মোস্তফা কামালের উপন্যাসের শিল্পিত বয়ান
কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামালের জন্মদিন আজ ৩০ মে। দিনটি উপলক্ষে কোনো ধরনের উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন এখনো প্রচলিত হয়নি। অথচ তিনি ৮৬টি গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর ‘জননী’(২০১৪) উপন্যাসটি ইতোমধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ২০১১ সালে তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জনক জননীর গল্প’ প্রকাশিত হয়। এসব গ্রন্থের আগেও তিনি ‘সিরিয়াস’ ধারার উপন্যাস রচনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার মধ্যে ‘বারুদ পোড়া সন্ধ্যা’(২০০৫), ‘হ্যালো কর্নেল’(২০১০) পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
এরপর তিনি লিখেছেন ‘জিনাত সুন্দরী ও মন্ত্রী কাহিনী’(২০১২), ‘কবি ও একজন নর্তকী’(২০১৩) প্রভৃতি উপন্যাসের বাস্তবধর্মী কাহিনী। চলতি বছর (২০১৬) প্রকাশিত ‘পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি’ এবং গত বছরের (২০১৫) ‘চাঁদের আলোয় রাগিব আলী এবং সে’- মোস্তফা কামালের সিরিয়াস ধারার আরো দুটি সৃষ্টিকর্ম। সিরিয়াস উপন্যাস রচনা সম্পর্কে তাঁর অভিমত হলো- ‘একজন লেখক পরিকল্পনা ছাড়া এগিয়ে যেতে পারেন না। ঈদ সংখ্যাকেন্দ্রিক একটা প্রস্তুতি থাকে, বইমেলা কেন্দ্রিক কিংবা সিরিয়াস কাজ করার একটা প্রস্তুতি সারা বছরই থাকে। সিরিয়াস কাজ প্রতিবছর সম্ভব হয় না। যেমন ‘‘জননী’’ উপন্যাসটি লিখতে আমার দীর্ঘ সময় লেগেছে। দেশ-বিদেশের অনেক উপন্যাস ও প্রাসঙ্গিক লেখা তার জন্য পড়তে হয়েছে। বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের জননী বা ‘মা’ শিরোনামের উপন্যাসগুলো মাথায় রাখতে হয়েছিল। এছাড়া বর্তমান শতাব্দীর বইগুলো পড়ে আমার মধ্যে উপলব্ধি হয়েছিল এ বিষয়ে লেখা যেতে পারে। সিরিয়াস কাজ করার ক্ষেত্রে এভাবে আমাকে প্রস্তুতি নিতে হয়।’
২.
মুক্তিযুদ্ধের শতাধিক উপন্যাসের মধ্যে ব্যতিক্রম ‘জনক জননীর গল্প’ (২০১১); বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধার জীবনের নতুন আখ্যান। উপন্যাসে বিবৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং অপর একটি রাজাকার চরিত্র বাস্তব ইতিহাস থেকে গৃহীত। আখ্যানে বিন্যস্ত ঘটনাধারা যুদ্ধের পটভূমি থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রসারিত হয়েছে। উপন্যাসে সমান্তরালভাবে দুটি চরিত্রের পরিণতি অঙ্কিত। আখ্যানের শেষে চরিত্র দুটির মৃত্যু দেখতে পাই আমরা। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। তাদের পরিচয়ও ভিন্ন। প্রথমে রাজাকার সলিমুল্লাহ চৌধুরী নিহত হয়েছে; তবে তার সমাধি হয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। আর কাহিনীর শেষে ক্লাইম্যাক্স অপেক্ষা করছিল পাঠকের জন্য আর তা হলো, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আবু সোলায়মান মারা গেলে থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জানান, ‘তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা রয়েছে তাতে তাঁর নাম নেই।’ এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রশাসনিকভাবে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়নি। তবে তাঁরই সহযোদ্ধারা তাঁকে মর্যাদা দিয়েছেন।
মূল চরিত্রের যাত্রাপথে ঔপন্যাসিক কৌশলে আখ্যানাংশে সংযুক্ত করে দিয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস। ষাটের দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশের ইতিহাসের মূল ঘটনাগুলো কখনো সোলায়মানের দৃষ্টিকোণে কখনো বা সলিমুল্লাহর পরিণতি ব্যাখ্যায় প্রযুক্ত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা এক জনক অবিরাম সংগ্রাম করে চলেন নিজের সংসার ও জননীরূপ দেশমাতৃকার জন্য। আর তাঁর স্ত্রী আলেয়া বেগম বাঙালির সর্বংসহা মায়ের মতো আগলে রাখেন হতাশাক্লিষ্ট সংসারটিকে। শেষ পর্যন্ত পাশে থাকেন তাঁর। ফলে উপন্যাসটি জনক জননীর গল্প হয়ে ওঠে। মোস্তফা কামালের ‘জনক জননীর গল্প’ উপন্যাসের আখ্যান বর্তমান বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্নতার মধ্য দিয়ে উপেক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার হচ্ছে।
৩.
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শওকত ওসমানের ‘জননী’ উপন্যাসের সূত্র ধরে বলা যায় মোস্তফা কামালের ‘জননী’তে(২০১৪) মধ্যবিত্ত এক মমতাময়ী মা’র জীবনালেখ্য স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত হয়েছে। সানজিদা বেগম উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। কেবল সানজিদা বেগমের সংসার এবং সন্তানের কাহিনী নয় তিন প্রজন্মের বেড়ে ওঠা সময়ের ছবি রয়েছে মোস্তফা কামালের এই আখ্যানে। ঔপন্যাসিক জননীর সংগ্রাম ও স্নেহময় চরিত্রের পাশে তুলে ধরেছেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে চাল ও লবণের সংকট ছয় সদস্যের এই পরিবারটির ওপর যে অভিঘাত ফেলেছিল তাও বর্ণিত হয়েছে। বিপদের সময় নিকট আত্মীয়দের দ্বারা প্রতারিত হওয়া এবং সেই কষ্ট জয় করে এগিয়ে যাওয়ার মনোবল চিত্রিত হয়েছে জননীর চরিত্রে। উপন্যাসে বিধৃত জননীর আত্মত্যাগ আর সেই অশ্রুপ্লুত দৃশ্যগুলো একটানা পড়ে শেষ করা সহজ কিন্তু বেদনার গভীরতা প্রত্যেককে স্পর্শ করতে বাধ্য।
৪.
মোস্তফা কামাল সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে একাধিক উপন্যাস রচনা করেছেন। তার মধ্যে স্থান-কালের বিন্যাসে বৈচিত্র্যময় আখ্যানের শৈল্পিক উপস্থাপনা হচ্ছে ‘হ্যালো কর্নেল’ (২০১০)। উপন্যাসটি দেশ এবং বিশ্বের বর্তমান জঙ্গিবিরোধী-পরিস্থিতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সৃষ্টিকর্ম। বাংলাদেশের সাহিত্যে এ ধরনের উপন্যাস আগে রচিত হয়নি। এই উপন্যাসের কাহিনী পাকিস্তানের জঙ্গি তৎপরতা ও আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তালেবানদের আক্রমণ সব মিলিয়ে সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক। ২০০৪ সালে মোস্তফা কামাল পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ছাড়া অন্য সব অঞ্চল প্রায় এক মাস চষে বেড়িয়েছিলেন। এরপর আরো দু’দফায় তিনি সেখানে যাবার সুযোগ পান। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দেখতে পান সেখানকার সমাজে কীভাবে জঙ্গিবাদ শিকড় গেড়ে বসেছে। জঙ্গিবাদের বাস্তবতা নিয়ে মোস্তফা কামালের ‘হ্যালো কর্নেল’-এ যুদ্ধ ও প্রেম একীভূত। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা উপন্যাসের কাহিনীর ফ্রেমে ধারণ করেছেন তিনি; দেখিয়েছেন এক জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতা রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে।
৫.
কেবল বিষয়বস্তুর দিক থেকে নয় মোস্তফা কামাল আখ্যান সৃজনে আধুনিক শিল্পপদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তাঁর কথাসাহিত্যে ম্যাজিক রিয়ালিটির পরিচয় পাওয়া যায়। ‘চাঁদের আলোয় রাগিব আলী এবং সে’(২০১৫) উপন্যাসে ম্যাজিক রিয়ালিজম এসেছে বাস্তব থেকে স্বপ্ন এবং স্বপ্ন থেকে বাস্তবের আখ্যানের মধ্য দিয়ে। স্বপ্ন অনেক ক্ষেত্রে সত্য ঘটনা হয়ে উঠেছে। কারণ ম্যাজিক রিয়ালিজম আসলে বাস্তবকে দেখার এক বহুমাত্রিক এবং সামগ্রিক পদ্ধতি। সেই কাজটিই করেছেন মোস্তফা কামাল। তিনি রোজকার জীবনে চমক তৈরি করেছেন; রাগিব আলীর কাহিনিতে মানুষের বিস্ময়কে তুলে ধরেছেন।
৬.
নারী চরিত্র রূপায়ণে মোস্তফা কামালের সহানুভূতি, আন্তরিকতা অসামান্য। বাস্তবতার নিরিখে পিছিয়ে পড়াদের সক্ষমতার জায়গাটি তৈরি করার কৃতিত্বও রয়েছে তাঁর। তাঁর জীবন-অভিধানে হতাশা শব্দটি নেই। তিনি স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে অদম্য চেষ্টা করেন। এ কারণেই হয়তো তিনি সাফল্য পাচ্ছেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। তাঁর পেশা সাংবাদিকতা আর নেশা লেখালেখি। ২৫ বছর ধরে তিনি নিয়মিত লিখছেন। সাংবাদিকতা ও লেখালেখি উভয় ক্ষেত্রেই তিনি সমান খ্যাতি অর্জন করেছেন।
‘পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি’ (২০১৬) একজন নারীর প্রত্যাশা, অচরিতার্থতা, যন্ত্রণা, সংগ্রামশীলতা তথা অস্তিত্বের সামগ্রিক আকাঙ্খার রূপায়ণে বিশিষ্ট। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘জননী’তে বড় ক্যানভাসে গ্রাম এবং শহরের ভূগোলকে কেন্দ্র করে মধ্যবিত্ত এক মমতাময়ী মা’র জীবনালেখ্য উপস্থাপিত হয়েছে। সানজিদা বেগম ওই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ‘জননী’ বিপুল সংখ্যক পাঠককে বিমোহিত করেছে। গত বছর মোস্তফা কামাল রচনা করেন ‘রুবীর কালো চশমা’(২০১৫)। সেই উপন্যাসে রুবীর ব্যক্তিমানুষের অতল গহীনে ডুব দিয়ে একজন নারীর যন্ত্রণা, কষ্ট, ভয়, হতাশা, সংশয়, সাহসিকতাকে পরিস্ফুট করেছেন তিনি।
অন্যদিকে নর-নারী সম্পর্কের বিচিত্র রূপ ও স্বরূপ তার সমাজ কাঠামোর বিচিত্র মাত্রা মোস্তফা কামালের ‘পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি’ উপন্যাসের মৌল প্রতিপাদ্য। মধ্যবিত্ত সমাজের সামগ্রিক চিত্রটি পারমিতার জীবনকে কেন্দ্র করে উন্মোচিত হয়েছে। একজন নারী পারমিতার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের যে বাস্তবতা তা যে কোনো স্তরের পাঠককে নাড়া দিবে। এদেশের মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিন্যাস নারী-পুরুষের সম্পর্ককেও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। ‘পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি’ উপন্যাসটি পড়লে সে সত্য সম্যক উপলব্ধি করা সম্ভব।
৭.
মোস্তফা কামাল নাগরিক জীবনের পারিবারিক সংকটকে ব্যক্তির বহুমাত্রিক চেতনার সংস্পর্শে দৃশ্যমান করেছেন। ব্যক্তি তো শুধু গণ্ডিবদ্ধ পরিবারের সংকটের চূড়ান্তসীমায় ক্ষয়ে গিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। সচেতন শিক্ষিত নাগরিক জীবনযন্ত্রণার মূলে থাকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাস্রোত। মোস্তফা কামাল এসব প্রসঙ্গ সংবাদপত্রের কলামে উপস্থাপন করেন প্রতিনিয়ত, একইভাবে কখনো কখনো সযত্নে তা উপস্থাপন করেন মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের অবয়বে। তবে তিনি অনাবশ্যক বিবরণ ও একঘেঁয়েমী কাহিনিসূত্র পরিহার করে নাগরিক কিংবা গ্রামীণ পটভূমির জীবনদগ্ধ উপন্যাস উপহার দিতে পেরেছেন, যার মূল সুর ইতিবাচক। এই ইতিবাচক জীবনদৃষ্টি ও সাবলীল গদ্যে শিল্পসম্মত কাহিনি বর্ণনার কারণে তাঁর অধিকাংশ উপন্যাস জনপ্রিয় হয়েছে।
৮.
বস্তুত মোস্তফা কামাল একজন নিবেদিত প্রাণ সাহিত্যকর্মী। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রতিদিন লিখি। যতটুকু পারি, লেখার জন্য নির্দিষ্ট সময় থাকে। সকালে বা যেকোনো সময় অফিস টাইমের বাইরে লেখা শেষ করি। পাশাপাশি আমি প্রতিদিন পড়ি। পড়ার অভ্যাস আমার বহু পুরোনো। প্রতিদিন পড়া আর লেখা নিয়ে আমি থাকি।’
প্রতিদিন লেখাপড়ায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে সাহিত্য সৃষ্টির শ্রমসাধ্য ধারা অক্ষুণ্ণ রাখা সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য। তিনি নিরন্তর চেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের সেবা করে যাচ্ছেন। সিরিয়াস ধারার এই জনপ্রিয় ও সফল কথাসাহিত্যিকের সৃজনকর্ম বহুমাত্রিক এবং জ্ঞানের সকল দিগন্তকে স্পর্শ করেছে। তাঁর সৃজনকর্ম আমৃত্যু সক্রিয় থাকুক জন্মদিনে এই প্রত্যাশা আমাদের।
এইচআর/আরআইপি