ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

আবুল কালাম শামসুদ্দীন: কালজয়ী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ | প্রকাশিত: ০১:৩৮ পিএম, ০৯ নভেম্বর ২০২৪

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক মুসলিম সাংবাদিক ও সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃত, প্রতিষ্ঠিত ও প্রশংসিত হন মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২)। মীর মশাররফ হোসেনের পর বাংলা সাহিত্যে যে কয়জন মুসলিম সাংবাদিক-সাহিত্যিক সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতায় খ্যাতি লাভ করেছেন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন (৩ নভেম্বর ১৮৯৭-০৪ মার্চ ১৯৭৮) তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন একাধারে একজন সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং সাহিত্যিক। তিনি তৎকালীন ভারতবর্ষের ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধানিখোলা গ্রামে (অধুনা বাংলাদেশ) জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাস করার পর কলকাতার রিপন কলেজে (সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) বিএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু ওই সময় (১৯২০-১৯২১) খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন এবং বিএ পরীক্ষা না দিয়ে কলকাতার গৌড়ীয় সুবর্ণ বিদ্যায়তন থেকে উপাধি পরীক্ষা (১৯২১) পাস করেন।

আবুল কালাম শামসুদ্দীন বিশ শতকের বিশের দশকে বাংলা সাংবাদিকতার ভূবনে আবির্ভুত হন। ১৯২৩ সালে ‘দৈনিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাংবাদিকতা চর্চা শুরু হয়। পরে ১৯২৪ সালে ‘সাপ্তাহিক মোসলেম জগৎ’, ‘দি মুসলমান’, ‘দৈনিক সোলতান’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’ প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে ‘দৈনিক আজাদে’ যোগদান করে তিনি ১৯৪০-১৯৬২ সাল পর্যন্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বাঙালি মুসলিম সমাজকে ইসলামি ভাবধারায় অনুপ্রাণিত করার জন্য কলকাতায় যে ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি (১৯৪০)’ প্রতিষ্ঠিত হয়; তিনি তার সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৪ সালে প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান পরিচালিত দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালে সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিনি রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠেন। ফলে তিনি ছাত্রাবস্থায় মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। পরিণত বয়সে প্রথমে তিনি প্রচণ্ড পরিমাণে আইয়ুব খানের বিরোধী ছিলেন এবং ভাষা অন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর সম্পাদিত ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বাংলা ভাষার দাবি সংক্রান্ত সম্পাদকীয় প্রকাশ করতেন নিয়মিত। তিনি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে পরদিন আইনসভার সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে প্রথমবার যে শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল, আবুল কালাম শামসুদ্দীন তার উদ্বোধন করেছিলেন। মানবতাবাদী এ সাংবাদিক ছিলেন পাকিস্তানের শাসকদের স্বৈরাচারী চরিত্র ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আকুণ্ঠ প্রতিবাদী।

১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের মনোনয়ন নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা-কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। তবে ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলন চলাকালে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তিনি এমএলএ থেকে পদত্যাগ করেন। তৎকালীন গভর্নরের কাছে পাঠানো পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেনঃ ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করায় ছাত্রদের উপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে তাহার প্রতিবাদে আমি পরিষদের আমার সদস্যপদ হইতে পদত্যাগ করিতেছি। যে নুরুল আমীন সরকারের আমিও একজন সমর্থক-এ ব্যাপারে তাহাদের ভূমিকা এতদূর লজ্জাজনক যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিতে এবং পরিষদের সদস্য হিসাবে বহাল থাকিতে আমি লজ্জাবোধ করিতেছি।’ কিন্তু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। বিষয়টি আশ্চর্যজনক হলেও সত্য। সে বিষয়ে অনেক ব্যাখ্যা হয়তো দেওয়া যাবে।

এ প্রসঙ্গে ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন তার ‘কালজয়ী সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন জীবন ও সাধনা’ বইয়ে বলেছেন, ‘ব্যক্তি-জীবনে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে তিনি একটি বিশেষ দলের সমর্থক ছিলেন। তা সত্ত্বেও সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি কোনো ব্যক্তি বা দলকে আক্রমণ করেননি। আবার কোনো ব্যক্তি বা দলের পক্ষ নিয়ে অহেতুক স্তুতিবাদ বা প্রশংসায়ও মেতে ওঠেননি। দীর্ঘ সাংবাদিক-সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার ওপর রঙের প্রলেপ লাগিয়ে নিজের কৃতিত্ব প্রচারের অপচেষ্টায় তিনি কখনো লিপ্ত ছিলেন না। যাঁর যতটা সম্মান প্রাপ্য তা তিনি দিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে স্বমত বা ভিন্ন মতাদর্শের কোনো প্রশ্ন তাঁর কাছে ছিল না। আঘাত হানার ক্ষেত্রেও তিনি কোনো অপশক্তিকে কৃপা করেননি। যা দেখেছেন, যাতে তিনি পীড়িত হয়েছেন তা-ই ব্যক্ত করেছেন দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে।’ (পৃ-১৩)

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কিছুদিন পর ‘দৈনিক আজাদ’ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬২ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার পর আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে নব প্রতিষ্ঠিত ‘দৈনিক জেহাদ’ পত্রিকার সম্পাদক হন। প্রায় দেড় বছর তিনি এ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এরপর ১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর তৎকালীন প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান ‘দৈনিক পাকিস্তান’ (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) নামে পত্রিকা প্রকাশ করলে তিনি এর সম্পাদক পদে যোগদান করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে এ পদ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এখানেই তাঁর সুদীর্ঘ গৌরবময় সাংবাদিক জীবনের অবসান ঘটে।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত লেখালিখি করেছেন। দুয়েকটি গল্প-উপন্যাস লিখলেও মূলত তিনি ছিলেন প্রাবন্ধিক, সূক্ষ্মদর্শী ও নির্ভীক সাহিত্য সমালোচক। তাঁর সুদীর্ঘ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবনে তিনি মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য ও সাংবাদিকতা চর্চায় নিবেদিত ছিলেন। সাংবাদিকতা, সাহিত্যচর্চা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইত্যাদি ছিল তাঁর জীবিকার চালিকা শক্তি। অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময় সাংবাদিক ও সাহিত্য জীবনে তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর ‘কাব্য সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান’, ‘মহাশ্মশান কাব্য’, ‘সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’, ‘আমাদের সাহিত্য’, ‘বাংলা ভাষায় নয়া শব্দ’, ‘সাহিত্য গুরুর বাঙালি প্রীতি’ এবং ব্যঙ্গ রচনা ‘একটি জনসভার রিপোর্ট’ সমকালে ব্যাপক সাড়া জাগায়। ছাত্রজীবনে আবুল কালাম শামসুদ্দীন বিদেশি সাহিত্যের, বিশেষত ইংরেজি ও রুশ সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক ছিলেন। তাঁর বইসমূহ হচ্ছে—কচিপাতা, অনাবাদী জমি, ত্রিস্রোতা, খরতরঙ্গ, দৃষ্টিকোণ, ইলিয়ড, নতুন চীন নতুন দেশ, পলাশী থেকে পাকিস্তান, দিগ্বিজয়ী তাইমুর ও অতীত দিনের স্মৃতি প্রভৃতি। তাঁর ‘অতীত দিনের স্মৃতি’ বইটি এখনো পাঠকের কাছে বেশ সমাদৃত। রুশ-ঔপন্যাসিক তুর্গেনিভের ‘ভার্জিন সয়েল’র অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ করেন দু’দফায়। প্রথমে ‘পোড়োজমি’ এবং পরে ১৯৩৮ সালে ‘অনাবাদী জমি’ নামে। আত্মজীবনী হিসেবে ‘অতীত জীবনের স্মৃতি’ তাঁর উৎকৃষ্ট রচনা। দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর এ গ্রন্থ প্রত্যক্ষদর্শীর দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। বাংলা একাডেমি থেকে ৩ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘রচনাবলী’।

লেখালিখির শুরুতেই তিনি একজন সাহিত্যবোদ্ধা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন সমালোচক হিসেবে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। মুসলিম বাংলা সাহিত্যের নব-মূল্যায়নে বিশেষ করে নজরুল কাব্যের মূল্যায়নে তাঁর ভূমিকা ও অবদান স্বীকৃতি লাভ করে। এ প্রসঙ্গে ১৩৩৩ সালের দ্বিবার্ষিক সংখ্যা ‘সওগাত’ পত্রিকায় বলা হয়ঃ ‘‘তিনি (আবুল কালাম শামসুদ্দীন) এই তরুণ বয়সেই বাংলার মুসলমান সাহিত্যিক সমাজে অদ্বিতীয় কাব্যরসগ্রাহী প্রতিভাশালী সমালোচকের স্থান দখল করিয়াছেন। ‘সাহিত্য’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘সওগাত’, ‘প্রতিভা’ প্রভৃতি সাময়িকপত্রে তাঁর বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে। ...ফলত সমালোচক হিসেবে উত্তরকালে তিনি বাংলা সাহিত্যে যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিবেন বইতেই তাহার পরিচয় পাওয়া যাইতেছে।” আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯২৭ সালেই নজরুল-কাব্যের আলোচনা প্রসঙ্গে বিদ্রোহী কবিকে বাংলার জাতীয় কবি এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা সাহিত্যের তৃতীয় যুগ-স্রষ্টা কবিরূপে আখ্যায়িত করেন। নজরুল যে ভবিষ্যতে তাঁর প্রাপ্য সাহিত্য-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবেন—সেই ভবিষ্যদ্বাণীও করেন। (‘কাব্য সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান’ সওগাত, ১৩৩৩-৩৪)

ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি মুসলিম সমাজে যে নবজাগরণ ঘটে, আবুল কালাম শামসুদ্দীন তার অন্যতম ফসল। সাংবাদিকতা, সাহিত্য, সমাজ উন্নয়ন, রাজনীতি, ভাষা ও মননশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে তিনি বাঙালি মুসলিম নবজাগরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে তিনি আমৃত্যু সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ছিলেন স্বজাতি ও স্বদেশপ্রেমিক একজন চিন্তাশীল, নিষ্ঠাবান সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। তাঁর মতো নিঃস্বার্থ নিবেদিতপ্রাণ মহৎ ব্যক্তি সমাজে নিতান্ত বিরল। একই শতকের ত্রিশের দশকে সাংবাদিক-সাহিত্যিক ওয়াজেদ আলী, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদসহ বেশ কয়েকজন মনীষী কলকাতায় একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার নাম ছিল ‘মোল্লাকি বিরোধী লীগ’। তারা তথাকথিত মোল্লা-মৌলবীদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন।

বাঙালি মুসলিমের নবজাগরণ, স্বাতন্ত্র্য-চেতনা, আত্মবিকাশ, অধিকার-সচেতনতা, স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর যুগপৎ ভূমিকা ছিল বিশেষ স্মরণীয়। এ প্রসঙ্গে কবি ও গবেষক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ বলেন, ‘দৈনিক আজাদ শুধু মুসলিম বাংলার প্রাচীনতম সংবাদপত্রই নয়, উপমহাদেশের মুসলিম নবজাগরণ এবং আজাদী আন্দোলনেরও নির্ভীক মুখপত্র। পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম বাংলার সাংস্কৃতিক নবজাগরণে ‘আজাদ’-এর ভূমিকা ঐতিহাসিক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে নতুন রাষ্ট্রের এবং বিশেষভাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ নিয়ে আমাদের সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ভাষাতত্ত্ববিদ, পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীরা ‘দৈনিক আজাদ’ ও ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় আলোচনার সূত্রপাত করেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগেই।’ (ভাষা-আন্দোলনে আবুল কালাম শামসুদ্দীন)।

মুসলিম লীগে যোগদান করে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক উত্থাপিত ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ (যা বিশেষভাবে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে পরিচিত) পাসের পর পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। লাহোর প্রস্তাবানুযায়ী, উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। এ কারণে অবিভক্ত বাংলা ও আসাম নিয়ে পূর্বাঞ্চলে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বাঙালি মুসলিম সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। ভবিষ্যৎ স্বাধীন রাষ্ট্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্দেশ্যে এ সময় থেকেই তাঁরা তৎপর হন।

তাঁর সম্পর্কে ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছেন, ‘আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছিলেন বিবেকী ও প্রতিবাদী চেতনার সাংবাদিক। একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে তিনি সবসময় সচেতন থাকতেন এবং জনতার সঙ্গে আত্মীয়তায় ও একাত্মায় ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ও দুঃসাহসী ভূমিকার কথা সর্বজনবিদিত।’ (কালজয়ী সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন জীবন ও সাধনা) অতীত দিনের স্মৃতি সম্পর্কে লেখক বলেছেন, ‘আমার অকিঞ্চিৎকর অতীত জীবনের এ-রেখাচিত্রের সৌন্দর্য-সুষমা তেমন-কিছু আছে কি না, জানি না। তবে বিগত অর্ধ-শতাব্দীব্যাপী এ দেশের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার বিকাশ ও অগ্রগতির ইতিহাসের বিচিত্র বিবরণীর কিছু কিছু এতে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি। সে-চেষ্টা ফলবতী হয়েছে কি না, তার বিচার ভার অবশ্য আমার উপর নয়।’ বইটি তিনি সত্তর বছর বয়সে লিখেছিলেন।

সারাজীবনের সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—সিতারা-ই-খিদমত (১৯৬১); সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬৭); বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭০); একুশে পদক (১৯৭৬)। তবে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে ‘সিতারা-ই-খিদমত’ ও ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করেন। অতীত দিনের স্মৃতি বইতে তিনি বলেছেন, ‘আমার আত্মজীবনী এমন কিছু মূল্যবান জিনিস হবে না যা না লিখলে দুনিয়ার ঘটনা-প্রবাহের কোনো পর্যায়ের কোনোরূপ অসম্পূর্ণতা থেকে যাবে। তবু তাঁরা বলছেন, যেহেতু আমার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন প্রায় দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের এবং যেহেতু এই দীর্ঘ সময়ের সাথে মুসলিম বাঙলার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবনের অনেক ভাঙাগড়ার কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে, তাই সেটা লিখতে হবে।’

১৯৭৮ সালের ৪ মার্চ ঢাকায় বাংলা সাংবাদিকতা জগতের এই দিকপালের মৃত্যু হয়। সাহিত্যিক সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সাহিত্যচিন্তা ও দৃষ্টিকোণের পরিচয় তাঁর বিভিন্ন রচনায় স্বাক্ষরিত। অর্ধ-শতাব্দীরও অধিককালের সাংবাদিক ও সাহিত্যজীবনে তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে বহুসংখ্যক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সাহিত্য, সমাজ-সংস্কৃতি ও জাতীয়তা বিষয়ে চিন্তামূলক প্রবন্ধ রচনা ছাড়াও সাহিত্যকর্মের একটা প্রধান অংশজুড়ে রয়েছে সাহিত্য সমালোচনা। উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক হওয়া সত্ত্বেও আবুল কালাম শামসুদ্দীন অহমিকাবোধে কখনো আচ্ছন্ন হননি। তিনি অত্যন্ত সহজ, সরল ও সাদাসিধা জীবনযাপন করেছেন। যশ ও খ্যাতির পেছনে কিংবা বিত্ত বৈভব গড়ে তোলার লক্ষ্যে কখনো প্রচেষ্টা চালাননি। তাই তো তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন।

তথ্যপঞ্জি

১. মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ, রেখাচিত্র যাঁদের হারিয়ে খুঁজি, বইপত্র, ২০১৪
২. আবুল কালাম শামসুদ্দীন, অতীত দিনের স্মৃতি, খোশরোজ কিতাব মহল, ২০০১, ঢাকা
৩. ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, কালজয়ী সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন জীবন ও সাধনা, সূচীপত্র, ২০১৯, ঢাকা
৪. মাসিক সওগাত, দ্বিবার্ষিক সংখ্যা, ১৩৩৩

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন