ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মুকিদ চৌধুরীর নাট্যোপন্যাস

গোমতীর উপাখ্যান: শেষ পর্ব

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:১৭ পিএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

গোমতীর স্রোত: কত রং

চোখের পর্দায় একটি অদৃশ্য নারী-মুখ
কুয়াশা এগিয়ে আসছে, এক্ষুনি নদীর সঙ্গে শুরু হবে রতি
মানুষটির পায়ের নিচে যে ভূমি, সেখানে গুঁড়ো গুঁড়ো নক্ষত্র-কণা

যুবা বয়স থেকেই অক্ষয় দাস ও রমেশ চক্রবর্তীর সম্পর্ক জটিল হয়ে এসেছিল। যোগাযোগও ভালো ছিল না। গ্রহদোষ হয়তো-বা। এক-এক সময় তাদের নষ্ট সম্পর্কটা ভীষণ খারাপ হয়ে উঠতো। তাই হয়তো উভয়ই চেয়েছিলেন পার্থ-চন্দ্রার বন্ধনের মাধ্যমে এক ধরনের সাঁকো তৈরি করা। কিন্তু পার্থের অন্যত্র সম্পর্ক রয়েছে তা শোনার পর রমেশ চক্রবর্তীর মনে অক্ষয় দাসের ওপর আবার নূতন করে বিরাগ সৃষ্টি হলো। এই সংবাদটি তার মনে একটা বড় ঘা দিলো। অন্তরে ক্ষত সৃষ্টি করল। ভাবনা কি যুক্তি মেনে চলে সব সময়? তার মন এখন বাস্তবিক কোন্ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন তা সঠিকভাবে বলতে পারছেন না অক্ষয় দাস। তিনি রমেশ চক্রবর্তীর বৈঠকখানায় বসে এ কথাই ভেবে চলেছেন। রমেশ চক্রবর্তীর ওপর দৃষ্টি যেতেই তিনি দেখলেন যে, তার চোখে-মুখে তীব্র বিরক্তিরেখা ভেসে উঠেছে। তারপরও অক্ষয় দাস কোনোরকম বিরাগবশত কিংবা সন্দেহবশে কিছুই বলতে চাইছেন না। মুহূর্তের দ্বিধা যেন। কারণে-অকারণে এরই মধ্যে কয়েকবার অক্ষয় দাসের ওপর রমেশ চক্রবর্তী ভীষণ বিরক্তও হয়েছেন।

