ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথ আমাকেই লিখেছেন

প্রকাশিত: ১১:৫৫ এএম, ৩০ মে ২০১৬

জগতে আনন্দ যজ্ঞে...
এই উদার আত্মীয়তার সুর যার কণ্ঠে, সকল বিশ্ববাসীকে যার এমন উদাস করা ডাক, তিনিই আমার আপনজন, আমার প্রাণের মানুষ-রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রতিভার পরিধি বিপুল, তাঁর পরিচয়ের ব্যাপ্তি আরো বিশাল। তাই তাঁকে আমার বলে দাবি করতে যাওয়া মূঢ়তা। কিন্তু যেখানে তাঁর গান, তাঁর কবিতা আমাকে স্পর্শ করে মনের মাঝখানে, তাঁর সুরে আগুন জ্বলে উঠে প্রাণে; সেখানে আমার দাবি তাঁর চরণ স্পর্শ করে। সেখানে তিনি আমার-একান্তই আমার।

তুমি যে সুরের আগুন...
এখন যদি বলি আমার জন্মের আগেই রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনের বহু কথা লিখে রেখে গেছেন, তবে তা মোটেই বিশ্বাস করবে না কেউ। কিন্তু আমি দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারি তাঁর অনেক গল্পের, উপন্যাসের নায়িকা আমিই; অর্থাৎ আমাকে না দেখে, না চিনে, না জেনেও অগণিত গানে, কবিতায়, গল্পে তিনি আমারই মনজগতের ছবি এঁকেছেন। কাজেই রবীন্দ্রনাথ যদি আমার জীবন-কাহিনি রচনা করে থাকেন তো সেটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আমার আনন্দে তাঁর কাব্য সমুজ্জ্বল, আমার অশ্রুতে তাঁর গান করুণ; তার প্রেমের গানে কায়া পেয়েছে আমারই হৃদয়াবেগ। তাইতো তিনি আমার প্রাণের মানুষ-মনের মানুষ, তিনি আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আমার প্রাণের মানুষ...
যদি মনেই করি সেই ছুটির দিনে যখন বৃষ্টিবাদল শেষে রোদ উঠেছিল, ঝিলমিলিয়ে তখন যে ছোট্ট মেয়েটি বেগুনী রঙের শাড়ি রোদ্দুরে দিচ্ছিল, সেই মেয়েটি কে? সে মেয়েটি কি আমিই? চুপিচুপি বলি- হ্যাঁ, সে মেয়েটি আমিই। দাদার জন্য মেঘে ওড়া পঙ্খীরাজের বাচ্চা দু’টি ঘোড়া আনতে আমিই তো ঘর ছেড়ে নৌকায় চারটে-পাঁচটা পাল তুলে দিয়েছি।

শিশুবয়সে এত এত ঘটনার কল্পনা করেছি আমি। শুধু বিস্ময়ের কথা এই যে রবীন্দ্রনাথ এসব আগেই বলে গিয়েছিলেন। জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়া অবধি ক্রমে ক্রমে তা আবিষ্কার করে বিস্মৃত হয়েছি। ছোট্ট বয়সে যখন তাঁর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিঃসংকোচে বলতাম, ‘আচ্ছা তুমি ক’টা কবিতা লিখেছিলে তা কি জানো?’

সেই থেকে আজ পর্যন্ত একই ভাবে মনের সব কথা মুক্তকণ্ঠে এই ব্যক্তির কাছে বলে যেতে আমার এতটুকু দ্বিধা নেই। ঘুমপাড়ানিয়া গানের পর সহজপাঠের সহজ-সরল ছন্দ- ‘ডেকে বলে ও-ঔ/ভাত আনো বড় বউ’। এর পরেও যখন পড়লাম, ‘একদিন রাতে আমি স্বপ্নে দেখিনু’ তখন স্ফূর্তি আর দেখে কে? রোজ ঘুমাবার আগে বলতুম যদি এমন স্বপ্ন দেখতে পারি! তখন উপহারে পেলাম ‘ছোটবেলা’। সেই প্রথম সাহিত্যের অনাস্বাদিত অপূর্ব আস্বাদ। আর একটি গান সেই সেদিন থেকে আজো আমার বীজমন্ত্র হয়ে আমাকে বার বার আত্ম-অবমাননা থেকে রক্ষা করে আসছে।

বিপদে যেন করি না ভয়...
মনের বিকাশে, প্রাণের স্মরণে জীবনের প্রতিটি ধাপে দেখা গেছে রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, গল্প। এমন কখনো হয়নি যখন পাইনি তাঁর দেখা। কী অসীম তৃষ্ণা তিনি জাগিয়ে দিয়েছিলেন সেই কবে, আজ পর্যন্ত সেই তৃষ্ণা নিবারণ হয়নি। ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাঁজাও ব্যাকুল বাঁশরি।

আমি চঞ্চল হে...
একদিন তিনি আমার কিশোর মনের প্রাঙ্গণে এই বাঁশিটি বাজিয়ে গিয়েছিলেন আর সেই থেকে কোন অজানার সন্ধানে আমি ব্যাকুল হয়ে ঘুরছি। কী চাই, আমি নিজেই জানি না। যা চেয়েছি, তা পাইনি; যা পেয়েছি, তা চাইনি। তবুও অত্যাশ্চর্য এ মোহ...। জীবনের সব বঞ্চনাকে উপেক্ষা করেও জীবনকে ভালবাসার শক্তি তিনিই আমাকে দিয়েছেন। জীবনকে হয়ত এতখানি ভালোই বাসতুম না, যদি না আমার কম্পিত কৈশোরে তাঁর পায়ের চিহ্ন না পড়তো।

কি পাইনে তারি...
তিনি আমায় না দেখে চিনেছেন, না চিনেও জেনেছেন। নইলে আমার মনের কথা তাঁর লেখনীর ভাষা পেল কীভাবে? এমন নিবিড়, অন্তরঙ্গ-একান্তভাবে কেউ আমায় জানে না। তিনিই আমার নির্জন দিনের, নিঃসঙ্গ মুহূর্তের একমাত্র সাথী। তাই তিনি আমার জীবন-মরণ সীমানা ছাড়ানো বন্ধু। জানতেও পারিনি কখন নিজের মনেই এই ধারণা উঠেছে যে রবীন্দ্রনাথের মহান জীবনস্রোতের মাঝে আমিও একটি অবিচ্ছেদ্য আবর্ত। আমার এ বিশ্বাস স্থির।

শৈশবকাল থেকেই আজ পর্যন্ত তিনিই আমায় গান শুনিয়েছেন। আমায় মাধুর্য্য আর সারল্যে ভরে দিয়েছেন ছোট্ট মিনির কচি মুখের অনর্গল কথায়; আমাকে রূপ দিয়েছেন সাধারণ মেয়ের ছত্রে-ছত্রে; চারুলতার একাকীত্বে আমারই দ্বীর্ঘশ্বাস। বিমলার যৌবনে জ্বলেছে আমারই প্রতিচ্ছবি। এত যিনি আমার আপন, এত নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ যিনি, তিনি কি আমার পরমধন না হয়ে পারেন? না। প্রভু আমার প্রিয় আমার...।

কে বলেন কবিগুরু অনন্ত ওপারে...
তাঁকে জানা যায় না, বোঝা যায় না। যখনই তাকে জানতে চেয়েছি বা বুঝতে চেয়েছি; তখনই তিনি ধরা দিয়েছেন তাঁর কবিতায়, গানে। পৃথিবীর কে কী ভাবেন, সমোলোচকরা কী বলেন, তাত্ত্বিকরা কী বোঝেন আর গবেষকরা কী লেখেন, তা নিয়ে তাঁরাই সন্তুষ্ট থাকুন। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি নিজে কী পেয়েছি শুধু এতটুকুই বলার অধিকার আমার আছে। তার জোরেই বলতে শিখেছি যে- তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম...।

লেখক: কবি ও কথাশিল্পী

এসইউ/আরআইপি

আরও পড়ুন