করোনাকালে রচিত গল্প: শঠ
ফাত্তাহ তানভীর রানা
তোরাব আলী বহুদিন আতা সাহেবের চামচামি করে আসছে। আতা সাহেবের ছেলে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করেছে। আর মেয়েও পড়ছে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। আতা সাহেব এখন সমাজসেবক। এক সময় যা-ই হোক না কেন, আতা সাহেবের এখন পয়সা হয়েছে। কিন্তু আতা সাহেবের দুঃখ, তাকে মানুষ খুব একটা চেনে না। আতা সাহেব পরিচিতি চান! সমাজের মানুষের জন্য কাজ করতে চান!
: সবাই ধান কাটছে। ডিসি কাটছে, সরকারি লোক কাটছে, রাজনীতিবিদ কাটছে, ব্যাংকার কাটছে, পুলিশ কাটছে, ছাত্রলীগ কাটছে, সেচ্ছাসেবকও ধান কাটছে।
: কেন, কৃষক কি ধানকাটা থেকে অব্যাহতি নিয়েছে নাকি রে?
: কী যে বলেন আতা ভাই? কৃষক কি আর অব্যাহতি পায়? কৃষক যে একা তাল পাচ্ছে না।
: হুম। আমাদেরও তো কিছু করা উচিত; নাকি? তুই খোঁজ-খবর নে! পরিচিত কোনো গ্রামে যা। তোরাব আলী, মানব সেবা করার ভালো সুযোগ পাওয়া গেছে।
সপ্তাহখানেক পর তোরাব আলী এসে আতা সাহেবকে বলল, ‘দরিদ্র কৃষক বারেক আলীর দুই বিঘা জমির ধান পেকেছে। পড়ে যায়। দেখার কেউ নাই, কাটার কেউ নাই! করোনায় টাকাও নাই!
: আর টাকা থাকে কিভাবে বল দেখি? দরিদ্র কৃষক! সারাবছর খেয়ে-খেটে কত আর বাঁচে বল?
: ভাই, অতি বন্যা-বর্ষণ, খরা তো লেগেই থাকে।
: তোরাব, তুই ওকে বলে দে আগামীকাল প্রত্যুষে আমরা যাবো ওর ক্ষেতে; ধান কাটবো সকাল দশটা থেকে।
: আপনি যাবেন ভাই!
: হুম। তো আর বললাম কী? তুই ক্যামেরাম্যান রেডি রাখিস।
মাহেন্দ্রক্ষণ এলো সকাল দশটা।
: ভাই সব রেডি, বারেক মিয়া বারবার জিগায় কখন ধান কাটবো।
: দুটো ক্যামেরা এসেছে? সাংবাদিক?
: সব ঠিকঠাক আপনি শুধু শুরু করেন।
আরও পড়ুন
অবশেষে ধান কাটা শুরু হলো। আতা সাহেব, তোরাব আলীসহ তারা ধান কাটছেন। সাথে ভিডিও চলছে, ছবি তোলাও চলছে। মাঝখানে এক সাংবাদিক বলল, ‘বস আমাদের কাজ শেষ। চলে যাবো। পেমেন্ট দেন।’ আতা সাহেব তোরাব আলীকে ইশারা করলেন। কিছু সময় পর সাংবাদিক চলে গেল।
এর কিছুক্ষণ পর আতা সাহেব জমি থেকে উঠে এলেন।
: তোরাব, কাজটা সহজ নয়; শরীর যে ঘেমে উঠল রে!
: ভাই, ছোটবেলায় বাবার সাথে ধান কাটছি, অনেক দিন পর। তাই কষ্টটা বেশি মনে হলো।
: ছবি ঠিকমতো তোলা হয়েছে? পত্রিকায়, টিভিতে যাবে তো? আমার নাম বলবে তো?
: বস সব ওকে। আপনি শুধু টিভিতে দেখবেন আর কাল পেপার পড়বেন।
: চল যাই। অনেক তো ধান কাটলাম। বাকিটা বারেক কাটুক।
আতা সাহেব গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন। বারেক আলী এসে বলল, ‘ধান কাটা তো অর্ধেকও শ্যাষ হইল না! চইলা যান স্যার? এখন আমি লোক পামু কই?’
আতা সাহেব চুপ। তোরাব আলী বলল, ‘এই ব্যাটা! তোর ধান কাটতে গিয়ে কি স্যার মরবেন নাকি? স্যার অসুস্থ হয়েছেন। তোর ধান কি অন্য কেউ কেটে দেবে? আহ! মামা বাড়ির আবদার? তোর ধান তুই কাট!’
বারেক চুপ করে গেল।
আতা সাহেব চুপ করে গাড়িতে বসে পড়লেন।
‘আজকাল গ্রামের লোক এত বদ হইতেছে শুধু মুখে মুখে তর্ক করে।’ বলল তোবার আলী।
আতা সাহেব চুপচাপ। গাড়ি চলছে। আতা সাহেব ভাবছেন, টিভিতে তাকে দেখলে কত মানুষই না প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে। আতা ভাই মহান মানুষ।
এসইউ/এমএস