কামরুল হাসান: তুলির আঁচড়ে বিদ্রোহী শিল্পীসত্তা

ফারজানা অনন্যা
বাংলা চিত্রশিল্পের ধারায় একটি জনপ্রিয় কনসেপ্ট হলো ‘বিদ্রোহ’। শিল্প-সংস্কৃতির এই সূক্ষ্ম শাখাটি বাঙালি জাতির দুর্বিনীত মনোভাবের মতোই বারবার বিদ্রোহের রঙে স্নাত হয়েছে। আর রাঙানোর সে কাজটি করেছেন সময়, সমাজ ও রাজনীতি সচেতন বিদ্রোহী চিত্রশিল্পীরা। জয়নুল আবেদিনের ‘বিদ্রোহী’ (১৯৫১), এস এম সুলতানের ‘চরদখল’ (১৯৭৬), কামরুল হাসানের ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ (১৯৭১) প্রভৃতি সাম্প্রতিক বাংলা চিত্রকলার ধারায় যে রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার সচেতনতার চিহ্ন এঁকে দিয়েছে; তা বাঙালির জন্য ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী চেতনার মতোই সমান গুরুত্ব বহন করে বলে আমার ধারণা।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বাংলা চিত্রকলায় বিদ্রোহী শিল্পীদের তালিকার প্রথম দিকে যে নামগুলো থাকবে, তার মধ্যে অগ্রগণ্য কামরুল হাসান (১৯২১-১৯৮৮)। বিদ্রোহ ছিল তাঁর মননে, মগজে। সমাজের খেটে খাওয়া ব্রাত্যজনদের নিয়ে যে চিত্রশিল্পে একটি নতুন ধারা গড়ে বেঁচে থাকা যায়; সে সাধনায় সফল শিক্ষক চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান। রাজনৈতিক সচেতনতা পটুয়া কামরুল হাসানকে দিয়েছিল এক বিশেষ ব্যক্তিত্ববোধ। তাঁর অঙ্কিত চিত্রকলা ষাটের দশকে বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জনসাধারণকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছে।
শৈশব থেকেই বিদ্রোহী স্বভাব ও ছবি আঁকার প্রতিকূল পরিবেশ নিয়ে বড় হতে হয়েছে কামরুল হাসানকে। পরিবারের সাথে বিদ্রোহ করেই ১৯৮৩ সালে ভর্তি হন কলকাতা আর্ট স্কুলে। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবার হওয়ায় ছবি আকার ক্ষেত্রেও নানা জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন। হয়তো এ কারণেই বৈরীতা ও বিদ্রোহের রেশ থেকে গেছে তাঁর শিল্পীসত্তায়। কামরুল হাসানের বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ (১৯৭১), ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’ (১৯৮৮), ‘তিনকন্যা’, ‘নাইওর’ (১৯৭৫), ‘উঁকি’ (১৯৬৭), ‘স্নান’ (১৯৬৬) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
কামরুল হাসানের এসব চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক সচেতনতা, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে নির্ভীক প্রতিবাদী মানসিকতা, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সমাজ সচেতনতাই প্রকাশিত হয়েছে। কামরুল হাসানের চিত্রকলার প্রধান উপাদান নর-নারী, পশু-পাখি ও প্রকৃতি। প্রতীক-রূপকের মধ্য দিয়ে তিনি আবহমান বাংলার গ্রামীণ সমাজের সামগ্রিক রূপ, বাংলার নিসর্গ, স্বৈরশাসকদের অত্যাচার, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চিত্র চমৎকারভাবে তুলে ধরেন।
সময়ের প্রয়োজনে যিনি জানোয়ারদের আসল রূপ উন্মোচন করতে পারেন; তিনিই তো প্রকৃত শিল্পী। ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়ার দানবমূর্তি সম্বলিত পোস্টার এঁকে কামরুল হাসান বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ‘১৯৭০ সালের দিকে ঢাকা জাদুঘরে কোনো এক অনুষ্ঠানে তিনি প্রথম ইয়াহিয়া খানকে সামনাসামনি দেখেন। প্রথম দেখাতেই ইয়াহিয়াকে তাঁর কাছে ডেভিলের মতো মনে হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসেই পোস্টারের জন্য তিনি ইয়াহিয়ার অনেকগুলো স্কেচ করেন। ওইসব স্কেচ সম্বলিত অন্তত দশটি পোস্টার ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তারিখে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাঁটা হয়েছিল। সেই পোস্টারে লেখা ছিল, ‘এই জানোয়ারটা আবার আক্রমণ করতে পারে’। তারপর এ দেশে ইতিহাসে বর্বরতম কালরাত এসেছে। ২৫ মার্চের পর ছবিটা আবারও ফিরে এসেছে, তবে এবার নিচের লেখাটা বদলে গেছে। আগে লেখা ছিল ‘এই জানোয়ারটা আবার আক্রমণ করতে পারে’। পরে সেটা হয়েছে ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’।’ (Annihilate the demos)
বিজ্ঞাপন
সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ পোস্টারটি বিদ্রোহের স্ফূলিঙ্গের মতো সম্পৃক্ত হয়ে আছে। কার্টুনটি হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ ও শাণিত হাতিয়ার। ছবিটি সম্পর্কে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের দানবসদৃশ প্রতিকৃতি-সম্বলিত পোস্টারটি আঁকার ভেতর শিল্পীর রূপকল্পনার গভীরতা ছিল, কলম ও তুলির দক্ষ আঁচড় ছিল, কিন্তু সবচেয়ে বড় ছিল শত্রুর প্রতি তাঁর গভীরতম ঘৃণা ও ক্রোধ, যা তিনি প্রতিটি দর্শকের ভেতর সঞ্চার করতে পেরেছিলেন। ...এ যাবৎকাল যুদ্ধের যতো পোস্টার আমরা দেখেছি এতটা ঘৃণাসঞ্চারী এবং ক্রোধ উদ্রেককারী দ্বিতীয়টি দেখিনি।’
১৯৭১ সালে ভারতে প্রবাসী সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘আর্ট ও ডিজাইন’ বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় কামরুল হাসানকে। এ বিভাগের অফিস ছিল কলকাতার সার্কুলার রোডে। এখানে কামরুল হাসানের নেতৃত্বে কাজ করেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুণ্ডু, প্রাণেশ মণ্ডল, জহির আহমদ, হাসান প্রমুখ। এই শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রচনা করেন একাধিক পোস্টার। এসব পোস্টারের মাধ্যমে পাকবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে যেমন তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়; তেমনই মুক্তিযোদ্ধাদের মনে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধের উৎসাহ ও উদ্দীপনাও সৃষ্টি হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে কামরুল হাসান কমিউনিস্ট পার্টির তৎপরতা ও কার্যক্রমের প্রতিও আগ্রহী ছিলেন। এদের সাফল্যও তাঁর কাম্য ছিল। মাহমুদ আল জামান (‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসানতের ছদ্মনাম) কামরুল হাসান সম্পর্কে স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘সেই সময়ে জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতি গভীর আস্থা থাকা সত্ত্বেও বামপন্থী ছাত্র-যুবকদের জন্য তার হৃদয়মনে আলাদা আসন ছিল। বামপন্থীদের আন্তরিকতায় তাঁর বিশ্বাস ছিল।’
বিজ্ঞাপন
কামরুল হাসানের আরেকটি মুক্তিকামী ছবি ‘উঁকি’ (১৯৬৭)। এটি রাজনৈতিক বিভাজনে সৃষ্ট দেশভাগের অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার প্রতীকায়িত একটি চিত্রকর্ম। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে সৃষ্ট অসহায়ত্ব কিংবা বন্দিত্বের সুস্পষ্ট প্রভাব ছবিটিতে। যে মুক্তির আশা মানুষ দেখেছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, সে মুক্তি তখনো পায়নি মানুষ। একটা মেয়ে, অল্প বয়সী কিশোরী। সে মাটির ঘরের বাঁশের জানালাটা খুলে উঁকি দিচ্ছে বাইরে। বাইরের জগতকে দেখতে চাইছে। চোখে তার রাজ্যের কৌতূহল; কিন্তু সেই সঙ্গে ভয়ও। সেটা বোঝা যায় মাথার ওপর আঁচল টেনে দেওয়া দেখে। কথা ছিল এ মেয়ে মাঠে গিয়ে খেলবে, অন্যদের সঙ্গে মিলে নাচবে, গাইবে। তালে তালে দেবে তালি। কিন্তু সে বন্দি হয়ে আছে, ঘরে। ঘরের ভেতরে পানির কলস আছে একটা, রয়েছে ধানের মটকিও। তারা নিশ্চিন্তে রয়েছে। মেয়েটি নেই। মেয়েটি চঞ্চল, সেজন্য জীবন্ত এবং সে জন্যই এই ঘর তার জন্য কারাগারবিশেষ। বাইরে যেতে নিষেধ। কার নিষেধ? অবশ্যই শত্রুদের। এই শুত্রুরা পশুবিশেষ! এই শত্রুরা বিভাজনে বিশ্বাসী।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো, কিন্তু মানুষ মুক্তি পেলো না। বন্ধ হলো না কামরুল হাসানের সংগ্রামও। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর আশাভঙ্গের যে সুর বেজেছিল তাঁর হৃদয়ে, তা জেঁকে ধরলো ১৯৭১ পরবর্তী সময়েও। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কামরুল হাসান দেশের মাটিতে ‘ব্রতচারী’ আন্দোলনের আদর্শ প্রসারের লক্ষ্যে সচেষ্ট হন। তাঁর হাত ধরেই ব্রতচারী আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৩ সালে তিনি (গুরুসদয় কর্তৃক প্রণীত ব্রতচারী নীতি আদর্শ সংক্রান্ত পুস্তক) ‘ব্রতচারী সখা’ গ্রন্থটি সংক্ষিপ্ত আকারে ভূমিকাসহ প্রকাশ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর এসব প্রয়াস আর অগ্রসর হতে পারেনি। কামরুল হাসান দুঃখ করে বলেছেন, ‘ওঁর মৃত্যুর পর তো সম্পূর্ণ বাঙালী বাংলাদেশী হয়ে গেলো।’
১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতীয় কবিতা উৎসবে সভাপতিত্ব করছিলেন কামরুল হাসান। সে সভাতে আবারও তাঁর বিদ্রোহের ছাপ রাখেন তিনি। ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’ শীর্ষক ব্যঙ্গচিত্রটি আঁকেন সেখানে। একজন প্রতিবাদী, সাহসী, সৎ ও বিবেকবান শিল্পী হিসেবে তাঁর চিত্রকর্মটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে ব্যঙ্গ করেই জনসম্মুখে স্কেচটি সম্পন্ন করেন। নির্ভীক বিদ্রোহী অবস্থাতে সেদিন সেখানেই আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তবে মরে গিয়েও বিদ্রোহ ছাড়েননি তিনি। তাঁর সৃষ্টি আজও মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে। আজও মানুষ চেষ্টা করে সেই কিশোরীকে মুক্ত করতে; যে উঁকি দিয়ে দেখছে, দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে কি না।
বিজ্ঞাপন
চিত্রকলায় অসাধারণ অবদানের জন্য কামরুল হাসান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। সেসবের মধ্যে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৫), কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৭৯), চারুশিল্পী সংসদ সম্মান (১৯৮৪), বাংলা একাডেমির ফেলো (১৯৮৫) এবং কাজী মাহবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৫) উল্লেখযোগ্য।
কামরুল হাসান ১৯৭২ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে শিবনারায়ণ দাস কর্তৃক ডিজাইনকৃত জাতীয় পতাকার বর্তমান রূপ দেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক, বিমান বাংলাদেশের লোগোসহ প্রায় চার হাজারের মতো কাজ নিজ হাতে করেছেন তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাস যতদিন থাকবে; ততদিনই এদেশের মানুষের স্মরণ করতে হবে কামরুল হাসানের মতো সময়ের আগে হাঁটা কালোত্তীর্ণ শিল্প ব্যক্তিত্বকে।
কামরুল হাসান চিত্রভাষায় জীবনকে শুধু শিল্পিত করার কাজই করেননি, তিনি জীবনের বলিষ্ঠ রূপকারও ছিলেন। জীবনকে সুন্দর করতে হলে আগে বাঁচতে হবে এই সত্যকে ধারণ করে অত্যাচারের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিল্পী কামরুল হাসানের তুলি ছিল এক অমোঘ ও লক্ষ্যভেদী হাতিয়ার। তাঁর এই হাতিয়ার শত্রুর হৃদয়ে সৃষ্টি করতো আতঙ্ক। সংগ্রামী মানুষকে দিতো মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেরণা।
বিজ্ঞাপন
সুন্দরভাবে বাঁচার লক্ষ্যে একটি জাতির আকাঙ্ক্ষাকে ফুলের মতো বিকশিত করার জন্য শিল্পকে তিনি প্রহরণ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে তিনি অনন্য, অসাধারণ ও অনতিক্রম্য শিল্পব্যক্তিত্ব।
তথ্যসূত্র
১. কামরুল হাসানের রাজনৈতিক পরিচয়, শাহরিয়ার কবির, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ৩য় বর্ষ ৩য় সংখ্যা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৮৫, পৃষ্ঠা- ৭৭, ৮০
২. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা- ৭৬-৭৭
৩. শিল্পী কামরুল হাসান, মাহমুদ আল জামান, দৈনিক সংবাদ, ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১, পৃষ্ঠা- ৭
৪. কামরুল হাসান: জীবন ও কর্ম, সৈয়দ আজিজুল হক, বাংলা একাডেমি, জুন ১৯৯৮, পৃষ্ঠা- ১৪৯
লেখক: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি।
বিজ্ঞাপন
এসইউ/এএসএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন