অতঃপর গুইসাপের গল্প
আশরাফুল ইসলাম
নাছনিয়ার বিল। ঠিক কী কারণে এই বিলের নাম নাছনিয়া হয়েছে, তা কেউ বলতে পারে না। তিন-চার গ্রাম মিলে বিস্তৃত এই বিল। একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত দেখা যায় না। ভরা বর্ষায় বিলটাকে মনে হয় যেন সমুদ্র। শরতের শেষ সময় মেঘের শরীরে আর কোনো জল সঞ্চিত নেই। যতটুকু আছে কাপড় চিপে চিপে যেমন জল বের করা হয়, মেঘেরাও ঠিক একইরকম ভাবে নিজেদের শরীর নিংড়ে বৃষ্টি ঝরায়।
বিলের পানি কমতে শুরু করেছে। বিলের দুইধারে কলমি গাছ আর তাদের শাখাগুলো অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। অনেক জায়গায় বড় বড় কচুরিপানার বিশাল আস্তরণ। আর যে জায়গাগুলোয় কচুরিপানা নেই; সেগুলোয় সাদা আর লাল শাপলার রাজত্ব। ঝাকে ঝাকে ফড়িং সেই শাপলাগুলোর ওপর বসে। অনেক সময় এক ফড়িংয়ের গায়ের ওপর আরেক ফড়িং বসে যায়। একে অপরকে আদর করে ভালোবাসে, সে দৃশ্য বড়ই সুন্দর। মাঝেমধ্যে কিছু ব্যাঙ লাফ দিয়ে উঠে ফড়িং ধরার জন্য। ফড়িংয়ের দল ভয়ে উড়ে যায়। তাদের শান্তি নষ্ট হয়। মিলন নষ্ট হয়।
বিলের মধ্যে নানা মাছের রাজত্ব। তবে এই বিল শৈল মাছের জন্য বিখ্যাত। একটু পরপর শৈল মাছ খলাশ করে শব্দ করে নড়ে ওঠে। আবার অল্প সময় পরই সে শব্দ মিলিয়ে যায়। বিলের মধ্যে অনেক দূর কিছু ছোট ছোট মাছ ধরা ডিঙি নৌকা দেখা যায়।
এখন মাঝদুপুর। বিলের মধ্যখানের এক জায়গায় কচুরিপানার দুর্ভেদ্য আবরণে দুটি গুইসাপের বাস। একটু আগেই বিলের একপ্রান্ত থেকে সাঁতার কেটে এসেছে তারা। ছোট ছোট মাছ খেয়ে পেট ভরে ফেলেছে। এতটাই খেয়েছে যে নড়ার শক্তি নেই। রোদের তেজ আজকে বেশ। তাই গুইসাপ দুটি কচুরিপানার ছায়ায় গা এলিয়ে দেয় বিশ্রামের জন্য। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পরে স্ত্রী গুইসাপটি পুরুষ গুইসাপের কাছাকাছি আসে। অস্ফুট শব্দ করে ওঠে পুরুষ গুইসাপটি। সে শব্দ শুনে স্ত্রী গুইসাপের কাছাকাছি আসে ভালোবাসার জন্য। ভালোবাসা পেয়ে স্ত্রী গুইসাপটি চুপ করে থাকে। তারা কচুরিপানার আরও গভীরে চলে যায়।
অনেক আদরের পরে হঠাৎ পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে পায়। পানির ঢেউয়ে কচুরিপানাগুলো নড়ে ওঠে। গুইসাপ দুটো সামান্য বাইরে বেরিয়ে আসে। একটা ডিঙি নৌকায় মাছ ধরছে তিনজন। দুজন মধ্যবয়সী, আরেকজন অল্পবয়সী কিশোর। কিশোর ছেলেটি নৌকার মাছখানে মাছ রাখার পাতিল নিয়ে বসে আছে। গায়ের রং বেশ উজ্জ্বল, সুঠাম দেহ। খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পরা কিশোর ছেলেটির হাতে সদ্য তোলা একটা ভাটফল। আনমনে সে তার খোসা ছড়াচ্ছে।
নৌকাটা কচুরিপানা ভেঙে আরও এগিয়ে আসে। এতে সেগুলো মাঝ বরাবর ফাঁক হয়ে যায়। একটা পানকৌড়ির সদ্য তোলা বাসাও ভেঙে যায়। হঠাৎ নৌকাটি থেমে যায়। নৌকার পেছনে যে লোকটা একটা বাঁশ দিয়ে নৌকা চালাচ্ছিল, সে বাঁশটি দিয়ে অল্পবয়সী কিশোরের মাথায় আঘাত করে। ছেলেটা তখন ভাটফল খাচ্ছিল। নৌকাটা তখন গুইসাপের খুব কাছাকাছি। ছেলেটার মাথা দুই টুকরো হয়ে যায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। দেহটা নৌকার পাশে হেলে যায়। মাথাটা পানির কাছাকাছি। এক ফোটা রক্ত একটি গুইসাপের গায়েও এসে পড়লো। কুচকুচে কালো বিলের পানি লাল হয়ে যায়। নৌকার অপরপ্রান্তের লোকটি চিৎকার করে ওঠে। বলে, ‘সাব্বাস বশির, অনেকদিন সুযোগ হাতছাড়া করেছি। আজকে সালামের একমাত্র পুত্রকে শেষ করে ওর বংশের বাতি নিভিয়ে দিলাম। ছেলেটা যখন একাই খেলছিল। কেউ ছিল না। খুব করে ভুলিয়ে-ভালিয়ে মাছ ধরার কথা বলে, নৌকায় ঘুরিয়ে বেড়ানোর কথা বলে আজকে আমাদের সাথে নিয়েছি। নে জলদি নে। তাড়াতাড়ি কর। ওর লাশটা আজকে কচুরিপানার নিচে রেখে যাই। যেন কেউ না জানতে পারে। না দেখতে পারে।’
অতি দ্রুত নৌকা থেকে নামে তারা। কচুরিপানার একদম গভীরে লাশ লুকিয়ে রাখে। নৌকায় লেগে থাকা রক্ত খুব দ্রুত পানি দিয়ে মুছে ফেলে। যে পথে এসেছিল; সেই পথেই চলে যায়।
কচুরিপানার গভীর আস্তরণ ভেদ করে কিশোরের লাশের কাছে যায় গুইসাপ দুটি। পানির অনেক গভীরে আছে লাশটি। স্ত্রী গুইসাপটি ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে, ‘মানুষ এতটা নির্দয় হয় কিভাবে? তার চেয়ে আমরা বিলের প্রাণিরা কত ভালো।’ সদ্য মরে যাওয়া কিশোরের মুখটা কত নিষ্পাপ। এর মা না জানি এখন কত খোঁজাখুঁজি করছে। গুইসাপ দুটি সিদ্ধান্ত নেয়, মৃত কিশোরের বাড়িতে যাবে তারা।
বিলের ওইধারে যে ছোট্ট গ্রামটি আছে। সেখানে বুঝি এর বাড়ি। পুরুষ গুইসাপের চোখ দিয়েও জল বেরিয়ে আসে। গুইসাপ দুটি ছেলেটির বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত স্থির করে। তারা অনেক দূরে চলে যাওয়া ডিঙি নৌকাটিকে লক্ষ্য করে দ্রুত সাঁতার কাটতে শুরু করে।
বিলে এবার প্রচুর মাছ হয়েছে। মাছ ধরার নানা যন্ত্র। আবুল মিয়া তার কারেন্ট জাল তোলার জন্য পানিতে নেমেছে। আজকে তার জালে খুব একটা মাছ পড়েনি। কিন্তু তার জালে দুটো গুইসাপ ধরা পড়েছে। গুইসাপ দুটোর পেট উঁচু হয়েছে দেখে ক্ষেপে যায় আবুল মিয়া। সে গালি দিয়ে ওঠে, ‘সোদানির পুত গুইসাপ, তোরা দুইজন জালের সব মাছ খাইছু। আজকে তোদের খবর আছে।’
ডাঙায় জাল নিয়ে উঠে আসে আবুল মিয়া। গুইসাপ দুটোকে জাল থেকে ছাড়ায়। ততক্ষণে গ্রামের দুরন্ত কিশোরের দল জমা হয়ে গেছে। তারা প্রবল উৎসাহে আবুল মিয়ার কাছ থেকে গুইসাপ দুটোকে নেয়। লাঠি দিয়ে পেটায়। রক্তাক্ত করে। গ্রামের অন্য কিশোরদের দেখানোর জন্য গুইসাপ দুটোর লেজে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘুরে বেড়ায় রাস্তা দিয়ে।
একসময় তাদের খেলার আনন্দ শেষ হয়ে যায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দুরন্ত কিশোরের দল গুইসাপ দুটোকে মুমূর্ষু অবস্থায় রাস্তায় রেখে ঘরে ফিরেছে। পুরুষ গুইসাপটা ততক্ষণে মরে গেছে। স্ত্রী সাপটাও মরার জন্য অপেক্ষা করছে। এমন সময় গ্রামের এক নারীর উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর তার কানে ভেসে আসে, ‘আমার খোকন কই রে? আমার খোকন, আমার বাপধন।’
এসইউ/জেআইএম