ফাত্তাহ তানভীর রানার গল্প
এই শহরে মুনের কেউ ছিল না
রাতে চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে। পুরো শহর আলোকিত হয়েছে। মাঝে মাঝে মেঘ এসে চাঁদের আলো নিষ্প্রভ করার চেষ্টায় রত। তবুও ভালো লাগছে। মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখতেই মুনের কথা মনে হলো। মুনও সবার মাঝে আলো ছড়াতো; গল্প করে, গান গেয়ে মাতিয়ে রাখতো। সে রাজনৈতিক সচেতন ছিল। সেটাই তার জীবনের কাল হলো না তো! আজ পিন্টুর মন খারাপ, মুন নেই; ঘরে একা চোখে ঘুম আসছে না।
গত রাতে বস্তির ঘরের মালিক এসেছিল রুমের ভাড়া চাইতে। পুলিশও কয়েকদিন আগে এসেছিল খবর নিতে। মুনের ব্যবহৃত কাপড়, ব্রাশ, পানির জগ, চায়ের মগ সব আছে; শুধু মুন ফেরেনি। পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে। ঘরের মালিক জানতে চায়, মুনের বদলে অন্য কাউকে তোলা হবে কি না। অবশ্য কোনো উত্তর দেয়নি রুমমেট সোনার।
মুন প্রতিবাদী ছেলে ছিল। সে জন্ম থেকে বঞ্চিত বলে, স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়াতো। এই শহরে মুনের কেউ ছিল না। জন্মের আগে বা পরে তার বাবা মাকে ছেড়ে চলে যায়। সে কখনো বাবাকে দেখেনি। বাবার শাসন, আদর, ভালোবাসা কিছুই অনুভব করতে পারেনি।
হকার মুন একটা প্রাইভেট কোম্পানির পার্ট টাইম বিপণন কর্মী ছিল। কোম্পানির একজন কর্মকর্তা মুনের পরিচিত। কোম্পানিতে সপ্তাহে একদিন ছুটি থাকতো। উত্তরা থেকে ভেতরে একটা কলেজেও সে পড়তো। যা আয় করতো তা দিয়ে পড়াশোনার খরচসহ সব হয়ে যেত। মুন এখনো ঘরে ফেরেনি, অনেকেই ফিরেছে। কেউ আহত হয়ে, কেউবা লাশ হয়ে ফিরেছে।
মুনের মোবাইল এখনো বন্ধ। ১৮ জুলাই মুনের মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। সেদিন সকালে অফিসের কাজ সেরে বিকেলে মায়ের সাথে দেখা করার জন্য ময়মনসিংহ যাওয়ার কথা ছিল। মুনের রুমের পিন্টু রাতে ঘরে ফিরলেও মুন ফেরেনি আজও! পিন্টু ধারণা করেছিল, মুন হাতের কাজ সেরে মায়ের কাছে গেছে। পরের দিন ছুটি ছিল, তারপর কারফিউ। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় কেউ কারো অবস্থান সম্পর্কে বুঝতে পারেনি।
পিন্টু, সোনার আর মুন এক রুমেই থাকতো। পিন্টু কখনো মুনের মাকে দেখেনি, গল্প শুনেছে। পিন্টুর কাছে মুনের মায়ের মোবাইল নম্বর ছিল না। মুনের নানা বাড়ি ময়মনসিংহ, তার মা সেখানে মানুষের বাসায় কাজ করে। মুনের বাবা চলে যাওয়ার পর মা আর বিয়ে করেনি।
সেদিন সর্বশেষ মুনকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ধাওয়া খেয়ে দৌড় দিতে দেখা গেছে। এরপর মুনকে আর কেউ দেখেনি। একজন ছাত্র হয়ে মুন বন্ধুদের পাশে দাঁড়াবে, তা-ই স্বাভাবিক।
দেশের অবস্থা খারাপ হলেও সোনার ও পিন্টু হাসপাতাল, মর্গে মুনকে খুঁজেছে। কোথাও মুনের সন্ধান মেলেনি।
‘মুন তুই ফিরে আয়। কথা দিচ্ছি, আর তোকে বাপ তুলে গালি দেব না।’ না ফিরলে আকাশে চাঁদ হয়ে সবাইকে আলো দিস।
এসইউ/এএসএম