নুজহাত জান্নাত ইরার গল্প: প্রতীক্ষা
পূর্ব পাকিস্তানের অজপাড়াগাঁ সুনামপুর। সুনামপুরে ছিল এক জেলে পরিবার। পরিবারটির প্রধান হারিস। আর তার সাথে ছিল বিধবা মা ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। হারিসের ধরা মাছ বিক্রির টাকায় কোনো রকমে তাদের দিন চলতো। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি তাদের পাশের গ্রাম রসুলপুরে আক্রমণ করে পাকিস্তানি হানাদারেরা। হানাদারেরা ওই গ্রামের অনেকের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। তারপর বাড়তে থাকে বর্বরতা। আজ এ গায়ে তো কাল ও গায়ে ঘটেই চলেছে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন।
হারিস আর চুপ করে ঘরে বসে থাকতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নেয় সে। একদিন অশ্রুসিক্ত চোখে মা ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে বিদায় জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের সহায়তায় যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। গেরিলা যুদ্ধের কলা-কৌশল প্রশিক্ষণ নিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে নেমে পড়ে হারিস।
হায়েনাদের থেকে নিজেদের বাঁচাতে গ্রামেই অনেকটা লুকোচুরি করে দিন পার করছিল হারিসের বৃদ্ধা মা ও স্ত্রী। একদিন সেই গ্রামে হানা দেয় হানাদার বাহিনী। তারা হারিসের বৃদ্ধা মাকে হারিস কোথায় আছে সে বিষয়ে জানতে চায়। হারিসের বৃদ্ধা মা হারিস সম্বন্ধে কোনো কিছু জানাতে অস্বীকার করে। তাই অমানসিক নির্যাতন করে বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে তাকে হত্যা করে হানাদারেরা। তারা পাশবিক নির্যাতন চালায় হারিসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর ওপর।
আরও পড়ুন
হঠাৎ একদল মুক্তিযোদ্ধা পাল্টা আক্রমণ করে হনাদারদের ওপর। বেশ কয়েকজন হানাদার ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বাকিরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা হারিসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে উদ্ধার করে আশ্রয় দেয় তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা নিরাপদ একটি বাংকারে।
হারিসের স্ত্রী তার শাশুড়িকে চিরতরে হারানোর বেদনা, স্বামীর ফিরে আসা ও অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে মুষড়ে পড়েন। তবে এই ভেবে আশায় বুক বাঁধেন, একদিন তার স্বামী বিজয়ী হয়ে ফিরে আসবেন। একদিন দেশ হানাদারমুক্ত হবে, স্বাধীন দেশে বেড়ে উঠবে তার সন্তান।
হঠাৎ একদিন হারিসের বউয়ের প্রসব বেদনা উঠলো। তীব্র বেদনার মধ্যেই সে শুনতে পাচ্ছিলো ঘন ঘন গুলির শব্দ। এমনই সময় জন্ম নিলো ফুটফুটে ছেলেসন্তান। একই সময় ভেসে এলো মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় উল্লাস। তাদের বাঁধভাঙা উল্লাসে যুক্ত হলো নবজাতকের সুতীব্র চিৎকার। মনে হলো এ চিৎকার যেন মুক্তির আনন্দ। মুক্ত হলো বাংলাদেশ।
মুক্ত দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে ফিরে এলেও ফিরে এলেন না হারিস। কেউ দিতে পারলো না হারিসের খোঁজ। হারিস ফিরে আসবে বলে এখনো দিন গোনেন হারিসের স্ত্রী ও না-দেখা সন্তান।
লেখক: শিক্ষার্থী, নবম শ্রেণি, সোনাতলা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বগুড়া।
এসইউ/এমএস