ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মুকিদ চৌধুরীর নাট্যোপন্যাস

গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৮

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৪০ পিএম, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

গোমতীর স্রোত: কতরং

পরিজন, সে নহে আপনজন
কতরঙে রঞ্জিত রুপোলি মেঘ

অক্ষয় দাস তার পুত্র পার্থের দরজার সামনে এসে উপস্থিত হলেন। পার্থ সবেমাত্র বিকেলবেলার ঘুম থেকে উঠেছে। তার চোখ-মুখ ফোলা। চুল এলোমেলো। পিতার পদশব্দে সে অবাক হলো। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হয় অক্ষয় দাসের। বরং অক্ষয় দাসের চক্ষুদ্বয়ের। চোখের মতো সুলভ অথচ যুগপৎ সুকোমল ও সুকঠিন বস্তু দুটি ভূমণ্ডলে আর-কিছু নেই, এবং একসঙ্গেই ব্যাখ্যাত ও অব্যাখ্যাত হিসেবে অতীব আশ্চর্য জিনিস দুটি। মানুষের মনের গভীরতম বার্তাটি নিঃশব্দে অনাড়ম্বরে প্রকাশ করে এই স্বচ্ছ দুটি চোখ। পিতার চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো, তার চোখের নিচে কেমন যেন গভীর চিন্তারেখা ফুটে রয়েছে।

অক্ষয় দাস বললেন, পার্থ তোর সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
পার্থ একটি চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, কী আলাপ বাবা?
বিছানার পাশে এক গাদা জামাকাপড় ডাঁই করা। গৃহকর্ত্রী লক্ষ্মী—পার্থের মা—এসে এসব ধুতে নিয়ে যাবেন, কেননা পার্থ কোনো গৃহকাজ করে না। এক গাদা জামাকাপড়ে তাকিয়ে অক্ষয় দাস বললেন, তোর জন্য একটি পাত্রী নির্বাচন করেছি।
কথাটি উল্লেখের সময় অক্ষয় দাসের ওষ্ঠ প্রান্তে একটু হাসির উদয় হয়েছিল, কিন্তু পার্থ যেন তা দেখেও দেখল না; সে কী বলবে বুঝে পাচ্ছে না। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। লক্ষ্মী চায়ের ভাঁড় নিয়ে উপস্থিত হলেন। একটি চায়ের ভাঁড় অক্ষয় দাসের সামনে রাখতে রাখতে বললেন, কোথায়?
পার্থ বক্রনয়নে অক্ষয় দাসের মুখের ওপর একটা কৌতুক-কটাক্ষ নিক্ষেপ করে অন্যমনস্কভাবে চায়ে চুমুক দিলো, তারপর মুখ থেকে চায়ের ভাঁড়টা নামিয়ে লক্ষ্মীর দিকে ভুরুভঙ্গি করলো। সে যেন তলিয়ে যাচ্ছে কোনো এক অজানা জগতে। অক্ষয় দাস বললেন, সময় হলেই জানতে পারবি।

অযৌক্তিকতায় অবাক হওয়ার জন্য চোখ এবং হাঁ যতটা বড় করা যুক্তিযুক্ত ততখানিই বড় করে লক্ষ্মী তার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। স্বামীর কণ্ঠে এরকম কথা শোনা লক্ষ্মীর অভ্যাস হয়ে গেছে যদিও, তবে তার ইচ্ছে, তার স্বামীকে আরও আপনার করে পাওয়া, সে সুখ অনির্বচনীয়। তার চোখ দুটি প্রার্থনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল; কিন্তু এই প্রার্থনার আবেদন আপাতত কোনো কাজে এলো না; তাই তিনি খানিকটা ভেবে বললেন: খাও, খাও, চা খাও। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। যা করতে যাচ্ছো তা আজ না হলেও কাল তো জানতে পারবো।
পার্থ তার মায়ের দিকে আর-একবার তাকাল। অসম্ভব বেদনার্ত এক মায়ের ছবি যেন তার চোখে ধরা পড়লো। মায়ের এই দুঃখটুকুই কেবল পার্থকে বিচলিত করতে পারে—এই স্থানটিতে কঠোর হতে তার বাধে না, তাই মাটির দিকে চোখ রেখে, স্খলিত জিভে প্রতিবাদ করল: কিন্তু বাবা, আমার পক্ষে এই ব্যাপারে সম্মতি দেওয়া সম্ভব নয়। অসাধ্যই বটে।
পার্থের কণ্ঠে এমন একটা কঠিন দ্বিধার সুর বাজল—যেন অক্ষয় দাস নিশ্চয়ই জানেন, তার পুত্রের এই অন্তরগত অকপটতা যেমন সত্য তেমনই নিস্ফল, এবং তার দুঃখ এইখানেই। এই দুঃখটুকু অবশ্য অক্ষয় দাসকে বিচলিত করতে পারলো না—এই স্থানে কঠোর হতে তার বাধে না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
মাটির দিকে চোখ রেখে পার্থ বলল, আমি অন্য স্থানে আবদ্ধ।
অক্ষয় দাস ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবার। অসহিষ্ণু ও অবরুদ্ধ স্বরে প্রশ্ন করলেন, অন্য স্থানে মানে?
লক্ষ্মীর ভুরু কুঁচকে উঠল, তিনি তীব্র প্রতিবাদ করলেন: কী! নিজের চোখ দিয়ে নিজের সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছিস—এর সংশোধন চাই। চক্ষুলজ্জা নেই তোর? নিজেকে একেবারে বিকিয়ে দিয়েছিস, পার্থ? কার সঙ্গে কথা বলছিস তা তোর জানা উচিত।
লক্ষ্মীর কথায় পার্থ অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে উঠল। নিরুপায় ও শান্তভাবে বলল: আমার প্রতি তোমার মন কেন এমন বিমুখ, সত্যি বলছি তোমাকে, এটি আমার বড় হেঁয়ালির মতো ঠেকে। তবে...
কথা শেষ করতে পারেনি পার্থ, স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। অক্ষয় দাসের চোখ দুটি অগ্নিময়। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, তবে আবার কী! কন্যাপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা ঠিক করে ফেলেছ বুঝি?
লক্ষ্মী মাথা নাড়লেন। তার গলায় কান্না। স্বর ফোটে না। একটুখানি কেশে গলা পরিষ্কার করে, অতিশয় ক্ষুণ্ণ হয়ে, বলতে লাগলেন: বড় দুঃখ হচ্ছে। কী নিষ্ঠুর! কী অন্যায়!
এখানেই এই আলোচনার সমাপ্তি ঘটা উচিত ছিল; কিন্তু পার্থ তা ঘটতে দিলো না। ক্লান্ত গলায় বলল, অন্যায় আমি কিছুই করিনি। কথাবার্তা যাকে বলে তা এখনো হয়নি।
লক্ষ্মীর চোখে-মুখে একটি বিরাট প্রশ্নচিহ্ন প্রকাশ পেল। পার্থের দিকে তাকিয়ে থেকেও কোনো সমাধান পাচ্ছেন না তিনি। অক্ষয় দাস বললেন, যখন হয়নি তখন সমস্যা কীসের! যে কাজের সূচনাই হয়নি, তাকে বাষ্পীয় কল্পনার শক্তিতে ঠেলে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অনর্থক! তাই বলছি, এতদিন যখন আমাকে না জানিয়ে চুপ থাকতে পেরেছিস, তাহলে আরও কয়েকটা দিন না-হয় নিশ্চুপই থাকলি।

পার্থ অবাক হলো। এসব কী হচ্ছে? কিছু ভয় ও দুশ্চিন্তা মিশে যায় তার মগজে। ছোট একটি উত্তর দিলো, হ্যাঁ।
পার্থের উদ্দেশ্যে লক্ষ্মী বললেন, আজ্ঞে, নিশ্চুপ থাকাটাই বরং তোর জন্য উত্তম।
পার্থ বলল, উত্তম হবে কি না তা জানি না, তবে জানি, আর কাউকে আমার পত্নীরূপে গ্রহণ করা অন্যায় হবে।
অক্ষয় দাস দ্রুতপদে ঘর ত্যাগের বন্দোবস্ত করলেন, কিন্তু দরজার পাশে এসে আবার থমকে দাঁড়ালেন, পিছু ফিরে বললেন: ন্যায়-অন্যায় সম্বন্ধে আমি ভালো জানি। তবে একটি কথা বলে রাখছি, এখানে বিয়ে না করলে তোর অন্যায় হবে। স্পষ্ট ভাষায় বলে দিচ্ছি, আমি মরলেই হয়তো-বা তোর অলক্ষণ ঘুচবে, এর আগে নয়।
পার্থ ভাবতে থাকে: ওর হাতে যদি তেমন ক্ষমতা থাকত, তাহলে এতদিনে সুশীলাকে ঘরে তুলে আনতোই।
পুত্রের ঔদ্ধত্যে খেপে লাল অক্ষয় দাস ঘর থেকে চলে গেলে লক্ষ্মী খুব হালকাভাবেই প্রশ্ন করলেন, কার সঙ্গে সম্পর্ক?
সুশীলা।
মেয়েটার সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে বুঝি?
হ্যাঁ।
ওকে তোর বাবা কখনোই মেনে নেবেন না।
জানি। কিন্তু...
কিন্তু আবার কী?

সুশীলার রূপদর্শন পার্থের ভাগ্যে প্রথম। সুশীলাকে দেখার আগে, বিচিত্র জীবনের দশদিকেই যে মানুষের জীবনচক্র ধাবিত হয় তা পার্থের যেমন অজ্ঞাত ছিল, তেমনই অজ্ঞাত ছিল প্রেম। সুশীলার রূপ যে কেবল ছায়া নয়, বরং তা রসাবেদনে পরিপূর্ণ একটি সজীব গভীর সত্য বাস্তবতা। সুশীলাকে দেখলেই তার পরমাত্মা যেন অমৃতলোকে চঞ্চল হয়ে ওঠে। এই সুশীলার স্পন্দন নিশ্বাসেই যেন পার্থের বন্দি প্রাণ মুক্তিলাভ করে মুক্তির আনন্দে উল্লসিত হয়। সুশীলার মুখখানি দীর্ঘদিন ধরে তার হৃদয়ে রক্তকমলের মতো ফুটে রয়েছে। হয়তো তাই পার্থ বলল, সুশীলার জন্য জীবনের সবকিছু ত্যাগ করা যায়। তুমি কথা বলে দেখো।
তোরা বাপ-বেটা মিলে আমার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিস।
মনে-মনে হাসল পার্থ। লক্ষ্মী ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। পার্থ নিরানন্দে গৃহ ত্যাগ করল। পলায়ন ছাড়া তার আর কীইবা করার উপায় আছে!

চমৎকার দেখাচ্ছে অমিতকে। অমিত পার্থেরই বন্ধু। বেগুনি রঙের ফতুয়া, সাদা পায়জামা। পার্থের মনে পড়ল, কিছুদিন আগে যাত্রাপালার নায়ক একই রকম পোশাক পরেছিল। একথা ভেবেই, হঠাৎ, খুবই বিরক্তি লাগছে পার্থের। কিন্তু অমিতের যাত্রাপালার নায়ককে নকল করার ব্যাপারটা সে সহ্য করতে পারছে না। সেই নায়কের সঙ্গে যেন অমিতের চেহারারও মিল রয়েছে। দরাজ উন্নত শরীর। পার্থের দিকে দরাজ গলায় অমিত প্রশ্ন ছুড়ল, এই অসময়ে এখানে একাকী বসে কী করছিস?
কোনো এক গাঢ় স্বপ্নের মধ্যে ভাসতে ভাসতে পার্থ বলল, কিচ্ছু না।
অর্ধেক ক্লান্তি নিয়ে অমিত বলল, হঠাৎ এটি কেমন পাগলামি শুরু করলি তুই!
পার্থ ভুরু কুঁচকে বলল, কীসের পাগলামি!
অমিত চোখ বন্ধ করে হাসল। পকেট থেকে একটি পাতলা রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে বলল, শুনলাম বিয়ে করতে যাচ্ছিস!
পার্থ নিজের দুর্বলতার কাছে আত্মসমর্পণ করল, তবুও কোথায় যেন একটি কষ্ট জমে থাকে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, সেই কথা। তবে তা ইচ্ছে করে অবশ্যই করছি না, বরং বলতে পারিস বাধ্যতামূলক।
ঘড়ঘড়ে গলায় জবাব দিলো অমিত, কী বোকার মতো কথা! বাধ্যতামূলক?
প্রথমে পার্থ কিছুই বলতে পারেনি। এক রকম সংকোচে আচ্ছন্ন। হাত-পা ঘেমে উঠছে। গলাও শুকিয়ে যাচ্ছে। কোনোক্রমে বলল, হ্যাঁ, বাধ্যতামূলক। মা-বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তো যেতে পারি না।

পার্থের হালকা কণ্ঠের কথাগুলোয় ঘৃণ্যাক্ষরের মতো একটা দ্বিধার দৌর্বল্য মিশে ছিল তা বোধহয় সে নিজেও অনুভব করতে পারেনি; পেরেছে কেবল অমিত। অমিত যখন পার্থের দিকে চোখ ফেরাল তখন এই দৃষ্টিতে তার হৃদয়ের সুকোমল প্রসন্নতার ছায়ামাত্রও ছিল না।
ব্যাপারটা ভীষণ স্বাভাবিক। স্বাভাবিক স্বরে পার্থ কথাগুলো বললেও তার কণ্ঠ বেয়ে যেন কান্না নেমে এলো। সে জানে, অমিত কান্নায় ভিজে যাওয়ার পাত্র নয়। তবুও অজানা ভয়ে, অসহায় অভিমানে সে চাপাকান্নায় ভেসে যেতে থাকে। অমিত সেদিকে কর্ণপাত না করেই ফুঁসে উঠল: একটা স্বাভাবিক যুক্তি খাড়া করে দিলি। মা-বাবার বিরুদ্ধে?
পার্থের তো সঠিক কোনো যুক্তির প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন যাবতীয় উচ্ছৃঙ্খলতার উদ্দেশ্যে কিছু একটা খাড়া করা। বলল, তাহলে বল্ আমার কী করা উচিত?
অমিত তার একটি কর্কশ কিন্তু নরম থাবা পার্থের পিঠে বসিয়ে বলল, তবুও কিছু কথা থেকে যায়।

পার্থের সারা আকাশজুড়েই তো সুশীলা। সে মানেই তার জীবন; তার জীবনের অসীমতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে ভাবতেই পারা যায় না। সে সুশীলায় জাগে, সুশীলায় ঘুমোয়, সুশীলায় মরে, সুশীলার জন্যই বেঁচে ওঠে—এসব তো অমিতের অজানা নয়। অমিতের প্রতি গভীর অভিমানে, এক চঞ্চল ব্যাকুলতায় পার্থ বলল: কী কথা?
অমিত বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বায়ুমণ্ডল একেবারে নিঃশব্দ—মনে হয়, কোথাও একটু শব্দ হলেই সেই শব্দের আর শেষ হবে না—ঘুরেফিরে কেবলই আসবে আর যাবে। অমিত ভেবে চলল: কী করেছে সুশীলা! খারাপ কিছু? সুশীলাকে তো বোঝানোর কেউ নেই। মা-বাবা সব বোঝাবুঝির বাইরে। ভাইটা উদাসীন। নিজে ঘুরে বেড়ায় আপনভোলা। গাছের মাথায় মাথায় সূর্যালোকের স্পর্শ—তাও সর্বোচ্চ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে অমিত বলল: সুশীলাকে ছেড়ে অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করা তোর জন্য বিশেষ কোনো মহৎ কর্ম হবে না, হতেও পারে না। ওর কথা তোর ভাবা উচিত।
ভেবেছি। পার্থ বলল।
অমিতের মাথার মধ্যে পাক দিতে থাকে শব্দটি। অমিতের অন্তরটাই যেন আবর্তিত হয়ে ঠোঁটে এসে একটি অতীব ক্রূর হাসির জন্ম নিলো। সুশীলার প্রসঙ্গটা অনিবার্য কারণে মৃদু কাঁপন ধরিয়ে দেয় তার সমস্ত শরীরে। সুশীলার বিষয়টি দামামার মতো বাজতে থাকে তার চিন্তা-চেতনায়। কিছুতেই ঠেলে সরাতে পারছে না, তাই বলল: ভাবলে অবশ্য তুই জানিস, সুশীলার মতো মেয়েকে না-ভালোবাসা বরং অন্যায়। ওকে বঞ্চিত করা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। ওকে ভালোবাসতে না-পারাটাই বরং অস্বাভাবিক, তাই না?
হয়তো-বা! পার্থের ঠোঁটের ফাঁকে বেরিয়ে এলো।

অন্যমনস্ক থাকলেও পার্থ বুঝতে পারে অমিত তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শান্ত-নরম চোখে দেখে নিলো একবার অমিতকে। অমিতের ঠোঁট একটু বাঁকা হয়ে আছে। এই বাঁকা ঠোঁটেই অমিত বলল, হয়তো-বা মানে! সুশীলাকে নিয়েই তুই জীবন গড়বি, এই তো কথা ছিল। নাকি নতুন মেয়েটিকে বিয়ে করার অভিপ্রায় হয়ে গেছে তোর?
আমি তো বিয়ে করতে চাই না। কিন্তু বাবা-মা...
বাবা-মায়ের দোহাই দেওয়া তোর সাজে না।
পার্থ জানে, নড়বড়ে সময়টা বড্ড বিপজ্জনক। অল্প হাওয়াকেই ঝড় বলে ভ্রম হয়। অমিতের দিকে তাকিয়ে নিজের চোখের ভাষা গোপন করে, ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নিরুৎসাহ মিশিয়ে বলল: সাজে কি সাজে-না তা আমি ভালো জানি।
ভয়ার্ত ব্যাকুল পার্থের চক্ষুদ্বয় দিগ্বিদিকে দৃষ্টি হেনে বেড়াচ্ছে। আতঙ্কের আতপে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠেছে; দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে তার চক্ষু দুটি এক-একবার নিষ্পলক হয়ে বুকের স্পন্দন থরথর করছে। জগৎময় সে মনে-মনে হাতড়ে বেড়াচ্ছে সুশীলার মুখখানি; বাঘের থাবার নিচে মৃগীর মতো তার কাঁপুনি। পার্থের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অমিতও বুঝতে পারে যে, পার্থ তার যুক্তি আর সিদ্ধান্তকে একটা বলিষ্ঠ মানবিক ব্যাখ্যায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। অমিত তাকাল আবার পার্থের মুখের দিকে। দুশ্চিন্তায় পুড়ে যাওয়া মুখের ওপর এখনো পরাজয় আর অপমান ভেসে রয়েছে। মনটা যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যাচ্ছে। তার আধারটা শুকনো ধূসর আকৃতিহীন। প্রতিমা বিসর্জন দিলে যেমন গলে যায় তেমনই। বিপন্ন পার্থের এই ছবিখানি দেখতে দেখতে উচ্চকণ্ঠে অমিত বলল: এত যেহেতু জানিস, তাহলে সুশীলার কথা চিন্তা করা কি তোর জন্য অন্যায়?

এই মুহূর্তে পার্থের চোখে ভেসে ওঠে সুশীলার সাহস! তার কোনো লোকভয় নেই। পরনিন্দারও পরোয়া করে না। শুধু চায় পার্থের ভালোবাসা। পার্থের বুক দুরুদুরু করে ওঠে। শক্তি সঞ্চয় করে পার্থ বলল, ন্যায়-অন্যায় আমি জানি না। শুধু জানি, সুশীলা ও আমার সম্পর্ক যেন অক্ষুণ্ণ থাকে সেজন্য আমাকে বাবার সংকল্পে রাজি হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তুই কিছু চিন্তা করিস না। যে-পথে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সে-পথে তোর আশীর্বাদ থাকলে আমাদের দুইজনেরই মঙ্গল হবে।

পার্থ কেমন অকারণেই অমিতকে একবার দেখে নিলো—বুক তার দুরুদুরু করছে। তার নিজের কণ্ঠস্বর যখন নিজের কানে পৌঁছায়; তখন তার মনে হয়, সে যেন সুশীলার অযোগ্য। এবং তার কণ্ঠ যে একটি দুর্বোধ্য বিঘ্ন অতিক্রম করে ফোটার পথ পেয়েছে তা যেমন তার, তেমনই অমিতেরও বুঝতে বাকি রইল না। অমিত বলল: আমি জানি, তোর ও সুশীলার বাঁধন ছিন্ন হওয়ার নয়।
ভুরুভঙ্গি করে পার্থ বলল, ছিন্ন হওয়ার কথা আসছে কেন?
একটা অস্থিরতার অনুভূতি এলোমেলো করতে চায় অমিতকে। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল: আসছে এইজন্য যে, আমার মন বলছে, তোদের চলার সূত্রে, তুই ইচ্ছে করলে গেঁথে নিতে পারিস কুড়িয়ে-পাওয়া উজ্জ্বল নিমেষের ক্ষণগুলো, যা তোর সব রকম বাধাকে অতিক্রম করতে সাহায্য করবে।
অমিতের এই দ্বিধাহীন অসংকোচ কথাগুলো পার্থের অন্তরে এক নিমিষের জন্য অতর্কিত একটি ধাক্কা দিয়ে গেল। এমনই সজীব অথচ নির্লিপ্ত স্পষ্টতা পার্থের সম্মুখে লোকাতীত হয়ে এই মুহূর্তে দেখা দিলো—অমিতের কণ্ঠে ক্লেশ ছিল না, ক্লেদ ছিল না, আধো-আধো ভাব ছিল না, প্রয়াসও নয়; কিন্তু আশ্চর্য এই যে, অমিতের মুখের দিকে অকাতরে পার্থ তাকিয়ে থাকার একটুখানি সংগতশোভন কারণের সন্ধানে মনে-মনে দিগ্বিদিকে ছোটাছুটি করতে থাকলেও তার অন্তরটি অতিশয় সংকুচিত দুর্বল হয়ে পড়ল। হয়তো তাই বলল: হয়তো-বা করতে পারবে, তবে...
বুকের মধ্যে খাঁ-খাঁ করে ওঠে অমিতের। কী হলো এতসব বলার পর! কোথাও তো সুশীলার ঘটতি নেই—না নিষ্ঠায়, না ভালোবাসায়। সে নিজের কথা আলাদা করে কোনো দিন ভাবেনি। দরকারও পড়েনি। এখনো পার্থ যেন তার কাছে তেমনই আছে। এখনো পার্থ যদি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, পৃথিবীটা আর-একদিকে হয়ে যাবে। কী আছে পার্থের মধ্যে! অথচ এই একই মানুষ এমন ব্যবহার করছে কেন? একটু নড়ে বসে পার্থের মুখের দিকে তাকিয়ে অমিত বলল, তবে আবার কী! শুধু জানি, তুই যদি তোর প্রেমকে জয়যুক্ত করতে চাস তাহলে বাবার আদেশের দ্বারে পড়ে থাকার কোনো কারণ দেখি না।
কিন্তু! যন্ত্রণায় ব্যাকুল হয়ে মানুষ যে-আর্তনাদ করে, সেই স্বর তার কণ্ঠের পরিচিত স্বর কখনই নয়—সেই স্বরের মধ্যে যে, তার বিসর্জনের ঢাক বাজে—পরে শুনলে সে তাকে চিনতেই পারবে না, এমন করেই পার্থ ‘কিন্তু’ শব্দটি উচ্চারণ করে। তার মুখ শুকিয়ে উঠল।
একবার মাটির দিকে চোখ নামিয়ে, একবার অন্যদিকে তাকিয়ে, একবার পার্থের দিকে চোখ ফিরিয়ে অমিত বলল: কিন্তু আবার কী! একটা বিকল্পপথ আবিষ্কার করা যাবে। আর তা না করতে পারলে তোদের দেনা-পাওনার হিসাব একদিন করতেই হবে।

পার্থ জানে, নিজের ও সুশীলার জীবনের বাইরে আর-কিছু ঘটার কোনো উপায় নেই। এই অনুভূতি তার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। এক নিরুপায় উপলব্ধি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সুশীলাকে বুকে সাপটে সমস্ত সুখ, সমস্ত আনন্দ উপলব্ধি করতে চায় পার্থ। সুশীলার প্রতি তার উন্মাদ অবিচ্ছেদ্য টানের উপলব্ধিও করছে সে, যা থেকে নিজেকে পৃথক করা সম্ভব নয়। সুশীলাকে বাদ দিলে সে এক অপূর্ণ মানুষ। সচকিত হয়ে পার্থ বলল, শক্ত কথা। কিন্তু বন্ধু, সর্বক্ষেত্রে এসব কথা চলে না। এরকম ঘটনা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তবুও বলছি, একটা কথা মনে রাখিস, অতীতের ভগ্নাবশেষ থেকে ফিরে আসাই উত্তম, নতুন কিছু সৃষ্টির আশায়।
অমিত মনে-মনে বলল: হয়তো সুশীলাকে নিয়ে পার্থের ভাবনার কোনো প্রয়োজন নেই। অমিতেরও এত সময় নেই অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চর্চা করে যাওয়া। তবুও সচেতনার আঘাতটা তার নিজের মধ্যেই বাজতে থাকে। ফের দরাজকণ্ঠ প্রকাশ করল, প্রেমের ক্ষেত্রেও বুঝি এমনই দুর্দশা। আসলে সুশীলারই কপালটিই মন্দ। ওর প্রেমে গলদ আছে, মানুষ চিনতে ভুল করেছে। তবে এও সত্য যে, তোর নতুন মানুষটির চেয়ে সুশীলা একেবারেই অযোগ্য নয়।
আমাকে ক্ষমা কর। আমাকে যেতে হবে।
আশ্চর্য! বিবেচনাশক্তি তোর গভীরতায় এতই অচঞ্চল?
পৃথিবীর অন্তরভূমির স্নিগ্ধ স্বচ্ছ জলধারা যেমন প্রস্রবণের আকারে নির্গত হয়; তেমনই পার্থের মনে সুশীলার মুখখানি উদিত হয়—যেন অকালশুষ্ক ধরিত্রীর বিস্তৃত বুকের ওপর দিয়ে এই অপরিমেয় মুখটির প্রবাহ বয়ে চলছে—জীবনের মূলে এই মুখটি যেন প্রাণময় পুষ্পাঞ্জলি। কিন্তু এই মুখটির প্রবাহের উৎস যেন তার রক্ত-মাংসে নয়। আকাশের নীল রংটা যেমন আকাশের গায়ে নেই; গিরির ধূসর গাম্ভীর্য যেমন গিরির অঙ্গে নেই; তেমনই সুশীলার মুখটি যেন বহু দূর থেকে বিচ্ছুরিত একটি অপরূপ লাবণ্যের বর্ণালি; অতি নিকটে, তবু অজানার গভীরতায় সে রহস্যময়—শুধু অনুভবের বস্তু। পার্থ অতিশয় অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে করতে বলল, গেলাম।
অমিত কোনো উত্তর দিলো না, বরং দুই হাত প্রসারিত করে মাটির বুকে শয্যা গ্রহণ করে, আর-একটি কবিতা ভাঙতে থাকে:
আমাকে ভালোবাসতে অনুরোধ করি না
শুধু মিনতি হৃদয়ের কপাটটি খুলে দাও না
জানো তো আমি অপেক্ষারত
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বড্ড ক্লান্ত
দাও না খুলে, ভালোবাসো চিরতরে।

পল্লির দক্ষিণ-প্রান্তে রৌপ্যপ্রবাহের মতো গোমতী নদীটি। নদীর ওপারে যত দূর দৃষ্টি চলে যায়; তত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্র, ক্ষেত্রের সীমান্তব্যাপী দিক্চক্ররেখা—তারই নিচে সূর্য ডুবে যাচ্ছে।
একদিকে, রাখাল বালকেরা গরু ঘরে ফিরিয়ে আনছে; অন্যদিকে, মাথা নেড়ে নেড়ে গরুগুলো মন্থরগতিতে চলছে, তাদের গলায় ছোট ছোট ঘণ্টা; কোনোটি নিজের বাড়ির কাছে এসেই দাঁড়িয়ে পড়েছে, কোনোটি ঘাড় ফিরিয়ে পিছিয়ে-পড়া বাছুরের দিকে তাকিয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ বিমলার মনে হলো: চেনা পৃথিবীটা যেন অচেনা। তিনি তখনো প্রদীপ জ্বালাননি।

গৃহ নীরব। তখনই রমেশ চক্রবর্তী ঘরে পা রাখলেন। জুতো খুলে খোলা পায়ে মেঝে স্পর্শ করলেন। চোখে প্রশ্ন ও বিস্ময়। বললেন: বিমলা, তুমি কোথায়? এখনো তো ঘরে প্রদীপ দেওয়া হয়নি।
স্বামীর কণ্ঠ শুনে বিমলা অনুমান করলেন, রমেশ চক্রবর্তীর কপাল কুঁচকে উঠেছে। বিমলার অস্থির লাগে। চেনা কণ্ঠের মধ্যেও তিনি হঠাৎ অজানিত, অপরিজ্ঞাত কিছু-একটা অনুমান করে দিশেহারা বোধ করলেন। আতঙ্কে চমকে তার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেলেন। এখান থেকেই বললেন, এই তো আমি এখানে! এত চিৎকার কেন? প্রদীপ নিয়ে আসছি।
রমেশ চক্রবর্তী ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছেন—তিনি একটা চেয়ার টেনে বসলেও তার মনে হলো, তিনি যেন একটি ঘূর্ণায়মান চক্রের ওপর বসে আছেন। বিঘূর্ণিত চক্র যেমন তার পৃষ্ঠের ওপর কোনো বস্তুকেই তিলার্ধ তিষ্ঠাতে দেয় না—তেমনই একটি কাণ্ড ঘটছে তার অন্তর্জগতে—তার জ্ঞানজগৎই যেন অবিশ্রুত পাকের ওপর পাক খেয়ে খেয়ে প্রতি মুহূর্তে তাকে ছুড়ে ফেলতে চাইছে অক্ষেত্রে। অতীতের অপর কোনো মূল্য থাক আর না-ই থাক, একেবারে নিরুপায় হয়ে চেয়ারটিকে আঁকড়ে ধরলেই যেন তার অস্বস্তি সহ্য করার মতো দৃঢ়তা তার মনে জাগ্রত হবে, কিন্তু তা হলো না। অতীত তার একেবারে শূন্য, তৃণের অঙ্কুরটি পর্যন্ত কোথাও নেই; শুধুই অর্থাভাব, ঋণের বোঝা। বর্তমান তাই অকস্মাৎ অসহ্য প্রখর হয়ে নিজের কাছে অতীব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তার অযোগ্যতাই একেবারে দুস্তর হয়ে উঠেছে। তার কাছে বর্তমানের আবছা অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটিও ভৌতিক মনে হচ্ছে।

বিমলা প্রদীপ হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে শোয়ারঘরে পৌঁছতেই দেখলেন, তার স্বামী অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে চেয়ার জড়িয়ে বসে আছেন। প্রদীপটি টেবিলের ওপর রেখে পাশ থেকে স্বামীকে এক মনে বিস্তার করতে থাকেন তিনি। অদ্ভুত দেখাচ্ছে লোকটিকে। খুব ফরসা। ছোট ছোট করে চুল ছাঁটা। শীত-গ্রীষ্মে ধুতি ছাড়া কিছুই পরেন না। অর্ধেকটা মুখ দেখেও বিমলা বুঝতে পারেন, তার স্বামী আজ ক্লান্তি বোধ করছেন। অর্ধেকটা মুখের ওপর দৃষ্টি রেখে এবং অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, কী ব্যাপার! তোমাকে আজ অন্য রকম দেখাচ্ছে যেন? কী হয়েছে বলো তো?
রমেশ চক্রবর্তী ঘুরে তাকালেন। স্ত্রীর মুখটি যেন তার কাছে মাধুর্যমণ্ডিত হয়ে দেখা দিলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আর বোলো না। মেয়ের একটি বিবাহপ্রস্তাব নিয়ে পণ্ডিত এসেছিল।
চন্দ্রার?
হ্যাঁ, এটি নিয়েই চিন্তা করছি।
ছেলেটি কী করে? কে-ই-বা সে? কী-ই-বা তার পরিচয়?
পিতৃহৃদয়ের সকল ব্যর্থতা পাঁজরের আড়ালে রেখে রমেশ চক্রবর্তী বললেন, আমাদের পাশের গ্রামের অক্ষয় দাসের পুত্রের সঙ্গে চন্দ্রার বিবাহপ্রস্তাব এসেছে। ধনে-জনে অক্ষয় দাস স্বনামধন্য। দশ গ্রামের লোক তাকে সম্মান করে। শুনলাম, ছেলেটিও নাকি বাপের ব্যবসায় মন দিয়েছে। সুদর্শন পাত্র। এক বাপের এক ছেলে। আজকাল ভালো পাত্রের সন্ধান পাওয়া যে কী কঠিন তা তো তুমি জানো!
পরিত্রাণের কথাই ভেবেছিলেন বিমলা, কিন্তু এই প্রস্তাব তার কাছে অপবিত্র মনে হলো। তা মনে হতেই তার সমগ্র চিত্তের একাগ্রতা ভেঙে গেল, তিনি আর অগ্রসর হতে চান না। যে বিয়েতে তার একমাত্র কন্যা প্রবেশ করবে সেখানে অশুচি অন্তরেই প্রবেশ করতে হবে—একথা তার মন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তার ওপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ আছে। ঈশ্বরের শুভ ইচ্ছায়ই তার কন্যার ব্রাহ্মণকুলে জন্ম হয়েছে। কিছুক্ষণ অন্যমনস্কের মতো এসব ভাবতে ভাবতেই স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, এমন প্রস্তাব শুনেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
বিমলার মন অতিসাধারণ। কোনো কিছুতেই তার কোনো অপরাধবোধ নেই। স্বামী ও সন্তান পালনের যে-সরল গার্হস্থ্য তিনি যাপন করেন তার মধ্যেও অন্যায়ের স্থান নেই। তার মনে কোনো লোভও নেই। তিনি বিশ্বাস করেন, নিজের মন ভালো থাকলে তার পরিবার শান্তিতে থাকবে। এ-ই তার আত্মকেন্দ্রিকতা। এই আত্মকেন্দ্রিকতার জন্যই হয়তো তিনি যোগ করলেন: ছেলে যদিও সুদর্শন, তবুও সে ব্রাহ্মণকন্যার উপযুক্ত হবে কি না তা ভেবে দেখা উচিত।

সবিনয়ে নিজের জীবনের পরাজয় নিঃশব্দে এবং ঘাড় গুঁজে স্বীকার করে নিলেন রমেশ চক্রবর্তী; তারপর ঘাড় তুলে বিস্মিত কণ্ঠে বললেন: অবশ্যই তা দেখা আবশ্যক, কিন্তু আমি জানি, আমার সঙ্গে তুমি দ্বিমত পোষণ করবে না। তাই বলছি, শুভকাজে বিলম্ব করা উচিত নয়। কী বলো?
নির্জন ঘরের ভেতর বিমলার দুশ্চিন্তা ছুটতে লাগল। সমস্ত শক্তিকে প্রাণপণে জাগ্রত করে সুচাগ্রের মতো তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে—চাঁপার কলির মতো তার আঁখিদ্বয় লীলায়িত কিন্তু অতীব কঠিন—রমেশ চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন: জাত বলে তো একটা কথা আছে, তাই না?
সাধারণ ভদ্রলোক এইরূপ অবস্থায় যেরূপ আচরণ করে, রমেশ চক্রবর্তীর আচরণে এই স্বাভাবিকতা ব্যতীত সবই দেখা দিলো; তিনি গর্জে উঠলেন: জাত ধুয়ে কি জল খাবো? আমাকে কি বুঝে নিতে হবে যে, তুমি এই প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছ?
বিমলার মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। সন্দেহ নেই, বুক ধড়ফড় করে বিমলাকে অতি অকস্মাৎ নিদারুণ একটা মানসিক পীড়া সহ্য করতে হচ্ছে। তবুও শেষ চেষ্টা করলেন, বললেন: তাই বলে ধনের জন্য মেয়েকে অজাতে ভাসিয়ে দেবে?
রমেশ চক্রবর্তীর চোখ-মুখ আরও কঠিন হয়ে উঠল। বললেন: তা যা-ই হোক-না কেন, বাঁচার জন্য অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। জীবন টিকিয়ে রাখতে চাইলে এই অমূল্য অর্থ ছাড়া উপায় নেই। তাই বলছি, যেখানে প্রাচুর্য সেখানেই রাজত্ব। অর্থই সংসারে সুখ বয়ে আনে, বুঝলে!
ঈশ্বর-নির্ভরতা মানুষের খানিকটা উদ্বেগ প্রশমিত করে, তাই হয়তো বিমলা বলে উঠলেন: সুখ এক-একজনের কাছে এক-এক রকম। সংসারও এক-একজনের কাছে এক-এক রকম।
এক পলকের জন্য রমেশ চক্রবর্তীর মন যেন দিশেহারা হয়ে গেল। পরক্ষণেই, বিমলার কথাটি যেন কানে যায়নি, এমনভাবে তিনি বলতে লাগলেন: নিজের সামাজিক অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকা কর্তব্য―এটি মনে করিয়ে দিয়ে কিন্তু যাদের আমরা জাতে উঠতে দিই না, উঠতে চেষ্টা করলে ধর্মের রব তুলে যাদের মাথার ওপর ঈশ্বরের নামে লাঠি উদ্যত করি, তাদের প্রশান্ত বাহ্য অবয়বের নিচে কত বড় একটা বিক্ষোভ অহর্নিশি আলোড়িত হচ্ছে তা বুঝি আমরা কল্পনাও করতে পারি না। একটু থেমে তিনি প্রশ্ন করলেন: তাদের ধমনিতে জল না রক্ত বইছে? এবং নিজেই তার উত্তর দিলেন: রক্তই বইছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে ওদের চিরদিন দাবিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তারপর রমেশ চক্রবর্তী হেসে বললেন, অর্থকড়ি যে সংসারে নেই সেখানে তো কেবল ছেঁড়া কাঁথা আর ফুটো চাল। যেমন আমাদের বর্তমান অবস্থা।
বিমলা নিজের চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বললেন, কিন্তু!
রমেশ চক্রবর্তী চোখ নত করে ছিলেন, কিন্তু বিমলার কথায় চোখ তুলে তিনি দেখলেন, বিমলার মুখমণ্ডল ভীষণ ম্লান হয়ে উঠেছে। তার দিকে তাকিয়েই বললেন, কিন্তু আবার কী?
বিমলার ঠোঁট কাঁপতে লাগল। নিঃশব্দ গভীর বেদনা তাকে মুহূর্তমাত্র সুস্থির থাকতে দিচ্ছে না। তিনি বিবর্ণমুখে বললেন, মেয়ের একবার যদি...

রমেশ চক্রবর্তী অবাক হলেন। অনুভব করতে পারলেন মেয়ের মতামত নেওয়া প্রয়োজন। বললেন: মেয়ের মতামত নিতে হয়, নেব। সেটি নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
তুমি জিজ্ঞেস করলেই ভালো। মেয়ে তোমাকে খুব ভালোবাসে।
কন্যার সর্বাঙ্গের ছবিটি—অতিসুন্দর, প্রকৃত সুন্দরের ছবিটি—তার স্মরণে এলে তার চিন্তাস্রোত যেন বিমলার সমানুভূতির সূত্র ধরে তাকে ধীরে ধীরে স্পর্শ করে চলেছে। হয়তো তাই রমেশ চক্রবর্তী বললেন, ঠিক আছে। জিজ্ঞেস করে নেবো।
এখন তাহলে আমি যাই। রাত্রির রান্না বসাতে হবে।
অপরাধীর মতো অতিশয় সংকুচিত হয়ে বিমলা যে কী বলতে বলতে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন, রমেশ চক্রবর্তী তার চৌদ্দআনাই বুঝতে পারলেন না। খানিক অবাক হয়ে তিনি বলতে লাগলেন, চন্দ্রার সঙ্গে কথা বলে নেবো। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না।

চলবে...

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন