গাজী আবদুর রহিমের গল্প
একজোড়া কদমের শিহরণ
অপলার আজ মন খারাপ। সে ঘরের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছে। এই কয়দিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। শ্রাবণ মাস বলে কথা। বৃষ্টির পানি পেয়ে জানালার বাহিরে হাসনাহেনা গাছের ফুলগুলো পড়ে কাঁদায় পচতে শুরু করেছে। চাপা একটা গন্ধ আসছে ঘরে; অপলার নাকে। এই গন্ধ শুকে তার মনটা কেমন যেন বেদনার্ত হয়ে উঠেছে। সে খেয়াল করলো জানালার ওপাশে একজন যুবক বৃষ্টিতে ভিজছে। তাকে দেখে অপলার হৃদয়ের ভাঙা দর্পণে হারানো স্মৃতি আবছা ভেসে ওঠে। বুকের ভেতর ভাঙা টান অনুভব করে।
মানুষ আসলে বদলে যায় নাকি ভোগের আশায় অভিনয় করে ভালোবাসার? শৈশবে কেউ একজন মিথ্যা ভালোবাসার কথা বলে অপলার সম্ভ্রমসম সম্পদ কেড়ে নিয়েছিল। মেয়েটা এখন অন্য একজনের সংসারে এসেও ভয়ে ভয়ে থাকে। ওর মনে শঙ্কা, ওর স্বামী যদি জানতে পারে শৈশবে অন্য যুবক ছিল ওর জীবনে, তাহলে ওর সংসার কি টিকবে? আচ্ছা প্রেমিকাকে ব্ল্যাক মেইল করে কয়দিন আগলে রাখা যায়? এক জীবনের জন্য আগলে রাখলেও কি ভালোবাসা পাওয়া যায়?
অপলার এখন জাবেদের কথা মনে পড়ছে। কিছুদিন হলো ওদের বিয়ে হয়েছে। জাবেদ একটা টেক্সটাইল কোম্পানিতে চাকরি করে গত ছয় বছর ধরে। ওদের সদ্য বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর ওর বাড়ির লোকজন বলেছিল বউ গ্রামের বাড়িতে মা-বাবার কাছে রেখে আসতে। কিন্তু জাবেদ বুদ্ধিমান যুবক। সে নতুন বউ বাড়িতে রেখে আসেনি। ও জানে নতুন বউ বাড়িতে রেখে আসলে ভালোবাসায় ঘাটতি থেকে যাবে। সে ভালোবাসা সারা জীবনে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কাটা ঘায়ে যত দ্রুত সম্ভব মলম লাগালে সহজে জোড়া লাগে, দেরি করলে জোড়া লাগে না, ঘা থেকে যায়—বিবাহের সম্পর্কটাও ঠিক এ রকম।
অপলা ভাবে জাবেদের কাছে কল করবে কি না। সে ভাবে এ সময় আবার তার অফিসের ব্যস্ততা থাকে। আবার যদি রাগ দেখায়। দেখালে দেখাক। আমি তার বউ, তাকে কল দেওয়ার অধিকার আমার ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা আছে বটে। সে ফোনের লকটা খুলে হাজব্যান্ড লেখা নাম্বারে ডায়াল করে কানে ধরে।
ফোনে কল আসতেই জাবেদ ডেস্কের দুপাশে তাকায়। দুপাশে ফারহানা ও আসিফ বড় বড় চোখ করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মজা নিচ্ছে।
জাবেদ কলটা রিসিভ করে বলে, কী করছো? আমাকে ভাবছো নিশ্চয়ই।
অপলা বলে, তোমাকে না ভাবলে কি কল দিতাম? কখন ফিরবে?
এতক্ষণ বৃষ্টির টপটপানি ছিল। এই মুহূর্তে প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। সব কিছু তলিয়ে যেতে লাগল।
জাবেদ বলে, কেন অপলা তোমার কি ঝড়-বৃষ্টিতে ভয় করছে?
অপলা রাগের সাথে বলে, ভয় করছে না। তোমাকে মনে পড়ছে খুব। এখন কয়টা বাজে যেন?
জাবেদ ডেক্সটপের স্ক্রিনে তাকায়। বলে, কয়টা আর দুপুর দেড়টা।
তুমি তিনটার মধ্যে বাসায় আসবা। নয়তো আমি বাসায় ভাঙচুর শুরু করবো। আমার অনেক রাগ উঠছে। নিজের হাতের আঙুল নিজ দাঁতে জখম করে ফেলেছি।
অপলা তুমি বোঝার চেষ্টা করো। আমি প্রাইভেট চাকরি করি। বললেই ছুটি হয় না।
এত কিছু আমি বুঝি না। তোমাকে আসতে বলেছি তুমি যে কোনো উপায়ে ছুটি নিয়ে আসো।
আচ্ছা, আমি চারটায় বাসায় পৌঁছাব।
আমি যে টাইম দিয়েছি, সেটাই ফাইনাল টাইম। বলে অপলা ফোনটা কেটে দেয়।
জাবেদ তখনো মোবাইল কানে ধরে অপলা অপলা বলতে থাকে। তারপর বোকার মতো ফোনটা রেখে দেয়। এই সময় ফারহানা ও আসিফ খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে।
আসিফ হাসতে হাসতে বলে, কে কল দিয়েছিল জাবেদ ভাই?
জাবেদ লজ্জিতভাবে বলে, কে আবার বোঝেনই তো সব। দশ দিন হলো বিয়ের এই সময়ে কে কল দিতে পারে বোঝেন না?
আসিফ দাঁতের পাটি কেলিয়ে হেসে বলে, কেমনে বুঝবো ভাই? আমি তো আর বিবাহিত নই।
জাবেদ বলে, তাহলে দেরি করছেন কেন?
আসিফ নির্দ্বিধায় বলে, লজ্জা আর ভয়।
জাবেদ সংকোচিত প্রশ্ন ছুড়ে মারে। কেন আপনি কি পুরুষ না?
সেটা আমার ভবিষ্যৎ বউ বলতে পারবে। আসিফ বলে।
ওদের কথার ফাঁকে বামহাত ঢোকায় ফারহানা। সে ডেস্কটপের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে জাবেদ আর আসিফের মাঝামাঝি দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হয়ে বলে, জাবেদ ভাই, ভাবি কি আপনারে পেয়ে সুখি না। এত উঁচু স্বরে কথা বলল যে!
জাবেদ থতমত খেয়ে বলে, না তেমন কিছু না। গ্রামের মেয়ে তো, সেজন্য জোরে কথা বলে। তা বাদে ও আবার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।
ফারহানা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে, বুঝলাম। ফারহানার কথার ভাবে বোঝা গেল, সে এ কথা বিশ্বাস করেনি।
এদিকে অপলা ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনটা বাজতে আর চার মিনিট বাকি। ঘড়ির কাঁটা ঘোরার ক্রমে ওর মুখটা গাড় লালচে আকার ধারণ করছে। দুটা বেজে আটান্ন মিনিটে কলিং বেল বেজে ওঠে। অপলা শুয়েই আছে। তৃতীয় বারে সে উঠে দরজা খুলে দেখে পাশের বাসার আন্টি এসেছে। তার ভাব দেখে অপলা বুঝে গেল সে নানা প্রশ্নের ফোয়ারা সাজিয়ে এসেছে। একটা একটা করে ছুড়ে দেবে। অপলা বলে আন্টি চা করে দেই? মিস্টি খাবেন? আনবো?
আন্টি বলে, না। কেবল খাবার খেয়ে আসলাম। ভাবলাম নতুন বিয়ে হয়েছে। তার ওপর শহরে নতুন এসেছো। তাই আসলাম কথাবার্তা বলতে।
অপলা বলে, আন্টি আমার না অনেক মাথাব্যথা করছে। আপনি বসে টিভি দেখেন। আমি একটু ঘুমাই?
আন্টি বলে, আচ্ছা। তুমি থাকো তাহলে। তুমি আমাদের বাসায় এসো।
আচ্ছা আন্টি। আপনি আবার আসবেন।
আচ্ছা।
দরজা খোলাই ছিল। ঠিক তিনটা চারে বাসায় ঢোকে জাবেদ। অপলা কোনো কথা বলে না। পারলে সে রাগে চোখে চোখে খেয়ে ফেলে জাবেদকে।
জাবেদ বলে, অপলা আমি এসেছি। তুমি খুশি হওনি?
অপলা বলে, না।
কেন?
তোমার আসার কথা তিনটার আগে। তুমি চার মিনিট লেট করলে কেন?
জাবেদ বলে, বসকে বুঝিয়ে আসতে একটু সময় লাগে। বললেই আসা যায় না।
জাবেদের বস অনেক ভালো মানুষ। বউয়ের সাথে ফোনে কথা বলার পর, কলিগদের অনুরোধে তাকে ছুটি দিয়েছে। বউয়ের জেদ পূরণ করবে না বলে ইচ্ছে করে দেরিতে বাসায় ফিরেছে জাবেদ। নতুন বউয়ের জেদ পূরণ করলে আজীবন ভুগতে হয়।
অপলা বলে, তুমি দ্রুত পাঞ্জাবি পরে নাও। নীল রঙেরটা। তারপর আমাকে নিয়ে রিকশায় করে দিঘির পাড়ে নিয়ে যাবে, যে দিঘির পাড়ে ফুলে ভরা কদম গাছ আছে।
জাবেদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। বলো কী? এই উত্তাল শহরে আমি দিঘিইবা কই পাবো, আবার কদম গাছ কই পাবো?
সে আমি কী জানি?
জাবেদ তার সহকর্মী আসিফের কাছে কল করে বলে, শহরে দিঘির পাড়ে কদম গাছ আছে, এমন জায়গা কোথাও আছে আপনার জানামতে?
আসিফ বলে, আছে শাহবাগের দিকে। আপনার মেসেঞ্জারে লোকেশন পাঠাচ্ছি।
বিকেল পাঁচটার দিকে জাবেদ ও অপলা দিঘির পাড়ে এসে পৌঁছায়। আকাশে মেঘ জমে আছে। গাছের পাতা ভিজে আছে। পানি টপিয়ে পড়ছে। জাবেদের শার্টের কিছুটা অংশ ভিজে গেছে। তার মনে আম্মার কথা ভেবে রাগ উঠছে। আম্মা কেন যে এই পাগলিটা তার গলায় পরিয়ে দিয়েছে।
অপলা বলে, কি, এতদূর নিয়ে আসলাম বলে রাগ করলে নাকি?
জাবেদ অভিনয়ের হাসি দিয়ে বলে, আরে না।
দিঘিটা জলে ভরে গেছে। আরেকটু জল হলে ছাপিয়ে পাড়ে পানি উঠে যাবে। এ বছর শ্রাবণ মাসে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে শহরের রাস্তা ভরে ওঠে পানিতে। তখন গাড়ি চলাচলে অসুবিধা হয়। হঠাৎ অপলা ঘাবড়ে যায়। চোরের মতো এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। ওর চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে ও কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে। তার এই ঘাবড়ানোর কারণ বুঝতে চেষ্টা করলো জাবেদ। জাবেদ জিজ্ঞেস করে, অপলা তোমাকে কিছুটা আপসেট লাগছে। এর কারণ জানতে পারি?
অপলা চোরের মতো ঢোক গেলে বলে, কই না তো। কোনো কারণ নেই।
অপলার কথা বিশ্বাস করলো না জাবেদ। সে এর কারণ বোঝার চেষ্টা করলো। বেশ দূরে একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটাকে দেখলে মনে হবে প্রশাসনের তদন্ত কর্মকর্তা। মাথায় আবার ক্যাপ পরেছে কালো রঙের। জাবেদ লোকটাকে দেখার চেষ্টা করলো। বছর ত্রিশের যুবক। গায়ের রং শ্যামলা। মুখে ব্রণের দাগ আছে, অসংখ্য। সন্ধ্যা সাতটায় ওরা বাসায় ফেরে।
ইদানিং প্রায় সময় অপলার মন খারাপ থাকে। রাতে ঘুম হয় না। বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে জাবেদ অপলার শরীরে হাত রাখলে অপলা ভয়ে কেঁপে ওঠে। কখনো হাত সরিয়ে দেয়। মনের সাথে শরীরের চাহিদার যোগসাজস রয়েছে। যখন মনে ডিপ্রেশন ঢোকে, তখন পেট, শরীরের সব ক্ষুধার মৃত্যু হয়। জাবেদ তেমন জোরাজোরি করে না। যেন ওর কোনো চাহিদা নেই। ও যেন অপলার চাহিদা পূরণের কর্মচারী। দুপুর বেলা বাসায় ফিরে জাবেদ দেখে, অপলার চোখের জলে নতুন শ্রাবণ মাস শুরু হয়েছে। জাবেদ দৌড়ে অপলার কাছে গিয়ে বসে ওর চোখের জল মুছে দিয়ে বলে, তোমার কী হয়েছে অপলা? তুমি কাঁদছো কেন? আমি খেয়াল করেছি, সারাক্ষণ তোমার মনমরা ভাব থাকে। কারণ কী?
অপলা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অপরাধীর ন্যায় নরম সুরে বলে, আচ্ছা কোনো স্ত্রী যদি তার যৌবনের একাংশ স্বামী ব্যতীত অন্য কাউকে পূর্বে দিয়ে থাকে এবং সেটা যদি স্বামী জানতে পেরে যায়। তাহলে সেই স্ত্রীর কি স্বামীর ঘরে ফিরে যাওয়ার অধিকার থাকে?
জাবেদ ধীরে বলে, থাকে। যদি সেই স্ত্রীর মধ্যে স্বামীর জন্য সৎ মহব্বত থাকে এবং সে যদি অনুতপ্ত হয়।
অপলা জোরে কাঁন্না করে জাবেদকে জড়িয়ে ধরে বলে, বিশ্বাস করো। আমি ইচ্ছে করে করি নাই। তখন আমার সতেরো। সবার মতো আমি একটা ছেলের প্রেমে পড়ি। সে ছিল মুখোশধারী প্রেমিক। দেখা করার জন্য ডেকে আমাকে কুপ্রস্তাব দেয়। আমি না করে দিই এবং ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। এরপর থেকে ওর কাছে থাকা আমাদের দুজনের একত্রে তোলা ছবি, রোমান্টিক ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাক মেইল করা শুরু করে। এ কথা তোমাকে না বলতে পারার কারণে আমার ভেতর শ্রাবণের মেঘেরা কষ্টের পাহাড় হয়ে দাবড়ে বেড়ায়।
জাবেদ বলে, এই ছেলেটা ওই কালো ক্যাপ পরা ছেলেটা ছিল। যে কি না তুমি যেখানে যেতে তোমাকে ফলো করতো। সেদিন শাহবাগে দিঘির পাড়েও এসেছিল, তাই তো?
অপলা গম্ভীর ভাবে বলে, হ্যাঁ। তুমি কিভাবে জানলে?
ওই ছেলেই আমাকে বলেছে, ক্ষমা চেয়েছে। বলেছে, অপলার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ তো আমার নেই। অনেকবার চেষ্টা করেও সফল হইনি। তাই আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
একটু থেমে জাবেদ আবার বলে, অন্য মেয়ে হলে তো বয়ফ্রেন্ডের সাথে খারাপ মেলামেশা করে রিলেশন চালিয়ে যেতো। তুমি তা করোনি। কারণ তোমার মনে খারাপি ছিল না।
জাবেদ বেড রুমে চলে যায়। তখনো ডাইনিংয়ের ভেজা জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে অপলা। কিছু সময় আগে কালো মেঘ ছিল আকাশে। এই মাত্র শুরু হলো ঝিরঝিরে বর্ষা। জানালার পাশের গাছটার পচা হাসনাহেনা ফুল বাড়ি মাতিয়ে তুলেছে বেদনার ঘ্রাণে।
পাশের ঘর থেকে জাবেদ ডাকে, এদিকে আসো অপলা। অপলা জাবেদের কাছে যায়। তার চোখ শুদ্ধ বানানে অনুতপ্তের গল্প লিখছে। যেন এখন ওর চোখে শ্রাবণ মাস চলছে। জাবেদ জড়িয়ে ধরে অপলাকে। অপলা শিউরে ওঠে। আকাশ থেকে মেঘ সরে যায়। জানালার ফাঁক দিয়ে সামান্য রোদ্দুর এসে পড়ে ঘরের মেঝেতে। রোদ্দুরের রশ্মির ন্যায় আলোর রেখা গিয়ে হঠাৎ এক দম্পতির মন ভালো হয়ে যায়।
এসইউ/জেআইএম