ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

শিশুতোষ গল্প

আমিও হবো মস্ত বড় জ্ঞানী

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৮:৪২ এএম, ১১ নভেম্বর ২০২৪

শাহ বিলিয়া জুলফিকার

মাহিম দুরন্ত ও কৌতূহলী। বয়স মাত্র দশ, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। লেখাপড়ায় তার একসময়ে ভালোই মনোযোগ ছিল। এখন সে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। সারাদিন ব্যস্ততা খেলাধুলায়, কখনো ছুটে যায় পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে গল্প শুনতে। কখনো বন্ধুদের নিয়ে রাস্তায় ছোটাছুটি করে। মা-বাবার ধমকও তার একপ্রকার নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাহিমের বাবা অফিস থেকে ফিরে দেখলেন, সে আবারো খেলায় মগ্ন। রাগে বাবার মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘মাহিম, সারাদিন শুধু খেলাধুলা! পড়তে বসো এক্ষুণি!’ মাহিমের খেলা থামাতে খুব একটা ইচ্ছা করছিল না। বাবার ধমক শুনে অবশেষে উঠে দাঁড়ালো। তবে সে সোজা চলে গেল দাদার ঘরে।

দাদা ছিলেন মাহিমের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। প্রায়ই দাদার কাছে এসে গল্প শুনতো। আজও সে একই কারণে এসেছে। দাদা তার দুষ্টুমি দেখে মুচকি হেসে বললেন, ‘কী দাদা ভাই, বাবা আবার বকেছে?’
মাহিম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘হুম। সারাক্ষণ শুধু পড়তে বলে। কিন্তু আমার পড়তে ভালোই লাগে না। আমি তো পড়বোই না!’
দাদা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘তুমি কি জানো না, জ্ঞানার্জন না করলে জীবনে কিছু হতে পারবে না? বড় হলে কী করবে বলো তো?’
মাহিম বিরক্ত হয়ে বলল, ‘দাদা, তুমি তো দেখছি শুধু উপদেশই দাও! আমি আজ এসেছি গল্প শুনতে। একটা ভালো গল্প শোনাও, না হলে চলে যাবো!’
দাদা হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে, মনোযোগ দিয়ে শোনো। তবে এরপর কিন্তু দুষ্টুমি করবে না।’

অনেকদিন আগের কথা। এক দেশে ছিলেন এক দয়ালু রাজা। তার দুটি ছেলে—একজনকে সবাই ‘বড় বাবু’ আর আরেকজনকে ‘ছোট বাবু’ বলে ডাকতো। বড় বাবু ছিলেন রাজ্যের গর্ব। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তার পড়াশোনার জন্য পুরো রাজ্যে সুনাম ছিল। রাজা তাকে অনেক ভালোবাসতেন এবং খুব গর্ব অনুভব করতেন।

অন্যদিকে ছোট বাবু ছিলেন পুরোপুরি বিপরীত। তার মধ্যে ছিল নানা রকম দুষ্টুমি আর প্রতিদিনই নতুন কোনো কীর্তি করে বসতেন। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছোট বাবুর দুষ্টুমি নিয়ে মানুষ হাসাহাসি করতো। রাজাও তাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকতেন। কেননা তিনি জানতেন রাজ্যের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই দুষ্টুমিই ভুল উদাহরণ হতে পারে।

বড় বাবু যখন উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে চলে গেলেন; তখন ছোট বাবু একদম একা হয়ে পড়লেন। মিশতে শুরু করলেন খারাপ ছেলেদের সাথে। দিনে দিনে তার দুষ্টুমির মাত্রা বেড়ে গেল। কখনো রাজ প্রাসাদ থেকে দামি কোনো সামগ্রী সরিয়ে ফেলেন, কখনো রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরক্ত করেন। একসময় রাজ্যবাসীর মনে ক্ষোভ জমা হতে শুরু করলো। অবশেষে ছোট বাবু এমন এক অপরাধ করে ফেললেন, যা রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী ক্ষমার অযোগ্য।

একদিন রাজা জানতে পারলেন, ছোট বাবু রাজ্যের কোষাগার থেকে চুরি করেছেন। তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। রাজ্যের সুনাম রক্ষার্থে তিনি ছোট বাবুকে পাঁচ বছরের জন্য জেলে পাঠানোর আদেশ দিলেন। এই শাস্তির কথা শুনে রানী খুব কষ্ট পেলেন। তিনি রাজার কাছে গিয়ে বললেন, ‘আপনি রাজা হতে পারেন কিন্তু বাবা হয়েও কি নিজের ছেলেকে এভাবে শাস্তি দেওয়া যায়?’
রাজা বললেন, ‘আমি শুধু তার বাবা নই। আমি এ রাজ্যের বিচারকও। রাজ্যের ন্যায়বিচার রক্ষার্থে যে শাস্তি অন্য কেউ পেতো, ছোট বাবুকেও সেটাই দিতে হবে। যদি তাকে ছাড় দিই, তাহলে জনগণের কাছে আমাদের সম্মান নষ্ট হবে।’

রানী কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেলেন। ছোট বাবুকে নিয়ে যাওয়া হলো জেলে। শুরুতে জেলের কঠিন জীবন তার জন্য ভীষণ কষ্টের হয়ে উঠলো। বদ্ধ পরিবেশ, কড়া নিয়ম-কানুন এবং একঘেয়ে জীবন তার সহ্য হচ্ছিল না। কিছুদিন এভাবেই চললো। কিন্তু ধীরে ধীরে ছোট বাবুর মধ্যে এক পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। সে উপলব্ধি করলো, তার জীবন এতোটাই মূল্যহীন হয়ে পড়েছে শুধু তার অসচেতনতার কারণে। সে ভাবলো, তার উচিত নিজের জীবন পরিবর্তন করা, কিছু ভালো কাজ করা।

একদিন রানী ছেলেকে দেখতে এলেন। চোখে জল নিয়ে বললেন, ‘বাবা, তুই কেমন আছিস? জেলের জীবনে তোর অনেক কষ্ট হচ্ছে, তাই না?’
ছোট বাবু মাথা নিচু করে রইলেন। মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলেন না। কারণ নিজের ভুলগুলো তখন তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কিছুক্ষণ পর ছোট বাবু মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মা, সত্যিই আমার জীবন বড় কষ্টের। আমি চাই নিজেকে বদলাতে, ভালো হতে। কিন্তু কিভাবে যে শুরু করবো বুঝতে পারছি না।’
মা সানন্দে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে তুই ভালো হতে চাস, তুই বড় হতে চাস? এজন্য আজ থেকে বইপড়া শুরু কর। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই তুই ভালো হতে পারবি।’
ছোট বাবু বললেন, ‘তাহলে আমি আজ থেকেই বইপড়া শুরু করবো।’
রানী প্রতিশ্রুতি দিলেন, প্রতি সপ্তাহে তিনি তার জন্য নতুন বই নিয়ে আসবেন। সেই শুরু হলো ছোট বাবুর নতুন জীবন। প্রথম প্রথম বই পড়তে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে তার মধ্যে পড়ার প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিতে লাগলো। বিভিন্ন বিষয়ে পড়তে পড়তে তার জ্ঞান বৃদ্ধি পেতে লাগলো। নতুন নতুন বিষয়, ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি, রাজ্য পরিচালনা, সমাজের কল্যাণ—এসব বইয়ের মাঝে হারিয়ে যেতে লাগলেন তিনি।

এভাবে কেটে গেল পাঁচ বছর। তিনি জেল থেকে ছাড়া পেলেন। বইপড়েই তার দিন কেটে যাচ্ছিল। তারপর ধীরে ধীরে তিনি এতটাই জ্ঞানী হয়ে উঠলেন যে, তার জ্ঞান রাজ্যের কোনো পণ্ডিতের চেয়েও বেশি হয়ে উঠলো। অথচ রাজা বা রাজ্যের কেউই জানতো না এই পরিবর্তনের কথা, রানী ছাড়া। রানী নিয়মিতই তার জন্য নতুন নতুন বই এনে দিতেন এবং ছোট বাবুর উন্নতি দেখে খুশি হতেন।

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ছোট বাবু আর প্রাসাদে ফিরে গেলেন না। তিনি নিজেকে একটা সাধক বা পথিকের মতো তৈরি করলেন। আগের সেই দুষ্টুমি যেন কোথাও বিলীন হয়ে গেছে। এখন তার দিন কাটে বইপড়ায় আর মানুষের সাথে জ্ঞান ভাগ করে। তিনি খুবই নম্র, ভদ্র এবং শান্ত মনের মানুষে পরিণত হয়েছেন। চারদিকে তার জ্ঞানার্জনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ তার সাথে দেখা করতে আসতে লাগলো, তার জ্ঞান শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো।

রাজা অবশেষে ছোট বাবুর জ্ঞানের কথা শুনে বিস্মিত হলেন। অন্য রাজ্য তথা দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসতে লাগলো তাকে দেখতে। তার কাছে জ্ঞান অর্জনের জন্য। রাজা তখনো ছোট বাবুর সামনে যাননি। কিন্তু বড় বাবু যখন বিদেশ থেকে ফিরলেন, তিনিও ছোট বাবুর খ্যাতির কথা শুনে তার সাথে দেখা করতে গেলেন।

ছোট বাবুকে দেখে বড় বাবু অবাক হয়ে গেলেন। আগের সেই উচ্ছৃঙ্খল ভাই আজ একজন পণ্ডিতের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। বড় বাবু তার সাথে কথা বলে বুঝলেন, ছোট বাবু জ্ঞানার্জনে এতটাই অগ্রসর হয়েছে যে, রাজ্যের অন্য কেউ তার সমকক্ষ নয়। বড় বাবু ছোট বাবুর জ্ঞান দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘তুমি এত জ্ঞানী হয়ে উঠলে কিভাবে?’
ছোট বাবু বললেন, ‘ভাইয়া, এই জ্ঞান আমি বই থেকে অর্জন করেছি। আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান হলো জ্ঞান। জীবন বদলাতে চাইলে, নিজের উন্নতি করতে চাইলে জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই।’

এ খবরে অবশেষে রাজা নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না। তিনি লজ্জা-শরম উপেক্ষা করে রানীকে নিয়ে ছুটে গেলেন ছোট বাবুর কাছে। সেখানে গিয়ে বললেন, ‘বাবা, আমার ভুল হয়েছে। আমি তোর প্রতি যথেষ্ট ধৈর্য দেখাতে পারিনি। তুই আমাকে ক্ষমা কর।’
ছোট বাবু বিনয়ের সাথে বললেন, ‘বাবা, আপনি সঠিক কাজই করেছেন। ন্যায়ের পথেই থেকেছেন। জেলে থাকাকালীন আমি জ্ঞানপিপাসু হয়ে উঠেছি, যা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’
রাজা বললেন, ‘তাহলে তুই কি কিছু চাস এখন?’
ছোট বাবু শান্তভাবে বললেন, ‘আমার কিছু চাওয়ার নেই। যদি সম্ভব হয়, গুটি কয়েক বই দিয়েন।’
রাজা বললেন, ‘আমি চাই তুই রাজা হবি।’
ছোট বাবু বললেন, ‘আমার রাজা হওয়ার যোগ্যতা নেই। আমি জ্ঞানী হবো।’
তারপর থেকে ছোট বাবু জ্ঞানচর্চাকেই জীবনের মূলমন্ত্র বানালেন। তিনি হয়ে উঠলেন মস্ত বড় জ্ঞানী, যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল দেশ-বিদেশে।

দাদা মাহিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী বুঝলে দাদাভাই? তুমিও কি জ্ঞানী হতে চাও না?’
মাহিম বলল, ‘জি দাদা, আমি আজ থেকেই পড়তে বসবো। ছোট বাবুর মতো আমিও হবো মস্ত বড় জ্ঞানী।’

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন