ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

রাইসুল এইচ চৌধুরীর গল্প: কুয়াশায় ঢাকা চাঁদ

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৭:২১ এএম, ১৭ জুন ২০২৪

ইভা আপুকে দেখলেই আমার মনটা ভালো হয়ে যায়। মানুষ এত ভালো হয়, আমি ইভা আপুকে দেখার পর বুঝতে পেরেছি। ছাদে উঠে প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে ইভা আপুকে দেখি। মানুষ এত সুন্দর হয় কী করে! মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করি। ইভা আপুর মেঘের ন্যায় কালো চুল আমাকে চুম্বকের মতো কাছে টানে। মাঝে মাঝে মনে হয়, ইস! যদি একটু হাত বোলাতে পারতাম।

কস্তুরি মৃগের ন্যায় ইভা আপুর চুলের ঘ্রাণ আমার দেহ ও মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ইভা আপু যখন কথা বলে; তখন আমি জাহ্নবীর কলকল ধ্বনি শুনতে পাই। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যাই অবিরাম; ক্লান্তিহীন-শ্রান্তিহীন। মনে হয় সারাদিন কথা শুনলেও আমার একগুঁয়েমি লাগবে না।

ইভা আপু আমাকে প্রায়ই বলে, শাওন, লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখিস, তাই না!
আমি না দেখার ভান করে বলি, ইস আমার বয়েই গেছে তোমাকে দেখার। এ পৃথিবীতে তোমার মতো সুন্দরী বুঝি আর নেই, তাই না?
হ্যাঁ, নেই তো। ইভা একটাই। আমার তুলনা শুধু আমি।
আমি মনে মনে বলি, সত্যি একটাই ইভা আপু আছে এ পৃথিবীতে।
ইভা আপু, আমাকে আদর করে শানু ডাকে। সারাদিনই নানা কাজ সে আমাকে দিয়ে করায়।
শানু, একটা ইরেজার নিয়ে আয় তো। রিমোটের ব্যাটারিটা কাজ করছে না। শানু, আমার ভীষণ আচার খেতে ইচ্ছে করছে। তুই এনে দিবি, ভাই আমার।
ইভা আপু আমাকে কাজের কথা বললেই আমি ভীষণ খুশি হই। পাগলের মতো ছুটে যাই যখন যা বলে। এই সুবাদে একটু কথা হয়, দেখা হয় এটা আমি অনেক উপভোগ করি।

ইভা আপু মাস্টার্স পাস করে চাকরির চেষ্টাই করেনি। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। অনেক আদরে বড় হয়েছে সে। রুটিন মাফিক জীবন ইভা আপুর পছন্দ নয়। তাই সে কোনোদিনই চাকরি করবে না। যদি পারে নিজে স্বাধীনভাবে কিছু একটা করবে, অন্যথায় এভাবেই জীবন চলবে। আমাকে প্রায়ই এ কথা বলে।

আমরা ইভা আপুদের বাসায় ভাড়া থাকি। আমি বিএএফ শাহীনে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পরই আমরা ইভা আপুদের বাসায় চলে আসি। ডিওএইচএস থেকে অনেক কাছে হয় আমার কলেজ।

আংকেল-আন্টি কখনো বুঝতেই দেয় না আমরা ভাড়াটিয়া। আমাকে নিজের ছেলের মতো আদর করেন। আংকেলের ছেলে থাকলে মনে হয় এর চেয়ে বেশি আদর করতেন না। আমার অবাধ যাওয়া-আসা ইভা আপুদের বাসায়।

২.
বৃষ্টি ইভা আপুর ভীষণ পছন্দ। আমিও বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করি। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আমি ছাদে উঠে দেখি, মনের আনন্দে বৃষ্টির জলে ভিজছে ইভা আপু। মেঘের মতো কালো কেশ বাতাসে উড়ছে। এ যেন মেঘের রানি কিংবা মেঘকন্যা। বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু জল ইভা আপুর মুখে পড়ে যেন ঐশ্বরিক দ্যুতি ছড়াচ্ছে। চুল দিয়ে বৃষ্টিস্নাত জল টপটপ করে ঝরছে। ছাদের মৃত্তিকা যেন প্রতিটি ফোঁটায় ধন্য হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ইভা আপুকে দেখছি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য যেন উপভোগ করছি।

কিরে কখন এলি? আবার লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিস তাই না?
না, এই তো আসলাম।
শোন, আমার একশটা চোখ। আমার চোখকে কেউ ফাঁকি দিতে পারে না।
আচ্ছা, সরি। বৃষ্টিতে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছিল। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলাম।
কান ধরে এক থেকে দশ পর্যন্ত গোন। আচ্ছা ঠিক আছে পাঁচ পর্যম্ত গোন।
মাফ করে দাও না আপু, প্লিজ।
মাফ করতে পারি এক শর্তে। তোকে বলতে হবে, আমার কোন জিনিসটা তোর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে।
তোমার সবকিছুই আমার ভালো লাগে। ইস। আমার যদি তোমার মতো একটা বোন থাকতো।
থাকতো মানে। আমি তাহলে কে তোর? আমি তো তোর বোনই। আচ্ছা তুই বললি আমাকে বৃষ্টিতে অনেক ভালো লাগছিল, অন্য সময়ে আমাকে ভালো লাগে না?
কী যে বলো আপু। তোমাকে সব সময়ই ভালো লাগে।
তাই না? বেশি চালাক হয়েছিস। আচ্ছা। তুই কি ঘুড়ি উড়াতে পারিস? আমার না ভীষণ ঘুড়ি উড়াতে ইচ্ছে করছে।
হ্যাঁ, পারি তো।
ইভা আপু আমার হাত দুটো ধরে বললো। ঠিক আছে ভাই। তাহলে আমার জন্য একটা ঘুড়ি নিয়ে আসিস। আমরা দুজন মিলে একসাথে ঘুড়ি ওড়াবো।

৩.
বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম শপিংয়ে যাবো বলে। লিফ্টে ইভা আপুর সাথে দেখা হয়ে গেলো। আমাকে বললো, কিরে কোথায় যাবি?
আমি বললাম, যমুনায় যাবো।
আমিও তো যাবো যমুনায়। তুই আমার সাথে চল।
আমি বললাম, তোমার মাস্ক কোথায়? শপিংমলে তো অনেক ভিড়।
আমার মাস্ক পরতে ভালো লাগে না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। তুই পরেছিস তো, তাতেই চলবে।
তাই বলে মাস্ক ছাড়া যাবে! এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।
বেশি পাকামি করছিস, তাই না। চল তোকে এত পাকামি করতে হবে না।

আমি আর কিছু না বলে সুবোধ বালকের মতো ইভা আপুর সাথে চলে গেলাম যমুনায়। মানুষের ভিড় দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু কে কার কথা শোনে। অনেকের মুখেই মাস্ক নেই। নেই সামাজিক দূরত্বের বালাই। ইভা আপুর শপিং শেষে আমাকে জিন্সের প্যান্ট আর টি-শার্ট কিনে দিলো। আমি বললাম, তোমার সাথে আছি এতেই আমি খুশি। আমার কিছু লাগবে না। আকাশি রঙের টি-শার্টটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ইভা আপু জানে আমার প্রিয় রং আকাশি।

৪.
আজ তিনদিন হলো ইভা আপুর দেখা নেই।
আমি ছাদের এক কোণে বসে আছি। কেমন যেন লাগছে আমার। আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেলো কা-কা শব্দ করে একটি কাক। ছাদের গাছগুলো কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে। ঠিকমতো জল দেওয়া হয়নি বোধহয়। মালিটা আজকাল ফাঁকি দিচ্ছে। ইভা আপুই এগুলো দেখাশোনা করতেন। দূরে আমগাছে একটি শালিক বসে আছে। ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে। না আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

ইভা আপুদের বাসায় যাই। আন্টি দরজা খুলে দিলেন। কিরে শানু, ভেতরে আয়।
আন্টি, ইভা আপুকে দেখছি না কয়েকদিন হলো।
হ্যাঁ। ইভার শরীরটা ভালো নাই। কয়েকদিন ধরেই বেশ জ্বর আর গলা ব্যথা।
আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। ইভা আপু কোনো কথাই শুনতো না। কোথাও গেলে কোনোভাবেই মাস্ক পরানো যেতো না।
ইভা আপু রুম থেকে বললেন। শানু এসেছিস, ভাই আমার। আমার মনে হয় করোনা হয়েছে। রুমে আসিস না।
আমি বললাম, তোমাকে না দেখে আমি যাবো না। এই কয়দিনে মনে হচ্ছে কতদিন তোমাকে দেখি না। তোমাকে না দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়, আপু।

আমি ইভা আপুর রুমে ঢুকলাম। কাঁথা গায় দিয়ে শুয়ে আছে। এ কয়দিনে এতটা শুকিয়েছে কল্পনাই করা যায় না। মুখে মাস্ক পরে আছে। আমার দু’চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগলো। আমি বললাম, তোমাকে কতবার বললাম, মাস্ক পরো, একটিবারও কথাটা শুনলে না।
আরে বোকা, আমার কিছু হবে না। দেখিস আমি ভালো হয়ে যাবো।
ভালো তো তোমাকে হতেই হবে। আমি না হয় কার কাছে যাবো। কার আদর, স্নেহ নেবো। বলেই কেঁদে ফেললাম।

বিকেলবেলা রিপোর্ট এলো, ইভা আপুর কোভিড পজিটিভ। রাত থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। আংকেল আমাকে ডেকে বললেন, শানু, ইভাকে তো হসপিটালে ভর্তি করাতে হবে।
আমি বের হলাম। হসপিটালের খোঁজে। কুর্মিটোলা, শেখ রাসেল, ঢাকা মেডিকেল, ইউনাইটেড হসপিটাল; কোথাও একটি সিটও পেলাম না। আমি দিশেহারা হয়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছি। কিন্তু কিছুই করতে পারছি না।
আংকেল বললেন, শানু চেষ্টা করো, অন্তত একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে।
আমি বহু চেষ্টা করে শ্যামলী থেকে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে বাসায় পৌঁছলাম।

ইভা আপু জোরে শ্বাস নিচ্ছে। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মুখের সেই শ্রী হারিয়ে গেছে করোনা ভাইরাসের আঘাতে। আমাকে দেখার পর একটু চোখ খুললো। কী যেন বলতে চাইলো। কিন্তু মুখ থেকে একটি শব্দও বের হলো না। আমি সারারাত ইভা আপুর শিয়রে বসে থাকলাম। যদি কেনো কিছুর প্রয়োজন হয়। আমি একমুহূর্ত বিলম্ব হোক, তা-ও চাই না।
কুর্মিটোলা হসপিটালে একটি আইসিইউ খালি হয়েছে। বললো সকালে নিয়ে আসেন।

৫.
দূর থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে।
ঝিঁ-ঝিঁ পোকার শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। কোথাও যেন একটি বেওয়ারিশ কুকুর ডেকে উঠলো। আমার বুকটা কেমন যেন ধীরে ধীরে ভারী হতে লাগলো। ভোরের আলো ফুটছে যেন আজ বিষণ্ন ভাবে। অনেক বিলম্ব করে।
আমি ইভা আপুকে ডাকলাম। কয়েকবার। কোনো সাড়া-শব্দ পেলাম না। আন্টি, আংকেলও অনেকক্ষণ ডাকলেন। কোনো শব্দ নেই। ইভা আপুর নিশ্বাসের ওঠানামা বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে। আন্টি, আংকেলের চিৎকারে আকাশ-বাতাস কাঁপছে।
আমার মুখ থেকেও একটি শব্দও বের হলো না। আমি অনেক জোরে চিৎকার করলাম কিন্তু সে চিৎকার কোথাও ধ্বনিত হলো না। শুধু আমার বুকের পাঁজর ভেঙে বুক থেকে অস্ফুট একটি গোঙানির শব্দ বের হলো।
আমার কানে বারবার বাজতে থাকলো, কিরে শানু, লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখছিস!
আমি বললাম, আমি আর কোনোদিন তোমাকে লুকিয়ে দেখবো না। তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না আপু। প্লিজ...

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন