সেলিম আল দীন ও কবিতা বিকেলের কহন কথা
বাংলা নাটকের গৌড়জন সেলিম আল দীনের জন্মদিন আজ। বাঙালির ভালোবাসায় পরিপ্লুত পুষ্পিত মহান এই শিল্পী আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর অবিনশ্বর মহাকাব্যিক সব সৃষ্টি সম্ভার। তাঁর নাটকই বাংলা থিয়েটারের বহুযুগের প্রতীক্ষার অবসান ঘটায়। বাংলার মাটিতে, বাংলার জলহাওয়ায় বাংলার প্রাণের ভাষাতেই জন্ম নেওয়া তার নাটকগুলো বাংলা নাটকের সব উপাদানকে ছুঁয়ে যায় আধুনিকের মন নিয়ে। এ কারণেই বাঙালির কাছে সেলিম আল দীন এক অবিস্মৃত নাম।
১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট সীমান্তবর্তী ফেনী জেলার অন্তর্গত সমুদ্রবর্তী সোনাগাজী উপজেলার সেনের খিলে জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রোত্তরকালের বাংলা নাটকের প্রধান পুরুষ সেলিম আল দীন (১৮ আগস্ট ১৯৪৯-১৪ জানুয়ারি ২০০৮)। তার সৃষ্টিশীলতার কিরণচ্ছটা ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদী ধারায় শ্রমজীবী মানুষ এবং বাংলার আবহমানকালের সংস্কৃতি এক মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি দানে সার্থক হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি নেওয়ার পর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন অধ্যাপনা।
ছোটবেলা থেকেই তার লেখক জীবন শুরু হলেও ১৯৬৮ সালে কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ (অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা) পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে কালো মানুষদের নিয়ে প্রথম বাংলা প্রবন্ধ ‘নিগ্রো সাহিত্য’ প্রকাশিত হয়। তার প্রথম রেডিও নাটক ‘বিপরীত তমসায়’ ১৯৬৯ সালে এবং প্রথম টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘লিব্রিয়াম’ প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। ‘বহুবচন’ কর্তৃক প্রযোজিত হয় তার প্রথম মঞ্চনাটক ‘সর্প বিষয়ক গল্প’ ১৯৭২ সালে। এরপর থেকে একের পর এক নতুন নতুন বিষয় ও আঙ্গিকে সৃষ্ট তার নাটক উচ্চারিত হয় বাংলা মঞ্চে, টেলিভিশনে। শুরু করেছিলেন বিদেশ অনুপ্রাণিত নিরীক্ষা ভর করে, কিন্তু খুব শিগগির তা বর্জন করে বাংলার মধ্যযুগীয় নাট্যরীতির সম্ভারে গড়ে তুললেন নিজর জগৎ। ভাঙা মানুষ, তারুণ্যের বিলীয়মান উপজাতি, লাঞ্ছিত নারী এই নিচুতলার মানুষেরই ভিড় লভ্য তার নাটকে। পাশ্চাত্য শিল্পের সব বিভাজনকে বাঙালির সহস্র বছরের নন্দনতত্ত্বের আলোকে অস্বীকার করে এক নবতর শিল্পরীতি প্রবর্তন করেন তিনি। যার নাম দেন ‘দ্বৈতাদ্বৈতরীতি শিল্পতত্ত্ব’।
বর্ণনাত্মক নাট্যরীতিতে লেখা তার নাটকগুলোতে নিচুতলার মানুষের সামাজিক নৃতাত্ত্বিক পটে তাদের বহুস্তরিক বাস্তবতাই উঠে আসে। জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মুনতাসির, শকুন্তলা, কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, হাতহদাই, যৈবতী কন্যার মন, চাকা, হরগজ, বনপাংশুল, প্রাচ্য, নিমজ্জন, ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল ইত্যাদি মঞ্চসফল ও পাঠকনন্দিত নাটক রচনার মধ্য দিয়ে ক্রমাগত তিনি নিজেকে অতিক্রম করে যেতে থাকেন। তিনি অবশ্য তার সৃষ্ট শিল্পের কোনো নাম দিতে চাননি। তার ভাষায় ‘আমি চাই আমার শিল্পকর্মগুলো নাটকের অভিধা ভেঙে অন্যসব শিল্পতীর্থগামী হয়ে উঠুক’। আখ্যান বা বর্ণনাত্মক নাট্যরীতিতে লেখা উপন্যাসগুলোতে তিনি কাব্য, উপন্যাস, চিত্রকর্ম প্রভৃতি শিল্পধারাকে এক মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেছেন। মধ্যযুগের বাংলা নাট্যরীতি নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলাদেশে একমাত্র বাংলা নাট্যকোষেরও তিনি প্রণেতা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণকেন্দ্রিক এথনিক থিযেটারেরও তিনি উদ্ভাবনকারী।
তার নাটক ‘চাকা’র চলচ্চিত্ররূপ আন্তর্জাতিকভাবে একাধিক পুরস্কার পেয়েছে। তার রচিত কথানাট্য ‘হরগজ’ সুইডিশ ভাষায় অনূদিত এবং ভারতের নাট্যদল রঙ্গকর্মী কর্তৃক হিন্দি ভাষায় মঞ্চস্থ হয়েছে। সেলিম আল দীনের নাটক ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগরসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য। রক্তের আঙুরলতা, অশ্রুত গান্ধার, গ্রন্থিকগণ কহে, ভাঙনের শব্দ শুনি, অনৃত রাত্রি, ছায়াশিকারী, রঙের মানুষ, নকশীপাড়ের মানুষেরা, প্রত্মনারী, হীরাফুল প্রভৃতি অসংখ্য জনপ্রিয় টিভি নাটকের রচয়িতা সেলিম আল দীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহুবিধ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে পান জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার। ২০০৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় তাকে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্যও ছিলেন। বর্ণময় কর্মজীবনে তিনি দেশে-বিদেশে বহুবার সংবর্ধিত হয়েছেন।
দুই.
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘আমরা যদি কিছু নাও করতে পারি তবে মহাকাল আমাদের এজন্য মনে রাখবে যে, আমরা রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি’ কথাটি বাংলা নাটকের গৌড়জন সেলিম আল দীনের কাছ থেকে শোনা। এখন তাঁর সম্পর্কেও যদি একই কথা উচ্চারিত হয় সেটি কি ভুল হবে?
সেলিম আল দীন এমনই এক ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যে, তার সান্নিধ্য পাওয়াটা সত্যি খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। বিশেষত আমরা যারা তরুণ তাদের জন্য ছিল এটি এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। আমরা নিঃসন্দেহে সেই দুর্লভ সান্নিধ্য পাওয়ার গৌরবের অধিকারী। যদি একটি ঝরাপাতাও প্রশ্ন করে এক জীবনে কী পেয়েছ? উত্তরে বলবো সেলিম আল দীন- এই পুষ্পিত নাম।
আমরা বিশেষত কবি শামীম রেজা, হামীম কামরুল হক, আসাদ আহমেদ, মাহবুব মোর্শেদসহ একগুচ্ছ তরুণ তাকে পেয়েছিলাম নানা রূপে কখনো শিক্ষক, পিতা, বন্ধু কিংবা তারও অধিকতর কিছু। বয়স পদ-পদবি খ্যাতি কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি আমাদের সম্পর্কে। একটা সৃজনশীল মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে আমরা বাঁধা পড়েছিলাম। একটা লেখা শেষ হয়েছে অমনি ডাক পড়তো আমাদের। পড়ে শোনাবেন। মতামত জানতে চাইবেন। মেনটি তিনি নিজেই লিখেছেন তার লেখা প্রাচ্য কথানাট্যের ভূমিকায়- “রচনা শেষে ‘প্রাচ্য’র পাঠ নিমিত্ত আমি আমার অনুবর্তী তরুণ কবি শামীম রেজা, আসাদ ও হারুন রশীদসহ মানিকগঞ্জ শহরে আসাদদের গৃহে গমন করি। যাবার পথে সঙ্গী ছিল রবীন্দ্র সঙ্গীত, সেই সায়াহ্নে আমার মনে বিশ্ব প্রেমের আলিম্পনা। রাত দশটা থেকে আসাদদের পরিবারের সবাকার নিদ্রা হরণপূর্বক ভোর পর্যন্ত আমি ‘প্রাচ্য’ পাঠ করি। আরক্ত চোখ সঙ্গীদের, চলে যাই প্রিয় নদী কালীগঙ্গা। হাঁটুজলে সমুদ্রস্নান। হঠাৎ একটা বানানো জলস্তব শুরু করি আমি কবিগণ নদীবন্দনা উচ্চারে আমার সঙ্গে। এ বেদনাবৃত কাহিনী শেষে জলজাত হুল্লোড়। এও বোধহয় প্রাচ্যমানস কিংবা সর্বোতভাবে মানব চরিত্রের বৈপরীত্য। (শ্রাবণ প্রকাশনী প্রাচ্য ভূমিকা ১৬ জানুয়ারি ২০০০)
ভাল কিছু রান্না করা হয়েছে খেয়ে যেতে হবে। এমনি অসংখ্য আবদার, অনুরোধ, আদেশ, নির্দেশ, অভিমান সবই চলতো তার সঙ্গে। কী অজানা ঘোরের মধ্যে কখন যে এক যুগেরও বেশি সময় তারসঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছি টের পাইনি। কখনো তার নতুন লেখা কপি করতে হয়েছে। বাজারে যেতে হয়েছে ভোর বেলায় উঠে। সেদিন হয়তো হলে ফেরাই হয়নি। গ্রাম ছিল তার পছন্দের জায়গা। কতোবার কতো জায়গায় তার ভ্রমণসঙ্গী হতে হয়েছে কখনো ইচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায় তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
সখীপুর গিয়ে সেখানকার ‘মান্দাই’ নামক এক অখ্যাত নৃ-গোষ্ঠীর জীবনাচরণ নিয়ে প্রথমে প্রবন্ধ লিখলেন দৈনিক বাংলায়। তারপর ‘বনপাংশুল’ নামে এক মহাকাব্যিক উপাখ্যানই লিখলেন এই জনগোষ্ঠীর জীবনকে ঘিরেই। এভাবে এক অখ্যাত ক্ষয়িষু নৃ-গোষ্ঠীকে তুলে আনলেন বইয়ের পৃষ্ঠায় ঢাকা মঞ্চে পাদপ্রদীপের নিচে। তারপর থেকে সখীপুরের প্রেমে পড়ে গেলেন। সেই সঙ্গে মান্দাইদেরও অনেকবার তিনি সখীপুরে গেছেন। রাত কাটিয়েছেন। সখীপুরের তার আরেক কৃতিমান ছাত্র অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান এর নামে বনপাংশুল-এর একটি চরিত্রের নামই রাখলেন। কারণ সখীপুরে ড. লুৎফর রহমানের শ্বশুরবাড়ি কালিদাস গ্রামের মান্দাইদের জীবনাচরণ দেখে তিনি তাদের নিয়ে বনপাংশুল নাটকটি লেখতে উৎসাহী হন। আর এ জন্য আমাকেও উৎসাহী করেন এই নৃ-গোষ্ঠীর মিথ (সুঃয) (জরঃঁধষ) নিয়ে পিএইচডি করার জন্য। তার নির্দেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হই তারই তত্ত্বাবধানে পিএইচডির ছাত্র হিসেবে।
দেখা করতে গেলেই বলতেন, আমি থাকতে থাকতেই ডিগ্রিটা নিয়ে নে। বলতাম কী যে বলেন স্যার। আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবেন আপনি? আপনাকে অনেক দিন বাঁচতে হবে। বাংলা নাটকের অনেক কাজ আপনার হাত দিতে হয়েছে। আরও অনেক কিছু দিতে হবে। আমাদের মতো অনেক ছাত্রকে পিএইডি ডিগ্রী দিতে হবে। তার আগে কোথায় যাবেন আপনি?
পিএইচডির একটি চ্যাপ্টার স্যারকে দেখালে খুব খুশি হলেন। প্রায় এক পৃষ্ঠা নতুন করে লিখে দিলেন। আদিবাসীদের নিয়ে এমন একটি লাইন লেখলেন- ‘তারা আমাদের থেকে অন্য হতে পারে কিন্তু ভিন্ন নয়।’ তারপর বললেন দেখলিতো এভাবে ভাষার সৌকর্ষ বাড়াতে হয়। লেখার এক জায়গায় ‘পুরানপ্রোক্ত’ শব্দটি যোগ করে বললেন, এভাবে শব্দ ভাণ্ডার বাড়াবি। লেখাকে একটা স্ট্যান্ডার্ডে দাঁড় করাবি। থিসিসের প্রথম চ্যাপ্টার নিয়ে সেমিনার করতে বললেন। প্রথমটা দেখলেই বোঝা যাবে বাকি গুলোতে কী করবি-এমনটিও বললেন। কিন্তু সেই সেমিনার করার সময়টুকুও তিনি দিলেন না। চলে গেলেন ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি।
টিএসসির পরিচালক থাকার সময় নানা রকম অনুষ্ঠান করতে শুরু করলেন। ১৯৯৭ সালে শুরু হওয়া কবিতা বিকেলের প্রথম পর্বের সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি তরুণ কবিদের উদ্দেশে বললেন, ‘কবিতা হৃদয়ানুভূতির নির্যাস। আত্মক্ষরণের তো বটেই আত্ম আবিষ্কারেরও- এ কথা সকলকে মনে রাখতে হবে। তিনি আরও বললেন, কবিতা গল্প উপন্যাস নাটক যাই বলিনা কেন সবই আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। কবিতা বিকাশকে আরও ব্যাপ্তি দেয়। আত্মপ্রকাশ না করলে কেউ স্বনির্ভর হয় না। তাই তরুণদের প্রকাশমুখিনতার বাহন হিসেবে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অতীব জরুরি।’
‘কহন কথা’ নামে একটি গানের দল করলেন আমাদের নিয়ে। সাবেরা তাবাসসুম টফি, কাজী সুস্মিন আফসানা শিমু, সাকিরা পারভীন সুমা, শশী, মামুন আব্দুলাহসহ অনেককেই তিনি কহন কথার আসরে ডাকলেন। দলের জন্য পিয়ানো কিনতে হবে। আমাদের নিয়ে দল বেঁধে ছুটলেন ঢাকায়। নিজে গান লিখলেন, তাতে সুর বসালেন। আমাদের মতো অসুরদের দিয়ে তা অনেক অনুষ্ঠানে গাওয়ালেন। তার সময়ে নানা রকম উৎসব অনুষ্ঠানে সরগরম হয়ে থাকতো টিএসসিসহ ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ।
মহুলা তলায় শুরু করলেন ‘মহুয়া ফোটার উৎসব’। এই উৎসবে প্রধান অতিথি হয়ে এলেন জাবির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন আহমেদ। কহন কথার শিল্পীদের পরিবেশনার পর মঞ্চে উঠলেন দলছুটের সঞ্জীব চৌধুরী। মহুয়া ফুলের মাতাল করা গন্ধ আর দর্শক শ্রেতার বিপুল সাড়া পেয়ে সঞ্জীবদাও মঞ্চ থেকে নামতে চাচ্ছিলেন না। হায় সেই সঞ্জীবদাও আজ কোন নক্ষত্রলোকে হারিয়ে গেলেন!
স্যারের সঙ্গে যখন গাড়িতে কোথাও যেতাম পীযূষ কান্তি সরকারের কণ্ঠে ‘গানে গানে তব বন্ধনও যাক টুটে’ এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটি বাজাতে বাজাতে বলতেন সুর ছাড়া প্রাণ ভীষম বাধা। সারাক্ষণ সুরের মধ্যে থাকবি। রবীন্দ্রনাথের প্রতি এমনই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, এক বার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘যদি নিজ হাতে রবীন্দ্রনাথকে এক কাপ চা তুলে দিতে পারতাম তাহলে জীবনে লেখতাম না।’
ফেনীর সেনাগাজী থানার সেনেরখীলে তার নিজ গ্রামের বাড়িতে একবার বেড়াতে গেলেন আমাদের নিয়ে। সঙ্গে পারুল ভাবী। আমি আর সানি ভাই গল্পস্বল্প করে মধ্যরাতে শুয়ে পড়েছি। কিছুক্ষণ পরই স্যারের ডাক। এই তোরা উঠ। প্রকৃতি থেকে পাঠ গ্রহণ কর। না উঠে উপায় কি। শীতের কুয়াশা এমনই যে একটু দূরেও দেখা যায় না। তারমধ্যে স্যার বললেন চল হাঁটি। আমরা হাঁটতে লাগলাম। স্যার বললেন, আমার সঙ্গে গান ধর। আকাশ ভরা সূর্যতারা বিশ্ব ভরা প্রাণ/ তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান/ বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান। অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার ভাটায় ভুবন দোলে নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান/ বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।’
এমনই ছিল তার জীবনবোধ। যে জীবন তিনি ধারণ করেছিলেন তা যুগস্রষ্টা শিল্পীর জন্য স্বল্পায়ুর কিন্তু যে জীবন তিনি যাপন করেন এবং ছুঁয়েছিলেন তার ব্যাপ্তি সীমাতীত। মর্তের তৃণবলি¬ থেকে আকাশমণ্ডলের নক্ষত্ররাজির মধ্যবর্তী সকল বস্তু ও প্রাণীর সঙ্গে মানবের সম্পর্ক নিরূপণে তিনি আমৃত্যু অনুসন্ধিৎসু স্রষ্টা। সেলিম আল দীনের রচনার নিত্য পাঠ নবতর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করায় তাঁর পাঠকদের।
আত্মাবিষ্কারের এক বিশাল সুযোগ রয়েছে সেখানে। গবেষকদের বিবেচনায় মহান স্বাধীনতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির মহার্ঘতা সেলিম আল দীনের রচনায় নতুন মাত্রা লাভের ফলে আমাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চার নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। জাতীয় সাহিত্যের ভিত তিনি রচনা করে দিয়েছেন আমাদের দায়িত্ব আচার্য সেলিম আল দীনের শিল্পাদর্শকে সমুন্নত রেখে ঔপনিবেশিকতার অবলেশমুক্ত স্বাধীন দেশের স্বতন্ত্র ভাষা-সংস্কৃতির অধিকারী বাঙালির সাহিত্যকে তার জাতিগত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বসাহিত্য সভায় উপস্থাপন করা। তবেই তাঁর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব হবে। আমরা এই মহান শিল্প স্রষ্টাকে আজকের দিনে গভীর শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি।
টাঙ্গাইলের সখীপুরের কচুয়ায় সেলিম আল দীন পাঠাগার প্রতিষ্ঠা তার সৃজনকর্ম মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষুদ্র প্রয়াস। সেলিম আল দীন পাঠাগার হয়ে উঠুক শিল্পসাহিত্যের তীর্থ ভূমি এই প্রত্যাশাও রইলো।
এইচআর/এমএস