই বৃষ্টির জন্য মনটা ছটফট করতে শুরু করলো। আসলে এতোটা বৃষ্টি পাগল আমি ছিলাম না। এখনো না। তবে এই মুহূর্তে মন চাচ্ছে বৃষ্টি নামুক। আকাশ ভেঙে নামুক। বৃষ্টির বড় বড় ফোটা চিমটে চিমটে তুলে নিক মাটির শরীরের মাংস। পুকুর বা খালের পাড় ভেঙে গলে গলে পড়ুক কাদামাটির পানি। অন্ধ করে দেয়া ঘোলা হয়ে যাক পুকুরের পানি। আর মনের সুখে গলা ফুঁলিয়ে গান ধরুক হলদেটে স্বাস্থ্যবান ব্যাঙের দল।
আজ বাড়িতে শুধু আমি। একা। আর কেউ নেই। আমি বাদে ঘরের সবাই একদিনের জন্য বেড়াতে গেছে। আমারও যাওয়ার কথা ছিল। যেতে ইচ্ছে করছিল না। তীব্র অনিচ্ছা। তবে বলতে পারিনি- কেন বেড়াতে যাবো না। অথচ বেড়ানোর কথা উঠলে আমার চেয়ে আর কারো আগ্রহ বেশি ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে কোথাও যেতে ভালো লাগছে না আমার। শুধু ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে রাখার মাঝে সুখ খুঁজে পাচ্ছি। এ এক ভিন্ন রকমের আনন্দ।
ক্লাসের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু একটা বানিয়ে বলতে হলো আমাকে, ‘না থাকলেই নয়। প্রয়োজনে সবার বেড়ানো বাদ দিতে হবে। নতুবা আমাকে রেখেই যেতে হবে।’ আমি জানতাম বেড়াতে যাওয়া বাদ হবে না। অগত্যা আমাকে রেখেই যেতে হলো। আর চোখে-মুখে কষ্টের মিথ্যা ছাপ ফেলে আনন্দে পড়ে রইলাম আমি।
বাড়িতে থাকতে পারার আনন্দ থাকলেও আসলে আনন্দে নেই আমি। বেশ কিছুদিন ধরেই আমার ভেতরের স্বাভাবিক আনন্দ উধাও হয়ে গেছে। এখন আর প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে সরলতার আনন্দ ঘিরে ধরে না আমায়। আগের মতো আর নদীর স্রোতধারার শব্দ, ফুলের উপর প্রজাপতির উড়ে বেড়ানোর অদ্ভুত সৌন্দর্য, কোমল হৃদয়ের ফুটফুটে কোনো শিশুর পবিত্রতায় ছুঁয়ে যাওয়া হাসিমুখ উদ্বেলিত করে না। মনটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। মনের উপর কি তাহলে মরিচার কোন আস্তরণ জমা হচ্ছে ধীরে ধীরে!
খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির মিহিকণা তীব্রবেগে ঘরে ঢুকে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার বিছানার কিছু অংশ। দ্রুত জানালা আটকে ফেললাম। বাইরে বৃষ্টির তীব্রতা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে বাতাসের বেগ। বৃষ্টি আর বাতাস মাখামাখি করে আছড়ে পড়ছে গাছপালা-ঘরবাড়ি ও মাটিতে। একটানা শোঁ শোঁ শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে মাঝে মধ্যে।
কিছুক্ষণ ধরেই আমার মাথার ভেতর কেমন যেন শূন্যতা এসে ভর করছে। মুখের ভেতর জিহ্বার একদম গোড়ার দিকে শুকিয়ে আসছে। কেমন যেন পিপাসা অথচ পানিতে তৃষ্ণা মিটছে না। শরীরের ভেতরে অস্থিরতা এসে ভর করছে। অস্থির হয়ে উঠছে মনও। ওদিকে বৃষ্টির বেগও কিছুটা কমে এসেছে ততক্ষণে।
এমন সময় ঘরের দরজায় দুম দুম শব্দ হতেই সজাগ হয়ে উঠলো মন। দরজার আঘাত সরাসরি মনের দরজা দিয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে আঘাত করলো। দ্রুত গিয়ে দরজা খুলতেই অর্ধভাঙা একটা ছাতা হাতে ভিজে চুপসে যাওয়া একমাত্র প্রিয় বন্ধুটি আমাকে ধাক্কা দিয়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো। অথচ আমার এই বন্ধুটিই এক সময় সবচে’ অপ্রিয় ছিল।
রাগে গজগজ করতে করতে বিছানার পাশে রাখা গামছা দিয়ে মাথা-শরীর মুছতে শুরু করলো। আর আমার যেন তখন তর সইছে না। ওকে তাগাদা দিলাম দ্রুত শরীর থেকে পানি মুছতে। আর আমি গেলাম এনার্জি ড্রিংকসের ক্যানটা আনতে। ইদানিং বৃষ্টিভেজা দিনে এনার্জি ড্রিংকসে অন্যরকম ফিল পাই আমরা।
ওদিকে বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেছে। আকাশও দ্রুত পরিষ্কার হয়ে উঠছে। তবে হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে। বাইরের অবস্থা দেখে এসে দরজা আটকে আমার রুমে এসে বসলাম।
আমার বন্ধুটি সব ব্যবস্থা করে রেখেছে ইতোমধ্যেই। আমি শুধু একটা রঙিন এক টাকার একটি কয়েন বের করলাম মানিব্যাগ থেকে। সাথে দিয়াশলাইয়ের জ্বলন্ত একটা কাঠি। সামনে এক টুকরো কাগজে স্বযত্নে মুড়িয়ে রাখা একটি ট্যাবলেটে আমার হাতের স্পর্শ। পরে আরো কিছু। মনটা ভরে উঠলো অদ্ভুত আনন্দে। যে আনন্দের অনুভূতি প্রকাশযোগ্য নয়। শুধুই উপভোগের!
তবে সমস্যা একটাই। এ ঘোর কেটে যাওয়ার পর অনুশোচনায় ভুগতে থাকি আমি। প্রতিবারই এরকম হয়। আর ভাবতে থাকি- গভীর এক অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমি! আমাকে ফিরে আসতে হবে। অথচ ফিরতে পারছি না! কেউ কি আছেন...?
এসইউ/পিআর