অক্ষয় দাস বললেন, বয়সের দোষ। এক-এক বয়সে এক-এক রকম দোষ থাকে রমেশ চক্রবর্তী। যৌবনকালে ছেলেরা একটু-আধটু প্রেম-ট্রেম করে থাকেই। সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু লাগে হয়তো। তবে তা ছেলেদের চরিত্র সম্বন্ধে কিছুই প্রমাণ করে না। তাছাড়া পার্থ তো সেই মেয়েটিকে বিয়ে করেনি।
রমেশ চক্রবর্তী হঠাৎ বলে উঠলেন, ওখানে বিয়ে হয়নি বলে কি এখন আমার মেয়েকে ওর কাছে গচ্ছিত করতে হবে? আমি আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারি না।
অক্ষয় দাস একটি ফিকে হাসি ঠোঁটে ধারণ করে বললেন, আপনি আমার কথাটা অন্যভাবে ধরলেন। আমি শুধু বলতে চেয়েছি, আপনিই আমাকে কথা দিয়েছিলেন চন্দ্রার সঙ্গে পার্থের বিয়ে দেবেন।
রমেশ চক্রবর্তী ক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন: না, তা আর সম্ভব নয়। আপনার পুত্রের অন্য এক নারীর সঙ্গে নিভৃত সম্পর্ক আছে, এ কথা শোনার পর বিরাট অভিমানে যে-মেয়েটির শরীর-মন পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছিল, তারপর সেই অবস্থা থেকে যখন আবার ধীরে ধীরে নতুনভাবে সতেজ হচ্ছে, তখন তাকে আমি জল্লাদের কাছে পাঠাতে পারি না। আপনাদের ওপর আমি কোনো বিদ্বেষ পুষে রাখিনি, তাই অনুরোধ—আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আমার মেয়েকে আর জড়াতে চাই না।
অক্ষয় দাস থতমত খেয়ে গেলেন, তারপর ঠোঁট কামড়ে তিক্ত স্বরে বললেন: প্রতিজ্ঞা আপনাকে রক্ষা করতেই হবে।
মাথা নেড়ে রমেশ চক্রবর্তী বললেন: আমি জানি, কথা দিলে তা রক্ষা করতে হয়। তা বেদবাক্য। কিন্তু মিথ্যা দিয়ে সত্যকে গোপন... না, না, আমি এই বিয়েতে রাজি নই। ধরে নেন এই আমার অক্ষমতা।
মাথায় রক্ত উঠে গেল অক্ষয় দাসের, তিনি উত্তেজিত ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন: আপনার ক্ষমতা, অক্ষমতা সম্বন্ধে আমি অবগত। তবে আমি এত সহজে আমার পরিবারকে অপমানিত হতে দিতে পারি না।
আপনার পরিবারকে কে অপমান করল? এই জীবনে ভাগ্যে যা ছিল তা-ই হয়েছে।
কর্কশ ও রুক্ষ কণ্ঠে বললেন অক্ষয় দাস: আমি অতশত বুঝি না।
কেন বুঝবেন না! সকলেই বোঝে, তবুও উলটো পথে হাঁটে।
উলটো পথে নয় বরং এই সংসারে থেমে থাকার উপায় নেই। বয়ে চলতে হয়। কখনো গ্রীষ্মের নদী হয়ে, কখনো-বা ভয়ংকর বর্ষার নদী হয়ে, কখনো কখনো শরৎকালের শান্ত নদী হয়ে। শীতের নদী তো দেখেছেন, কত রং তার; ঠিক আপনারই মতো।
রমেশ চক্রবর্তী খুব অবাক হলেন। চমক খেলেন। বললেন: আমার মতো কত রঙের মানুষের মতের সঙ্গে আপনার যখন মত অমিল, তাহলে কী করবেন?
অক্ষয় দাসের পায়ের তলা থেকে যেন হঠাৎ মাটি সরে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো; তিনি বিমূঢ়, বিহ্বল; তা উপলব্ধি করেই উগ্রভাবে বললেন: সময় হলেই বুঝতে পারবেন। অক্ষয় দাস এত সহজে ছাড়ার পাত্র নয়।
মারামারি করবেন?
প্রয়োজন হলে তা-ই করব। শক্তির প্রয়োগ করে হলেও দেখিয়ে দেব আমার পরিবারকে অপমান করা এত সহজ নয়।
তাহলে তা-ই করুন। আপনি এখন আসতে পারেন।

অক্ষয় দাস চলে যাওয়ার পর রমেশ চক্রবর্তী ছুটে এলেন অমিতের কাছে। বললেন: তুমি কি জানতে না, তোমার বন্ধু পার্থ একটি অসহায় মেয়েকে প্রতিজ্ঞা করেছিল তাকে বিয়ে করবে? এখন তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না। মেয়েটি বড্ড অসহায়। তুমি একবার ভেবে দ্যাখো তো, মেয়েটির জন্য তোমার কি কোনো দায়িত্ব নেই?
অমিত বলল, অবশ্যই আছে।
তাহলে তা পালন করো।
আপনি কী করতে বলছেন?
একটি অসহায় মেয়ের মানসম্মান নিয়ে পার্থ ছেলেখেলা খেলবে তা কী করে সম্ভব? তোমাকেই নির্ধারণ করতে হবে সেই মেয়েটিকে কীভাবে রক্ষা করা যায়।
আপনিই বলে দিন আমার কী করা উচিত?
তোমার শক্তি-বিদ্যা-বুদ্ধি প্রচুর। আমি এখন বুড়ো মানুষ। আমার কি আর তোমার মতো শক্তি-বিদ্যা-বুদ্ধি আছে?
আপনি গুরুজন। অভিজ্ঞতাও অনেক।
তুমি যখন বলছ, তাহলে শোনো। অসহায় নারীর মানসম্মান তোমার মতো যুবকরাই রক্ষা করে। তারা প্রয়োজন হলে শক্তি প্রয়োগ করতেও দ্বিধা করে না। মেয়েটির মানসম্মান তোমাকেই রক্ষা করতে হবে। তাই না!
কিন্তু...
কিন্তু আবার কী! অর্থের প্রয়োজন হলে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেয়ো। তুমি যা-ই করো আমি তোমার সঙ্গে আছি। অসহায় নারীর মানসম্মান রক্ষার্থে তোমাকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য।
আপনি সঙ্গে থাকলে আমি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি।
এই তো দামাল ছেলের মতো কথা! আমি কি কখনো তোমার সঙ্গ ত্যাগ করতে পারি? তবে বাবা, যা-ই করো, বিজয় তোমাকে ছিনিয়ে আনতেই হবে।
তা পারব। সেটা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।
তাহলে কাজে লেগে যাও।

চা-পানের দোকানের সামনে একটি টুলে স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে অমিত। মনে অদ্ভুত শূন্যতা। সে শূন্যমনে আশেপাশের কোলাহল দেখতে লাগল। কোলাহলটি তার কাছে অতি বিচিত্র ও রহস্যময় ঠেকছে। কখনো দোকানদারের চড়া গলার তীক্ষ্ণ স্বরে হেসে ওঠা তাকে চমকে দেয়। বিস্তৃত শূন্যতার মধ্যে থেকে তার মন বিহ্বল হয়ে বেরিয়ে আসছে। তারপর কী যেন সন্ধান করছে। না-পেয়ে আবার শূন্য হয়ে উঠছে। রাস্তার ওপাশে রহস্যময় ময়লা-মাঠের দিকে ভাষাশূন্য চোখ নিবদ্ধ হয়ে আছে তার। কিছুটা ভয়ে, কিছুটা বিস্ময়ে তার চোখ হঠাৎ কেঁপে উঠল। রাস্তা দিয়ে একটি ছায়া আবছা অন্ধকারে মিলেমিশে নিঃশব্দে যেন চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে আসছে। ছায়াটিকে ঘিরে রয়েছে প্রেতাত্মার মতো বীভৎস সংগোপনতা। হিমভয়ে স্তব্ধ হয়ে এলো অমিতের দেহ। প্রাণে উষ্ণতা সৃষ্টির জন্য বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল ছায়াটির দিকে। অন্তরের ধূসর মরুর মতো শূন্যতা ধু-ধু করছে। ছায়াটি কাছে আসতে বিড়ির কড়া গন্ধ তার নাকে এসে ধাক্কা খেল। মুখ তুলে তাকাতেই চেহারাটি স্পষ্ট হলো। শতদল। দোকানের ক্ষীণ আলোয় এবার ওরা পরস্পরের দিকে তাকাল। শতদলের চোখে দীনতা, অমিতের চোখে ঈষৎ ক্লান্তির ছায়া। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল উভয়ই; তারপর শতদল বলল: তুমি তাহলে এখানে! ভালোই হলো তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে।
কয়েক মুহূর্ত অমিত কিছুই বলল না, তারপর আস্তেধীরে বলল: কোনো দরকার আছে বুঝি?
চা খাবে? উত্তরের অপেক্ষা না করেই শতদল দোকানদারকে নির্দেশ দিলো চায়ের জন্য।
আর কিছু? দোকানদার জানতে চাইল।
মুড়ি বাতাসা যা আছে দাও। চায়ের সঙ্গে কিছু-একটা তো লাগেই। শতদল বলল। অমিত নীরবতায় ডুবে রইল।
শতদল বলল: হৃদয় যখন ক্ষত হয়, তখন সেই ক্ষত দিয়ে রক্ত ঝরে।
উষ্ণতরল পদার্থ গলা বেয়ে যেন মুখে উঠে গালের দুই পাশ দিয়ে নীরবে ঝরছে। অমিত বলল, রক্ত?
কিছুক্ষণ শতদল কোনো উত্তর দিলো না। তারপর বলল, একটা কথা ছিল তোমার সঙ্গে।
অমিত জানতে চাইল, কী?
সুশীলা ও চন্দ্রার বিষয়।
শতদলের কথায় হঠাৎ অমিতের অন্তর ঝলকে উঠল। একটি বিড়ি ধরাল। তারপর অমিত বলল, কী জানতে চাও?
কয়েক মুহূর্ত পরে অচেনা এক কণ্ঠে শতদল বলল, একজনকে তো সরিয়ে দিতে হয়।
শতদলের দিকে তাকাতেই অমিত দেখতে পেল, তার চোখে এক পাণ্ডুর প্রাণের বীভৎসতা দেখা দিয়েছে। ধড়মড়িয়ে উঠল অমিত। তবুও তার ঠোঁট দুটি অদ্ভুতভাবে নিষ্কম্প। শতদলের প্রতিটি প্রকাশিত অক্ষর এবং প্রতিটি দেহভঙ্গি সে নীরবে হজম করার চেষ্টা করছে। আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবছে কী উত্তর দেবে! বাক্শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে, জীবন-মৃত্যুর বিষয়ে মুখে ভাষা খুঁজে পাওয়া সহজ নয়; অবশেষে ভীতত্রস্ত কণ্ঠে বলল: সরাতে হবে কেন?
শতদল নির্দয়ভাবে ও অপ্রত্যাশিতভাবে বলল, এই সুশীলা-চন্দ্রা বিষয়টি এখন একটি মারাত্মক হিংসা-বিদ্বেষে পরিণত হয়েছে। পার্থের বাবা এখন তার দোষটি পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছেন। তিনি একজনকে সরিয়ে দিতে চান।
শতদল এরকম কথা বলতে পারে তা অমিত ভাবতে পারেনি। হতবিহ্বল অমিত পালটা উত্তর দিতে পারল না। চোখে পরাজয়ের নিবিড় গ্লানি। তারপর অমিত ও শতদলের মধ্যে যুক্তিতর্ক শুরু হলো। এক সময় তা পরিণত হলো কথা-কাটাকাটিতে। অবশেষে তাণ্ডবে। শতদল আচমকা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল অমিতের ওপর। একেবারে খ্যাপার মতো। এত আচমকা এবং ভয়ংকরভাবে আক্রমণটা করা হলো—অমিত নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। অমিত মাথায় আঘাত পেল। গ্রামের মানুষ দেখল জটলা বেঁধে। জটলা ভেঙে পার্থ এগিয়ে এলো। গ্রামে হাতাহাতি, মারামারি লেগেই থাকে, তাই গ্রামবাসীর জন্য এটি এমন নতুন কিছু নয়। এক সময় তারা সবই ভুলে যাবে।

অমিতের আহত হওয়ার সংবাদটি শুনে সুশীলা ও মিথুন কোনাকুনি, ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে, পায়ে-হাঁটা সিঁথিহীন পথ চিরে হেঁটে চলল। এই-জমি, সেই-জমি; এই-পথ, সেই-পথ; এই-বাড়ি, সেই-বাড়ি; এই-গলি, সেই-গলি শ্লথগতিতে অতিক্রম করে অবশেষে অমিতের বাড়িতে এসে পৌঁছল তারা। পায়ের নিচে শক্ত ইটের মতো মাটি রেখে হাঁটতে হাঁটতে সুশীলার আঙুলের ডগায় আঘাত লাগে; মিথুন অবশ্য তার দিদির কষ্ট বুঝতে পারে। সে এও বোঝে, সুশীলার পক্ষে এতটা পথ অতিক্রম করা চাট্টিখানি কথা নয়, তবুও তাকে হাঁটতে হয়। সুশীলা ও মিথুনকে দেখে অমিত বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইল। কিন্তু মিথুন বাধা দিয়ে বলল: দাদা, তুমি শুয়ে থাকো। ব্যস্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
মিথুন লম্বা কিন্তু রোগাটে গড়ন। মাঝারি ধরনের মুখ। ওর মুখে সত্যিই লাবণ্য রয়েছে। গায়ের রং শ্যামলা হলেও মুখের রং তেমন মনে হয় না। নাক, চোখ, থুতনি সুছাঁদে গড়া। তার দিকে তাকিয়ে অমিত বলল, আমাকে নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। মাথায় একটু আঘাত পেয়েছি, এই যা। তাছাড়া ঠিক আছি।
সুশীলা বুঝতে পারল, কথাটি নিতান্ত মুখের কথা, মনেরও নয়।
সুশীলার উদ্দেশ্যে অমিত বলল, দাঁড়িয়ে রইলে যে! বসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
সুশীলা বুঝতে পারল না, নতুন কথা আর কী থাকতে পারে অমিতের। বলল, তুমি এখন কথা বলবে! ভীষণভাবে কপাল কেটেছে। যন্ত্রণা অবশ্যই হচ্ছে তোমার। সুস্থ হও, তারপর না-হয় কথা হবে।
অমিত বলল, কপাল ঠিক আছে। ফুলেছে সামান্য। ওষুধ লাগিয়ে দিলে সেরে যাবে। ব্যথা মরার ওষুধও খেয়েছি।
সুশীলা বলল, তা হোক, তবু...
জরুরি কথা। বসো তুমি। আমার কিছু কথা আছে। তা তোমাকে বলতেই হবে। তারপর যা ভালো তা করো।
মিথুন বলল: দাদা, তুমি কি পার্থদার সম্বন্ধে কিছু বলতে চাইছ? আমি ওর যা মতিগতি দেখছি—তাতে মনে হয় না, দিদির ব্যাপারে ওর কোনও মাথাব্যথা আছে। তুমি ধরে নাও সম্পর্কটা কাটাছেঁড়া হয়ে গেছে। এখন আমরা নিজেদের মতো করেই বাঁচতে চাই।
সুশীলা বলল, তুমি কি ওর সঙ্গে কথা বলেছ?
অমিত বলল, না। তারপর একটু চুপ থেকে নিজেকে টেনে বসল।
মিথুন বলল, পার্থদা আর আমাদের বাড়ি মাড়ায় না।
অমিত বলল, না-মাড়ালেই ভালো। পার্থের পিতা একজন অমানুষ। সুশীলা বা চন্দ্রা দুইজনের মধ্যে একজনকে এই পৃথিবী থেকে সরানোর জন্য অর্থের বিনিময়ে একজন খুনি ভাড়া করেছিলেন।
সুশীলা বলল, এও কি সম্ভব! এত নিচে নামতে পারে ওরা!
মিথুন নিজের দিদিকে জানে। সুশীলা একেবারে নিরীহ মুখ-বোজা মেয়ে নয়। তার জেদ আছে, রাগ আছে, মুখও আছে। সে সবকিছু সহজে মেনে নেয় না, সহ্যও করে নেয় না। তাছাড়া অন্যায়—সে সহ্য করবেই কেন? করবেও না। মিথুন বলল: পার্থদা শুধু অমানুষই নয়, সন্ত্রাসীও। ত্রাসের সাহায্যে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে।
সুশীলা ভীষণ খেপে গেল, বলল: ও নিজের পরিবারের জন্য আমাদের হত্যা করতে চায়। আমরাও দেখে নেব। আমার সঙ্গে অপকর্ম!
অমিত চমকে উঠল। কিন্তু কিছুই বলল না। কয়েক পলক তাকিয়ে রইল সুশীলার মুখের দিকে।
মিথুন বলল: দাদা, তোমাকে আমাদের একটা কথা বলার আছে।
দুই মুহূর্ত সবাই চুপ। নীরবতা ভেঙে অমিত বলব, তুমি তো এখনো বসলে না। দাঁড়িয়ে থাকলে কথা বলব কেমন করে?
মিথুন বসল।
সুশীলা ডানদিকের কপাল থেকে চুল সরিয়ে, অমিতের দিকে না-তাকিয়েই বলল, আমরা আর এই গ্রামে থাকব না।
অমিত বুঝতে পারল না কথাটি। শুধু তাকিয়ে রইল।
অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থাকে সুশীলা। তারপর বলল, আমরা মামার কাছে চলে যাচ্ছি। মামা একেবারে একা। তার কোনো বউ-বাচ্চা নেই। মামার শরীরও বর্তমানে ভালো যাচ্ছে না। নিজে নিজে কিছুই করতে পারছেন না। যে লোকটা মামার দেখাশোনা করত সেও চলে গেছে। প্রতিবেশীরা কোনোরকম দুটি অন্ন ফুটিয়ে দেয়। তাও আবার সব সময় নয়।
অমিত অবাক হলো। মামার খবর সে কখনো জানত না। সুশীলার বাবার মৃত্যুতেও তার মামাবাড়ির কেউ এসেছিলেন বলেও তার মনে হয় না। শ্রাদ্ধতে তো নয়ই। সুশীলাদের করুণ অবস্থায়ও কোনো দিন শোনেনি মামার কাছে চলে যাবে। তাহলে এখন কেন? স্তব্ধ হয়ে ভাবতে থাকে অমিত।
মিথুন বলল, মামার একটা চোখও নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অন্ধের মতো চলছেন। আমরা আজই চলে যাওয়ার চিন্তা করছি।
অমিত বলল, তোমরা যাবে ভাবলে, যাবে। ফিরবে কবে?
সুশীলা বলল: ধরে নাও, আমরা ওখানেই থেকে যাব। মামাকে রেখে ফেরার কোনো ইচ্ছে নেই।
অমিত একেবারে বিমূঢ় বিভ্রান্ত হয়ে গেল। অস্ফুট গলায় বলল, সুশীলা!
সুশীলা কোনো উত্তর দিলো না।

আজ বৃষ্টি নেই। ঘরের জানালাগুলো খোলা। অমিত একটা মোড়া টেনে উঠোনে বসে আছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। পার্থ এসে উপস্থিত হলো সন্ধ্যার মুখে। এসেই বলল, আমার অন্যায় হয়ে গেছে। ক্ষমা চাইতে এলাম।
অমিত অবাক হলো। কিছুই বলল না। শুধু আঘাত ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি তার নেই। বুকের ভেতর ভার হয়ে আছে। পার্থকে ছিবড়ে করে দিতে যে ইচ্ছেটা অন্তরে প্রবল হচ্ছিল সেটা এখন যেন নিস্তেজ।
পার্থ কিছু না বলেই ঘর থেকে একটা জলচৌকি বের করে এনে রাখল মোড়ার পাশে। তারপর বলল, চা-টা হবে?
এ কথা বলেই আবার ঘরে চলে গেল। ডাকতে লাগল। কেউ একজন আসতেই সে চায়ের কথা বলল। তারপর ফিরে এসে বসল অমিতের কাছে।
অমিত বলল, চাঁদের ষোলোকলা তো তোর পূর্ণ হলো। সকল লেজ কাটা তো শেষ করলি।
কার লেজ কাটলাম?
তা তুই-ই ভালো জানিস।
এসব গুজব।
শতদলকে দিয়ে আমার ওপর আক্রমণটাও বুঝি গুজব ছিল?
বললাম তো আমার অন্যায় হয়েছে। মাথা ঠিক ছিল না। চন্দ্রার পরিবারের ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে এমনটা হয়েছে। আমাকে তুই ক্ষমা করে দে। আর কখনো এমনটা হবে না।
কেউ একজন দুটি চায়ের ভাঁড় দিয়ে গেল। চা খেতে শুরু করেছে পার্থ। অমিত তার পকেট থেকে একটি বিড়ি বের করে পার্থের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, হঠাৎ ভদ্রলোক হতে চাইছিস কেন?
পার্থ কথাটি ইচ্ছে করেই শুনল না। শোনার কিছুই যেন নেই। পুরাতন সেসব কথা। সকলেই বলে, আবার সকলেই শোনে। পার্থ বলল, অমিত?
বল্।
বিড়ি ধরিয়ে নিয়েছে পার্থ। বলল, সুশীলার ব্যাপারে বাবা মত দিয়েছে। চন্দ্রার প্রতি আমার আর আকর্ষণ নেই। সে সুকান্তকে নিয়ে সুখে থাক্। এখন তুই সুশীলাকে ঘরে তোলার ব্যবস্থা কর।
দেরি হয়ে গেছে।
মানে?
সুশীলা ও মিথুন তোর কারণেই এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
কবে?
আজই।
পার্থ কোনো দিন ভাবতে পারেনি, একবারের জন্যও মনে হয়নি, সুশীলা এমন কাজ করতে পারে! হয়তো সে এখনো যায়নি, কিন্তু যাবে বলে ঠিক করে নিয়েছে। সুশীলা গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে এটি বড় কথা নয়; আসল কথা হচ্ছে, সে কেমন করে পার্থকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবল? তা কি কেউ করতে পারে? এমন অদ্ভুত কথা সে কোনো দিন শোনেনি। এমন অদ্ভুত জিনিস এই সংসারে ঘটে থাকতে পারে কিন্তু পার্থ তার জীবনে এমন ঘটনা কখনো শোনেনি। আশ্চর্য ভঙ্গিতে পার্থ বলল, সে আর কখনো ফেরবে না?
না। এই গ্রামের প্রতি তার আর কোনো টান নেই। ভালোবাসাও নেই।
আমি?
তোর কারণেই সে জেদি, একগুঁয়ে, অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। তুই বড্ড ভুল করে ফেলেছিস।
পার্থ আর-কিছু বলল না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে উঠে দাঁড়াল। এক সময় চলে গেল।

অমিতের কাছ থেকে ফিরে এসে পার্থ যখন সুশীলাদের বাড়িতে এলো, তখন সে অবাক। কিছুই চিনতে পারছে না। সে অন্যমনস্কভাবে চারপাশ দেখে নিলো একবার। নীরব, নিস্তব্ধ। পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করল। হাঁটতে হাঁটতে বিড়ি ধরাল। হঠাৎ সুশীলা কেন চলে যাচ্ছে? যাচ্ছে যাক—ফিরবে কবে?
কাঠ-বাঁশের বেড়া দেওয়া ও টিনের ছাউনির বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়াল সে।
একটা বাদুড় উড়ে গেল তার মাথার ওপর দিয়ে।
বারান্দায় উঠে এসে সে আরও অবাক হলো।
একটি মরচে-ধরা তালা ঝুলে রয়েছে রুদ্ধদ্বারে।
তোমাকে দেখার মতো চোখ নেই—তবু,
গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই—তুমি
আজও এই পৃথিবীতে র’য়ে গেছ।
কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ;
বহুদিন থেকে শান্তি নেই।

গোমতীর শূন্যস্রোত
যাত্রাদল

প্রথম: তারা এগিয়ে চলেছে জীবনের বিচিত্র প্রকাশের বিস্তীর্ণ চালচিত্র ধরে।
দ্বিতীয়: ওরা মানুষ তাই এগিয়ে চলেছে।
তৃতীয়: ওরা মানুষ বস্তুজগতের নিত্যরূপান্তরলীলাতেও।
চতুর্থ: জীবনের ঐতিহাসিক স্তরগুলোর অসংখ্য অপমৃত্যুর ফাঁদ এড়িয়ে আজও ওরা জীবিত।
পঞ্চম: রূপান্তরের দোলা লেগেছে অবয়বে, সামাজিক কাঠামোয়, তবুও ওদের মতোই মানুষ সেই প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে আজও মানুষ।
দলপ্রধান: কেননা মানুষ চিরদিন বাঁচতে চেয়েছে সচেতনভাবে, কেননা মানুষ বুঝতে পেরেছে বাঁচতে গেলে প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়তে হয় তাকে, পাল্টাতে চায় পরিবেশ, নিজেকেও।
ষষ্ঠ: কেননা মানুষ চেয়েছে বাঁচতে।
সপ্তম: কেননা মানুষ জেনেছে লড়াই করতে।
অষ্টম: তাই বেঁচে থাকার এই অনন্ত ইচ্ছের শিল্পরূপই গোমতী উপাখ্যান।

সমাপ্ত...

আগের পর্ব পড়ুন
গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১০
গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১১
গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১২
গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১৩
গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১৪

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন