ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মুকিদ চৌধুরীর নাট্যোপন্যাস

গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১২

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৩:১৪ পিএম, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

ওম অখণ্ডমণ্ডলাকারং, ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্
তৎপদং দর্শিতং যেন, তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ

বর্ষায় গোমতী অঞ্চলের অবস্থা হয় জলে-ভেজা কাকের মতো।
প্রতি বছরই এমনটা হয়। কোনো কোনো অঞ্চল জলে ডুবে যায়। লোকজনের দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়।
কিন্তু মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের জীবনে এই প্রথম শুরু হলো অপরিসীম কষ্ট সহ্যের পালা। বিশ-বাইশজন চৌকস ও দুঃসাহসী বীর, রাধারমণ ও রাজবিদূষককে সঙ্গে নিয়ে ক্লান্ত, শ্রান্ত ও কিছুটা হতাশাগ্রস্ত মানুষের মতো মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য যখন জঙ্গল ভেঙে একটি খোলা প্রান্তরে এসে পৌঁছলেন; তখন ঝড় প্রায় শেষ হওয়ার পথে। তিনি পেছন ফিরে দেখলেন, ঝোড়োসন্ধ্যার শেষলগ্নটি ভেসে চলেছে দূরে। অন্ধকারে এই অঞ্চলকে পুরোপুরি ছেয়ে যাওয়ার আগেই ঝড় থেমে গেল। ফলে এক আশ্চর্য ঝড়-মনমাতানো আবেশে আচ্ছন্ন করে ফেলল এই খোলা প্রান্তরটিকে। এমন আশ্চর্য ঝড়-মনমাতানো আবেশ এই ভূখণ্ডেই হয়তো সম্ভব! আর-একটুকু অগ্রসর হয়ে অবশেষে খোলা প্রান্তরের এক পাশে একটি পরিত্যক্ত কুটিরের সামনে এসে দাঁড়ালেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য।

এই কুটিরেই আশ্রয় নেওয়ার আদেশ দেন দ্বিধাগ্রস্ত ও কিছুটা বিমর্ষ মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য। ত্রিপুরার পূর্ব ভাগে মণিপুর রাজ্যের শুরুটা মনে হয় এখান থেকে। এমন স্নিগ্ধ পরিবেশ মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের জীবনে হয়তো এই প্রথম এসেছে।
আশ্রয় নেওয়ার মতো এই জায়গাটিই বটে, মহারাজ। ফিসফিস করে বললেন রাধারমণ। তিনি মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের চেয়ে বয়সে কিছুটা অনুজ।

মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যকে বেশ কাহিল দেখাচ্ছে। ভেতরে কেমন যেন এক দুর্বলতা রয়েছে, ফলে শরীরের শক্তি ফিরে পাচ্ছেন না। তার করুণ অবস্থা দেখে রাধারমণ বললেন: দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে চাইলে মহারাজ আপনাকে অনুরোধ করছি, এই কুটিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করুন।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য কিন্তু একটুতেই কাতর হওয়ার মতো মানুষ নন। যদিও তিনি জানেন: তার বাইরেটা লোহা বা পাথরের তৈরি নয়, আবার রুগ্ন বা দুর্বলও নয়, সাধারণভাবে এক রকম, তবে অশ্বারোহণ করতে করতে হাড়ে কাঠিন্য ধরে গেছে। প্রাণশক্তি তার রীতিমতো যথেষ্ট। আপাতত ঝড়ের ধাক্কা তাকে কাবু করলেও তিনি বিচলিত নন। তাই বললেন: ছাগলের মতো কথা বলবেন না। আপনি ভাবছেন যে, এই ঝড় আমার ক্ষতিসাধন করেছে। যেখানে অন্তরের আঘাত প্রচণ্ড, সেখানে বাইরের এই ছোট আঘাত তেমন ক্ষতিসাধন করতে পারে না। না, আমি ভেঙে পড়ব না। তবে রাধারমণ, এই অঞ্চলটি কতটা নিরাপদ?
সেনাপতি যা বলেছেন, তাতে এক রাত্রের মধ্যে অতিক্রম করে আসতে পারে এমন কোনো সেনাচৌকি এর আশেপাশে নেই।
এলাকাটি কি মণিপুরের অধীনে?
সঠিকভাবে কিছুই বলা যাবে না, মহারাজ।
তাহলে ঝড়ের রাত্রিটি আমি বাইরেই কাটাব। সহ্য করব এই ঝড়তাণ্ডব। হায় কৃষ্ণাভামিনী ও সুহাসিনী, তোমাদের এই বৃদ্ধ পিতা তার সর্বস্ব তোমাদের প্রদান করেছেন। এখন মনে হচ্ছে এমন কাজ পাগলেই করে।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের মুখ থেকে এমন কথা প্রকাশের জন্য রাধারমণ মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। তাই হালকাভাবে বললেন: আপনি অনুগ্রহ করে এসব কথা মনে স্থান দেবেন না। যা করেছেন তা ত্রিপুরার মঙ্গলের জন্যই করেছেন। এখন অনুগ্রহ করে ভেতরে চলুন। বিশ্রাম গ্রহণ করুন।
মেঘঘন রাত্রিতেও এক রকম আলোর প্রতিফলন ঘটে। সেদিকে তাকিয়ে বীরদলের সেনাপতি বললেন: মহারাজ, খবর নিয়ে জেনেছি, এই অঞ্চলে কারো কর্তৃত্ব তেমন একটা নেই। আশপাশে কয়েকজন সামন্ত রাজ্যপাল আছেন, তারা নামেই শুধু রাজ্যপাল। আপনি আদেশ দিলে সহজেই আমাদের আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারব। চারদিকে শুধু ঘন জঙ্গল আর জলাভূমি। লোকালয় খুব কম। দক্ষিণ দিক তো একেবারে বিরান ভূমি।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন: ঠিক আছে সেনাপতি, বীরদের বিশ্রামে পাঠিয়ে দাও। পাচকদের বলো তাড়াতাড়ি খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য। খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্বস্ত পাহারাদারদের রেখে বাকিদের পুরোপুরি বিশ্রামে যেতে বোলো। পথের ক্লান্তি কাটিয়ে ওঠার প্রয়োজন আছে। কে জানে, সামনে কী আছে!
রাধারমণ বললেন: মন খারাপ করার কিছুই নেই, মহারাজ। সেনাপতি তো বললেন, এই অঞ্চলটা নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যথা নেই। মনে হচ্ছে কম শক্তি ব্যয় করেই এখানে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য গড়ে তোলা সম্ভব। আশপাশের রাজ্যপালদেরও বশে আনা কঠিন হবে না।
সেনাপতি বললেন, সকালে আবার খোঁজখবর নিয়ে দেখব। কী করা সম্ভব।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, এটা নিয়ে সকালেই কথা হবে। তুমিও ক্লান্ত নিশ্চয়। বীরদের জন্য একটু আরাম-আয়েশের আদেশ দাও, সেনাপতি।
সেনাপতি বললেন, তাই হবে মহারাজ।
রাজবিদূষক ততক্ষণে দড়ির খাটিয়া বের করে দিয়েছে। একটি মাদুর পেতে দিলো খাটিয়ার ওপর। রাধারমণ তার উদ্দেশ্যে বললেন, এবার তুমি যাও। মহারাজের জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করো। ঘোড়ার পিঠে মহারাজের জন্য আলাদা খাবারের আয়োজন ও সরঞ্জাম রয়েছে। সেগুলো এনে আহারের আয়োজন করো।
রাজবিদূষক চলে গেলে রাধারমণ বললেন: মহারাজ, বীরবৃন্দের শয্যা তৈরি হয়ে গেছে। খাবারের আয়োজনও শুরু হয়ে গেছে। সুগন্ধি ভেসে আসছে বাতাস থেকে।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, সব দিকেই আপনার চোখ-কান সজাগ!
চোখে-মুখে হাসি ফুটিয়ে রাধারমণ বললেন, আপনার আশীর্বাদ, প্রভু।

কিছুক্ষণের মধ্যে চারদিকে সুনসান নীরবতা নেমে এলো। চৌকস পাহারাদারদের চঞ্চলছায়া মেঘলা রাত্রের অন্ধকারে প্রেতের মতো যেন ঘুরে বেড়াতে লাগল। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বাতায়নের পাশে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে লাগলেন। হঠাৎ পরিত্যক্ত কুটিরের একটু দূরে একটি কদমগাছের ওপর তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। পাশে গুটিতিনেক নারকেল গাছ, মনে হচ্ছে, এখনো মাথা নেড়ে চলেছে। বেলগাছ, নিমগাছও। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক মনে-মনে বললেন: কন্যাদ্বয়ের কারণে আজ পৈতৃক রাজ্যপাট ছেড়ে এক রকম নির্জন পরিত্যাগ একটি কুটিরে আশ্রয় নিতে হলো। বর্মণ দস্যুদের বিরুদ্ধে কত লড়াই করে ত্রিপুরাকে রক্ষা করেছিলাম! পার্শ্ববর্তী রাজাদের রাজ্যলোলুপতাও ছিল ত্রিপুরার ওপর। তাদের থাবা থেকে ত্রিপুরাকে রক্ষা করতে গিয়ে জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই কাটাতে হয়েছে যুদ্ধবিগ্রহে। এবার একটু শান্তি চাই। এখানেই জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হয় না।

মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের মনের মধ্যে যেন সম্পূর্ণ এক নতুন উপলব্ধি সৃষ্টি হতে লাগল। তাই রাধারমণের দিকে তাকিয়ে বললেন, আগে আপনি একটু বিশ্রাম নিন। পরে সবকিছুর ব্যবস্থা করবেন।
রাধারমণ মাথায় হাত ঘষতে ঘষতে বললেন, আমি ঠিক আছি, মহারাজ। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। রাজধানী ছাড়ার আগে আমি কয়েক মাসের জন্য সকল বন্দোবস্ত সেরে রেখেছি। পথে কী হয় তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য হঠাৎ আনমনে বলতে লাগলেন: দরিদ্র, নগ্ন মানুষ এই নিদারুণ ঝড় থেকে কী করে নিজেদের রক্ষা করে? মাথার ওপর যাদের কোনো ছায়া নেই, যারা অভুক্ত, তারা এই নিদারুণ সময়ে কীভাবে বেঁচে থাকে? আমাকে না-হয় আপনি বাঁচিয়ে রাখবেন, কিন্তু ওদের কী হবে! আমি এতদিন এসব ভাবিনি। আজ নিজে এই অবস্থায় পড়ে উপলব্ধি করছি।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের কণ্ঠস্বরে এমন এক জোর এবং আবেগ ছিল যে, রাধারমণ আর কোনো কথাই বলতে পারলেন না। রাধারমণ গভীর দৃষ্টিতে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বিচিত্র এক উত্তেজনা তার স্নায়ুমণ্ডলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। রাধারমণের বুকের ভেতরটা শুধু শিরশির করে উঠল। আশ্চর্য এক সুখ তার বুকে ভেতরটা দখল করে নিলো, খানিকটা দ্বিধাও। পাঁচমেশালি অনুভূতি যেন।

যূথী মালতির কতকথা গোপনে বলে মলয়
প্রীতির বন্ধনে রোমাঞ্চিত হল মর্ত্যালয়

লোকগুলো ঘুমে নির্বাপিত, কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। দক্ষিণ কোণ থেকে শুধু একটি মশালের আলো বেরিয়ে আসছে। শশিভূষণ কাউকে না-জানিয়ে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের খোঁজে হাতে একটি মশাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। চারদিক নির্জন। নিস্তব্ধ। ঝড় থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। অশ্বের কাদা-মাড়ানো পথ ধরে সে গোমতীর তীরের শ্মশানঘাটের নিকটবর্তী এসে দাঁড়াল। শ্মশানঘাটে তো সে অনেকবার এসেছে, কিন্তু কোনো দিন তার মনে ভূতপ্রেতের ভয় হয়নি, কিন্তু এই মুহূর্তে কেন হচ্ছে? যদি এসব অদৃশ্য আত্মার অস্তিত্ব থাকে, যদি আমি তাদের সাহায্য চাই, তাহলে কি তারা এগিয়ে আসবে? হয়তো আসবে। কিন্তু এমন দুর্যোগপূর্ণ সময়ে মানুষের ডাকে মানুষই সাড়া দেয় না, ভূতপ্রেতরা কি সাড়া দেবে? হয়তো-বা দেবে, হয়তো-বা তারা জ্যান্ত রক্ত-মাংসের মানুষের মতো হৃদয়হীন নয়! এসব ভাবতে ভাবতেই শশিভূষণ শ্মশানঘাট অতিক্রম করে একটি দিগন্ত প্রসারিত জঙ্গলে এসে উপস্থিত হলো। জঙ্গল ভেঙে পরিত্যক্ত কুটিরটিকে দেখতে পেল। সে এসে কুটিরের সামনে উপস্থিত হতে-না-হতেই পাহারারত রাজরক্ষীরা তাকে বাধা দিলো। একজন বলল, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ?
আমি শশিভূষণ। ভালো করে দেখুন। আমি অপরিচিত কেউ নই।
অন্যজন শশিভূষণের মশালটি হাতে নিয়ে তার মুখের কাছে তুলে নিরীক্ষণ করে বিকৃত স্বরে বলল, আপনি কী চান? এই রাত্রে আপনি এখানে এসেছেন কেন?
আমি মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তাকে ফিরিয়ে নিতে চাই।

রাধারমণ মেঝেয় বিমূঢ়ভাবে শুয়ে ছিলেন। হঠাৎ মানুষের কথাবার্তা ও পদশব্দ তার কানে ভেসে এলো। তিনি উঠে বাইরে এলেন। মশালের তীব্র আলোয় যা দেখলেন তাতে তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থেমে গেল। যেন সর্বশরীরের রক্তস্রোত বন্ধ হয়ে গেল। তিনি আরও অগ্রসর হতেই শুনতে পেলেন শশিভূষণ এই ঝড়ের রাত্রে এসেছে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। তিনি শশিভূষণকে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের কাছে এনে উপস্থিত করলেন। ঘুমন্ত মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের সম্মুখে শশিভূষণ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এক সময় ফিসফিস করে রাধারমণকে জিজ্ঞেস করল, এখন কী করব আমি?
রাধারমণ বললেন, আমরা মহারাজের নির্দেশের ভৃত্য, আমাদের তো ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা নেই। আপনি বরং তার ঘুম-ভাঙা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
তা-ই করা উচিত। অতঃপর শশিভূষণ পায়চারি করতে লাগল। একবার আকাশের দিকে তাকাল। বৃষ্টি-পড়া বন্ধ হলেও সমস্ত আকাশজুড়ে ভাদ্র মাসের কালো ঘন মেঘের রাজত্ব চলছে বলে মনে হলো। বাতাস নেই, হয়তো-বা বৃষ্টি আবার নামবে। পায়চারি করতে তার আর ভালো লাগছে না। ডান পায়ের আঙুল ব্যথায় টনটন করছে। পথে ঠোক্কর খেয়েছিল জোরে।
মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর গলায় আওয়াজ উঠল, কে ওখানে? রাধারমণ, জানালার পাশে কে দাঁড়িয়ে আছে?
রাধারমণ কোনো উত্তর দিলেন না। বরং শশিভূষণ ছুটে এসে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের পা জড়িয়ে ধরে আর্তকণ্ঠে বলল, আমি শশিভূষণ।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য ধড়মড় করে উঠে বসলেন। চারদিক একবার দেখে নিয়ে বললেন, তুমি এখানে কেন এসেছ?
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের শরীর ও মন উভয়ই ক্ষুব্ধ। তিনি বুঝতে পারছেন না বাইরে মেঘ ডাকছে কি না! না, না, ডাকছে না! অন্যমনস্ক তিনি। হয়তো মেঘ আরও জমাট বেঁধেছে। বাইরে ঝরাপাতার শব্দ বাড়তে থাকে। ছেঁড়া পাতা কি উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে ঘূর্ণির মতো!
শশিভূষণ একটা আস্ত কাচ আচমকা ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়ার মতো বলে উঠল, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। আপনার কন্যার কঠোর নির্দেশের মধ্য দিয়েই আমার কাজ শেষ হতে পারে না। তার নির্দেশে হয়তো-বা আমার গৃহের সিংহদ্বার বন্ধ হয়ে গেছে, তাই বলে এই দুর্যোগপূর্ণ রাত্রিতে, আপনি এমন অবস্থায় থাকতে পারেন না। তাই আমি আপনাকে নিতে এসেছি।
অত্যন্ত চাপা এক অভিমান ও বেদনা মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যকে উতলা করে তুলল। অশান্ত হয়ে উঠল তার মন। ক্রমশ ক্ষোভ দেখা দিলো তার চোখে-মুখে। রাগ, আক্রোশ উভয় দেখা দিয়েছে যেন। তাই হয়তো বলে উঠলেন, আজ্ঞে। বলো তো দেখি, তোমার এমন বজ্রপাতের কারণ কী?
রাধারমণ ভাবলেন, মারাত্মক কথা! কিন্তু মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য কী করবেন তা অনিশ্চিত। একথা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই রাধারমণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তবে তাও তিনি জানেন, অন্যের পছন্দের ছাঁচে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বেঁচে থাকবেন না। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের মধ্যে এক ধরনের আক্রোশ বিদ্যামান। মাঝেমধ্যে তা আচমকাই প্রকাশ পায়। এসব ভাবতে ভাবতে রাধারমণ বললেন: মহারাজ, আপনি শশিভূষণ বাবুর সঙ্গে চলে যান।
একথায় মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের মাথায় এক প্রকার আগুন জ্বলে উঠল। অন্তরে যতই আক্রোশ থাকুক না কেন, তিনি নির্বোধ নন। বললেন: না, কখনোই নয়। জীবনে যা পাওয়ার তা পেয়ে গিয়েছি ভাগ্যবশে। সৌভাগ্য নিশ্চয়। জীবন-যুদ্ধে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা কীট-পতঙ্গে আছে, উদ্ভিদেও আছে—এ বিধিদত্ত প্রেরণা। তবে আমি মানুষ হয়ে কেন বেঁচে থাকতে চাইব না? আলবত চাইব। কীট-পতঙ্গ, উদ্ভিদ রং বদলায়। আমিও বদলাব। ধরণি সব সুখ কৃপণের মতো লুকিয়ে রেখেছিল আমার কাছ থেকে, এতদিন পর তা পুষ্পাঞ্জলির মতো আমার সম্মুখে ছড়িয়ে দিয়েছে। কেন আমি তা দুই মুঠো ভরে কুড়িয়ে নেব না! ঈশ্বর আমাকে নূতন বর দিয়েছেন; আমি কেন তা প্রত্যাখ্যান করব! কেউ কখনই তা করে? আজ আমার মনে হচ্ছে: অতীত আর বর্তমানের মাঝখানে একটা পূর্ণচ্ছেদের রেখা টেনে দিচ্ছি। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য হচ্ছে তোমার সঙ্গে আমি কথা বলছি। তোমার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। তোমার সমাদর ও নিরাপত্তা—কোনোটাই আমি চাই না। মনে রেখো, দুঃখকে যখন কেউ ভাগ করে নেয়, তখন দুঃখ ততটা কঠিন বলে মনে হয় না; আর যে একা দুঃখ ভোগ করে তার আঘাতটা পড়ে অন্তরের অনেক গভীরে। তাই আমি আমার কষ্ট ও দুঃখকে তোমার বহনযোগ্য করতে চাই না। তুমি এখন আসতে পারো।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের কথায় শশিভূষণ যেন খসে-পড়া পাতার মতন হয়ে গেল। হয়তো-বা এখনো খসে পড়েনি, কিন্তু পড়তে কতক্ষণ! শীর্ণ দেখাচ্ছে তাকে। মাথা লম্বা হলেও শরীরে মেদমাংস নেই। হাড় বেরিয়ে রয়েছে। বর্ণ শ্যামলা। মুখটি সরু ধাঁচের। চোখ দুটি গভীর ঘন। ধবধবে দাঁত।
সে হতাশ্বাস শূন্যদৃষ্টিতে মহারাজের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আমি তাহলে আসি।
মহারাজ বললেন, আজ্ঞে, এসো।

শশিভূষণ চলে চাওয়ার কিছুক্ষণ পরই হঠাৎ একটি বনহস্তীর চিৎকার শুনে রাধারমণ বেরিয়ে এলেন। দেখতে পেলেন, মশাল হাতে রাত্রি-জাগা কয়েকজন বীর ও সেনাপতি দৌড়াচ্ছেন। তিনি তাদের পিছু পিছু ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখলেন, পাহারাদারদের একজনের ছিন্নভিন্ন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। তার সঙ্গীটি ঘটনার আকস্মিকতায় পুরোপুরি দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সেনাপতি পাহারারত সৈনিকের কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করার পর জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছিল?
ভয়ার্ত কণ্ঠে সৈনিক বলল, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা একটি বনহস্তীর দিকে বল্লম তাক করেছিল সে। সঙ্গে সঙ্গেই হস্তীটি ওর দিকে তাড়া করে। আমি এগিয়ে আসার আগেই, চোখের পলকে সবকিছু শেষ হয়ে যায়।
সেনাপতি বললেন, এই অঞ্চলের বুনোপ্রাণী খুবই হিংস্র। কিন্তু ওদের আক্রমণ না করলে সাধারণত এরকম করে না। বনহস্তীটি হয়তো ভেবেছিল সে আক্রান্ত হয়েছে। এখন ওদের প্রজনন-মৌসুম, তাই তাদের গা-গরম। একটু সাবধানে থাকা উচিত সকলের।

সুরগীতললিতকলায় নির্মমনিষ্ঠুর ঝড় উড়িয়ে দাও
বৃষ্টির পায়ে চারণকবিরা অর্ফিয়াসের সুরসৃজনে মগ্ন হও

এই মুহূর্তে পূর্ব দিকে আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। গত রাত্রির দুর্ঘটনাটি এখনো মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য মেনে নিতে পারছেন না। পাহারাদারের সৎকারের আদেশ দিয়ে তিনি কুটিরে প্রবেশ করে বিশ্রামের জন্য যেমন শরীর এলিয়ে দিয়েছিলেন খাটিয়ায়, তেমনই এখনো, তিনি শয্যা ত্যাগ করেননি। নিদারুণ একটা দ্বন্দ্বের আর বিবেকবুদ্ধির লাঞ্ছনার মাতামাতির মধ্যে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের সময় কাটতে লাগল, বড় কষ্টের সময়। তার আত্মগ্লানিরও সীমা নেই। তার দেহে ক্লান্তি এসেছে, আর শক্তিক্ষয়কর কেমন একটা আতঙ্ক। তিনি অতীতকে যতই প্রাণপণে ভুলতে চান, কিন্তু প্রকৃতি যেন তার নিষ্ঠুর অভিজ্ঞান নিয়ে এসে তার সম্মুখে দাঁড়ায়। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য কখনো মনে করেন যে, অতীত তার বুকের রক্তে স্থূল ভারাক্রান্ত হয়ে তার জীবনের অঙ্গ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তার এই অনুভূতি অসত্য, আর আত্মপ্রবঞ্চক, প্রকৃতি যেন তাই তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সত্তা যাকে প্রাণের ব্যগ্রতায় আড়ালে রাখতে চায়, তাকেই প্রকৃতি সম্মুখে টেনে এনে দেয়।

রাধারমণ গৃহে প্রবেশ করে দেখলেন, উষার শুকতারার মতোই যেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের চিন্তিত চক্ষু দুটি, উন্নত ললাট, অপ্রীতিকর তার মুখশ্রী, সুগঠিত দেহ ও প্রশস্ত বক্ষদেশ—বীর্য ও তেজস্বিতারই পরিচয় দিয়ে চলেছে; কিন্তু তিনি এখন বেশ দুর্বল; তার চক্ষু দুটিতে, তার ললাটে, তার মুখশ্রীতে, তার দেহ ও প্রশস্ত বক্ষদেশে ধরা পড়ে এক রকম অনুশোচনা। এই অনুশোচনা তার তৃতীয় কন্যার জন্যই।

মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য সমস্ত সকাল ডুবে রইলেন বিশ্রামে। বিশ্রাম শেষ করেন এক অস্বস্তি নিয়ে। গুমোট গরম। বাতাসে আর্দ্রতা এত বেশি যে, নিশ্বাস নেওয়াও কষ্টকর। রাত্রির স্নিগ্ধ আবহাওয়া এখন একেবারে বিপরীত। গত রাত্রের বিভীষিকার কথাও তার স্মরণ থেকে বিচ্যুত হয়নি। হয়তো-বা তার পূর্বপুরুষদের মনে মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ কিংবা রক্তারক্তি দেখে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো না, তবে এরকম একটি মৃত্যু মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের হৃদয়ে দাগ কাটল। একেবারেই অকারণে একটি প্রাণ ঝরে গেল। যুদ্ধক্ষেত্রে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটে, তা তো স্বাভাবিক নিয়ম, মনে একটা প্রস্তুতি থাকে; কিন্তু বন্যপশু একজন জলজ্যান্ত মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে রেখে যাবে, তা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়! সংশয়াকুল অন্তরে তার তিলার্ধ স্বস্তি নেই। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন: মানুষের প্রাণ এত সহজে বিলীন হয়ে যায়! তার বুকের ভেতর দ্রবীভূত অগ্নি যেমন আছে, তেমনই সুশীতল জলস্রোতও বইছে, কিন্তু তার বুকে কেবল আগুন।

দুপুরের আহারের পর, মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, এখানে আর এক মুহূর্তও থাকা চলে না। মণিপুরের রাজপ্রাসাদেই আশ্রয় নেওয়া উচিত। তিনি প্রত্যাশা করছেন সেখানে পৌঁছলে নতুন আর কোনো ঝামেলা সৃষ্টি হবে না। রাধারমণ দেখলেন, মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের চোখে কী গভীর মর্মভেদী দৃষ্টি! এই দৃষ্টির মধ্য দিয়ে যেন কোনো অজ্ঞাত মানসলোকে চলে যাচ্ছেন তিনি। হঠাৎ মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, আমার রাজ্যকে রক্ষা করার জন্যই আমি আমার কনিষ্ঠ কন্যাকে হারিয়েছি। তোর হাতের স্পর্শও কি আমি আর এই জীবনে পাব না? তোকে খুঁজে পেয়ে আমি কি আর বলতে পারব না যে, আমার চোখ খুঁজে পেয়েছি। তারপর রাধারমণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি মণিপুরের পথ সম্বন্ধে পরিচিত?
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের পদতলে দীর্ঘ ছায়াটি তার ব্যথিত হৃদয়ের একটি ম্লান নিঃশব্দ দীর্ঘনিশ্বাসের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। এইদিকে তাকিয়ে রাধারমণ বললেন: আজ্ঞে মহারাজ, মণিপুরের পথ আমার সুপরিচিত।
সাগরগর্ভ থেকে ওঠার সময় লক্ষ্মীর বরাঙ্গে উত্থিত অর্ধ-সূর্যালোক ঠিক এমনই উদ্ভাসিত হয়েছিল যে, দেবগণ উল্লাসে ও বিস্ময়ে জয়ধ্বনি করে ওঠেন; রাধারমণের ‘সুপরিচিত’ শব্দটি যেন ঠিক তেমনই মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের অন্তরে জয়ধ্বনি করতে লাগল। বললেন: তাহলে আপনি আমাকে মণিপুর রাজপ্রাসাদে নিয়ে যান।
রাধারমণ বললেন: ঠিক আছে, মহারাজ।
রাধারমণের কণ্ঠে এমনই সুর যেন বাজল—যা স্নিগ্ধ, গোপন আনন্দে মধুময়।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন: আচ্ছা, ত্রিপুরা রাজ্যের সম্পদের বিলিব্যবস্থা এমন হয় না কেন, যেন কারো কাছে অতিরিক্ত না থাকে, আবার প্রত্যেকের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে থাকে।
রাধারমণ বললেন: ভবিষ্যতে এমন ব্যবস্থা করা যাবে, মহারাজ।

রাধারমণ কিছুদিন আগে এক দূতের মাধ্যমে একটি পত্র পাঠিয়েছিলেন মণিপুরে। এই দূত কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছে। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যকে বিশ্রামে পাঠিয়ে তিনি দূতের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। দূত রাধারমণের পত্র পাঠে মনোমোহিনীর যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তারই বিবরণ দিতে লাগল: রাজকুমারী আমার সামনেই পত্রটি পড়লেন, তার চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে; তবে তার আচরণে আবেগের চেয়েও বেশি করে চোখে পড়ে এক দ্রোহী নারীকে। তিনি ক্রোধে কখনো উন্মত্ত হয়ে যাননি। ধৈর্য ও দুঃখ যেন পাশাপাশি বিরাজ করছিল।

সংকটে আশাতীতভাবে উত্তীর্ণ হয়ে রাধারমণের যতটা উল্লাস ঘটেছে, দূতের কথায় ঘটেছে তার তিনগুণ। তার সারা প্রাণে এক অনির্বচনীয় অমৃতস্রোত বইয়ে দিচ্ছে। তিনি পুলকিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, রাজকুমারী কি অন্য কিছু জানতে চাইলেন?
দূত বলল: তিনি ‘পিতা’, ‘পিতা’ বলে আর্তনাদ করছিলেন। মণিপুরে এসে শাস্ত্রাধ্যয়ন ও আরাম-আয়েশের ভেতর তার পিতা এক পুণ্যজীবন উপভোগ করতে পারবেন। ধীরে বয়ে চলা মণিপুরের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার পিতার হৃদয়ে শিহরণ জাগাবে বলেই তার বিশ্বাস। এই অবসর জীবনে মণিপুরের রূপ অকল্পনীয় আলপনায় ও মায়াবী জাদু নিয়ে ধরা দেবে তার পিতার কোমল হৃদয়ে। প্রাকৃতিক এক সুরক্ষা রয়েছে এই মণিপুরে। বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর, পাহাড়ি নদী, গাঢ় নীল আকাশ—সব মিলিয়ে এখানে বসবাস করা তার পিতার জন্য কঠিন হবে না। তিনি রাজপ্রাসাদের অলিন্দে বসে জ্বলজ্বলে সন্ধ্যাতারা পূর্বাকাশ থেকে শেষরাত্রের তারা হয়ে পশ্চিমাকাশে কীভাবে মিলিয়ে যায়, তা আনন্দচিত্তে উপভোগ করতে পারবেন। তাছাড়া পূর্বে ঘন বন রয়েছে, সেখানে হিংস্র পশুর রাজত্ব। তিনি ইচ্ছে করলে শিকারেও যেতে পারবেন। এভাবেই রাজকুমারী মহারাজকে নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্নজাল বুনে চলছিলেন। তারপর ভগ্নহৃদয়ে তিনি আরও কিছু কথা বলছিলেন। তা আমি বুঝতে সক্ষম হইনি। নিজের মনের কথা তিনি নিজের মনেই চেপে রেখেছিলেন।
রাধারমণ বললেন, মহারাজকে নিয়ে আমরা তাহলে তার কাছেই যাব।

চলবে...

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন