গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বলের সাক্ষাৎকার
‘দেশের মুসলমানদের বইয়ের মাধ্যমে প্রামাণ্য কিছু দিতে পেরেছি’
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল ইতিহাস ও প্রত্নগবেষক। জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৩, মুন্সীগঞ্জ জেলা সদরের বড় কেওয়ার গ্রামে। পিতা আলহাজ আবুল হাসেম খান ছিলেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের অ্যাকাউন্টেন্ট। মা খাদিজা বেগম গৃহিণী। দুজনই প্রয়াত। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিএসএস সম্মান, এমএসএস (অর্থনীতি)। লেখালিখির বয়স চার দশকের কাছাকাছি। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৪টি। বর্তমানে তিনি মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক রজত রেখা পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি তার গবেষণা ও লেখালিখি বিষয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও কথাশিল্পী মুহাম্মদ ফরিদ হাসান—
জাগো নিউজ: শৈশব এবং শিক্ষাজীবনের কোনো বিশেষ স্মৃতি আছে কি, যা আপনাকে প্রত্নসম্পদ নিয়ে গবেষণা করতে অনুপ্রাণিত করেছে?
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল: একেবারে ছোটবেলার কথা বলি। আমাদের বাড়ির পাশে চার-চারটি মুসলিম ঐতিহ্য রয়েছে। কেওয়ার বারো আউলিয়ার মাজার (স্থাপিত ৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ), কেওয়ার শেখদ্বার হোসাইনী (র.) মাজার (স্থাপিত ১০৫২/১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দ), কেওয়ার মিয়াবাড়ি জামে মসজিদ দেখে দেখে বড় হয়েছি। ওখান থেকে কিছুটা প্রভাবিত হয়ছি এটা সত্যি। তবে উঠতি বয়সে, ১৯৮৭ সালের শেষদিকে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সহকারী সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল গফুর আমাকে বাংলাদেশের প্রাচীনতম মসজিদ নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করেন। আমাকে লালমনিরহাট জেলায় পাঠান। আমি বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদ নিয়ে কাজ করি। এই শুরু বৃহৎ পরিসরে।
জাগো নিউজ: প্রত্নসম্পদ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী ছিল?
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল: চ্যালেঞ্জ অবশ্যই আছে। ইট, কাঠ, সুরকি, লোহা, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা মূর্তি নিয়ে কাজ করতে যাওয়া মানে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো। প্রত্নতত্ত্ব বিষয়টি রসকষহীন সাবজেক্ট। এর পাঠক সংখ্যা খুব কম। এরপর শতবছরের প্রাচীন কোনো বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করতে কোথাও গেলে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। সহজে কেউ তথ্য দিতে চায় না। অনেক ইমারত ব্যক্তিদখলে থাকায় সঠিক তথ্য নেওয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। দখল ছুটে যাওয়ার ভয়ে তথ্য দেয় না। সরকারও প্রত্নতত্ত্ববিদদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন না। এর মধ্যে দু’একটা ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। এ ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের অর্থে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রত্নতত্ত্ব জরিপ ও খনন করছে। তদের এ মহতি উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ উদ্ঘাটনে প্রত্নবিদদের আর্থিক সহায়তা প্রদান প্রয়োজন বলে মনে করি।
জাগো নিউজ: আপনার বইগুলোর মধ্যে কোনটি আপনার কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং কেন?
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল: আমার এ পর্যন্ত ২৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে। শুধু আমার বেলায় নয়, প্রত্যেক লেখকের কাছে তার লেখা বইগুলো সন্তানতুল্য। আমার লেখা সব গ্রন্থ আমি অতি গুরুত্বসহকারে লিখি। আমার বইগুলো আল্লাহর অশেষ রহমতে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। আমার সবকটি বই সরকারের কোনো না কোনো সংস্থা কিনেছে। তবে প্রথম বই ‘ইতিহাস ঐতিহ্যে বিক্রমপুর’ হাতে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি। আমার লেখা বইটি ও দুর্গনগরী মুন্সীগঞ্জ জেলাব্যাপী আলোচিত ও ব্যাপক পঠিত। বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহাসিক ১০০ মসজিদ শুধু বাংলাদেশে নয় ভারতেও অসংখ্য কপি বিক্রি হচ্ছে। মসজিদ নিয়ে আমার বেশ কয়েকটি গ্রন্থ আছে। আমি জোর গলায় বলতে পারি, আমি এদেশের মুসলমানদের জন্য বইয়ের মাধ্যমে প্রামাণ্য কিছু উপহার দিতে পেরেছি।
জাগো নিউজ: প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলো কী?
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সমস্যা গভীর। পাঠকগণ আমাকে ক্ষমা করবেন। প্রত্নতত্ত্ব চর্চা করতে এসে দেখলাম আমাদের বিজ্ঞ লেখকগণ স্ব স্ব সম্প্রদায়কে প্রাধান্য দিয়ে অন্যদের এড়িয়ে গেছেন। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়ই হোক—এটাই সত্য। কী প্রত্নতত্ত্ব, কী স্থাপত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য একটি বিশেষ সময়ে মুসলমানদের সম্পর্কে অনেক কিছুই এড়িয়ে গেছেন। তাই নতুন গবেষকদের জন্য অনেক তথ্য উদ্ঘাটন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এ সমস্যায় আমিও পড়ি হরহামেশায়। ধরুন ঢাকার কামান ওসমানী উদ্যান থেকে ঢাকা গেটে নেওয়া হলো। কিন্তু কামানটি দৈর্ঘ, রাউন্ড, ওজন জানা নেই। ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরের শাপলা ভাস্কর্য এর কতটা পাপড়ি, পাপড়ির দৈর্ঘ-প্রস্থ কত তা কোথাও পাইনি। কিন্তু পাওয়া তো জরুরি। দোয়েল ভাস্কর্যের তথ্য নিয়ে একই সমস্যা। বর্তমানে আমি নিজে যেয়ে মেপে মেপে স্থাপত্য রূপ বের করি। প্রকৌশলীর হিসেবের সাথে আমার তথ্য অমিলও তো থাকতে পারে। এটা একটা বড় সমস্যা। আগেই বলেছি ফিন্যান্স সমস্যা, সহযোগী মনোভাবের সমস্যা, প্রচার অর্থাৎ পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিকস মিডিয়া এ বিষয় নিয়ে প্রচার বিমুখ মনে হচ্ছে।
আমাদের প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে বইয়ের সংখ্যা কম। ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী, আ. কা. ম জাকারিয়া, ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, মো. মোশাররফ হোসেন, প্রফেসর আব্দুল করিম, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, প্রফেসর আয়েশা বেগম, সৈয়দ মো. তৈফুর, মুনশী রহমান আলী তায়েশ। এ ছাড়া কানিংহাম, মি. লি, মি. ক্লে, ডি ওয়েলি ছাড়া বই নেই। তারা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। এর পরের তথ্য অবশ্য আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে হবে। তাই সরাসরি স্পটে যেয়ে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি ও পালি-ভাষা অভিজ্ঞ পণ্ডিতের সংখ্যা খুব কম। আপনি দেখবেন, বিগত ৭০-৮০ বছরের মধ্যে নতুন কোনো কপার প্লেট, মূর্তি লিপি, মসজিদ লিপি, কয়েন বা মুদ্রার পাঠোদ্ধার হয়নি। শুধু তাই নয়, মুন্সীগঞ্জে পাওয়া ভোজ বর্ম দেবের শিলালিপিরও পাঠোদ্ধার হয়নি ১০০ বছরে। যারা প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন, তাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। দেখা যাচ্ছে যারা প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তারা খুব কমই এ বিষয় নিয়ে আগ্রহী।
জাগো নিউজ: লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনার প্রক্রিয়া কী? কীভাবে একটি বইয়ের ধারণা থেকে শুরু করে তা সম্পূর্ণ করেন?
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল: আমি যে বিষয় নিয়ে লিখি, শুরুতেই ওই বিষয়ের ওপর কিছু বই পড়ি। এরপর আমি সরাসরি ওই স্পটে যাই এবং সম্মুখ ধারণা নিই। কোনটি আগে কোনটি পরে এটা পাণ্ডুলিপি লেখার পরে ঠিক করি। আগে লিখে সংরক্ষণ করি। পরে বাছাই করি। এ বিষয়ে যারা পারদর্শী তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে তারপর বই প্রকাশ করি।
জাগো নিউজ: গবেষণা ও লেখালিখি করার সময় কীভাবে তথ্যসূত্র সংগ্রহ করেন?
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল: বাংলাদেশের সব জেলায়ই কমবেশি প্রত্নস্থল রয়েছে। যেগুলো উদঘাটন হয়েছে তা হয়তো রেফারেন্স বইয়ে রয়েছে। যেগুলো উদঘাটন হয়নি বা সদ্য উদ্ঘাটন হয়েছে তার জন্য সরাসরি ওই স্পটে যেয়ে কাজ করতে হয়। আমিও একইভাবে করি।
জাগো নিউজ: মুন্সীগঞ্জের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যকে রক্ষা এবং তুলে ধরার জন্য আপনার পরামর্শ কী?
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল: আপনি অবশ্যই জেনে থাকবেন সরকারিভাবে বেশ কয়েক বছর আগে মুন্সীগঞ্জকে প্রত্ননগরী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ জেলায় ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে রয়েছে বিক্রমপুর ইতিহাস পরিষদ, মুন্সীগঞ্জ ইতিহাস ঐতিহ্য, অগ্রসর বিক্রমপুর নামে একাধিক সংগঠন। অগ্রসর বিক্রমপুর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্যে রঘুরামপুর ও নাটেশ্বরে খনন কাজ করেছে। নাটেশ্বর নিয়ে আমার অসংখ্য লেখা আছে যা বিভিন্ন পত্রিকায় ও বইয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে। আমার গবেষণার ফসল নাটেশ্বর প্রত্নস্থল। মুন্সীগঞ্জের আরও প্রত্নস্থল বল্লালবাড়ি, ধামারণ, ধামধ, সুখবাসপুর, রামপাল, অতীশ দীপঙ্করের বাড়ি খনন করা ও তা পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করা। একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা হয়েছে তবে তা যথেষ্ট সমৃদ্ধ নয়। মুন্সীগঞ্জ জেলা নিয়ে আরও গবেষণা ও অধ্যায়ন প্রয়োজন বোধ করি। তরুণ ও নতুন প্রজন্মের নিকট মুন্সীগঞ্জের অতীত দিনের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধির কথা জানাতে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সব কিছু সঠিকভাবে নতুনদের কাছে পৌঁছাতে হবে।
জাগো নিউজ: বর্তমানে কোনো নতুন গবেষণা প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন কি?
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল: হ্যাঁ, মুন্সীগঞ্জের মুসলিম ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করছি। মুন্সীগঞ্জের মুসলমানদের নিয়ে মোটেও কাজ হয়নি। এর মধ্যে ৫০ ভাগ কাজ সম্পন্ন করেছি। বাকিটা আরও মাস তিনেক লাগবে।
জাগো নিউজ: যারা প্রত্নসম্পদ নিয়ে গবেষণা করতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী হবে?
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল: যারা প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক তারা প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে বই পড়বে। এর মধ্যে ড. নলিনীকান্ত ভট্টাশালীর আইকোনোগ্রাফ বুড্ডিস্ট অ্যান্ড হিন্দুজ স্ক্যালপচার অব ঢাকা মিউজিয়াম, কয়েন অ্যান্ড ক্রনলোজি আর্লি ইন্ডিপেন্ডেন্ট সুলতান অব বেঙ্গল, মুনশী রহমান আলী তায়েশের তাওয়ারিখে ঢাকা, খন্দকার মাহমুদুল হাসানের প্রাচীন বাংলার পথে প্রান্তরে পড়া প্রয়োজন। আমার লেখা বাংলাদেশের প্রত্ন ইতিহাস ও আধুনিক ঢাকা, বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহাসিক ১০০ মসজিদ। আগ্রহীরা চাইলে পড়তে পারেন।
জাগো নিউজ: নতুন লেখকদের জন্য আপনার বিশেষ কোনো পরামর্শ আছে?
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল: আমার মনে হয় ভালো লেখক হতে হলে ভালো পাঠক হতে হয়। যতই পড়বে ততই শিখবে। আমি এই মন্ত্রে বিশ্বাসী। অধ্যবসায়ের বিকল্প কিছু নেই। একটা ভালো বই একজন মানুষের জীবন পাল্টে দিতে পারে বলে আমি মনে করি। তাই আসুন আমরা বই পড়ার অভ্যাস গড়ি।
জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল: আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আপনাকে এবং জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ।
এসইউ/জেআইএম